Published : 20 Apr 2020, 05:57 PM
লেখাটি শুরু করি করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে বৃটিশ একজন ডাক্তারের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে। তার ওই বর্ণনার বিবরণ কোনো এক পত্রিকা থেকে নেয়া! ওই ডাক্তার বলেছেন, "আমার চোখের সামনে হাসফাঁস করছেন একজন রোগী। তার ফুসফুস টানতে পারছে না অক্সিজেন। গড় গড় শব্দ হচ্ছে। চোখের সামনে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করছেন ওই রোগী। করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের প্রত্যেকের মুখে অসহনীয় বেদনা। তারা অক্সিজেন নেয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না। ফুসফুস সাপোর্ট দিচ্ছে না। তাদের মুখ থেকে বিকট শব্দ বেরিয়ে আসছে। এক দশকেরও বেশি সময় আমি বৃটিশ জাতীয় স্বাস্থ্য স্কিমের একজন চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এ সময়ে আমার মনে হয়েছে, যা দেখার ছিল তার সবই দেখেছি। কিন্তু করোনাভাইরাস যে ভয়াবহতার প্রকাশ ঘটিয়েছে তার জন্য আমি কখনো প্রস্তুত ছিলাম না।" করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বৃটিশ একজন ডাক্তারের। এমন অভিজ্ঞতা শুধু তার একার নয়, এ পেশায় যারা আছেন, যারা রোগীদের সেবা দিচ্ছেন তাদের সবার।
নতুন করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ বর্তমানে সারাবিশ্বে একটি আতঙ্কের নাম। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম পৃথিবীর অসংখ্য দেশের মানুষের মধ্যে মৃত্যুভয় জাগিয়ে তুলেছে কোভিড-১৯ রোগ। এরই মধ্যে এ রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ২৩ লাখের কাছে। মৃত মানুষের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার। মৃত্যুর ভয়ে পৃথিবীর মানুষ আজ দিশেহারা। মানুষ আতঙ্কিত কখন বুঝি গলায় ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে, জীবনের স্পন্দন থেমে যায়!
আজ কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষদের যে অবস্থা সেই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে আমাদের এই প্রিয় বসুন্ধরারও, বহুদিন, বহুকাল, বহু বছর ধরে। দশক দশক ধরেই মানুষ, এই ধরিত্রীর চারিদিক থেকে শ্বাসনালী চেপে ধরে বসে আছে। ধরিত্রীর জল, স্থল অন্তরীক্ষ সব জায়গাতেই আমরা ক্ষত বিক্ষত করছি, করেছি, অহরহ। মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু যার কারণে এই মানব প্রজাতির জন্ম, সেই বসুন্ধরা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করছে, অঝোরে কাঁদছে। বসুন্ধরার সেই রোদন আমরা কত জন দেখতে পাচ্ছি, আর দেখেই বা কি করেছি বা করছি!
পৃথিবীর প্রাণিকুলের বেঁচে থাকার জন্যে যে অক্সিজেন অপরিহার্য, তার ৫০-৮৫ শতাংশ আসে সমুদ্র থেকে। সমুদ্রের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের গড় পরিমাণ ০.০০০% (৮.00 পিপিএম), আর বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ ২০.৯৫%। সমুদ্রে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র শেওলাজাতীয় উদ্ভিদ (phytoplankton) সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন উৎপন্ন করে। এই অক্সিজেন সমুদ্র কিন্তু নিজের জন্যে রাখে না, আমাদের বায়ুমন্ডলে ছেড়ে দেয়, স্থলভাগের প্রাণিদের বেঁচে থাকার জন্য। তার মানে পানিতে অক্সিজেন থাকেও অনেক কম আর এই অক্সিজেন থাকে পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায়, তাই পানির অক্সিজেনকে বলে দ্রবীভূত অক্সিজেন (dissolved oxygen)। এই স্বল্প পরিমাণ দ্রবীভূত অক্সিজেনকে সম্বল করে জলজ প্রাণি বেঁচে থাকে, থাকতে হয়।
অনেকেই হাইপোক্সিয়া (hypoxia) শব্দটির সাথে পরিচিত। মেডিকেল প্রফেশনের সাথে যারা জড়িত তারা শব্দটি আরও ভালো জানেন। তারা জানেন, হাইপোক্সিয়া এমন একটি অবস্থা যখন মানব দেহের টিস্যুতে অক্সিজেনের ঘাটতি থাকে। এই হাইপোক্সিয়ার কারণে শ্বাসকষ্ট এবং রক্ত সঞ্চালনে ব্যাঘাত ঘটে। তখন অতিরিক্ত অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। পৃথিবীব্যাপী সমুদ্রের তলদেশে হাইপোক্সিয়া বা অক্সিজেন স্বল্পতা বিরাজ করছে অনেক কাল ধরে। হাইপোক্সিয়ার প্রভাবে ধুকছে সমুদ্রতল, প্রায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ছটফট করছে অক্সিজেনের জন্যে, ধুকছে প্রকৃতি ও জীব জন্তু, কীট-পতঙ্গ। আমেরিকার লুইসিয়ানা আর টেক্সাস অঙ্গ রাজ্যের উপকূলে, গালফ অব মেক্সিকোর উত্তরাংশে ১৯৭২ সালে প্রথম চিহ্নিত হয় হাইপোক্সিক অঞ্চল, ২০০৮ সালের ভিতর পৃথিবীব্যাপী ৪০০ এর অধিক হাইপোক্সিক অঞ্চল চিহ্নিত হয়। আর বর্তমান সময়ে প্রায় ৫০০ এর উপরে হাইপোক্সিক অঞ্চল চিহ্নিত হয়েছে। জলধির তলদেশে এই হাইপোক্সিক অবস্থা বা মৃত অবস্থা (dead zone) কেমন করে হয়েছে আর কেনই বা হয়েছে? এক কথায় সমুদ্রের তথা আমাদের ধরিত্রীর এই অবস্থার জন্যে একমাত্র দায়ী আমরা, মানব জাতি, মানব সভ্যতা।
সমুদ্রে অথবা পানিতে কিংবা স্থলভাগে বা ল্যান্ডফিলে যে ময়লা, বর্জ্য, আবর্জনা ফেলা হয় তা একদিন না একদিন পচবেই, বা বিয়োজিত (decompose) হবে। বর্জ্য, আবর্জনা পচার সময়কাল নির্ভর করে পদার্থের বা বস্তুটির উপাদান, পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, পিএইচ আরও অনেক কিছুর ওপরে। তাই এই পচার প্রক্রিয়া একদিনেও হতে পারে, একশ দিনেও হতে পারে অথবা লাগতে পারে একশ থেকে এক হাজার বছর। যেমন একটি ব্যাক্টেরিয়া কয়েক সেকেন্ডের ভিতরে সম্পূর্ণভাবে পচে যেতে পারে। আবার স্বাভাবিক অবস্থায়, প্রয়োজনীয় তাপমাত্রায়, মৃত্যুর ২৪-৭২ ঘন্টার মধ্যে মানুষের শরীরের ভেতরের অঙ্গের পচন সম্পূর্ণ হয়। ত্রিশ দিনের ভিতর মানুষের দেহ পচে গলে তরল হয়ে যায়। সমুদ্রের তলে একটা টিনের পাত্র পচতে সময় লাগে ৫০ বৎসর, অ্যালুমিনিয়ামের পাত্র ২০০, সিগারেটের গোড়া (বাট) ২-১২, প্লাস্টিক ব্যাগ ১০০-৫০০ বৎসর। ফোমের ডিসপোজেবল কাপের প্রয়োজন হয় ৫০০-১০০০ বৎসর।
