Published : 26 Apr 2020, 04:10 PM
মৃত্যু-মহামারীর অন্ধকার পেরিয়ে অবশেষে জীবন ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে। প্রশান্তপাড়ে এখন জীবন স্বাভাবিক হবার পথে। কিন্তু কোনো গড়িমশি বা ওজর আপত্তি শুনতে নারাজ সরকার। বলে রাখি আমাদের দেশ মানে বাংলাদেশের মতো অনেক দেশের সাথে করোনা কালের মিল আছে এ দেশটির। এখানেও করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বিদেশ থেকে আগত যাত্রীরা। দায়ী সমুদ্র বিহারে আগত বিশাল জাহাজ থেকে যাত্রীদের বেরুতে দেয়া। দায়ী সামাজিক সংক্রমণ। ঠিক যেভাবে ইতালি, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, চীন ফেরতরা ছড়িয়েছে বাংলাদেশে। তবে কিছু ব্যাপারে এদেশ এগিয়ে। এর ভৌগলিক অবস্থানে কোনো সীমান্তবর্তী দেশ নাই। সমুদ্রবেষ্টিত বলে সে একা। এদের সুবিধা সবকিছু বন্ধ করে দেয়াটা সহজ। দেশে তা অসম্ভব। তার প্রমাণ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পুরোপুরি শুরু হয়ে যাবার পরও মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গার দল। এখানে আর একটা সুবিধা যা আসলে নিয়ম বা নীতি মেনে চলা। জরিমানা আমাদের দেশেও হয়। কিন্তু কাকে জরিমানা করা যাবে কাকে যাবে না তার একটা হিসাব আছে। কে জরিমানা দেবে আর কে উল্টো পুলিশকে জরিমানা দিতে বাধ্য করবে তারও একটা হিসাব থাকে।
যেমন আমরা যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই আওয়ামী লীগের কোনো বড় নেতা কিংবা বিএনপির কোনো বড়সড় নেতা রাস্তায় নিয়ম ভঙ্গ করলে পুলিশ পারবে তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করতে? কিন্তু আমাদের সিডনি তথা নিউ সাউথ ওয়েলস অঙ্গ রাজ্যের সংস্কৃতি মন্ত্রী ইতোমধ্যে জরিমানা দেয়াসহ চাকরি থেকে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। ছেড়ে দিয়েছেন মন্ত্রীর পদ। অথচ কিছুই না তিনি হলি ডে হোমে গিয়েছিলেন, থেকেছিলেন সেখানে। এটা কি দেশে সম্ভব? কাজেই আইন না মানার সংস্কৃতি সাধারণ মানুষের ভেতরও চলছে চলবে। বলছিলাম করোনাভাইরাস থেকে বেরিয়ে আসার গল্প। অনেকে মনে করেন ২ কোটি ৩০ লাখের মতো জনসংখ্যা বলে অস্ট্রেলিয়ায় এসব সম্ভব। কথাটা ভুল। নিয়ম মানাটা আর আইন ঠিকভাবে প্রয়োগ করা সভ্যতা আর সমাজের বিষয়। আমাদের তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে অনেক আগে।
যখন এ লেখা লিখছি মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মোটামুটি স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে সিডনিসহ গোটা দেশ। ইতোমধ্যে কিছু কিছু রাজ্য তার পথে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে সঠিক পরিকল্পনা আর নিয়ম মানার ফলে। নিয়ম না মানার সংস্কৃতি কিন্তু সব সমাজে সব দেশে চলমান। করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুতে সিডনির বিশ্বখ্যাত বন্ডাই বীচ বিষয়ে সারা দুনিয়ার মিডিয়ায় নেগেটিভ শিরোনাম হয়েছিল। নিষেধ অমান্য করে শয়ে শয়ে মানুষ সমবেত হয়েছিল বীচে। পরের দিন প্রধানমন্ত্রীর কড়া ধমক আর জরিমানার পরিমাণ বাড়ায় সুড়সুড় করে গর্তে ঢুকে গেল সবাই। বন্ধ হয়ে গেল বীচ কালচার। দেশে যিনি বা যারা গার্মেন্টস শ্রমিকদের রাস্তায় নামিয়েছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাদের বিরুদ্ধে বলার পরও কি তারা দুঃখ প্রকাশ বা মাফ চেয়েছে? আজ আপনি দেশে করোনাভাইরাস রোগীর যে ক্রম বর্ধমান সংখ্যা দেখছেন তা কিন্তু ঐ পাপের ফল। এরপর আসবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পালা। এসব কারণে আমরা সহজে পারব বলে মনে হয় না।
