প্রতিবন্ধী শিশুটিকে খেলায় হারিয়ে আমার শক্তিমান পুত্র বিজয়ের দেঁতো হাসি হাসবে– এরকম হিংস্র প্রতিযোগিতার রাজ্যে নিজের সন্তানকে রেখে যেতে চাই না আমি।
Published : 09 Jul 2024, 11:50 AM
নীতিকথা বলে মানুষকে তার ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধ্বে নিয়ে আসা কঠিন। হীন স্বার্থপরতা যখন গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয়, তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে নিগ্রহ ছাড়া বাড়তি কিছু জোটে না। তবুও আপসহীন ভাষায় নিজের ভাবনা প্রকাশ করব। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে কথাগুলো বারংবার বলেছিলাম, আজ আবারও বলছি, আমি কোটা ব্যবস্থার পক্ষে, যাতে কেউ অন্যায্যতার শিকার না হয়, কেউ বঞ্চিত না হয়, সেই জন্য। স্বার্থপরতা কোনো নীতি হতে পারে না; কোটা বাতিলের দাবি ন্যায়পরায়ণতার পরিপন্থি। সমাজে সর্বগ্রাসী দুর্নীতিমনস্কতার আরেকটি বহিঃপ্রকাশ বলে এই কোটাবিরোধী আন্দোলনকে আমি মনে করি।
অসম প্রতিযোগিতা নয়
অসম প্রতিযোগিতার রাজ্যে আমার সন্তানকে রেখে যেতে চাই না। সেই প্রতিযোগিতায় আমার সন্তান যদি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে, তবুও না। কারণ আমার সন্তান সবল হলেও আমার ভাইয়ের একটি প্রতিবন্ধী সন্তান আছে। আমার সবল সন্তানটির সঙ্গে ওই প্রতিবন্ধী শিশুটি জীবনের দৌড়ে পাল্লা দেবে– এ রকম কুৎসিত ‘লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড’ দেখতে চাই না। প্রতিবন্ধী শিশুটিকে খেলায় হারিয়ে আমার শক্তিমান পুত্র বিজয়ের দেঁতো হাসি হাসবে– এরকম হিংস্র প্রতিযোগিতার রাজ্যে নিজের সন্তানকে রেখে যেতে চাই না আমি।
এক পায়ে চলা মানুষটির জন্য, পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য, সংকটগ্রস্ত মানুষদের জন্য, বঞ্চিত মানুষদের জন্য সুরক্ষামূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা চাই। প্রত্যেকের সুরক্ষা ও অগ্রগতির জন্য সংরক্ষিত কোটা চাই। বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে চাকরির কোটা শতভাগ করা চাই।
‘Survival of the fittest’ অর্থাৎ ‘যোগ্যতমের টিকে থাকা’ জঙ্গলের তত্ত্ব। দেশটা জঙ্গল নয়। এখানে মানুষ বাস করে। মানুষের দেশে মানবিক সমাজ চাই। জোর যার, মুল্লুক তার– তা হবে না। শুধু শক্তিমান বাঁচবে তা হবে না। শুধু মেধাবী বাঁচবে, কম মেধার মানুষ টিকতে পারবে না– এ রকম সভ্যতা বহির্ভূত চিন্তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হবে।
আমার পরিবারে পাঁচটি ছেলে। তাদের দুই জন মেধাবী, দুই জন চলনসই এবং একজন বোকাটে স্বভাবের। এই পাঁচ জনের মধ্যে শুধু মেধাবী দু’জন বাঁচবে? বাকিদের কোনো কাজকর্ম থাকবে না? তাদের বাঁচতে হবে না? যার দাঁত আছে সে অন্য প্রাণীকে কামড়ে খাবে– দেশটাকে এমন জঙ্গল বানাতে দেয়া যায় না। যে দুর্বল তাকেও খেয়ে পড়ে বাঁচতে দিতে হবে। যে আপাত দৃষ্টিতে দুর্বল তাকে সবল ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
মেধাবীদের আন্দোলন?
নামে কোটা বিরোধী আন্দোলন হলেও এটি আসলে সরকারি চাকরির মুক্ত বাজার তৈরির আন্দোলন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাজার অর্থনীতির স্রোতের তোড়ে এদেশের সাম্যবাদী, সমাজতান্ত্রিক, এমন কি পুজিবাদী ‘কল্যাণ রাষ্ট্রে’র ধারণায় বিশ্বাসী সবগুলো মহল ভেসে গেছে। এখন সবাই মুক্ত বাজারে প্রতিযোগিতা চায়। প্রতিযোগিতার এই বাজারে শুধু তথাকথিত ‘মেধাবীদের’ স্থান থাকবে! কী আশ্চর্য!
