অন্যদিকে আওয়ামী লীগের এটা মনে রাখা উচিৎ অচলায়তন শেষতক এমন এক বাস্তবতার জন্ম দেয়, যার ফল বিষময়। যে আওয়ামী লীগ আমরা রাজপথে দেখেছি সে দল এখন নেই।
Published : 15 Oct 2022, 10:16 PM
বাংলাদেশের মানুষ যে সাম্প্রদায়িকতা পছন্দ করে না সেটি আবারও প্রমাণিত হলো। এবারের শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপিত হয়েছে নিরাপদ ও শান্তিতে। আপনারা যারা এজন্য সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীকে ‘ধন্য’ ‘ধন্য’ করবেন আমি তাদের দলে নই। আমি ধন্যবাদ ও ভালোবাসা জানাবো আমাদের দেশের মানুষ বিশেষত নারী সমাজকে। দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীতে বিভিন্ন মণ্ডপে বাংলার নারী সমাজের যে ছবি, যে মূর্তি আমি দেখেছি- তাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এটাই বলে দিচ্ছে এদেশে মৌলবাদের জায়গা নাই। নিরাপত্তা বাহিনী ও রাজনীতিকে ধন্যবাদ কারণ এবার কেউই বাধ সাধেনি। গেলবারের যে অনভিপ্রেত ঘটনা, তা সম্ভব হয়েছিল রাজনীতি ও কর্তাদের কল্যাণে। এবার অন্তত সেটুকু হয়নি।
বাংলাদেশের মানুষের যে শুভবোধ আর সদিচ্ছা তাতে কালো কালি বা কালিমা ঢালে রাজনীতি। আর সে কারণেই রাজনীতি যদি সঠিক পথে না চলে সঠিক পথ খুঁজে না পায় তাহলে সমস্যাও যাবে না। দেশের উন্নয়ন আর্থসামাজিক পরিবেশ এবং সরকারের দাবি মোতাবেক আমরা এগিয়ে চলেছি। এই চলার রাস্তাটা অমসৃণ। বিশেষত করোনার পর দুনিয়ার সব দেশের অর্থনীতি কমবেশি চাপে আছে। আমাদের সিডনিতেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে সাবধানতার পাশাপাশি সাহায্য অব্যাহত আছে। যা বাংলাদেশে পরিমিত বা নেই। ফলে মূল বিষয় এখন সংকট মোকাবেলা। তারপরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনীতি, যা অপ্রত্যাশিত ছিল না ।
আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি- এ দ্বন্দ্ব দেখছি তরুণ বয়স থেকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এক দশক না পেরোতেই দাঁড়িয়ে গেল জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি। আমরা যারা ঘটনা দেখে বড় হয়েছি তাদের জানা রয়েছে, জেনারেল জিয়ার জীবদ্দশায় বিএনপি দল হিসেবে এমন শক্তিশালী কিছু ছিল না। মনেও হয় নি। মূলত তার হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপির রমরমা ভাব শুরু হতে থাকে। যার মূল কারণ, নেতা বা শাসক হিসেবে দাঁড়িপাল্লায় ওঠার আগেই জিয়ার মৃত্যু। আরেকটি বড় কারণ বিএনপি মূলত আওয়ামী লীগ বিরোধীদের একটি প্ল্যাটফর্ম।
আমি আগেও লিখেছিলাম, অসহায় একা খালেদা জিয়াকে দেখলেই বিএনপির একসময়ের জাঁদরেল নেতাদের মুখচ্ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, যারা নিজেদের মতো করেই নিজ নিজ স্টেশনে নেমে গেছেন। শেষ স্টেশনে খালেদা জিয়া একা। এমন কি তার বেঁচে থাকা পুত্র তারেক রহমানও পাশে নেই। কিন্তু এটা মানতে হবে বিএনপি মরেনি। বরং ভেতরে ভেতরে তারাই শক্তিশালী। তারা যে কতটা শক্তিশালী তা বোঝার জন্য আপনার কোনও বিজ্ঞান বা অংক জানার দরকার নাই। তৃতীয় মেয়াদে টানা দেশ শাসনে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাদের কথা আর কাজেই বুঝবেন তাদের মূল টার্গেট বা প্রতিপক্ষ আসলে কারা?
