Published : 06 Apr 2020, 09:04 PM
করোনাভাইরাস বিশ্বে এক আতঙ্ক ও সারি সারি মৃত লাশের কারণ। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের মৃতদেহ থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। এটি খুবই ছোঁয়াচে। করোনাভাইরাস নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা বিশ্বে বিরাজমান। যেমন, চীন বলছে করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রের একটি রাজনৈতিক কৌশল ও জৈব অস্ত্র। আর যুক্তরাষ্ট্র মনে করে এটি চীনের তৈরি, কারণ ভাইরাসটির উৎপত্তি চীনের উহানে। অন্যদিকে এটা নিয়ে ইরান গবেষণা করছে এটা জৈব অস্ত্র কিনা। ইতালির এক ডাক্তারের দাবি চীনেরও আগে তার দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি যুক্তিও দেখিয়েছেন। চীনের উহানের আগে ইতালির লুম্বার্ডিতে করোনা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। তখন এই মহামারীর বিষয়ে তিনি ও একদল চিকিৎসক সরকারকে সতর্ক করেছিল। তাদের সর্তকবার্তা হালে পানি পায়নি। তার খেসারত ইতালিকে দিতে হচ্ছে। ইতালির এই চিকিৎসকের কথা নতুন বিতর্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তবে ইতালি প্রথম করোনা সংক্রমণের ঘটনা ভালভাবে মোকাবেলা করেছিল। তুরস্ক দাবি করেছে, ১৪ ফেব্রুয়ারি মিলান থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে কডোনা শহরে এক বাসিন্দা হাসপাতালে ভর্তির পর তখনও প্রয়োজনীয় সতর্কমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে ঐ রোগীর মাধ্যমে হাসপাতালের কর্মীসহ পুরো গ্রামবাসী করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
এছাড়াও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, চীন যদি আগেভাগেই সতর্ক করত বা তথ্য গোপন না করত আজকে বিশ্বে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হত না। এর মানে তিনি চীনকে সরাসরি দায়ী করছেন। ডনাল্ড ট্রাম্পের কথায় ক্রমাগত অভিযোগের সুর। তার দেশকে বিপন্ন করছে বাইরের দেশ থেকে আসা ভাইরাস। কিছুদিন আগে তিনি করোনা নিয়ে হাসাহাসি করতেন। দ্রুত ছড়ানো ভাইরাসকে পাত্তা দেননি, নাম দিয়েছিলেন ফরেন ভাইরাস। তিনি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে বা যারা করোনা ছেড়েছে, আমেরিকা ঠিক সময় এর জবাব দিবে। কারণ তিনি মনে করেন কোন চক্রান্ত ছাড়া তাদের দেশ বিপদে পড়তে পারে, এটা তারা বিশ্বাস করে না। আর এখন তিনটি রাজ্যসহ অনেক প্রতিষ্ঠান লকডাউন করে রাখা হয়েছে।
আবার ভারতীয় এক গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে চীনে করোনা ভাইরাসে এক কোটি লোক মারা গিয়েছে। কিন্তু সরকারি তথ্য অনুসারে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত করোনায় চীনে মৃতের সংখ্যা প্রায় ৩,৩৩৩।
ডব্লিউএইচও শুধু ব্রিফ করছে, জোরালো কোনো কর্মসূচি দেখছি না। এমনকি জাতিসংঘ একটি বড় প্ল্যাটফর্ম, এর কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। করোনা মোকাবেলায় জাতিসংঘের আরও কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে।
এখন করোনার কেন্দ্রস্থল যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, ইরান। করোনার সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রে। আমরা মনে করি ভবিষ্যতে করোনা উল্লেখিত দেশে মারাত্মক দিকে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রে জানুয়ারি মাসে প্রথম ধরা পড়ে করোনাভাইরাস। মার্চে এসে ট্রাম্প বলেন করোনাভাইরাস একটি মৌসুমী রোগ। এটা কি বলতে পারে একটি উন্নত দেশের প্রেসিডেন্ট? ঢাকা ও নিউইয়র্কের মানুষের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই, এদিকে উভয় শহরই ঘনবসতিপূর্ণ। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে নিউইয়র্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে অনেক দেশের লোক আসা যাওয়া করে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০ দিন আগে করোনায় আক্রান্ত ছিল ১০৫৫, ৬ এপ্রিল তা এসে দাঁড়ায় ৩,৩৬,৮৩০ এবং মৃত ৯,৬১৮ জন। নিউইয়র্কে ২২ দিন আগে করোনায় আক্রান্ত ছিল ২৯৮ জন, এখন আক্রান্ত ১,২৩,০১৮, মৃত প্রায় ৪,১৫৯ জন। নিউইয়র্কে দুর্ভাগ্যবশত সুস্থ হওয়ার সংখ্যা কম। ওয়াশিংটনে এখন আক্রান্ত ৭,৯৮৪ জন, মৃত ৩৩৮ জন। কিন্তু অন্যান্য দেশে সুস্থ হওয়ার সংখ্যা অনেক। গত ২৮ মার্চের তারিখে