Published : 13 Apr 2020, 03:48 PM
পহেলা বৈশাখ। বাংলা নতুন বছর ১৪২৭-এর প্রথম দিন।
এবার বাংলা নববর্ষকে বরণ করা হচ্ছে এক ভিন্নতর পরিস্থিতিতে। উৎসবের মেজাজে নেই দেশের মানুষ। আতঙ্ক-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-মৃত্যু ভয়ে তৈরি হয়েছে এক অসহনীয় অবস্থা। এক অদৃশ্য মানবঘাতী ভাইরাসের দাপটে গোটা পৃথিবী এখন টালমাটাল। করোনাভাইরাসে মৃত্যু ঘটছে হাজার হাজার মানুষের। এই মৃত্যু মিছিলের শেষ কোথায় কেউ জানি না। মানুষে মানুষে নৈকট্য নয়, দূরত্ব এখন কাম্য। এই অবস্থায় এবার বৈশাখ বরণ হবে একসঙ্গে নয়, ঘরে ঘরে, যার যার মতো করে, পারিবারিক পরিবেশে।
ভোরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রমনার বটমূলে ছায়ানটের উদ্যোগে 'এসো হে বৈশাখ, এসো এসো' গানের মাধ্যমে শুরু হবে না বৈশাখবন্দনা। বের হবে না চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা। পরিস্থিতির কারণে নতুন বছরকে বরণ করার আয়োজনে এবার থাকবে হয়তো কিছু নতুনত্ব। বাধার মুখে বাঙালি সৃজনশীলতার পরিচয়দানে সক্ষমতা আগেও দেখিয়েছে। এবারও দেখাবে। ঘরেই হতে পারে নতুন নতুন আয়োজন। পারিবারিকভাবেই হতে পারে গানের অনুষ্ঠান, কবিতা পাঠ, ছবি আঁকা – এরকম আরো কত কী! হয়তো তাতে উদ্দামতা, তারুণ্যের বাধভাঙা উচ্ছ্বাস থাকবে না, তবে থাকবে 'রসের আবেশরাশি'। মোট কথা পহেলা বৈশাখে বিষণ্ণতা নয়, অবসাদ নয় – হোক সৃষ্টি সুখের উল্লাস। চিত্তকে ভয়শূন্য রেখে আমরা মেতে উঠব সীমিত বৈশাখী উৎসবে। সীমার মাঝেই তো হয় অসীমের সন্ধান। স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করব না, নিজে আনন্দ করতে গিয়ে অনেকের জীবন নিরানন্দ ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলব না।
পহেলা বৈশাখ বাঙালির উৎসবের দিন, আনন্দের দিন, সম্প্রীতির দিন, সৌহার্দের দিন। পহেলা বৈশাখ মানে হালখাতা, পহেলা বৈশাখ মানে গ্রাম্য মেলা। নাগর দোলা, হাওয়াই মিঠাই, বাতাসা, পুতুল নাচ, গান, সার্কাস, মুখোশনৃত্য – আরও কত কী! আজকাল আয়োজনে ব্যাপকতা এসেছে, এসেছে কিছুটা পরিবর্তনও। কিন্ত পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে বাঙালির আবেগ ও ভালবাসা আছে চির জাগরুক। শুভ নববর্ষ বলে একে অপরের শান্তি, সুখ, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনায় কোনো পরিবর্তন নেই, ব্যত্যয় নেই।
ঈদ কিংবা পূজাও উৎসব। ওই উৎসবেও আনন্দ হয়। আর আমাদের আনন্দ মানেই তো খাওয়া-দাওয়া, নতুন পোশাক পরা, দল বেধে ঘুরে বেড়ানো, আড্ডায় মেতে ওঠা। ঈদ-পূজার উৎসব আয়োজন সর্বজনীন নয়। তাতে ধর্ম বিশ্বাসের গণ্ডি আছে। মুখে বলা হয়, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। কিন্তু বাস্তবে তা আচরিত হওয়া কঠিন। হিন্দু যাবেন না ঈদের নামাজের মাঠে। মুসলমান মন্দিরে করবেন না নৈবেদ্য নিবেদন। কিন্তু পহেলা বৈশাখের উৎসবটা প্রকৃত অর্থেই সবার, সব বাঙালির, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির উৎসব বর্ষবরণ।