কোটা নয়, মেধার ভিত্তিতে চাকরি? বাবাজি, তুমি কেমন মেধাবী? মেধাবী হলে আমলা বা কেরানি হতে চাও কেন? বিজ্ঞানী হও দেখি! মেধাবী হলে চিন্তায় ও কর্মে সৃজনশীল হও। তোমার আন্দোলনই বলে দিচ্ছে, তুমি মেধাবী নও। তুমি মূলত সুবিধাবাদী। তুমি অপেক্ষাকৃত দুর্বলের সকল সুবিধা কেড়ে নিয়ে নিজের সুবিধা নিশ্চিত করতে চাও। তোমার মস্তিষ্ক সেভাবে কাজ করে না বলে তুমি বড় কিছু চিন্তা করতে পার না। মেধাবী হলে বড় কিছু ভাবতে। বড় কিছু নয়; তুমি ঘুষের চাকরি পাওয়ার জন্য ব্যাকুল। নইলে একজন মেধাবী মানুষ সরকারের কেরানি বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হওয়ার জন্য কেন ব্যাকুল হবে?
আমাদের দেশে মেধা যাচাইয়ের মানদণ্ড কি? পাবলিক পরীক্ষা? আমার ৫৩ বছরের জীবনে আমি অনেকগুলো এসএসসি পরীক্ষায় হলের বাইরে দাঁড়িয়ে পাসের যুদ্ধ অবলোকন করেছি। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে দেখেছি। মাস্টার্স পর্যন্ত অস্যংখ্য বন্ধু-স্বজনের পাস করার, এমনকি ভাল রেজাল্ট করার কাণ্ড দেখেছি। কোটায় নয়, তথাকথিত ‘মেধার ভিত্তিতে’ অসংখ্য মানুষকে নিয়োগ পেতেও দেখেছি। নিয়োগের আগে এসব ‘মেধাবীর’ তদবির দেখেছি। দেখে দেখে ঘেন্না ধরে গেছে। সবাই মেধাবী?
“কিন্তু, কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?/ দোকানে কেন এ দর কষাকষি?– পথে ফুটে তাজা ফুল!” – কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী কবিতাটা একটু মনে করিয়ে দিতে চাই ‘মেধাবী আন্দোলনকারীদের’। যে ছেলেটি তোমার ব্যাগ বহন করল, অথচ স্কুলে ঢোকার সুযোগ পেল না, তুমি কি তার চেয়ে বেশি মেধাবী? শোষক-মনস্কতা এ রকম চিন্তায় আত্মপ্রসাদ পায়। ঢাকায় কয়েকটি স্কুলে ভর্তির জন্য মহা-লড়াই চলে। এই কয়েকটি স্কুলে যারা পড়ার সুযোগ পেল শুধু তারাই কি মেধাবী? বাকি লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী যারা ঢাকায়-গ্রামে-ছোট শহরে লেখাপড়া করছে তাদের কি মেধা নেই? যে ছেলেটি পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ করল তার কি মেধা নেই? শিক্ষা শেষে তার কাজ পাওয়ারও সুযোগ থাকবে না?
আমি অসংখ্য ছেলে-মেয়েকে নানা কারণে ঝরে যেতে দেখেছি– যারা এই দাবিদার ‘মেধাবীদের’ চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী। ফুটপাতে শুয়ে থাকা ছেলেকে দেখেছি অসামান্য সুরেলা কণ্ঠে গান গাইতে। সুযোগ পেলে সে হয়তো আমাদের প্রতিষ্ঠিত অনেক শিল্পীকে ছাড়িয়ে যেত। ১১/১২ বছরের এক সুইপার বালক আমাকে মামা ডাকত। সুন্দর ছবি আঁকত ছেলেটি। তার আঁকা ছবি আমাদের মত ভদ্রঘরের মানুষদের বিষ্ময়ে অভিভূত করত। সেই ছেলেটিকে তার বাবা ময়লা নিষ্কাশনের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। ‘মামা, আমি যে মেথর! ভগবান কেন যে মেথর বানালো!’– তার এই কথা আজো আমার হৃদয়ে বাজে। সে এখন কোথায় আছে, কেমন আছে জানি না।
ওই মানুষগুলো জানে না, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ তাকে সুইপারের কাজে যেতে বাধ্য করেছে। উন্নত দেশে সুইপারের ছেলে সুইপার হতে বাধ্য হয় না। এমন তো হতে পারত যে ওই ছেলেটি বড় হয়ে এস.এম. সুলতান বা জয়নুল আবেদিনকে ছাড়িয়ে গেছে! আমার দেশে কতসংখ্যক লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির সম্ভাবনাকে শৈশবেই খুন করা হয় তার পরিসংখ্যান কে দেবে? তুমি বা আমি কিসের জন্য মেধার বড়াই করি বন্ধু? আমাদের লজ্জা হয় না! প্রকৃত প্রতিভাকে নিত্যদিন খুন করে আমাদের তরুণরা কেরানির চাকরির জন্য মেধার প্রতিযোগিতা করতে চায়! কি আশ্চর্য নীতিকথা!
