Published : 04 Apr 2020, 05:48 PM
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন একটাই আলোচ্য ইস্যু, করোনাভাইরাস। ক'জন নতুন করে আক্রান্ত হলো ক'জন মৃত্যুবরণ করল, মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সত্য বলল নাকি মিথ্যা বলল, কোন দেশের কী অবস্থা, ট্রাম্প কী বলছে, পাশের দেশ ইন্ডিয়ায় কী হচ্ছে, মমতাজ মুখার্জী কেন ও কীভাবে ভাল নেতা হিসেবে প্রমাণ দিচ্ছে, কী খেলে করোনাভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করার শক্তি পাবে শরীর, কোন দোয়া পড়লে কোভিড-১৯ থেকে রেহাই পাবেন, ঘরে বসে কে কী করছেন, কী কী নতুন রান্নার রেসিপি শিখলেন ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ই ঘুরে ঘুরে সারাদিন চোখে পড়ে নিউজফিড জুড়ে।
কিন্তু আজ অন্যরকম একটা সংবাদে চোখ আটকে গেল আমার, কেউ একজন শেয়ার করেছেন বিবিসির একটি সংবাদ- করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনে নির্যাতনকারীর সাথে ঘরে আটকা পড়েছেন অনেকে। ইন্ডিয়া ও আমেরিকা থেকে দুজন নারীর কথা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে সংবাদটিতে।
ইন্ডিয়ায় যে নারী নিয়মিত স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তার ঘরে কয়েকটি সন্তান রয়েছে। আগে যেহেতু সন্তানরা স্কুলে যেত, বাবার হাতে মায়ের নির্যাতনের দৃশ্য তাদের কম দেখতে হত। এখন স্কুল বন্ধ থাকায় বাচ্চারা নিয়মিত বাবার নির্যাতনের দৃশ্য অবলোকন করছে। নিজেরাও ভীত হয়ে পড়ছে। কারণ এতদিন বাবা কেবল মায়ের ওপরেই তার সমস্ত রাগ ঝাড়ত। কিন্তু এখন দীর্ঘসময় বাচ্চাদের সাথে ঘরে থাকার কারণে বাচ্চাদের ছোটখাট ভুলত্রুটিও তার চোখে পড়ছে এবং সে বাচ্চাদেরও ধমকাচ্ছে। সিএনজি চালক স্বামী কাজে বের হলে এই নারী গোপনে এলাকার একটি সংগঠনের মাধ্যমে সেলাই ও লেখাপড়া শিখছিলেন যাতে নিজে উপার্জনক্ষম হলে অত্যাচারী স্বামীকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন বাচ্চাদের নিয়ে। ঘরে নির্যাতনের শিকার নারীদের সংগঠনের পরামর্শদাতারা নানাভাবে সহায়তাও দিত। কিন্তু লকডাউনে এখন ক্লাস বন্ধ, ফলে নির্যাতনের ব্যাপারে কোনো সহায়তাও নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
অপরদিকে, নিউ ইয়র্কের এক কিশোরী লকডাউনে তার বাবার সাথে থাকতে বাধ্য হচ্ছে যে কিনা মেয়েটিকে শারীরিক ও যৌন উভয়ভাবেই দীর্ঘদিন যাবৎ নির্যাতন করে আসছে। মায়ের সহায়তার আশায় সে বাড়ি ছেড়েছিল। মাস কয়েক আগে সে থেরাপিও নিতে শুরু করেছিল। কিন্তু মায়ের স্বল্প আয়ের পথটিও বন্ধ হয়ে গেলে মা তাকে বাবার কাছেই ফিরে যেতে বলে। মেয়েটির ভাষ্যমতে, বাবা তাকে শিশুবস্থা থেকেই এসব নির্যাতন শুরু করে। সে এখনো সেসব নির্যাতনের কথা তার মা বা বোনকে পুরোপুরি বলেনি। থেরাপি তাকে সাহায্য করছিল, ভবিষ্যতের ব্যাপারে সে আশান্বিত হয়ে উঠছিল। কিন্তু যে আশ্রয়কেন্দ্রে সে থেরাপি নিচ্ছিল, করোনাভাইরাসের কারণে তা বন্ধ হয়ে গেছে। আর গত সপ্তাহেই তাকে তার বাবার কাছে ফিরে যেতে হয়েছে। মেয়েটি বলছে, "সে সারাদিন বাসায় থাকে। দিনের বেলা সে টিভি দেখে আর রাতে আমি তার পর্নো দেখার শব্দ শুনতে পাই"।
লকডাউনের কারণে নারী ও শিশুরা কি আরো বেশি করে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে? সংবাদটি পড়ে আমার ভাবনারা তাড়িত হলো। এতদিন বিষয়টি নিয়ে না ভাবলেও এবার গুগল করতে বসলাম, লকডাউনে বিশ্বজুড়ে 'পারিবারিক নির্যাতন'-এর কি অবস্থা একটু দেখা দরকার। এবার আরো কিছু সংবাদ আমার নজরে পড়ল।