কোনো জিনিসের অথবা বস্তর বা পদার্থের পানিতে অথবা মাটিতে পচার জন্যে অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। আসলে পচা (decompose) মানে বস্তুর বা পদার্থের ভেঙ্গে ছোট হতে হতে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অণুর আকৃতি ধারণ করা। আর এই কাজটি করে অণুজীবেরা (microorganisms, যেমন ব্যাকটেরিয়া)। এই অণুজীবদের বেঁচে থাকার জন্যে এবং বস্তু বা পদার্থকে ভেঙ্গে ফেলার কাজটি ঠিকভাবে করার জন্যে প্রয়োজন হয় অক্সিজেন, আর এই অক্সিজেন এরা পানির দ্রবীভূত অক্সিজেন থেকে শুষে বা টেনে নেয়। এতে পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ক্রমে হ্রাস পায়। এই যে মাইক্রোঅরগ্যানিজম তাদের নিজেদের শ্বাস নেয়া আর বস্তুকে ভেঙ্গে ফেলার জন্যে পানি থেকে অক্সিজেন টেনে নিচ্ছে তাকে বলে বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিম্যান্ড। ব্যাপারটা বুঝতে কি কঠিন হয়ে গেল? আরেকটু বুঝিয়ে বলি। পানিতে এমনিতেই অক্সিজেন কম থাকে, তাও থাকে পানির ভেতরে, দ্রবীভূত অবস্থায়। এখন পানিতে বর্জ্য আবর্জনা ফেলা হলো। পানিতে যত বেশি বর্জ্য আবর্জনা ফেলা হবে সেই পানিতে তত বেশি মাইক্রোঅরগ্যানিজম জন্ম নেবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আর এই জন্ম নেয়া মাইক্রোঅরগ্যানিজমের নিজেদের জন্যে আর বর্জ্য আবর্জনাকে ডিকম্পোজ বা বিয়োজন বা পচানোর জন্যে অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। আর এই অক্সিজেন এরা তাদের অবস্থানের জায়গার পানি থেকেই টেনে নেবে। তার মানে যে এলাকাটায় বর্জ্য আবর্জনা ফেলা হয়েছে ঐ এলাকার পানি থেকে অণুজীবদের অক্সিজেন টেনে নেওয়ার কারণে অক্সিজেনের ঘাটতি পড়বে। তার অর্থ ঐ এলাকায় বসবাসরত অন্যান্য জলজ প্রাণি যেমন, মাছ্, শামুক ঝিনুক, কীট পতঙ্গ প্রত্যেকেরই শ্বাসের জন্যে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এর ঘাটতি পড়ে। এই অবস্থাটাই বায়োলজিক্যাল হাইপোক্সিয়া। এই বায়োলজিক্যাল হাইপোক্সিয়া ঘটে জৈব পদার্থের ক্ষেত্রে। যেমন প্রাণি-উদ্ভিদজাত আবর্জনার ক্ষেত্রে।
আমরা তো সমুদ্রে শুধুই জৈব আবর্জনাই ফেলছি না বা ফেলি নাই। অজৈব আবর্জনা যেমন লোহা-লক্কর, প্লাস্টিকের ব্যাগ, পুরানো ভাঙ্গা গাড়ি, উড়োজাহাজ কত কিছুই তো ফেলেছি আর ফেলছি। এই অজৈব আবর্জনাও এক সময় না এক সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হবে, এক বৎসরেই হোক, আর এক হাজার বছরে হোক। অণুজীব বা মাইক্রোঅরগ্যানিজম কিন্তু এই অজৈব আবর্জনা ভাঙতে পারে না। এদের বিয়োজন বা ডিকমপোজিশন হয় রাসায়নিক প্রক্রিয়ায়। অর্থাৎ শুধু অক্সিজেন দিয়ে। বুঝতে কঠিন লাগছে? সহজ করে বলি। যদি লোহার কোনো চাকু, ছুরি, বটি বা লোহার কোনো ধাতব জিনিস বাইরে খোলা জায়গায় ফেলে রাখা হয়, তাহলে কিছু দিনের ভিতর বস্তুটির উপর মরিচা পড়ে যাকে ইংরেজিতে বলে রাস্ট। মরিচা পড়তে পড়তে ধাতুর বস্তুটি একসময় ছিদ্র ছিদ্র হয়ে পড়ে, হাত দিয়ে চাপ দিলেই ঝুরঝুরে হয়ে ভেঙ্গে পড়ে। মরিচার সৃষ্টি হয় যখন ধাতব বস্তুটি তার আশে পাশের বাতাস থেকে অক্সিজেন টেনে নেয়। এই অক্সিজেন লোহার বা ধাতব পদার্থটির সাথে মিশে এক ধরনের ভঙ্গুর যৌগের সৃষ্টি করে। এই প্রক্রিয়াকে বলে কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড। একই ঘটনা ঘটে সমুদ্রের তলদেশে। কোনো ধাতব বা অজৈব পদার্থ যখন আবর্জনা হিসাবে, বর্জ্য হিসাবে সমুদ্রে ফেলা হয় এসব বর্জ সমুদ্রের তলদেশে জমা হয়। এই তলদেশে থেকেই পদার্থগুলি তার আশেপাশের পানি থেকে অক্সিজেন টেনে নেয়, শুষে নেয়। কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ডে বর্জ্য পদার্থ আরও অনেক বেশি, দ্বিগুণেরও বেশি অক্সিজেন পানি থেকে টেনে বা শুষে নেয়। তাহলে কি হলো! যখন সমুদ্রের পানিতে টনকে টন আবর্জনা ময়লা বর্জ্য ফেলা হয়, যার ভিতরে জৈব আর অজৈব দু'ধরনের বর্জ্যই থাকে, এই বর্জ্য পানি থেকে দ্রবীভূত অক্সিজেন টেনে নেয়। যার ফলে পানিতে বসবাসরত অন্যান্য প্রাণি যারা পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন এর ওপরেই বেঁচে থাকে, তাদের অক্সিজেনের তীব্র অভাব হয়। কাজেই বর্জ্য পদার্থ পানিতে যত বেশি হবে, পচতে যত বেশি দিন সময় লাগবে, যত অজৈব ধরনের হবে, পানির দ্রবীভূত অক্সিজেন তত বেশি নিঃশেষিত হবে। এভাবেই অক্সিজেন নিঃশেষিত করে সমুদ্রের তলদেশে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল বিশাল ডেড জোন বা মৃত অঞ্চল।
নাম শুনেই বোঝা যায়, সমুদ্রের যেখানে কোনো প্রাণি থাকে না বা থাকতে পারে না, সেটাই ডেড জোন। ডেড জোনের সৃষ্টি হাইপোক্সিয়া থেকে। ডেড জোন কোনো থিওরী বা কল্পকাহিনি নয়। যে কেউ সমুদ্রের তলদেশে ডুব দিলেই দেখতে পাবেন, মাইলের পর মাইল কোনো চলমান জীবের চিহ্ন নেই। এমন কি সমুদ্রের শৈবাল তাও নেই। যেন সমুদ্রের তলদেশে মরুভূমি। বছরের পর বছর স্বল্প অক্সিজেনে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে করতে যে জীবজন্তু এখনও বেঁচে আছে, এরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। অসুখ, রোগ-জীবাণু এদের সহজেই সংক্রমিত করে ফেলছে। মাছসহ সমুদ্রের বহু জীব তাদের প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। বংশ বিস্তার সীমিত হতে হতে নিঃশেষ এর পর্যায়ে চলে এসেছে। এতদিন ঐ হাইপোক্সিয়ার প্রভাব শুধু সমুদ্র তলদেশেই সীমিত ছিল। এখন এর প্রভাব সমুদ্রের উপরিভাগেও দেখা যাচ্ছে। তারমানে শুধু তলদেশেই নয়, এখন সমুদ্রের উপরিভাগেও ডেড জোনের সৃষ্টি হচ্ছে।
