Published : 11 Apr 2020, 04:36 PM
বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নেয়া করোনাভাইরাসের ত্রাস বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে। চীনের উহানে গত বছরের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া এ ছোঁয়াচে ভাইরাস অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশে দেশে। ইতোমধ্যে দুই শতাধিক দেশে ভাইরাসটি আঘাত হেনেছে, কেড়ে নিয়েছে প্রায় এক লক্ষ মানুষের প্রাণ। আক্রান্ত করেছে সতেরো লক্ষেরও অধিক সংখ্যক মানুষকে। প্রথম আক্রান্ত দেশ চীন এই মরণঘাতি ভাইরাসটি মোকাবেলায় সফল হলেও কিছু কিছু দেশ বিশেষ করে ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইরান একেবারে নাজেহাল হয়ে পড়েছে। উন্নয়নের দিক থেকে প্রথম সারির এসকল দেশ উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিয়েও যেভাবে নাকানিচুবানী খাচ্ছে সেটা সত্যিই বিস্ময়কর! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খুব বাস্তবিক কারণে, দরিদ্র দেশসমূহের নিকট দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে এবং একইসাথে হুশিয়ারিও করেছে যদি দেশগুলো যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তা ইউরোপের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে যার আভাস ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পাওয়াও শুরু করেছে। দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়। এরপর পুরো মার্চ এর সংক্রমন সেভাবে না বাড়লেও এ মাসের প্রথম থেকে এটি বাড়তে থাকে। এখন পর্যন্ত দেশে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪৮২ জন, যার মধ্যে ৩০ জন মারা গেছেন।
কিন্তু মার্চ পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক কম থাকার কারণ হিসেবে জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন-যেহেতু কিট ও পিসিআর মেশিন সংকটের কারণে কম সংখ্যক রোগীর নমুনা পরীক্ষা কম হয়েছে তাই আক্রান্তের সংখ্যাও কম থেকেছে। আর এখন পরীক্ষার সুবিধা বাড়ানোর ফলে দিনে দিনে আশংকাজনক হারে বাড়তে শুরু করেছে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও। ইতোমধ্যে দেশের ১৫টি জেলা ও চারটি ক্লাস্টার চিহ্নিত হয়েছে যেগুলোর উপর বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। এছাড়া কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হওয়ায় দেশে সাধারণ ছুটি চলছে (লকডাউনের পরিবর্তে), সর্বস্তরের মানুষকে ঘরে কোয়ারেন্টিনে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। তারা মাঠ প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করছে। কিন্তু অতি জনঘনত্বের দরিদ্র এই দেশে মানুষকে বিশেষ করে অভাবী মানুষকে ঘরে আটকে রাখা সত্যিই অসম্ভব। দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী নিম্ন আয়ের মানুষের সামর্থ্যের কথা চিন্তা করে সরকার ইতোমধ্যে নানারকম সহায়তা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এরমধ্যে ঘরে ফেরা কর্মসূচির আওতায় চাল ও নগদ অর্থ সহায়তা, বিশেষ প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় নির্দিষ্ট কিছু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো ইত্যাদি অন্যতম। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে প্রদেয় সহায়তাও চলছে। কিন্তু চলতি এই সংকটের গভীরতা ও সম্ভাব্য স্থায়ীত্ব বিবেচনায় সরকারি বিশেষ সহায়তা কার্যক্রমে সুশাসন নিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, শাসন প্রক্রিয়ার প্রথাগত দুর্বলতা, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, সহায়তা প্রদান কর্মসূচিতে কার্যকর জনঅংশগ্রহণ না থাকা ইত্যাদি কারণে সরকারের গৃহীত বিশেষ এই সহায়তা কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্যও ব্যহত হতে পারে। এই সহায়তা কার্যক্রমে প্রান্তিক, সমাজবিচ্ছিন্ন, জাতিগত সংখ্যালঘু ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর অধিকারভিত্তিক প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করার বিষয়টিকেও অধিকতর গুরুত্বের সাথে পরিবীক্ষণ করা প্রয়োজন। আলোচ্য নিবন্ধে, দেশের প্রান্তিক, জাতিগত সংখ্যালঘু এবং পিছিয়ে পড়া বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠীর অধিকারভিত্তিক সহায়তা প্রাপ্তির গুরুত্বের ওপর আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।
