শিক্ষা ক্ষেত্রে ফরম পূরণে অভিভাবকের জায়গায় বাবা-মা অথবা আইনগত অভিভাবকে রাখার নির্দেশ দিয়ে এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। এর ফলে অভিভাবক হিসেবে যে কোনো একটা পরিচয় দিয়ে ফরম পূরণের সুযোগ তৈরি হলো। যেখানে আগে অভিভাবকের ক্ষেত্রে বাবা ও মা উভয়ের নাম দেয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল।
মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আগে শিক্ষার্থী তথ্য ফরমে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে বাবার নাম পূরণ করতে না পারায় ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের এক তরুণীকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রবেশপত্র দিতে অস্বীকৃতি জানায় রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড। পরবর্তীতে এ ঘটনার যথাযথ অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এবং সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মায়ের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার দাবিতে ২০০৯ সালের ২ অগাস্ট মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং নারীপক্ষ যৌথভাবে জনস্বার্থে হাই কোর্টে রিট করে। সেই রিটের প্রাথমিক শুনানি হয় ২০০৯ সালে ৩ অগাস্ট বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর বেঞ্চে। সে সময় আদালত রুল জারি করে। একপর্যায়ে রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে এই ঐতিহাসিক রায় দিলেন দেশের উচ্চ আদালত।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মায়ের নামে ফরম পূরণ করে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ চেয়ে এক দশক আগে করা এক রিট মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত মঙ্গলবার বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন। আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আইনুননাহার সিদ্দিকা। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী এস এম রেজাউল করিম এবং আয়েশা আক্তার। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশ গুপ্ত।
এই রায় ঐতিহাসিক। আমাদের সমাজে মায়ের ভূমিকা নিয়ে কত গান, কত কবিতা-গল্প। যৌবনে বাংলাদেশ কাঁপানো একটি গান ছিল মা গো মা, ওগো মা, আমারে করলি রে তুই দিওয়ানা। মাকে নিয়ে গানটির কথা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু এর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি। এমন হাজারও গান-কবিতায় মা বন্দনার জোয়ার আছে। কথায় কথায় আমরা বলি মায়ের পায়ের তলায় সন্তানের বেহশত। বেহশত বললেও মা আসলে নিগৃহীত এক নারী। বাপের সেবা, সন্তানদের দেখভাল করতে করতে ক্লান্ত মায়ের শেষ জীবন নিয়ে কি আসলেই কেউ ভাবে? ভাবলে আমাদের দেশের মায়েদের কি এত দুর্দশা থাকত?
একদা মায়ের আসন সত্যি ছিল অটুট। তারাই ছিলেন সংসার ও সমাজের কর্ণধার। মনে থাকতে পারে মা আমাদের জননী ছিলেন। এই জননী বিষয়টি সমাজে যত আবেগের ততটাই কষ্টের। মাকে মনে পড়ে, মনে পড়ে বলে গান গাওয়া বাঙালি পরিবার ও সমাজে তাকে কোথায় রেখেছি আমরা? সবাই জানেন জন্মদাত্রী হন মা। পিতার ঔরসজাত হলেও সন্তান ধারণ করেন মা। জন্ম দেন তিনি। ধারণ করেন তিনি। তার চেয়ে বড় পরিচয়সূত্র আর কে আছেন? উপমহাদেশের বীর সন্তান স্বামী বিবেকানন্দ। এই তেজী মানুষটি বলেছিলেন, যতক্ষণ না মা বলছে সন্তান কার ততক্ষণ কেউ জানে না আসলেই সন্তান কার? এই পরিচয়সূত্র চিরন্তন।
এখন আবার দিনকাল পাল্টেছে। বিয়ে বিষয়টি নিয়ে এখন নতুন করে ভাবছে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই। ছেলেমেয়েদের একটা বড় অংশই বলতে গেলে বিবাহবিরোধী। শহরে বসবাসকারী অনেকেই এখন বিয়ে ছাড়াই লিভ ইন সম্পর্কে অভ্যস্থ হচ্ছেন।
তবে বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কের একটি সমস্যা সন্তানের জন্মদান এবং অভিভাবকত্ব। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় বা চাহিদায় সন্তান ধারণ চলছে, চলবে। ওইসব মায়েরা সিঙ্গেল মাদার। তাছাড়া যারা নানা কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের শিকার হন তারাও তো সিঙ্গেল মাদার। এ ছাড়াও আমাদের দেশের উন্নয়ন যেমন সত্য, তেমনি সত্য তার পাশে অন্ধকার। প্রান্তিক শ্রেণির লোকজনের ঘর-সংসার সবসময় তোপের মুখে থাকে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সেখানে কাচের বাসনের মতো। এই আছে, তো এই ভেঙ্গে টুকরা। এর মাঝেই জন্ম নিয়ে ফেলে বেশ কিছু সন্তান। যখন ঘর ভেঙ্গে যায় তখন এই সন্তানেরা অনিবার্যভাবেই মায়ের দায়িত্বে থাকে। বাপ তখন অন্য বৌয়ের সাথে ব্যস্ত। এই ছেলে-মেয়েগুলোর অনেকেই পিতার নামও জানে না। এরা যাবে কোথায় ?