বিশ্বাসযোগ্য কিছু সাইটে 'লকডাউনের ফলে পারিবারিক নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার শংকা' প্রকাশ করেছে। খোদ ব্রিটেনে নির্যাতনের ঘটনা রিপোর্ট করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে যে হটলাইনের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে গত সপ্তাহান্তে ৬৫ শতাংশের বেশি টেলিফোন কল এসেছে বলে সরকার জানিয়েছে, বিবিসির রিপোর্ট।
এদিকে সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান বলছে, মানুষের জীবন বাঁচাতে বিশ্বব্যাপী গৃহীত পদক্ষেপ লকডাউনের কারণে আমাদের সমাজের একটি দুর্বল গ্রুপ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। আর এই দলে রয়েছে নারী ও শিশুরা। বিশ্বব্যাপী চলা হোম কোয়ারেন্টিনে নির্যাতনকারীদের হাতে আরও নির্যাতিত হবে নারী ও শিশুরা। আর এর আলামত ইতোমধ্যে মিলতে শুরু করেছে।
চীনের হুবেই প্রদেশে পারিবারিক নির্যাতনের হার বেড়েছে তিনগুণ; ব্রাজিলের বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছে এই হার বাড়বে ৩০-৪০ শতাংশ; স্পেনের কাতালনে নির্যাতনের হার বেড়েছে ২০ শতাংশ; সাইপ্রাসে বেড়েছে ৩০ শতাংশ; ইতালি, জার্মানি ও ভারত প্রভৃতি দেশেও আশংকাজনক হারে বাড়ছে পারিবারিক নির্যাতন।
ইতালিতে ভায়োলেন্স নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে নারীদের নিয়ে কাজ করা ডিআইআরইয়ের সভাপতি লেলা প্যালাডিনো বলেন, 'একটি বার্তা এমন ছিল যে, এক নারী নিজেকে বাথরুমে আটকে রেখে সাহায্য চাইছিল। এই অভূতপূর্ব জরুরি অবস্থায় নারীরা বাইরে যেতে না পারায় আরও হতাশা বৃদ্ধি পেয়েছে।'
উন্নত দেশগুলোতেই যদি এই হয় অবস্থা তাহলে দরিদ্র দেশগুলোর কী অবস্থা- এধরণে কোনো তথ্য-উপাত্ত অবশ্য আমি খুঁজে পেলাম না, তবে তা অনুমেয়। জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেনের নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, "আমেরিকা ও ব্রিটেনের মতো পৃথিবীর উন্নয়নশীল বেশির ভাগ দেশে হটলাইনে সাহায্য চাইবার মত ব্যবস্থা নেই।"
"এসব দেশে যেখানে নিম্ন আয়ের পরিবারে এক বা দু কামরার মধ্যে মানুষকে দিন কাটাতে হয় সেখানে নির্যাতনকারীর অত্যাচারের প্রতিকার চাওয়া এই কঠিন সময়ে নির্যাতিতদের জন্য একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ।"
এবার ভাবুন তো বাংলাদেশের অবস্থা। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে যেখানে ১৫০০'র বেশি মানুষ বাস করে, ছোট ছোট খুপড়ি ঘরে ৪-৮ জন দিনাতিপাত করে, সেরকম একটি দেশে লকডাউনে যখন পরিবারের সবাইকে নিয়ে বন্দী থাকতে হচ্ছে তখন সেখানে পারিবারিক নির্যাতনের মাত্রা কি বাড়বে না? নির্যাতন হলে তো নারী বা তার সন্তানরা কোথাও গিয়ে লুকোবে সে সুযোগও এখন আর নেই।
চলমান লকডাউন অবস্থায় পারিবারিক নির্যাতনে সহায়তা দিতে সরকার কি কোনো জরুরি হটলাইন নাম্বার চালু করেছে? আমার জানা মতে বাংলাদেশের জরুরি হেল্পলাইন নাম্বার ৯৯৯-এ কল করে সহায়তা চাইলে হয়তো সহায়তা পাওয়া সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশের নির্যাতিত নারীরা কি জানেন কিভাবে কল করতে হয়? বা আদৌ সহায়তা পাবেন কিনা সে নিশ্চয়তাও তো নেই।
আমি বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, লকডাউনের এই সময়ে পারিবারিক নির্যাতনে নারী ও শিশুদের জন্য সহায়তার ব্যবস্থা করুন। তাদের আশ্বাস দিন যে ঘরে নির্যাতনকারীর সাথে বন্দী থাকলেও তারা একেবারে অসহায় হয়ে পড়েনি। সরকার ও সাহায্যকারী সংস্থাগুলো এ বিষয়ে অবগত আছে এবং তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তৎপর।