মানব সভ্যতার প্রথম থেকেই সমুদ্রকে আমরা আবর্জনা, উচ্ছিষ্ট ফেলার "উন্মুক্ত বিশ্ব ভাগাড়" হিসেবে ব্যবহার করে আসছি। যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয় পদার্থ, বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, সমুদ্রে ফেলা হয়েছে তার প্রভাব হাজার বছর ধরে থাকবে। কি ফেলা হয় নাই সমুদ্রে! সারা বিশ্ব থেকে টনকে টন শিল্প কারখানা, কৃষি খামার, শহরের ড্রেইনেজ ব্যবস্থা থেকে দূষিত পানি, রাসয়ানিক সার, পলি মাটি, কীটনাশক পুরাতন গাড়ি, ট্রেন, উড়োজাহাজ, ইলেক্ট্রনিকস, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, সিগারেটের গোড়া, প্লাস্টিক, কটন বাড আরও অসংখ্য আবর্জনা সমুদ্রে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রতিটি উপাদানই সমুদ্রের তলদেশে হাইপোক্সিয়া ঘটাচ্ছে। কয়েকটি সাধারণ বর্জ্য নিয়ে এখানে একটু বিস্তারিত লেখা হলো, কারণ, এগুলো আমরা, এই ব্যক্তি আমরা, সমুদ্রের পরিবেশে সরাসরি ছড়াচ্ছি।
যখন পৃথিবীর জনসংখ্যা ১৯৫০ সালে ২.৫ বিলিয়ন ছিল, তখন ১.৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বিশ্বব্যাপী প্রস্তুত করা হয়েছিল; আর ২০১৬ সালে যখন পৃথিবীর জনসংখ্যা ৭ বিলিয়নের বেশি, প্লাস্টিকের সামগ্রী প্রস্তুত হয়েছে ৩২০ মিলিয়ন টন, ২০১৮ সালে ৩৬০ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এই ধারা চলতে থাকলে ২০৩৪ সালের ভেতর উৎপাদন হবে এর দ্বিগুণ। আমাদের অনেকের গোসলের পর মাথায় ভেজা টাওয়েল পেঁচিয়ে কটন বাড দিয়ে কান চুলকাতে খুব আরাম লাগে, আরামের চোটে চোখ মুদে আসে। প্রত্যহ কান না চুলকালেও এই কটন বাড আমাদের বাথরুমে, কসমেটিকস ব্যাগে অথবা ফ্রিজের মাথায় রাখা বিভিন্ন আইটেম এর মধ্যে অপরিহার্য একটি আইটেম হয়ে গেছে। শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যেই ১৩.২ বছরে বিলিয়ন কটন বাড ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীব্যাপী প্রতি দিন ১.৫ বিলিয়ন কটন বাড প্রস্তুত করা হয়। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কারণে কটন বাড পুনঃ ব্যবহার করা যায় না। ব্যবহারের পর আবর্জনা হিসাবে ফেলে দিতে হয়। এই আবর্জনার বেশির ভাগ পয়ঃনিষ্কাশন, নালা-নর্দমা নদী পেরিয়ে সমুদ্রে যেয়ে আশ্রয় নেয়। কটন বাডের যে প্লাস্টিক তা সরল প্লাস্টিক নয়। জেনে অবাক হবেন শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই কটন বাডের প্লাস্টিকসহ অন্যান্য প্লাস্টিক, খাবার মনে করে ভুলে বা দুর্ঘটনাবশত গলাধকরণ করে প্রতিদিন ২৫০টি সামুদ্রিক প্রাণি, আর সেই সাথে প্রায় ২৭০০ সামুদ্রিক পাখী মারা যায়। শুধু তাই নয় এই কটন বাডের প্লাস্টিকসহ অন্যান্য প্লাস্টিক আমাদের পরিবেশে বিপুল পরিমাণে মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়াচ্ছে, যার প্রভাব প্লাস্টিকের তৈরি উপাদানের থেকেও ভয়াবহ। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রসংগে পরে আসছি।
বর্তমান সময়ের সব কিছুকে ছাড়িয়ে সিগারেটের বাট এক নম্বর বর্জ্য পদার্থ। ধুমপায়ীর সংখ্যা কমলেও সারা বিশ্বে ৫.৬ ট্রিলিয়ন সিগারেট ধুমপানে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে অনেক বেশি, কারণ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। ধরা যাক ৬ ট্রিলিয়ন সিগারেট প্রতি বছর ধুমপায়ীরা ব্যবহার করছে। তারমানে ৬ ট্রিলিয়ন সিগারেটের বাট বর্জ্য হিসাবে পরিবেশে এসে মিশছে। অনেক ধুমপায়ীর ধারণা রয়েছে সিগারেটের বাট মাটিতে ফেললে পরিবেশের খুব বেশি ক্ষতি হয় না। কারণ এরা পচনশীল (biodegradable)। ঠিক, সিগারেটের বাট বায়োডিগ্রেডেবল! কিন্তু মাটিতে বা পানিতে পচে মেশার আগে এরা পরিবেশে কয়েক বৎসর পর্যন্ত থাকতে পারে। সিগারেট বাটের যে ফিল্টার, তা প্লাস্টিক দিয়ে বানানো। অত্যন্ত সুক্ষ্ণ একধরনের সেলুলোজ অ্যাসিটেট-এর প্লাস্টিক তন্তু। তাছাড়া এই সিগারেটের ফিল্টারে থাকে হাজারো কেমিক্যাল যারা মাটির সংস্পর্শে এসে মাটির আশে পাশের অক্সিজেন টেনে নেয়, মাটিতে ছোট ছোট উদ্ভিদ, অমেরুদন্ডী প্রাণি, পোকামাকড় এদের মেরে ফেলে। Clean Virginia Waterways USA কর্তৃপক্ষ একটি পরীক্ষায় দেখিয়েছে দুই গ্যালন পানির ভেতর শুধু একটা সিগারেটের বাট ছেড়ে দিলে পানি যে পরিমাণ বিষাক্ত হয় তা পানির উপরে ভেসে থাকা ছোট ছোট পোকা (water flies, zooplankton) মেরে ফেলার জন্যে যথেষ্ট। ফিল্টারের সেলুলোজ অ্যাসিটেট ভেঙ্গে গিয়ে তৈরি করে অসংখ্য মাইক্রোপ্লাস্টিক।