অফিসে আমার সহকর্মী ৬ জন পিয়নের মধ্যে অন্তত ৫ জন তুখোড় মেধাবী। তাদের বুদ্ধিমত্তা এবং তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার-দক্ষতা আমাকে মুগ্ধ করে। কম্পিউটার বিভাগে কাজ দিলে ওরা অনেক ভাল করত। এমনকি সাংবাদিকতা করলে ওরা আমাদের কিছু সাব-এডিটর বা রিপোর্টারের চেয়ে ভাল পারদর্শিতা দেখাত– এ আমি নিশ্চিত। আমাদের আবার মেধার বড়াই!
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির কোনায় বসে যে ছেলেটি জুতা সেলাই করে, তার কি অধিকার নেই আপন যোগ্যতাবলে ড. বি. আর. আম্বেদকরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার? আমার রাষ্ট্র ও সমাজ কি সে সুযোগ তাকে দিচ্ছে? ফুটপাতে কিংবা বস্তির দারিদ্র্যে নিঃশেষিত হচ্ছে সম্ভাবনা। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের সংবিধানে শোষণমুক্তির প্রত্যয় আছে। সেই প্রত্যয় ভুলে গিয়ে স্বার্থপরদের দাবির মুখে দেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, কোটা ব্যবস্থা থাকবে না! এমন সিদ্ধান্ত ন্যায় ও মানবতার বিচারে অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। আদালত তা বাতিল করে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মেধার প্রতিযোগিতা
তুমি ক্লাসের পড়া মুখস্ত করেছ জন্য মেধাবী? পাবলিক পরীক্ষায় পাশ করা যদি মেধার মানদণ্ড হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা মেডিকেলে ভর্তির জন্য আবার পরীক্ষা দাও কেন? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য আবার দফায় দফায় পাশ দিচ্ছ। এত পাশের পর সরকারি চাকরি পেতে নতুন করে পরীক্ষা দিতে হবে কেন? এতগুলো পাশ করার পরও রাষ্ট্রের কাছে একটি কর্ম পাওয়ার স্বাভাবিক অধিকার কি তোমার হয়নি? সুইপার, পিয়ন, দারোয়ান, পুলিশের কনস্টেবল থেকে সরকারের ক্যাডার সার্ভিস পর্যন্ত চাকরির জন্য পরীক্ষা দিতে হয়। মাননীয় সরকার বাহাদুর কি ‘মেধাবী সুইপার’, ‘মেধাবী পিয়ন’, ‘মেধাবী কেরানি’ বেছে নেওয়ার জন্য চাকরির পরীক্ষা আয়োজন করে? এসব পদে যারা কোটায় চাকরি পায় তারা কম মেধাবী, আর যারা কোটার বাইরে থেকে চাকরি পায় তারা বেশি মেধাবী? প্রশ্নটি আবারও করছি। যারা কোটার ভিত্তিতে পিয়নের বা দারোয়ানের চাকরি পেল সেকি ‘কম যোগ্য পিয়ন’ এবং যে কোটা ছাড়া চাকরি পেল সেকি ‘বেশি যোগ্য দারোয়ান’? একটু ভেবে উত্তর দাও তো বাছারা! হায় ‘মেধাবী’ চাকরি প্রার্থীরা, তোমরা কি কারণে মেধার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে যাও? এ শুধু একটি চাকরির জন্য অসহায়ত্ব নয় কি? সেখানে মেধার ভূমিকা কতটুকু?