২. দেশের প্রান্তিক, জাতিগত সংখ্যালঘু এবং পিছিয়ে পড়া বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠী বলতে কাদের বোঝানো হচ্ছে?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো'র সর্বসাম্প্রতিক তথ্যে (২০১৯) বলা হয়, বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা শতাংশের হিসেবে প্রায় ২১%। যার মধ্যে প্রায় ১১% আবার হতদরিদ্র! বিশ্ব ব্যাংকের ক্রয়ক্ষমতার সমতা অনুসারে (পিপিপি) যাদের দৈনিক আয় ১ ডলার ৯০ সেন্টের কম, তাদের হতদরিদ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটা আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশে প্রতি পিপিপি ডলারের মান ধরা হয়েছে ৩২ টাকা। সেই হিসেবে বাংলাদেশের ২ কোটি ৪১ লক্ষ মানুষ দৈনিক ৬১ টাকা ৬০ পয়সাও আয় করতে পারে না। কিন্তু আর্থিক সামর্থ্য বিচার ছাড়াও আরও কিছু সামাজিক-রাজনৈতিক সূচকে যদি পরিমাপ করা যায় তাহলে দারিদ্রতার সাধারণ সজ্ঞায় পড়া মানুষের মধ্যে বেশ কিছু সাব-ক্লাস্টার বা গুচ্ছ চিহ্নিত করা যাবে। আর এসকল সূচকের একটি হলো জাতিগত সংখ্যালঘুত্ব। সতমলের আদিবাসী, নারী, শিশু, প্রতিবন্ধীগণও সেই সকল গুচ্ছের আওতায় পড়বে। যাহোক, আলোচ্য পরিসরে আলোচনটি সরকার ঘোষিত বিশেষ সহায়তা কার্যক্রমে উপর্যুক্ত জনগোষ্ঠীকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
৩. বিপন্নতার আপেক্ষিকতা এবং অধিকার অঙ্গিকার
যে কোনও মহামারী বা দুর্যোগে সবকিছুর মতো ত্রাণ বিতরণ নিয়ে যে হুলুস্থুল হয় সেট যে করোনাভাইরাস সংকট কাঠিয়ে ওঠার জন্য ঘোষিত বিশেষ সহায়তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রেও যে হবে সেটা অনুমান করাই যায়। আর এ সকল ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক কারণে বঞ্চিত হয় যারা শারিরীক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য নানা কারণে অপেক্ষাকৃত দুর্বল তারাই। এই দুর্বলতা ও বিপন্নতার মাত্রা সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা নিয়ে আলোচনা করা জরুরি মনে করি। এটি ঠিকভাবে বুঝতে যদি আমরা ব্যর্থ হই তাহলে, সার্বিকভাবে ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রমটিও অনেক দিক থেকে ব্যর্থ হবারও আশংকা থেকে যাবে। একজন দরিদ্র, শারিরীকভাবে দুর্বল, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী, নারী ও শিশু ত্রাণ নিতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার (ভালো অথবা মন্দ) সম্মুখীন হবেন সেটির অনুঘটক হিসেবে মূলত কাজ করবে তার আপেক্ষিক শক্তি অথবা তার বিপন্নতার মাত্রাই। কারণ, শুধু মহামারী নয়, বরং স্বাভাবিক সময়েও দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনায়/প্রেক্ষিতে একজন মানুষের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নির্ধারিত হয় তার আপেক্ষিক শক্তি বা দুর্বলতা বিবেচনায়। বিষয়টি সুষ্পষ্ট করতে একটি উদাহরণ নেয়া যাক। যেমন, যখন কোনও সাইক্লোন বা টর্নেডো একটি জনপদের উপর বয়ে যায় তখন কি ঐ জনপদে বসবাসকারী পরিবার, ব্যক্তি, জীবজন্তু এবং গাছপালার প্রতি সমান প্রভাব রেখে যায়? উত্তর হলো, না। কারণ, ঐ জনপদে বসবাসকারী প্রতিটি এককের (ব্যক্তি, জীবজন্তু, গাছপালা ইত্যাদি) শক্তির বা অবস্থানের ভিন্নতা রয়েছে। তারা বয়সে, শক্তিতে, অবস্থানে, সংখ্যায় এবং শক্তির মাত্রায় সম অবস্থায় থাকে না। তাই টর্নেডোর শক্তি একটি পাঁকাবাড়ির কোনও ক্ষয়ক্ষতি করতে না পারলেও খুপড়ি ঘরকে সমূলে উড়িয়ে নিয়ে যায়। কারণ ঐ ঘরটি আগে থেকেই জীর্ণ অবস্থায় ছিল কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় তার জীর্ণতা কতোটা বিপন্ন ছিল তা সাদাচোখে পরিমাপ করা যায়নি। তেমনিভাবে, একটি চারাগাছ, বা একটি কাঠাল গাছ, বা একটি তালগাছ বা বাঁশগাছও সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। কারণ, ঐ গাছগুলোর শারিরীক শক্তি, ডালপালার পরিমাণ ও উচ্চতা, বাতাস প্রবাহ বা বাতাস আটকানোর সুযোগ, শেকড়ের শক্তি ইত্যাদি ভিন্ন। আবার, ক্ষয়ক্ষতি কাটিকে উঠতে বা পুনর্বাসনে একজন দরিদ্র মানুষের যত বেশি সময় লাগবে, তার চেয়ে অনেক কম সময় লাগবে একজন ধনী মানুষের। কারণ, যার অর্থ আছে সে চাইলেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করে মুহূর্তেই ক্ষয়ক্ষতি পুষিতে নিতে পারে।