সাধারণত উচ্চ অক্ষাংশে শীতপ্রধান উন্নত দেশসমূহে শাক-সবজি উৎপাদনের জন্য তৈরি বিশেষ এক ধরনের কাঁচের ঘরকে সবুজ ঘর বা গ্রীন হাউস (Green House) বলা হয়ে থাকে। কাঁচ স্বাভাবিকভাবেই সূর্যের আগত ক্ষুদ্র তরঙ্গরশ্মিকে ভিতরে প্রবেশ করতে দেয়, কিন্তু প্রতিফলিত দীর্ঘ তরঙ্গের সৌরবিকিরণকে কাঁচ কোনোভাবেই বাইরে বেরোতে দেয় না, ফলে এই ঘরের মধ্যে তাপমাত্রা আটকা পড়ে ক্রমশ ঘরের অভ্যন্তরস্থ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং শাক-সবজি বা গাছপালা জন্মানোর জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠে। 'গ্রীন হাউজ প্রভাব' কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন সুইডিস রসায়নবিদ সোভানটে আরহেনিয়াস। শিল্প বিপ্লবের যুগে হাজার হাজার টন কয়লা পোড়ানোর ফলে যে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে মিশছে তার কুফল সম্পর্কে সোচ্চার হয়ে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, বায়ুমন্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইড যদি দ্বিগুণ হয় তবে পৃথিবীর তাপমাত্রা ৫০ সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলও অনেকটা গ্রীন হাউসের মত আচরণ করছে। বায়ুমন্ডলে অবস্থিত কিছু গ্যাস ও অন্যান্য উপাদান (কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, জলীয় বাস্প নাইট্রোজেন অক্সাইড প্রভৃতি) পৃথিবীর তাপমাত্রাকে ধরে রাখছে গ্রীন হাউসের কাঁচের দেওয়ালের মতো। এ রকম প্রায় ছয় ধরনের গ্যাসকে গ্রীন হাউজ গ্যাস বলা হচ্ছে। গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমন আজ বহুল আলোচিত। মানুষের ছয় ধরনের কার্যকলাপের কারণকেই প্রধানত গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমণ আর বিস্তারকে দায়ী করা হয়। এই ছয় ধরনের কার্যকলাপ, যানবাহন (২৮.৯%), বিদ্যুৎ উৎপাদন (২৭.৫%), শিল্প-কলকারখানা (২২.২%), বাণিজ্যিক ও আবাসিক আবাসন (১১.৬% ), কৃষি (৯%) ও ভূমির ব্যবহার ও বনাঞ্চল (১১.১%)। গ্রীন হাউজ গ্যাসের মধ্যে কার্বনডাই অক্সাইড নির্গমণ সবচেয়ে আলোচিত আর বহুল পরিচিত একটা নাম। মানুষের কার্যকলাপে ২০১৯ সালে ৪৩.১ বিলিয়ন টন কার্বনডাই অক্সাইড আমাদের পরিবেশে নির্গত হয়েছে। আমরা প্রতিদিন গড়ে ১০০ মিলিয়ন ব্যারেল পেট্রোলিয়ামজাত ফুয়েল ব্যবহার করছি। অর্থাৎ প্রতিদিন আমরা বিপুল পরিমাণ কার্বনডাই অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছি।
মানুষসহ অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণির জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজন বিশুদ্ধ বায়ু। বিশুদ্ধ বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ শতকরা ০.০৩-০.০৪ ভাগ। কিন্তু এর বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুতে থাকলে মানুষের শ্বাসকষ্ট দেখা যায়। কোনো পরিবেশে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ শতকরা ২৫ শতাংশের বেশি হলে সেখানে মানুষসহ কোনো প্রাণির পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৭৫০ কোটির ওপরে মানুষের বাস। এ হিসেবে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩৬ গিগাটন (Gt) (১ গিগাটন = ১ বিলিয়ন মেট্রিক টন) কার্বন বায়ুতে মিশে যাচ্ছে। বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আর বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের এক হিসেবে জানা যায় ১৮৬০ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এ ১০০ বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ০.০২৮৩% (২৮৩ পি.পি.এম) থেকে ০.৪৪% (৪৪০ পি.পি.এম) বেড়ে গেছে। পরিবেশবিদরা জানিয়েছেন যে আগামী ২০ বছরের মধ্যে কার্বন দূষণ যদি ৪০ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ র্পযন্ত কমিয়ে ফেলা না যায় তবে ২০৩৬ সালের আগেই হয়তো বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৫০ পিপিএম বা ০.০৪৫% যা জলবায়ু এবং মানব সভ্যতার অস্তিত্বের পক্ষে ভয়ঙ্কর। সবচেয়ে বড় কথা বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ ব্যাপক হারে কমতে থাকলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটবে গণমৃত্যু। শুধু তাই নয়। বায়ুমন্ডলে যদি কোনো কারণে কার্বন, নাইট্রোজেন ও সালফার অক্সাইডের আধিক্য দেখা দেয় তখন বৃষ্টির পানি বা শিশিরের সঙ্গে এসব গ্যাস মিশে বৃষ্টির পানি বা শিশিরের অম্লত্ব বৃদ্ধি পায়। শিল্পযুগের বিকাশের আগে থেকে মানুষের কারণে সৃষ্ট কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিতে বিশাল মহাসাগরের ভূমিকা অনন্য। বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানি, কাঠ পোড়ানোসহ বিভিন্ন দাহ্য কর্মকাণ্ডে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন হচ্ছে। এসব কার্বন ডাই-অক্সাইডের প্রায় ৩০ শতাংশই শুষে নেয় মহাসাগরগুলো। যদি কার্বন ডাই-অক্সাইডের নির্গমণ কমানো না যায়, তবে ২০৫০ সাল নাগাদ মহাসাগরের অম্লত্ব প্রায় ১৫০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গত সাড়ে ছয় কোটি বছরের মধ্যে (সেই ডাইনোসরের যুগে) এত দ্রুত হারে এভাবে সাগরের অম্লত্বের পরিমাণ বাড়েনি। মহাসাগরের পানিতে অম্লের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিরূপ প্রভাব কী হতে পারে, তা এই স্বল্প পরিসরে ব্যাখ্যা দিতে যাচ্ছি না। তবে প্রথম ধাক্কায় সমুদ্র থেকে যে অক্সিজেন আমরা পাই তাতে ঘাটতি হবে। ফাইটোপ্লাঙ্কটন (ছোট ছোট সামুদ্রিক শেওলা জাতীয় উদ্ভিদ) মারা যাবে, মারা না গেলেও তারা প্রয়োজনীয় অক্সিজেন উৎপন্ন করতে পারবে না। অম্লত্ব বেড়ে গেলে সমুদ্রে যে মিলিয়নস, ট্রিলিয়নস টন শামুক, ঝিনুকসহ সমস্ত ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের খোলস যুক্ত প্রাণি আছে তাদের খোলস তৈরি হবে না, খোলস তৈরি না হলে এরা মারা যাবে। তাছাড়াও সমুদ্রে যত মৃত প্রাণির খোলস সমুদ্রের তলদেশে, সমুদ্রের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, অম্লতার প্রভাবে এগুলো ক্ষয় হতে হতে ধ্বংস হয়ে যাবে। National Oceanic and Atmospheric Administration, US এর তথ্য অনুযায়ী সমুদ্রের উপরিভাগের পানির পিএইচ ইতোমধ্যেই ০.