এসব কথা কেউ কখনো ভেবেছেন বলে শোনা যায়নি। এবার অন্তত হাই কোর্ট একটি যুগান্তকারী সিদ্বান্ত দিতে ভুল করেনি। দুনিয়ার বহুদেশে এর অস্তিত্ব আছে। উন্নত দেশগুলোতে মায়ের পরিচয়ই মূখ্য। সবাই জানেন সন্তান নাবালক থাকাকালীন সময়ে মায়ের অধীনে থাকে। ওইসব সন্তানেরা পিতার সাথে কালেভদ্রে মিলিত হয় মাত্র। তবু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তার আধিপত্যের কারণে এতদিন পিতার নামে ছড়ি ঘুরিয়ে আসছিল। আমাদের দেশে তো আরও বিপদ। পিতা তথা পুরুষ যা বলে তাই আইন। এত বছরের এই অচলায়তনে ঘা দিয়েছে হাইকোর্ট। মায়ের থেকে আপন কেউ নাইরে দুনিয়ায় এমন গানে বিভোর সমাজ এবার অন্তত মাকে পরিচয়সূত্র হিসেবে মানতে বাধ্য হবে।
পরিবারের উপার্জন পদ্ধতিও পাল্টে গেছে। এখন পরিবারে মা-বাবা দু-জনই রোজগার করেন। শুধু কি তাই? যেসব মায়েরা চাকরি করেন না তাদের আয়ের উৎস হয়তো টাকা নয় কিন্তু তাদের যে শ্রম আর মেধায় সংসার চলে তার কি কোনো হিসাব রাখি আমরা? আমার এক অতিচতুর বন্ধু অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব পাবার পরীক্ষায় স্ত্রীকে কিছু করে না সংসার দেখে এ কথা বলেছিলেন। ব্যস। সেবার তার নাগরিকত্ব জোটেনি। ডাহা ফেইল। বন্ধুটি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল বোর্ডকে। কেন সে ফেইল করেছে? উত্তরে তারা জানিয়েছিল ঘরের নারীর সম্মান আর শ্রমের মূল্যায়ন যিনি জানে না তাকে তারা নাগরিকত্ব দিতে ভাববে আরও একবার। বলাবাহুল্য বন্ধুটি পরেরবার আর এই ভুল করেনি। আমাদের সমাজে এতদিন মায়েদের কিছু করে না এই কথা বলাটা এবার কি বন্ধ হবে? যে মা সকালের চা থেকে রাতের খাবার পর্যন্ত যোগান দেন, যিনি না থাকলে ভোরও অন্ধকার ওই মা পরিচয়সূত্র হবেন না তো কে হবেন?
হাই কোর্টের এই রায় আমাদের চোখ খুলে দিল। এখন সময় তার বাস্তবায়ন। তাকে সামনে নিয়ে যাওয়া। মা-ই আমাদের শক্তি। আর একটা কথা, কোন খারাপ মা হয় না দুনিয়ায়, মা মানেই ভালো, মা মানেই স্নেহের ধারা। মা-ই আমাদের জনম ও জন্মের পরিচয়।