সে কারণে, দুর্যোগে মানুষের আপেক্ষিক বিপদাপন্নতা পরিমাপ এবং সে মতোই কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন পরিকাঠামো গ্রহণ করা এখনকার বাস্তবতায় একটি অন্যতম অগ্রাধিকার। করোনাভাইরাস সংকট মোকাবেলায় সরকারের ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে (ত্রাণ বিতরণে) গতানুগতিক সমাজিক ক্ষমতা বিন্যাস, উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর আর্থিক-সামাজিক সামর্থ্য, শারিরীক প্রতিবন্ধীতার ধরণ ও মাত্রা, জেন্ডার প্রেক্ষিত, শিশুদের বিশেষ প্রয়োজন এবং সর্বোপরি জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি বিশেষ ফোকাস দিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সহায়তা নির্দেশিকা ও ত্রাণ বিতরণের জন্য গৃহীত আচরণবিধির সমন্বয়ে একটি বিশেষ অপারেশনাল গাইডলাইন এখন অতি জরুরি।
৪. দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বিপন্ন মানুষের অধিকার ও প্রবেশগম্যতা
দেশের সরকার এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অব্যাহত প্রচারে যারা অবকাঠামো নির্ভর উন্নয়নে বুঁদ হয়ে হয়েছিলেন, করোনাভাইরাস সংকট তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের উন্নয়নের পরিকাঠামোর দুর্বলতাগুলো। শুধু তাই নয়, এ ধারার উন্নয়ন যে কম্প্রিহেন্সিভ নয় সেটিও। আর একপেশে উন্নয়নে থেকে যাওয়া বহুবিধ দুর্বলতার কারণে এখনও কোটি কোটি মানুষকে সরকারি ত্রাণ সহায়তা নিয়ে বাঁচতে হচ্ছে। আর করোনাভাইরাস সংকটের এখন পর্যন্ত যে ধরণ তাতে সবাই মনে করছে এটি প্রলম্বিতও হবে। সংকটের স্থায়ীত্ব বিবেচনায় নিয়ে সরকার ইতোমধ্যে জরুরি-স্বল্প-মধ্যম-দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি ও প্রণোদনা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। পরিস্থিতিকে বুঝে এমন বাস্তবভিত্তিক ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি ঘোষণা করায় সরকার অবশ্যই সাধুবাদ ডিজার্ভ করে কিন্তু সেটার মাঠ পর্যায়ের বাস্তবায়ন কত সুষ্ঠুভাবে হবে সেটাও বড় একটি বিবেচনা। যাহোক, এখন সরকার ঘোষিত সামাজিক নিরাপত্তা তথা বিশেষ সহায়তা কর্মসূচিকে সফল করতে সর্বাগ্রে দরকার অধিকারভিত্তিক একটি প্র্যাগমেটিক অ্যাপ্রোচ নেয়া যাতে উপর্যুক্ত জনগোষ্ঠীর অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা যায়।
কনভেনশনালি, আমাদের দেশের ত্রাণ বা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির দর্শন হল-জরুরি পরিস্থিতিতে আর্তমানবতাকে (খাদ্য ও চিকিৎসা দিয়ে) বাঁচিয়ে রাখা। আর সে কারণে, এ ধরণের ত্রাণ বা সেবা প্রদানের কার্যক্রম যখনই গ্রহণ করা হয়েছে তখন সবক্ষেত্রেই দরিদ্র আর কষ্টকর অবস্থায় নিপতিত জনগোষ্ঠীকে 'উপকারভোগী', দুস্থ, বিপন্ন আর সহায়-সম্বলহীন একটি বিয়িং হিসেবে বিবেচিত করা হয়েছে। উদ্ভুত সংকটে বিষয়টি সত্য ধরে নিলেও বলতে হয়, এ ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সবক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, মানুষ কখনও কেবল সেবাভোগী/উপকারভোগী সত্ত্বা নয়। সর্বাবস্থায় মানুষ একজন সৃজনশীল আধার হয়ে উঠতে পারে, পারে তার সামর্থ্যের প্রকাশ ঘটাতে। যা একবিংশ শতাব্দীতে ত্রাণ বা বিশেষ সহায়তা কার্যক্রমের মনস্তত্ত্বে গুণগত পরিবর্তন আনতে পারে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ, বাংলাদেশের সংবিধান, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সনদ, খাদ্য অধিকার সনদ, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির আধিকার, শিশু অধিকার সনদ, জেনেভা সনদ, আদিবাসী অধিকার সনদসহ বৈশ্বিকভাবে রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক অনুস্বাক্ষরিত সনদসমূহে বিশেষ গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে- মহামারীতে/দুর্যোগ পরিস্থিতিতে ঝুঁকিগ্রস্থ মানুষ কী কী অধিকার ভোগ করবে সে বিষয়গুলো। প্রসঙ্গত কয়েকটি এখানে তুলে ধরছি-
এছাড়া, মহামারী সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ আইন-২০১৮তে এ যাবত বাংলাদেশে সংঘটিত ২৫টি সংক্রামক রোগ এবং বিশেষ রোগের প্রাদুর্ভাবকে সরকার কর্তৃক সংক্রামক হিসেবে ঘোষণা এবং প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। সাথে সাথে এটাও বলা হয়েছে যে, যে কোনও সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সরকার সম্ভব সকল ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ গাইডলাইন মেনে চলবে।