১৫ কমে গেছে। এই অবস্থা যদি চলতেই থাকে তাহলে এই চলমান শতাব্দীর শেষেই সমুদ্রের পানির অম্লতা ১৫০% বেড়ে যাবে। সমুদ্রের পানির অম্লতা, হাইপোক্সিয়া বুঝার জন্যে খুব বেশি কেমিস্ট্রি বুঝার দরকার নেই। এইটুকু বুঝতে পারলেই যথেষ্ঠ যে আমরা যেভাবে এই পৃথিবীর জলে-স্থলে ময়লা, আবর্জনা, বর্জ্য ফেলছি তাতে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের অক্সিজেন শেষ হয়ে আসছে. যেভাবে কার্বন পুড়াচ্ছি, বায়ু মন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড বাড়িয়ে দিচ্ছি তা পৃথিবীকে আরও বেশি অক্সিজেন শুন্যতার দিকে ঠেলে দিচ্ছি। এখন সারা পৃথিবীতে অনেক জায়গাতেই বিরাজ করছে হাইপোক্সিয়া, তখন হবে অ্যানোক্সিয়া। অ্যানোক্সিয়া মানে সম্পূর্ণ অক্সিজেন শুন্যতা।
এরকম আরও অনেক কারণে আজ পৃথিবীর সাগর, মহাসাগর হুমকির সম্মুখীন। সেই সাথে জীবজন্তুর বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের সরবরাহ। হাইপোক্সিয়া, সমুদ্রের অম্লতা বৃদ্ধি, গালফ অফ মেক্সিকোতে হোক আর আরব সাগরে হোক, কিংবা ভারত মহা সাগর বা বঙ্গোপসাগরে, তাতে অন্য এলাকার বা অঞ্চলের অধিবাসীদের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার কোনো কারণ নেই। মহাসাগর, সাগর, সমুদ্রের কোনো ভৌতিক সীমারেখা (physical barrier) নেই। আমরা মানুষেরা কাল্পনিক ভৌগলিক সীমারেখা দিয়ে পৃথিবীর অবিচ্ছিন্ন জলরাশিকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করেছি, বিভিন্ন নাম দিয়েছি আটলান্টিক মহাসাগর প্রশান্ত মহাসাগর, ভারত মহাসাগর ইত্যাদি। অবিচ্ছিন্ন মহাসাগর, সাগর, সমুদ্রের বিপুল জলরাশির ভেতর বিভিন্ন স্থলভাগে আমরা বসবাস করছি। ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে প্রশান্ত মহাসাগরে একটি কার্গো জাহাজ ডুবে যায়। জাহাজটিতে একটা কনটেইনারে প্লাস্টিকের খেলনা সামগ্রী ছিল। এই খেলনা সামগ্রীর ভিতর ছিল হলুদ রঙের প্লাস্টিকের ছোট ছোট হাঁসের বাচ্চা। গত প্রায় তিন দশকের কাছাকাছি সময় ধরে এই প্লাস্টিকের হাঁসের বাচ্চা সারা পৃথিবীর সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। আলাস্কার উপকুল থেকে জাপান, অস্ট্রেলিয়ার উপকুল থেকে ইউরোপের উপকুল, বেরিং প্রণালী থেকে আর্কটিকেও এদের মাঝে মাঝে দেখা মেলে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, কিছু খেলনা হাঁসের বাচ্চা এখনও এত অক্ষত আছে দেখে মনে হয় একেবারেই নতুন। এই হাঁসের বাচ্চাগুলোর ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা মানব সমাজকে একটা বড় শিক্ষা দিয়েছে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাস হোক, আমরা একে অন্যের সাথে সংযুক্ত। সাগর মহাসাগর আমাদের সংযুক্ত রেখেছে।
এক তথ্যে বলা হয়েছে পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের ২৮% আসে রেইনফরেস্ট থেকে, ৭০% আসে সমুদ্র থেকে আর নাকি ২% অন্যান্য উৎস থেকে। জাতিসংঘের গত বছরের রিপোর্টে দেখা যায়, গত ১০ বৎসরে বিশ্বের এক কোটি ৭০ লাখ হেক্টর বনাঞ্চল বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ হিসাবে প্রতি মিনিটে ধ্বংস হচ্ছে ৮ হেক্টর বনভূমি। ইউরোপের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিমালিকানাধীন বন মালিকদের প্রতিষ্ঠান এসসিএ-এর তথ্যমতে, প্রত্যেকটি দেশের মোট আয়তনের অন্তত পঁচিশ ভাগ বনভূমি থাকা আবশ্যক। গাছ পৃথিবীর বাতাসকে শুদ্ধ করে, কার্বনডাই অক্সাইড শোষণ করে আর অক্সিজেন উৎপন্ন করে। এক একরের গাছপালাসহ ভূমি বছরে যে অক্সিজেন উৎপন্ন করে তা ১৮ জন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের অক্সিজেন প্রতি বছরের অক্সিজেনের চাহিদার সমান। আর ২.৬ টন কার্বনডাই অক্সাইড পরিবেশ থেকে শুষে নেয়।
করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ বলেন আর পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বলেন কিংবা ধরিত্রী রক্ষা, কোনো কাজই কোনো দেশের সরকারের পক্ষে একা সফল করা সম্ভব নয়। ব্যক্তি, কম্যুনিটি বা অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশ গ্রহণ, সাহায্য, সচেতনতা ছাড়া অসম্ভব। আপনাকে আমাকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার আপনাকে ডাকছে কিনা, বা সরকারের সহযোগিতা পাচ্ছেন কিনা তাতে কিছুই যায় আসে না। দেশটা সরকারের নয়, পৃথিবীটাও কোনো সরকারের নয় বা কোনো জাতির একার নয়। পৃথিবীটা সমগ্র মানব জাতিসহ সমস্ত প্রাণের, সবার। কাজেই এই বসুন্ধরা রক্ষার কার্যক্রমের পরিধির বিন্দুটা আপনাকে, আমাকেই আঁকতে হবে। আপনিই শুরু করুন, দেখবেন এক সময় পরিধি আঁকা হয়ে গেছে, এই বৃত্ত আঁকার কাজে সবাই জড়িয়ে পড়েছে। আপনার যে কাজের মধ্যে দিয়ে পরিবেশে দূষণ ছড়াচ্ছে, বায়ুমন্ডল সমুদ্র বিষাক্ত করে ফেলছে সেই কাজগুলো চিহ্নিত করে ফেলুন। কমিয়ে দিন দূষণ ছড়ানোর প্রক্রিয়া।