এটি কোনও বানোয়াট বা বাজে প্রতিপক্ষ নয়। সে কারণেই আওয়ামী লীগ নেতারা নামমাত্র বিরোধী দল জাতীয় পার্টি বা কমিউনিস্ট পার্টিসহ কোন বাম দলকেও পাত্তা দেন না। তাদের সব ভাষণেই বিএনপির কথা ঘুরে ফিরে আসে। তাতেই প্রমাণিত বিরোধী দল আসলে এখনো বিএনপি ।
বাংলাদেশে মুসলিম লীগ না থাকলেও, তার ভাবধারা বহাল তবিয়তে রয়েই গিয়েছে। কাজেই এ ভাবাদর্শের লোকজনও বিএনপিতে দিব্যি ঠাঁই করে নিয়েছে। উপমহাদেশ ভাগ হবার কালে মুসলিম ও হিন্দু- এই দুই জাতিসত্তার লড়াই ছিল কংগ্রেস আর মুসলিম লীগকে ঘিরে আবর্তিত। ভারতে এখনও নিভু নিভু কংগ্রেসের সলতে কখন ঝলসে ওঠে বলা মুশকিল। অন্যদিকে নানা ভাঙচুরে পাকিস্তানে জিন্নাহ-র মুসলিম লীগ বিলুপ্তপ্রায়, কিন্তু আছে। আমাদের দেশের রাজনীতি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর মুসলিম লীগকে অদৃশ্য করে রাখলেও তাদের ভাবধারা, আদর্শ ও সমর্থকরা সবাই মরে যায়নি। তারা আছে, প্রবলভাবেই আছে। তাদের সমর্থনের জায়গাটা বিএনপি হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এর সাথে যোগ হয়েছে বামপন্থা থেকে সরে আসা সুপরিচিত নেতৃত্বের একটি বড় অংশ। এদের সবাইকে দেখলেই আপনি বুঝবেন কথাটা কতটা সত্য।
শুরুতে বলছিলাম দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা যাই হোক না কেন রাজনীতি গরম হতে শুরু করেছে। একতরফা দেশ শাসন আর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনে জিতে আসার সংস্কৃতি কোন রাজনৈতিক দলকেই শক্তিশালী করে না। দলগতভাবে তাদের সাংগঠনিক যোগ্যতা বরং কমে যেতে পারে। সেটি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বোঝা না গেলেও পরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুনিয়ার বহু দেশ ও জাতিতে সেটা দেখার পরও আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। ভুলে থাকতে ভালোবাসি।
আওয়ামী লীগ রাজপথের দল। তাদের শক্তির উৎস জনগণ। সেই জনগণ থেকে দূরে সরে এসে হাইব্রিড নেতানির্ভর আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত কি নেতারা ভাবেন? একমাত্র বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ব্যতীত বাকি নেতাদের বেলায় জনগণের মনোভাব জানাটা তাদের জন্যই জরুরী। সে যাই হোক উত্তপ্ত রাজনীতির মূল কারণ আসন্ন নির্বাচন।
এবারের নির্বাচন যেন ভালোভাবে হয় অর্থাৎ মানুষ যেন ভোট ঠিক মতো দিতে পারে, গণনা যেন ঠিক মতো হয় এবং ফলাফল যেন সঠিকভাবে বেরিয়ে আসে- এগুলো নিশ্চিত করাই সবার উদ্দেশ্য। বলাবাহুল্য, প্রতিবারের মতো এবারও নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি দূতদের কথাবার্তা এবং এ বিষয়ে মাথা ঘামানো শুরু হয়ে গেছে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর দৌড়ে অনেকদূর অগ্রসর হওয়া বাংলাদেশের জন্য এটি অনভিপ্রেত ও অপমানজনক। কিন্তু এর কারণগুলো অজানা নয় কারো। আওয়ামী লীগের আমলে যদি ভোটের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যেত, তাদের সাধ্য ছিল না মাথা ঘামায় বা নাক গলায়। সে পথটা সরকার ও বিরোধীদল উভয়ে মিলেই সুগম করে রেখেছে।