৫. করোনাভাইরাস মহামারী সংকট মোকাবেলায় সরকার ঘোষিত উদ্যোগ
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলায় নতুন করে ৬৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে তৈরি পোশাক খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। নতুন চারটিসহ পাঁচটি প্যাকেজে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা, যা জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।
তিনি বলেন এ সহায়তার পদক্ষেপ হিসেবে তাৎক্ষণিক করণীয়, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এখানে রয়েছে। তিনি প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সরকারি ব্যয়বৃদ্ধি ও কর্মসৃজনকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা জানান। শ্রমিক-কর্মচারী বা অন্যান্য কর্মজীবী মানুষ যাতে কর্মহীন না হয়ে পড়েন, সে জন্য প্রধানমন্ত্রী আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ, ঋণসুবিধা দেওয়ার কথা জানান। সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপকতা বাড়ানোর কথা জানান তিনি।
এছাড়া, গত ২৩ মার্চ মন্ত্রীসভার বৈঠকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে নিম্ন আয়ের কোনও ব্যক্তি যদি স্বাভাবিক জীবনযাপনের অক্ষম হয় তাহলে সরকারের ঘরে ফেরা কর্মসূচির আওতায় সহায়তা পাবেন। এ বিষয়ে তিনি জেলা প্রশাসকদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান। প্রয়োজনীয় খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য জেলা প্রশাসক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় করার কথা বলেন তিনি।
গত ২ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলার অংশ হিসেবে ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। যেখানে তিনি বলেছেন,
দিনমজুর, শ্রমিক, কৃষক যেন অভুক্ত না থাকে। তাদের সাহায্য করতে হবে। খেটে খাওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অতিরিক্ত তালিকা তৈরি করতে হবে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, সমাজের সব স্তরের জনগণকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। প্রশাসন সবাইকে নিয়ে কাজ করবে।
সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, যেমন- কৃষি শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশা/ভ্যান চালক, পরিবহন শ্রমিক, ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, পথশিশু, স্বামী পরিত্যাক্তা/বিধবা নারী এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ নজর রাখাসহ ত্রাণ সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
৬. মহামারী বা দুর্যোগকালীন সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা সহায়তা কর্মসূচিতে প্রান্তিক, সুবিধাবঞ্চিত ও জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষের অধিকারভিত্তিক প্রবেশগম্যতার প্রয়োজনীয়তা
শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে, দুর্যোগ দুর্বিপাকে প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের বিপন্নতার আপেক্ষিকতা মাত্রা নিরূপণ এবং তাদের অধিকার সমুন্নত রাখার জন্য বিশেষ পরিবীক্ষণের প্রয়োজনীয়তা কথা। চলমান করোনাভাইরাস মহামারীতে অধিক ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের জন্য ঘোষিত বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে প্রতিটি প্রান্তিক মানুষের অধিকারভিত্তিক প্রবেশগম্যতা নিশ্চিতে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় যে সকল স্কিমে এই সময়ে সহায়তা দেয়া হবে এ বিষয়ে নতুন নীতিমালা গ্রহণ করা দরকার। এছাড়া, সরকারের চলমান ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে সরকারি সেবা অতি দ্রুত উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর যে অঙ্গীকার সেই বিষয়টি এ সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বিবেচনায় নেয়া জরুরি। মনে রাখা দরকার, যারা নিম্ন আয়ের আর প্রান্তিক তাদের কাছে এই সামাজিক সেবাই আপাতত বেঁচে থাকার ভরসা। তাই এ সংক্রান্ত সকল কর্মসূচিতে উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর অধিকারভিত্তিক প্রবেশগম্যতা এখন সময়ের দাবি।