বলছিলাম এদেশে বা যেসব দেশে নিয়ম মেনে এখন পথ খুলতে শুরু করেছে তারা তো কোনো ম্যাজিক করেনি। শুধু মানুষকে ঘরে থাকতে বাধ্য করেছে। বাধ্য করেছে সামাজিক দূরত্ব মানতে। যেসব জাহাজে যাত্রী এসেছে তাদের সকলকে হোটেলে রেখে তারপর রিপোর্ট নিয়ে বাড়ী পাঠিয়েছে। সহজ হিসাব। যারা মানবে না তারা অপরাধী এটাই নিয়ম। আমাদের মানুষগুলোও বড় উটকো স্বভাবের। জায়গায় জায়গায় পুলিশকে হয়রানী করা তাদের গায়ে গরম পানি ঢেলে দেবার মতো অসভ্যতা করছে। ইচ্ছেমতো রাস্তায় বেরুচ্ছে এগুলো কি সরকারের দোষ? সরকার তো কোন ছার স্বয়ং ঈশ্বরও এদের বাগে আনতে পারবেন না। সময় হাতে কম। এখন পরিস্থিতি খারাপ হতেই থাকবে। আর চাইলেও কোনো সাহায্য পাওয়া হবে কঠিন। বিশ্ব বাস্তবতায় কেউ কাউকে সাহায্য করার জায়গায় নাই। করোনাভাইরাস ঠেকাতে মানুষগুলোকে দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য করা না গেলে অসংখ্য জীবনহানি মানতে হবে। যেমন সরকারকে ঢালাও দোষারোপ করে লাভ নাই তেমনি সরকারকে বিপদে ফেলার খোয়াব দেখার মানে আত্মহত্যা ডেকে আনা। তথ্য প্রবাহ যেন সত্য ও ভয়হীন থাকে। না হলে আমেরিকা বা ইউরোপের কিছু দেশের পরিণতি ডেকে আনা হবে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া তা গোপন রাখেনি বলেই আজ আশার আলো দেখছে। কথাগুলো বললাম এই কারণে ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়েও চলছে নানা ধরনের মুখরোচক ও আতংকজনক প্রচারণা।
গতকাল জনপ্রিয় একটি টিভি চ্যানেলে কর্তব্যরত বরিশাল মেডিকেল কলেজের ডাক্তারদের সাথে আলাপচারিতা দেখলাম। টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার যেই বললেন পিপিই পরে গরমে দশ মিনিটের বেশি থাকা মুশকিল আর তাদের কোনো এসির ব্যবস্থা নাই অমনি ক্যামেরা ঘুরে গেল অন্যদিকে।
পরের জন তো আরো সাংঘাতিক কথা বলা শুরু করলেন। তিনি বলছিলেন ইন্টার্নিদের কথা। জরুরি হলেও তাদের কাজে লাগানো যায় না। কারণ তাদের হোস্টেলে খাবার নাই। খাবার বা বাজার করতেও যেতে পারছে না তারা। জনগণের একাংশ যাবার একমাত্র রাস্তাটা বন্ধ করে দিয়েছে ভয়ে। অমনি ক্যামেরা আবার ঘুরে গেল অন্যদিকে।
না, এটা টিভি বা সাংবাদিকের অপরাধ না। সবাই জানেন কে কতটা বলতে পারে আর কতটা পারে না। অন্যদিকে কিছু ডাক্তার নামধারী অমানবিক মানুষেরাও নাকি দশ লাখ টাকার লোভে, নার্সরা ৫ লাখ টাকার লোভে পজিটিভ হয়ে আইসোলেশনে যাওয়ার ভুল পথ বেছে নিচ্ছে। এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। কিন্তু বলা হচ্ছে, কিশোরগঞ্জে নাকি এমনটা চলছে। যখন এলাকার নাম বলা হয় তখন তা খুঁজে বের করা কঠিন কিছু না। কিন্তু ঘন্টা বাঁধবে কে?
পশ্চিমবঙ্গের গভর্ণর চেপে ধরায় মমতা দি'র থলের বেড়াল বেরিয়ে আসছে। গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতা আছে বলে সত্য নিয়ে তর্ক চলছে সেখানে।
আমরা একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া মূলত কাকে বিশ্বাস করবো আর কাকে করবো না সেটাই জানি না। তবে এটুকু বুঝি ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা ভাল না থাকলে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার কমবে না। মানুষের দুর্ভোগ ও জীবনের ঝুঁকি বাড়বে।
পবিত্র রমজান মাসে তথ্য ও বাস্তবতার পবিত্রতা রক্ষা হোক। মনে রাখা দরকার নানা কারণে বাংলাদেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি এখনো তেমন ভয়ংকর হয়ে ওঠেনি। এটা বজায় রাখা না গেলে একদিকে রোগে আরেকদিকে অভাব অনটনে দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে। সেটা কারো কাম্য হতে পারে না।
মারী মহামারী পেরিয়ে আজ সিডনি পৌঁছে যাচ্ছে আলোর বন্দরে। আফসোস থাকবে একটাই এ যাত্রায় এখনো বহুদেশ বহুমানুষ সঙ্গী হতে পারছে না। আমাদের জন্মভূমিও না। আমরা চাই বাংলাদেশ আলোর পথ দেখুক। মানুষ ফিরে আসুক স্বাভাবিক জীবনে। নিয়ম মানটা বড়ই জরুরি।