আমরা সবাই, সমগ্র মানবকূল, খুব বেশি বিদ্যুৎ শক্তি নির্ভর (energy dependent) হয়ে উঠেছি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, কাজে কর্মে। এতটুকু গরম আমাদের সহ্য হয় না। সাথে সাথে এয়ার কুলার চালিয়ে দেই, অথবা ফুল স্পীডে ফ্যান। অনেকেই আমরা শীতের রাতে ফুল স্পীডে ফ্যান অথবা এয়ার কুলার চালিয়ে মাথা অবধি মোটা লেপ বা কম্বলে ঢেকে নাক ডেকে ঘুমাতে পছন্দ করি। ঘুম নাকি খুবই আরামের হয়। অনেকে তো বলেনই আমি শীতকালেও ফ্যান না চালিয়ে ঘুমাতে পারি না। হায়রে অপচয়! চিন্তা করেন তো পৃথিবীতে কত কোটি কোটি মানুষ আছে যারা শীতের রাতে লেপ কম্বল তো দূরের কথা, ঠিক মতো নিজের শরীরটাও ঢাকতে পারে না। জবুথবু শুয়ে রাত কাটায়। আফ্রিকার দেশগুলোর দিকে তাকান, ইয়েমেনের বাচ্চাগুলোর দিকে তাকান, কিংবা বাংলাদেশের ছিন্নমুল, ভাসমান মানুষগুলোর দিকে। আবার দিনের বেলা একটু ঠান্ডা লাগলেই হিটার। হিটারের তাপে অনেক সময়ই ঘর ওভেনের মতো গরম হয়ে থাকে, তবুও ঠান্ডা লাগে। এই যে ইলেক্ট্রিসিটির, প্রাকৃতিক গ্যাসের বিপুল অপচয় এর ফলে কিভাবে দূষণ ছড়াচ্ছেন, প্রকৃতিতে কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে যাচ্ছে? তা ভেবে কি একটু অস্বস্তি আমাদের হয় না? অস্বস্তি, গ্লানিবোধ আমাদের হতেই হবে। কারণ আমরা তো মানুষ, আমরা জোর গলায় বলি, "প্রত্যেকে মোরা পরের তরে"। মানুষ ছাড়া আর সমস্ত জীবজন্তু প্রাণি তিনটা উদ্দেশ্য নিয়ে বেঁচে থাকে: নিজের সুবিধা, খাদ্য ও প্রজনন। মানুষ স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষের ভিতর আছে প্রেম, ভালোবাসা, মায়া, মমতা, একে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা, সহযোগিতার ক্ষমতা।
মেইন সুইচ বন্ধ করার আলসেমিতে আমরা ইলেকট্রনিক সামগ্রী স্ট্যান্ড বাই মোডে রেখে দেই। টিভি, ইলেকট্রনিক খেলনার কনসোল, ভিসিআর, ভিসিপি রিমোট দিয়ে বন্ধ করার পরেও একটা লাল আলো জ্বলতে থাকে। এটাই স্ট্যান্ড বাই মোডের সুইচ অফ। এই স্ট্যান্ড বাই মোডে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয় না। আপনার মাসিক বা ত্রৈমাসিক ইলেক্ট্রিসিটি বিলের ১০% এর উপরের খরচ স্ট্যান্ড বাই ইলেক্ট্রিসিটি অপচয়ের কারণে। শুধু আপনার একারই বছরে স্ট্যান্ডবাই অপচয়ের কারণে ১০০-১৫০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার অতিরিক্ত খরচ হয়। একটা এলসিডি টিভির স্ট্যান্ড বাই ইলেক্ট্রিসিটি অপচয় বছরে ৫.৫০-৬.০০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার, গেম কনসোল ১৩-১৫, কম্পিউটার মনিটর ২.৫০-৩.৫০, ওয়াশিং মেশিন ১০.০০-১৫.০০, ডিশ ওয়াশার ৬.০০ অয়্যারলেস মডেম ১৭.৫-২৬.০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার। শুধু যে অর্থের অপচয় হচ্ছে তাই নয়। এই অপচয়কৃত বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে জ্বালানি পোড়াতে হচ্ছে আর এই জ্বালানী পোড়ানোর জন্য বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে যাচ্ছে। আপনি ইচ্ছে করলেই এই অপচয় রোধ করতে পারেন। আপনি কি জানেন চা বা কফি বানানোর জন্যে ইলেক্ট্রিক কেটলিতে পানি গরম করার জন্যে অথবা ইলেক্ট্রিক হটওয়াটার ব্যাগ গরম করার জন্যে কি পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ করতে হয়? আপনি ইলেক্ট্রিক কেটলি ব্যবহার করবেন না- তা হয়ত কেউ বলবে না, কিন্তু যদি না করেন সবচেয়ে ভালো। চা বানানোর জন্যে অ্যালুমিনিয়ামের কেটলিতে গ্যাসের চুলায় পানি গরম করতে পারেন। অথবা ইলেক্ট্রিক কেটলি বা হটওয়াটার ব্যাগে কখনই ঠান্ডা পানি ব্যবহার করবেন না। সিঙ্কের হট ওয়াটার ট্যাপের গরম পানি ইলেক্ট্রিক কেটলি বা হটওয়াটার ব্যাগে নিয়ে তারপর কেটলি বা হটওয়াটার ব্যাগের সুইচ অন করুন, সময় কম লাগবে, বিদ্যুৎ কম খরচ হবে। ডিশওয়াশার, ক্লোথস ওয়াশার, ড্রাইয়ার এর উপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে দিন। এই সমস্ত মেশিনপত্র বিপুল বিদ্যুৎ খরচ করে, বায়ুমন্ডলে কার্বনডাই অক্সাইড বাড়িয়ে দেয় আপনার মুল্যবান শখের জিনিস পত্রের আয়ুষ্কাল কমিয়ে ফেলে, পরিবেশ দূষিত করে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের আরেকটি উৎস আমাদের জামা কাপড়, বিশেষ করে সুতি কাপড় ছাড়া অন্য যেকোনো ফেব্রিকের কাপড় চোপড়। বেশি বেশি সুতির জামা কাপড় ব্যবহার করুন। সুতির জামা কাপড়, পরিধেয় পরিবেশবান্ধব। জার্মানীর একদল গবেষক দেখিয়েছে ওয়াশিং মেশিনের একটা সাইকেলে আনুমানিক ৭০০,০০০ মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা পরিবেশে অবমুক্ত হতে পারে। তারা বলছেন এই মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা সম্পূর্ণভাবে ডিকম্পোজ হতে ১০০০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। এই সময়ে এই কণাগুলি যেখানেই থাকুক, মাটিতে বা পানিতে, সম্পূর্ণভাবে ডিকম্পোজ হতে এরা আশেপাশের অক্সিজেন শুষে নেবে। এই রকম আরও অসংখ্য ব্যাপারে আপনি আপনার বুদ্ধি দিয়ে বিদুৎ কম খরচের উপায় বের করতে পারেন। মোদ্দা কথা জ্বালানী দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের উপর আমাদের নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। ইচ্ছে করলেই আমাদের পক্ষে এই কাজগুলি করা সম্ভব।
প্লাস্টিকের সামগ্রী ব্যবহার কমিয়ে দিন। উন্নত বিশ্বে প্লাস্টিক আজ বর্জ্য হিসাবে এক নম্বরে। মনে রাখবেন প্লাস্টিক অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের শরীরে ক্যান্সারের জন্যে দায়ী। জলে, স্থলে এমনকি মেরুতে প্লাস্টিকের ভয়াবহ প্রভাব আমরা সবাই জানি। এক বছরেই হোক, বা এক হাজার বছরে হোক প্লাস্টিক পচে যে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়, তার ক্ষতিকর প্রভাব এখনো পুরোপুরি জানা নেই।