বেসরকারি (কর্পোরেট ও নন কর্পোরেট) অসংখ্য প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে নিম্নস্তর থেকে নির্বাহী পদ পর্যন্ত শুধুমাত্র মৌখিক সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে চাকরি দেওয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা কি সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কম? বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিক দক্ষতার কারণ কি? তবে পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা যাচাই কি কাজে লাগে? তবুও চাকরি ক্ষেত্রে যারা প্রবেশাধিকার পাচ্ছে তাদের সবাই তোমাদের তথাকথিত মেধার প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়েই তো চাকরি নিচ্ছে– সে কোটাই হোক আর কোটাবিহীন হোক।
যারা কোটায় নিয়োগ প্রাপ্ত হয় তাদের কি রাস্তা থেকে ধরে এনে চাকরি দেয়া হয়? তাদের মেধা যাচাই করা হয় না? তারা কি শিক্ষার বিভিন্ন স্তর পার হয়ে আসেনি? তারা কেউ মেধাবী নয়, আর তুমি মেধাবী– এটা কোন বিচারে দাবি কর? বিসিএস পাস না করলেও কি কোটার ভিত্তিতে সরকারি ক্যাডারে চাকরি দেওয়া হয়? যে ছেলে বা মেয়েটি বিসিএস কোয়ালিফাই করল তাকে তুমি মেধাহীন বল কোন অধিকারে?
মেধার পরীক্ষা চাও না, তুমি তুমি আসলে চাকরি চাও। যেভাবেই হোক করে খেতে চাও। পিয়নের চাকরি হোক, আর সচিবের পদ হোক– তোমার চাকরি দরকার। কোটা ব্যবস্থাকে তোমার স্বার্থের প্রতিবন্ধক মনে হয়েছে, তাই তুমি আন্দোলন করেছ। চাকরি চাওয়াটা অন্যায় নয়। এটা তোমার অধিকার, সে তুমি মেধাবী হও আর কম মেধাবী হও। এই চাকরি ক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ করা অর্থাৎ ঘুষের বিনিময়ে চাকরি দেওয়া বন্ধ করা তোমার প্রধান দাবি হওয়া উচিত ছিল। তুমি তা করছ না।
কেমন কোটা চাই?
দুর্বল ও অবহেলিতের স্বার্থ রক্ষা এবং জাতীয় সমতার নীতি সমুন্নত রাখার জন্যই কোটা পদ্ধতি বহাল রাখা অনিবার্য। দেশের পিছিয়ে পড়া সকল জনগোষ্ঠিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনে বিদ্যমান কোটাসমূহ সংস্কার করা দরকার। সরকারি চাকরির সিস্টেমটা পুরোপুরি ভাগ করে দেওয়া দরকার– যাতে কেউ বঞ্চিত না হয়। একটি বৈষম্যের সমাজে দুর্বল জনগোষ্ঠীকে রেহাই দিতে হলে এবং সমভাবে অগ্রগতির সুযোগ দিতে হলে, রাষ্ট্রীয় সকল সুবিধা মানবিক ও প্রগতিশীল বিচারবোধ থেকে শতভাগ বণ্টনের ব্যবস্থা করা উচিত।
প্রথমত: নারী কোটা। দেশের নারীরা উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তিতে সমঅধিকার পায় না। এ কারণে তারা অর্থনৈতিকভাবে এখনো পুরুষের উপর নির্ভরশীল। নারী-পুরুষ সমতার ভিত্তিতে একটি সুষম সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি বড় অন্তরায়। অন্তত কর্মক্ষেত্রে নারীদের সম-অবস্থানে নিয়ে আসুন; নারীরা এগিয়ে যাক। এখন পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নারীর অবস্থান ১০ শতাংশের বেশি হবে বলে মনে হয় না। চাকরিতে নারী ও পুরুষের অনুপাত সমান করতে হলে নারী কোটা বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা দরকার। নারীদের শিক্ষার হার বেড়েছে। সুতরাং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম এবং ব্যত্যয়ের সুযোগ রেখে সরকারি চাকরির ৫০ শতাংশ নারীর জন্য এবং ৫০ শতাংশ পুরুষের জন্য সংরক্ষিত করুন। দেশের সুষম অগ্রগতি হোক।
দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ক্রমাগত কমছে। সরকারি জরিপে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত দেশের অন্তত ৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী হিন্দু। এছাড়াও বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং আদিবাসী বিভিন্ন গোষ্ঠীর আলাদা ধর্মমত আছে। অথচ সরকারি চাকরিতে ৪ শতাংশ সংখ্যালঘু আছে বলে মনে হয় না। ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে এসব মানুষ নানাবিধ প্রতিকূলতায় ভোগে তারা। সমতল ও পাহাড়ে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী সংকটগ্রস্ত। বর্তমান বাস্তবতায় সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অন্তত ২০ শতাংশ চাকরি ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য বরাদ্দ রেখে ৭৫ শতাংশ চাকরি সংখাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ করা উচিত। তবে কেউ প্রচলিত কোনো ধর্মেই বিশ্বাস না করতে চাইলে তাকে বাধ্য করা যাবে না। বাকি ৫ শতাংশ কোটায় তারা সরকারি চাকরিতে ঢুকতে পারবেন। এ রকম কোনো আবেদনকারী না থাকলে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু যে কোনো সম্প্রদায়ের ব্যক্তি সেই কোটায় চাকরিতে নিযুক্ত হবেন।
ধনি ও দরিদ্রের কোটা সুস্পষ্ট করা দরকার। ধনি ব্যক্তিদের সরকারি চাকরির প্রয়োজন কি? যারা বেশি টাকা খরচ করে ছেলেমেয়েদের উন্নত বা বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন তাদের চাকরির দরকার কি? রাষ্ট্র চাকরির অগ্রাধিকার নির্ধারণ করবে দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েদের জন্য। চাকরিতে আবেদনের সময় পরিবারের ও ব্যক্তিগত সম্পদের হিসাব বিবরণি জমা দিতে হবে। নিজের ও পিতা-মাতার আয়কর সনদ সংযুক্ত করতে হবে। চাকরির জন্য দুষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে চারিত্রিক সনদ নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
লিঙ্গবৈচিত্র্যময় মানুষগুলো একটা বাজে পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করছে। জীবনের মূলধারায় এদের সম্পৃক্ত করতে হলে তাদের জন্য চাকরির কোটা নির্ধারণ করে দেওয়া দরকার। যারা বেঁচে থাকার প্রয়োজনে গণিকাবৃত্তি বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে তাদের পুনর্বাসনের সুযোগ দেয়া দরকার। মেথর, মুচি, ডোমসহ সমাজের অন্ত্যজ জনগোষ্ঠি হিসেবে পরিচিতদের জন্য আলাদা কোটা দরকার। কাজের পছন্দ বা অপছন্দ কোনো ব্যক্তির জন্মের সঙ্গে গেঁথে দেওয়া বিষয় নয়। অন্য কর্মের যোগ্যতা থাকলেও তাকে ময়লা টানতে হবে– বিজ্ঞানী, দার্শনিক, মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না– এটা হয় না। শুধু জন্মের কারণে বৈষম্য প্রদর্শন করা দেশের সংবিধান সমর্থন করে না। এটা চরম অন্যায়; ভয়ঙ্কর বর্ণবাদ।
এরপর আসে মুক্তিযোদ্ধা কোটা। আমি কোটা ব্যবস্থার পক্ষে। তবে এটাও স্পষ্ট করে বলতে চাই, পশ্চাৎপদ গোষ্ঠিধারণার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা কোটা যায় না। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা সংরক্ষণ মূলত একটি সংরক্ষিত বিশেষাধিকার (প্রিভিলেজ)। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কাউকে বিশেষাধিকার ও সম্মান দেওয়া যেতেই পারে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের এই বিশেষাধিকার কিভাবে দেবেন, কতবার দেবেন– সেটা আলাদাভাবেও ভাবা যেতে পারে।
প্রয়োজন ইতিবাচক পক্ষপাত
আসুন মানবতাকে সমুন্নত রাখার জন্য চাকরি ক্ষেত্রে ইতিবাচক পক্ষপাত (affirmative discrimination) দেখাই। ১০০ টি পদের বিপরীতে পাঁচ হাজার আবেদন পড়েছে। এদের মধ্যে যোগ্যতম ২০০ জনকে আমরা নির্বাচিত করব। এই ২০০ জনের সবাই যোগ্য হলেও তাদের সবাইকে চাকরি দেওয়ার সুযোগ নেই। এই পর্যায়ে ইতিবাচক পক্ষপাতের পন্থা নিতে হবে। ২০০ জনের মধ্যে চাকরির প্রয়োজনটা কার সবচেয়ে বেশি? তাকে আগে বেছে নিতে হবে? তার সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নিতে হবে। এজন্য সংরক্ষিত কোটা ব্যবস্থা দরকার।
হ্যা, চাকরিটা যদি ডাক্তারের হয়, তাহলে এ ধরণের কোনো বিবেচনা অগ্রাধিকার পাবে না। মেধা তালিকায় যে সবার উপরে, সেই নিয়োগ পাবে। চাকরি যদি বিজ্ঞান গবেষণার হয়, তাহলে মেধা তালিকায় যে এক নম্বর, তাকেই নিয়োগ দিতে হবে। অন্যান্য প্রায় সকল ক্ষেত্রে সংরক্ষিত কোটা আগে, তারপর সিরিয়াল বিবেচনা। কোটা বাতিল নয়; প্রগতিশীল সংস্কার দরকার।