পরিসংখ্যান অনুসারে অন্যান্য দেশে করোনায় আক্রান্ত লোকের বয়স ৬০-৭০ এর মধ্যে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের টেনিসি প্রদেশে ২০-৩০ বয়সের মানুষ করোনায় বেশি আক্রান্ত। সংখ্যা হলো ২৬০। যা অন্য বয়সের তুলনায় বেশি। এর কারণ হলো যুবকদের অবহেলা। যুক্তরাষ্ট্র শুধু তিনটি স্টেট যেমন ওয়াশিংটন, ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্ক লকডাউন করেছে। শুধু এই তিনটি লকডাউন করলেই হবে না, বাকি সব স্টেটও বন্ধ করা উচিত। শুরুতে লোকজন রাস্তায় আড্ডা দিয়েছে, ক্লাবে গিয়েছে, এই তুচ্ছতাচ্ছিল্য আজ আতঙ্কের কারণ। আমরা মনে করি যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ নাগরিকের সচেতনতার ঘাটতি ছিল, বিদেশি নাগরিক স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টিনে রয়েছে। ওয়ালমার্টে প্রবেশের সময় স্যানিটাইজার, এন্টি-ভাইরাল টিস্যু রয়েছে, তারপরও অনেকেরকে তা ব্যবহার না করে ভিতরে প্রবেশ করতে দেখা গেছে।
কানাডা বেশ সতর্ক ছিল, এজন্য আক্রান্তের সংখ্যা কম। যেখানে বেশি সংক্রমণের আশংকা ছিল। কারণ এ ভাইরাস ঠাণ্ডায় বেশি ছড়ায়, বিশেষজ্ঞদের মতে। ইতালি প্রথম দিকে অবহেলা করেছে তার খেসারত দিচ্ছে পুরো দেশ ও দেশের লোক। দিন দিন মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলছে। চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মত ইতালি সাবধান হলে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা কম হতো।
বাংলাদেশ সরকারের করোনা মোকাবেলায় কিছুটা ঘাটতি রয়েছে, কেউ কেউ মনে করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানুয়ারিতে করোনা নিয়ে আগাম ব্যবস্থাপনা ও কৌশলের বিষয়ে সতর্ক করেছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ তখন আঁচ করতে পারেনি যে করোনাভাইরাস এত মারাত্মক রূপ ধারণ করবে। কিন্তু বর্তমানে যে উদ্যোগ নিয়েছে এটা অবশ্য ভাল। এটা আরও পূর্বে নিলে খুবই ভাল হতো। তাই আইইডিসিআরসহ সবাইকে অধিকতর সতর্কতার সাথে অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে নিয়ে সমন্বয় করে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কাজ করতে হবে।
বিশ্ব নেতারা এখনও বিতর্কিত বক্তব্য দিচ্ছেন। যেমন মেক্সিকান গভর্নর মনে করছে, গরিব লোকেরা করোনায় আক্রান্ত হবে না। বর্তমানে ১০০০ বা ১০০০ এর বেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত দেশের সংখ্যা ৬০টি। মোট আক্রান্ত দেশ ২১০ সুতরাং বাকি ১৫০ দেশের নেতারা এখনই যদি হার্ডলাইনে যায়, তাহলে মহামারী থেকে কিছুটা হলে বিশ্ব রক্ষা পাবে। বিশ্বে স্বস্তি ফিরে আসবে। তারা ভার্চুয়াল সভা করে সমন্বিত বা আঞ্চলিক পদক্ষেপ নিতে পারে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সার্কভুক্ত দেশ ভার্চুয়াল সভা করে নেওয়া পদক্ষেপ খুবই ভালো উদ্যোগ ছিল।
কিছু দেশের চীন বিদ্বেষী মনোভাবই আজকের করোনা পরিস্থিতির জন্য দায়ী। কারণ যখন চীন বিপদে পড়ছে, তখন অন্য বড় দেশ বা নেতারা চীনকে সহযোগিতা করেনি। বরং চীনকে নিয়ে সমালোচনা করেছে। চীন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর তেমন কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। বরং অনেক দেশ তখন অর্থনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। করোনাভাইরাস মহামারী রূপ ধারণ করার পিছনে বহুবিধ কারণ থাকতে পারে। আমরা মনে করি বিশ্ব নেতাদের দূরদর্শিতা একটা বিশেষ কারণ।
সকল বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এগিয়ে আসতে হবে। তারাও সব শিক্ষার্থীদেরকে সচেতন করে করোনার ঝুঁকি কমাতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ বাকী আক্রান্ত দেশগুলোকে চীন ও জাপানের ন্যায় ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেহেতু চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সফল হয়েছে। তাই সকল দেশকে ভূ-রাজনীতি, আন্তর্জাতিক হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে সমন্বিত নীতিমাল ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই করোনাভাইরাস থেকে বিশ্ব মুক্তি পাবে। যদিও বর্তমানে আশার আলো হল, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র একসাথে করোনাভাইরাস মোকাবেলা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এটা কিছুটা হলেও স্বস্তির খবর।