জলজ পরিবেশে প্লাস্টিক ও মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব দৃশ্যমান। সমুদ্রের মাইক্রোপ্লাস্টিকের চেয়ে স্থলভাগের ভুমিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক আরও বেশি অনেকাংশেই ২৩ গুণেরও বেশি। জার্মানীর একদল গবেষক বলছেন এই মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা সম্পূর্ণভাবে ডিকম্পোজ হতে ১০০০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। এই সময়ে এই কণাগুলি যেখানেই থাকুক, মাটিতে বা পানিতে, সম্পূর্ণভাবে ডিকম্পোজ হতে এরা আশেপাশের অক্সিজেন শুষে নেবে। কিন্তু মাটিতে এর প্রভাব এখনও তেমনভাবে জানা যায়নি। তবে এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত মাইক্রোপ্লাস্টিক মাটির গুণাগুণ উর্বরতা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলতে সক্ষম। মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবেশের, মাটির ইকোসিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারদের সম্পূর্ণভাবে অথর্ব করে ফেলতে পারে। কোনো এক জায়গার মাটি কেমন উর্বর তা নির্ভর করে সেই মাটিতে কি পরিমাণ অনুজীব, ওয়ার্ম ছোট ছোট অমেরুদন্ডী প্রাণি আছে তার উপর। এরাই বসুন্ধরার ইকোসিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার। যেমন শামুক, ঝিনুক, খোলসযুক্ত প্রাণি সমুদ্রের ইকোসিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার। মাইক্রোপ্লাস্টিক সব ধরনের ইকোসিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার ধ্বংস করতে সক্ষম। সেই সাথে মাটির উপরিভাগের অক্সিজেন টেনে নিয়ে মাটিকে হাইপোক্সিক থেকে অ্যানোক্সিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম। কাজেই যেখানে সেখানে প্লাস্টিকের ব্যাগ, প্লাস্টিকের বোতল, কটন বাড, প্লাস্টিকের সামগ্রী, সিগারেটের বাট ফেলবেন না। রাস্তায় আশেপাশে প্লাস্টিকের কিছু দেখলে কুড়িয়ে বাসায় এনে রিসাইক্লিং বিনে ফেলে দিন। ভাববেন না আমি তো ফেলিনি আমি কেন কুড়িয়ে আনব। আপনি ফেলেননি ঠিক আছে, কিন্তু অক্সিজেনের জন্যে কষ্ট পাবে, যন্ত্রণায় ছটফট করবে আপনার আমার সন্তানেরা, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। মনে রাখবেন এই মাটির উপরেই আপনার আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেঁচে থাকবে।
ঘর গৃহস্থালি রান্না-বান্নার কাজে বর্জ্য-আবর্জনার সৃষ্টি কমিয়ে আনুন। রান্না ঘরের মাছ মাংস তরিতরকারি কাটাকুটির বর্জ্য আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলবেন না। এমন কি বিনে ফেলার আগে দেখুন না এগুলো কাজে লাগানো যায় কিনা! বাসা বা বাড়ির সাথে যদি এক চিলতে জায়গা থাকে কিংবা ছাদে একটা ড্রামে এই বর্জ্যগুলো রেখে পচিয়ে সার বানিয়ে ফেলুন। এই বর্জ্য পচানোর সময় ড্রামের ভিতর বর্জ্যের পরতে পরতে একটু শুকনা খড় আর অল্প একটু বেকিং সোডা দিয়ে দিন, গন্ধ ছড়াবে না। আবারও, যদি এক চিলতে জায়গা থাকে সেই জায়গাতে বাগান করুন। তরিতরকারি, সবজি ফলান। ছাদে টবেও আপনি চমৎকার সবজি ফলাতে পারেন দুই তিনটি টবে মরিচ গাছ, একটি টবে ধনিয়ার পাতা বা ছোট সাইজের কাঠের অগভীর বাক্সে লাল শাক, পুই শাক। এক টবগুলিতে বা বাগানের জায়গাগুলিতে নিজের বাসার বর্জ্য থেকে বানানো সার দিন। এই সারে আপনার গাছ চমৎকার ভাবে বেড়ে উঠবে চমৎকার ফলন দেবে। যদি ছাদে বাগান হয় ছাদের চারিপার্শ্বের কার্বনডাই অক্সাইড টেনে নিয়ে বাতাসে ছড়াবে অক্সিজেন। সর্বোপরি আপনি আপনার পরিবারের জন্যে নিশ্চিত করতে পারছেন ফরমালিন ছাড়া, বিষাক্ত কেমিক্যাল ছাড়া বিশুদ্ধ শাক, সবজি, তরিতরকারি। একটা কথা মনে রাখবেন বাণিজ্যিক ভাবে অরগ্যানিক শাক-সবজি, তরিতরকারি ফলমুল ফলানো সহজ নয়। কিন্তু স্বল্প পরিসরে আপনার বাগানে, তা সে টবেই হোক, বা ছাদে হোক বা মাটিতে হোক, আপনি পারবেন।
পৃথিবীর সিংহভাগ পানির ৯৭% সমুদ্রের পানি, লবনাক্ত। স্বাদু পানির পরিমাণ ৩%। এই ৩% স্বাদু পানির ২.৫% সহজলভ্য নয়। সহজলভ্য পানির পরিমাণ ০.৫%। আরেকটু সহজ করে বলি! মনে করেন সারা পৃথিবীতে পানির পরিমাণ ১০০ লিটার, তাহলে মানবজাতির বেঁচে থাকার জন্যে ব্যবহার যোগ্য পানি মাত্র ০.০০৩ লিটার (আধা চা চামচ পরিমাণ)। এখানে উল্লেখ্য এই পরিমাণ পানি সারা মানবজাতির জন্যে আর এই পানি দিয়েই চাষাবাদ, কৃষিকাজ, শিল্প কলকারখানায় ব্যবহার থেকে শুরু করে ঘর গৃহস্থালির কাজে আর জীবন রক্ষার্থে পান করার জন্যে মজুদ আছে। বিনিদ্র রাতে, সবাই যখন গভীর ঘুমে, কিছুতেই চোখ দুটিতে ঘুম আসতে চায় না। মাথার দুই পাশের শিরা দপ দপ করে, তখন কানে যদি কোনো পানির ট্যাপ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ার শব্দ কানে যায়, অসহ্য লাগে। নির্ঘুম রাতে কলের পানি পড়ার শব্দ বা অকেজো হয়ে যাওয়া কমোডের ট্যাঙ্ক থেকে পানি পড়ার শব্দ ভয়ঙ্কর ভাবে সরাসরি মাথার মগজে লাগে। রাতের নিস্তব্ধতায় উত্তপ্ত মস্তিস্কে হয়ত ঐ সামান্য শব্দই বেশি বেশি মনে হয়। এই বেশি বেশি মনে হওয়াটা বোধহয় বিক্ষিপ্ত মানসিক অবস্থার কারণে, হয়তো কাল্পনিক। শব্দ বেশি মনে হওয়াটা কাল্পনিক হলেও এই যে ফোটায় ফোটায় পানি পড়ে এর বাস্তবতা প্রকৃত অর্থেই অনেক বড়। US EPA-এর তথ্যানুযায়ী সমগ্র আমেরিকাতে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন গ্যালন পানি নষ্ট হয়, অকেজো বাসা বাড়িতে পানির ট্যাপ, কমোডের ট্যাঙ্ক এগুলো থেকে ফোটায় ফোটায় পানি পড়া বা পানি লিক করার কারণে। পানি যে কত মুল্যবান কত দুর্লভ তা বুঝতে পারছে ইয়েমেন, আফ্রিকার কিছু দেশ সেই সাথে ইন্ডিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষেরা, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। করোনার বিরুদ্ধে প্রাথমিক সুরক্ষা হিসেবে সাবান-পানি সবচেয়ে বেশি কার্যকর। কিন্তু বিশ্বের প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের হাতেই সাবান-পানি নেই। সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে। এ দুই মহাদেশের বেশিরভাগ মানুষের জন্যই পর্যাপ্ত পানি নেই। এই মানুষগুলোর কথা ভেবে হলেও পানির অপচয় করবেন না। পানির অন্য নাম জীবন। আর এই জীবনের জন্যে প্রয়োজন অক্সিজেন। পানি দূষিত হয়ে পড়লে অক্সিজেন কমে যাবে। পানি শেষ হয়ে গেলে অক্সিজেনও শেষ হয়ে যাবে।