সে হিসেবে বর্ষবরণের উৎসবই হওয়ার কথা বাঙালির প্রধান জাতীয় উৎসব। কিন্তু হয়েছে কি? না, পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়েও বিভেদ-বিভ্রান্তির অপচেষ্টা আছে, ছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির কৃষ্টি-ঐতিহ্যকে অবদমনের চেষ্টা করেছে। একে 'হিন্দুয়ানি' বলে প্রচার করেছে। তবে বাঙালি সেটা মানেনি। পহেলা বৈশাখকে একটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম নিরপেক্ষ উৎসব হিসেবেই পালন করে আসা হচ্ছে। বাধা দিলে বাধা না মানাই হল বাঙালির এক সহজাত প্রবণতা। পহেলা বৈশাখ পালনে বাধা দিয়ে পাকিস্তানিরা বাঙালিকে হারাতে পারেনি, নিজেরাই হেরেছে।
এখনও যারা বাঙালির বর্ষবরণের উৎসবের বিরোধিতা করেন, মঙ্গল শোভাযাত্রায় অমঙ্গলের চিহ্ন দেখেন, তাদেরও পিছু হঠতে হবে। কারণ বাঙালির রক্তে আছে দ্রোহ, এ রক্ত পরাভব মানে না। 'জ্বলে পুড়ে ছাড়খার তবু মাথা নোয়াবার নয়'। বাঙালি বিশ্বাস করে- মুছে যাবে গ্লানি, ঘুচে যাবে জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হবে ধরা।
আমাদের জীবনে দুঃখ-বেদনা আছে। জয়ের আনন্দের পাশাপাশি সাময়িক পরাজয়ের কাতরতাও আছে। আমরা পাই, আবার পেয়েও হারাই। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা অবদমিত হয় না। পুরাতন বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে আমরা বরণ করি এই আশা নিয়ে যে, নতুন বছরে আমরা 'পুরাতন অপরাধ'-এর পুনরাবৃত্তি করব না। বৈশাখ চির নতুনকেই ডাক দিতে এসেছে। আমরা নতুন করে সংকল্পবদ্ধ হব, দুবেলা মরার আগে মরব না, আমরা ভয় করব না। আমরা মানুষ হয়ে ওঠার সাধনা করব। মনুষ্যত্বের জয়গান গাইব। ধর্ম যেন আমাদের যুক্তিবোধ ও শুভবোধকে আচ্ছন্ন করতে না পারে। আমরা যেন ভুলে না যাই, মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। 'মানুষ এনেছে ধর্ম যেন, ধর্ম আনেনি মানুষ কোনো'। যেকোনো পশ্চাৎগামিতাকে প্রতিরোধ করে, আঁধারের বুকে আলো জ্বালানোর প্রতিজ্ঞা নিয়েই আমরা আবাহন করব নতুন বছরকে – ১৪২৭ বঙ্গাব্দকে।
করোনাভাইরাসকাল চিরস্থায়ী হবে না। এখন আমরা চারদিকে মৃত্যু দেখছি, বিষাদ-বিপন্নতা দেখছি। কিন্তু অচিরেই আমরা জীবন দেখব, দেখব জীবনের জয়োল্লাস। মৃত্যু চিরসত্য, জীবন অনিত্য। তবু জীবনের জয়গানই আমরা করি। বিদায়ী বছর আমাদের ওপর করোনাভাইরাসের 'আবর্জনা' চাপিয়ে দিয়েছে। নতুন বছরে এই আবর্জনা দূর করে আমরা মানুষে মানুষে দূরত্ব ঘুচিয়ে জীবনকে ভালোবাসার দিগন্ত প্রসারিত করব।
শুভ নববর্ষ। জয় হোক বাঙালির। জয় হোক মানুষের।