যারাই বিরোধী দলে থাকে তারা এসব দূতদের আনুকূল্যের জন্য পাগল হয়ে ওঠে। আর সরকারে থাকা মানুষজন এর নিন্দায় ফেটে পড়েন। এই সংস্কৃতি রোধ করতে হলে নির্বাচন সঠিক করার বিকল্প নাই। রাজনীতির পালে হাওয়া লাগার সাথে সাথে যে নৈরাজ্য বা অসঙ্গতির ঈঙ্গিত দেখছি, তা অশুভ। ভাঙাচোরা জাতীয় পার্টিতে বিরোধ তুঙ্গে। ইউটিউব ও টিভিতে রওশন এরশাদকে দেখে মায়া লাগলো। তার চেহারায় পড়েছে বয়সের ছাপ। খবরে দেখলাম তার গাড়ি থেকে পতাকা নামিয়ে নিয়েছে জাতীয় পার্টির একাংশের নেতা কর্মীরা। ঢাল-তলোয়ারহীন জাতীয় পার্টিই যদি এমন করে, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে গণতন্ত্র? আর বিএনপি? তাদের কাজ হচ্ছে সুযোগ হাতছাড়া করা আর তপ্ত বাক্য বিনিময়ে খাল কেটে কুমির নিয়ে আসা। আমানুল্লাহ আমানরা বিএনপির দু:সময়ে কোথায় ছিলেন কে জানে! এখন বলছেন: “প্রস্তুতি নিন, কর্মসূচি আসছে; কাঁচপুর ব্রিজ, টঙ্গি ব্রিজ, মাওয়া রোড, আরিচা রোড, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া সারা বাংলাদেশ বন্ধ করে দেবেন। এই বাংলাদেশ চলবে না। আগামী ১০ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়। এর বাইরে কারও কথায় দেশ চলবে না।”
এ জাতীয় কথাবার্তা বলার আগে নিজেদের চেহারাটা আয়নায় দেখে নেয়া উচিৎ ছিল না? এই আমানরা খালেদা জিয়ার কারাবন্দিত্ব ও মুক্তির ব্যাপারে কিছুই করতে পারেননি। খালেদা জিয়ার দু:সময়ে এসব নেতাদের হুংকার তাই মানুষ কানে তুলবে বলে মনে হয় না। মাঝখান থকে বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ সুযোগও হয়তো হাতছাড়া হয়ে যাবে। নেতৃত্ব বদল, স্বাধীনতার ঘোষণা, জন্মদিনে কেক কাটা, মৌলবাদের সঙ্গ বর্জনসহ বহু জরুরী বিষয়ে মনোযোগ দেবার কথা না ভেবে- এসব বলার ভেতর হয়তো জোশ থাকে, কিন্তু দুরাবস্থা থেকে বেরোবার পথ থাকে না ।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের এটা মনে রাখা উচিৎ অচলায়তন শেষতক এমন এক বাস্তবতার জন্ম দেয়, যার ফল বিষময়। যে আওয়ামী লীগ আমরা রাজপথে দেখেছি সে দল এখন নেই। স্তাবক আর পদ-পদবী-পদক লোভীদের ভিড়ে চিড়েচ্যাপ্টা অবস্থা দলের। আদর্শ লুণ্ঠন আর বাণিজ্যের যাঁতাকলে বন্দি মানুষের মুক্তির জন্য শুদ্ধ গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকল্প নাই।
এরপরও কি কেউ তা মানবেন না!
সিডনি