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের প্রকৃতি যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। করোনাভাইরাসে ভ্রমণ নিষিদ্ধ থাকায় বেশ কিছুদিন ধরে এখানে বিরাজ করছে শুনশান নীরবতা। জনশূন্য সৈকতে নির্জনতার সুবাদে জেগে উঠেছে প্রকৃতি। বালিয়াড়িতে ঝাঁকে ঝাঁকে বিচরণ করছে লাল কাঁকড়া, ডালপালা মেলতে শুরু করেছে সাগরলতা। নাসা আর ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির স্যাটেলাইটে ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের বায়ুমন্ডলে স্বল্পমাত্রার দূষণ রেকর্ড করেছে। কোয়ারেন্টিন কার্যকর হওয়ার পর থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে চীনে বায়ুদূষণ ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। বিভিন্ন শিল্পস্থাপনা, কল-কারখানা থেকে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। নাসার Goddard Space Flight Center এর এয়ার কোয়ালিটি গবেষক Fei Liu বলছেন, "করোনার প্রভাবে প্রকৃতিতে এত দ্রুত পরিবর্তন, বিশুদ্ধতা আমি আগে কখনও দেখিনি"। ফিনল্যান্ডের সেন্টার ফর এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের বিশ্লেষক লরী মিল্লিভির্টারের মতে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় জানুয়ারির শেষের দিকে চার সপ্তাহের মধ্যে চীনের কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমণ ২৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ইতালির কথা বলতে গেলে, পুরো দেশটাই এখন লকডাউন। সড়ক, নৌ, আকাশ, রেলসহ সব যোগাযোগ বন্ধ। নৌ-চলাচল বন্ধের কারণে ভেনিসের নোংরা খালগুলো এখন পরিষ্কার হতে শুরু করেছে, পানির নিচে মাছ খেলা করতে দেখা যাচ্ছে। ইতালির বাতাসেও চীনের মতো নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের নাটকীয় হ্রাস লক্ষ করা গেছে। ওয়াশিংটন পোষ্টের এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, উত্তর ইতালিতে এই হ্রাসের হার সবচেয়ে বেশি। তবে পরিবেশের এই সাময়িক উপকার উদযাপনের কোনো উপলক্ষ হওয়া উচিত নয়, ইতিহাস বলছে, এমন অবস্থা কেটে যাওয়ার পর কার্বন নিঃসরণের হার তার আগের জায়গায় ফিরে যেতে সময়ক্ষেপণ করেনি। Minnesota DNR Senior Climatologist Dr. Kenneth Blumenfeld বলছেন "প্রকৃতির এই সামান্য পরিবর্তন খুব বেশি তাৎপর্য বয়ে আনে না। তবে এটাও ঠিক সামগ্রিক প্রভাব নির্ভর করবে কতদিন আমরা প্রকৃতিকে এরকম আনডিসটার্বড রাখতে পারব"। তিনি আরও বলছেন, "The real question is going to be what do we do after we get into recovery?"
অনেকেই বলছেন করোনাভাইরাসের মতো বিপর্যয় বোধহয় প্রকৃতির প্রতিশোধ। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানুষ ক্রমেই প্রকৃতির ওপর তার আধিপত্য বিস্তার করেছে। প্রকৃতি স্থবির নয়, সে সজীব—এ কথা প্রায় সোয়া শ বছর আগে আমাদের জানিয়ে গেছেন আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু। প্রকৃতি একসময় প্রতিশোধ নেবে, এমন এক সম্ভাবনার কথা প্রায় দেড় শ বছর আগে উল্লেখ করে গেছেন ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস। প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে পারে, এমন কথা সম্ভবত তিনিই প্রথম বলেছিলেন তার অসম্পূর্ণ ডায়ালেক্টিকস অব নেচার গ্রন্থে। আমি কোনো মনীষী নই, দার্শনিকও নই। তবে আমার ধারণা প্রকৃতি কখনই আমাদের ওপর, মানবজাতির ওপর প্রতিশোধ নেয় না। নেবে না। কারণ আমরা এই বসুন্ধরার সন্তান। জননী কখনও তার সন্তানদের কৃতকর্মের জন্যে প্রতিশোধ নেয় না, কষ্ট পায় জননী, নিজে যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে যায়, আর বলে- আমার সন্তানেরা যেন থাকে দুধে ভাতে! বসুন্ধরার প্রধান চালিকা শক্তি তার প্রকৃতি (ecosystem)। বসুন্ধরার যন্ত্রণা দেখে, মানুষের অত্যাচারের নমুনা দেখে প্রকৃতি জেগে ওঠে মাঝে মাঝে, সরব হয়ে ওঠে ধরিত্রীর ক্ষত-বিক্ষত শরীরে শুদ্ধতার প্রলেপ দেয়ার জন্যে। কে জানে এই কোভিড-১৯ হয়ত তারই একটা প্রয়াস!
আপনি আমি কি একটাবার চিন্তা করতে পারি, আমাদের সন্তানেরা বা তাদের সন্তানেরা, আমাদের বংশধরেরা, শুধু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের জন্যে কেমন ছটফট করছে! অক্সিজেনের জন্যে তাদের ফুসফুস ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে, ধীরে ধীরে। এক পর্যায়ে ফুসফুস বুকফেটে বেরিয়ে যেতে চাইছে। ওপার থেকে আমাদের সন্তানদের, বংশধরদের এই পরিণতি দেখে আমাদের কেমন লাগবে! আইসোলেশন বলেন, সোশাল ডিসট্যান্সিং বলেন, আর ভেন্টিলেশন, ভ্যাকসিন, যাই বলেন কোনো কিছুই কাজ করবে না। আমরা চিন্তা না করলেও আমাদের বসুন্ধরা বুঝতে পারছে আমাদের পরিণতি, আমাদের বংশধরদের পরিণতি। তাই বসুন্ধরা কাঁদছে। বসুন্ধরা করোনায় আক্রান্ত মানুষের কষ্ট দেখে কাঁদছে, কাঁদবে বসুন্ধরা আমাদের বংশধরদের কষ্ট দেখে। বসুন্ধরা আজ নিজেই ক্ষত বিক্ষত। তার সন্তানদের ঠোকরে। তবুও কাঁদে বসুন্ধরা। কেঁদেই যাবে বুঝি আজীবন।
(প্রবন্ধটি লিখতে বেশ কিছু প্রকাশিত তথ্যের সাহায্য নেয়া হয়েছে। কেউ চাইলে সরবরাহ করা যাবে- লেখক।)