নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠার দিনটিকে সরকার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলেও এ লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বরং অপরিকল্পিত ও ব্যয়বহুল উন্নয়ন সত্ত্বেও বাংলাদেশের সড়কগুলো মৃত্যুফাঁদ হয়ে উঠেছে।
Published : 22 Oct 2024, 01:01 AM
প্রতিবারের মতো এবারও ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে— ‘ছাত্র জনতার অঙ্গীকার, নিরাপদ সড়ক হোক সবার’। এ প্রতিপাদ্যে ২০১৮ সালে সংগঠিত ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের উদ্দেশ্যকে উপজীব্য করা হয়েছে। ২০০৯ হতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়কালে দেশে সবচাইতে বড় অরাজনৈতিক আন্দোলন হিসাবে ব্যাপকতা লাভ করে ওই আন্দোলনটি। ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে কোটা সংস্কারের দাবি থেকে শুরু করে বিগত সরকারের পদত্যাগের দাবিতে যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ও অংশগ্রহণ করেছে— তাদের বড় একটি অংশ ২০১৮ সালের জুলাই-অগাস্টে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের হেলমেট বাহিনী এবং পুলিশ ও প্রশাসনের হামলা-মামলার শিকার হয়েছিল।
অতীত অভিজ্ঞতার কারণে ২০২৪-এ সরকারের দমন-পীড়নে পিছু না হটে কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকারের পদত্যাগের এক দফার দাবিতে উপনীত হয়। রক্তক্ষয়ী ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও অভুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পলায়নের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে এবারের প্রতিপাদ্য তাৎপর্যময় ও প্রাসঙ্গিক। এই প্রতিপাদ্যে ২০২৪-এর পহেলা জুলাই হতে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে ছাত্র-জনতার চূড়ান্ত বিজয়কেও ধারণ করা হয়েছে। বিশেষ করে, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম ১০ দিন সড়কে যান ব্যবস্থাপনায় ছাত্র-জনতার ভূমিকাও গুরুত্ব পেয়েছে।
সড়কে বিভিন্ন সময়ে যারা স্বজন হারিয়েছেন কিংবা যারা পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছেন তাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমন্বিত কন্ঠে বাংলাদেশের সড়কসমূহকে সর্বসাধারণের জন্য নিরাপদ করার দাবি জানানোর একটি বিশেষ দিন জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। একইসঙ্গে, সড়কে অকালমৃত্যু বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, সড়কসমূহ নিরাপদ করতে প্রয়োজনীয় আইন-নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নকে এগিয়ে নিতে সরকারের জন্যও এটি একটি বিশেষ দিন।
এটি একটি মর্মান্তিক দিনও। ১৯৯৩ সালের এ দিনে চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান যাবার পথে পটিয়ার সড়কে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের সহধর্মিনী জাহানারা কাঞ্চন এক মারাত্মক রোড ক্র্যাশে মৃত্যুবরণ করেন। ইতোপূর্বে ‘রোড একসিডেন্ট’ বাংলায় ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ হিসাবে ব্যবহৃত হলেও বিশ্বে এখন ‘রোড একসিডেন্ট’ এর পরিবর্তে ‘রোড ক্র্যাশ’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। স্ত্রীর মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়া ইলিয়াস কাঞ্চন নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলেন। চলচ্চিত্রে ওই সময়ের জনপ্রিয়তাকে মাড়িয়ে তিনি বাংলাদেশের সড়কে মানুষের মৃত্যুর নিরব মিছিল থামাতে প্রতিজ্ঞা করেন। এ লক্ষ্যে স্ত্রী হারানোর শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই, ১ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে সড়ক নিরাপত্তায় কাজ করার উদ্যোগ নেন এবং ১ ডিসেম্বর ১৯৯৩ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) প্রতিষ্ঠা করেন।
চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে খুব অল্প সময়েই নিসচা সারাদেশে বিস্তৃতি লাভ করে এবং ১৯৯৪ সাল থেকে, প্রতিবছর ২২ অক্টোবর দিনটিকে ‘নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসাবে পালন শুরু হয়। তখন থেকেই এ দিবস উদযাপনে সরকার, বিশেষত, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকলেও গত ৭ বছর যাবত এ দিনটি উদযাপনে সরকার প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়।
নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠার দিনটিকে সরকার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলেও এ লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বরং অপরিকল্পিত ও ব্যয়বহুল উন্নয়ন সত্ত্বেও বাংলাদেশের সড়কগুলো মৃত্যুফাঁদ হয়ে উঠেছে। যেসব কারণে সড়ক নিরাপদ করা যায়নি তন্মধ্যে অতিরিক্ত বা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, যানবাহনগুলোর প্রতিযোগিতা, নির্ধারিত স্থান ব্যতীত সড়কের মাঝখানে যাত্রী ওঠানো-নামানো, অধিকাংশ সড়কে বাস-বে না থাকা, সড়ক নির্মাণের সময় নিরাপত্তার বিষয় উপেক্ষা করা, চালক ও যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতির দুর্বলতা, লাইসেন্সবিহীন বা ভুয়া লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন ও অনিরাপদ গাড়ির চলাচল, একই সড়কে বিভিন্ন গতির যান চলাচল, লেন মেনে গাড়ি না চালানো, সড়কে পথচারী ও বাইসাইকেল চালকদের নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষা, হেলমেট ব্যতীত ও অতিরিক্ত গতিতে মোটর সাইকেল চালানো অন্যতম।
২০১৮ সালের জুলাই-অগাস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের ফলে সরকার দ্রততার সঙ্গে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ পাস করলেও এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। ২০১৮ সালে আইনটি পাস করার পর শুধু চালক-মালিকদের বাধার কারণে বিধিমালা জারি করতে ৪ বছর সময় লাগে। তদুপরি, বিগত সরকার চালক-মালিকদের সঙ্গে আপোস করার কারণে কয়েকটি ধারা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। ফলে দেশের সড়কসমূহ নিরাপদ করা যায়নি।
২০১৮ সালে সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনের ফলে আইনটি করা হলেও এতে নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠার অধিকাংশ বিষয় অনুপস্থিত। মূলত যানবাহন ও চালক সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বিধান এতে বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর [বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), বাংলাদেশ পুলিশ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যথা সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন] মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে এবং গাড়ির মালিক ও চালকদের অসহযোগিতার কারণে এ আইনটির সড়ক নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
এতে প্রতীয়মান হয়েছে, সড়ক নিরাপদ করার জন্য দেশে পূর্ণাঙ্গ একটি আইন প্রয়োজন। ইতোমধ্যে, সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কর্মরত সংস্থাসমূহ এ দাবি জানিয়েছে। সড়ক নিরাপদ করার জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন না থাকায় সড়কসমূহ নিরাপদ করা সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে দেখা যায়, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশের সড়কে মানুষের মৃত্যু অনেক বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে রোড ক্র্যাশের কারণে বছরে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মারা যায়। একই সংস্থার ২০২৩ সালের প্রকাশিত বৈশ্বিক প্রতিবেদনে জানা যায়, সড়কে মৃত্যুসংখ্যা বছরে ৩১ হাজারের বেশি। যারা সড়কে মারা যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশ সুস্থ্য-সবল ও কর্মক্ষম মানুষ। বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষম মানুষের অকালমৃত্যু ও পঙ্গুত্ব দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অনেক পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তি রোড ক্র্যাশে মৃত্যুবরণ করায় মারাত্মক আর্থিক সঙ্কটে দিনাতিপাত করছে তারা। আবার রোড ক্র্যাশে কর্মক্ষম ব্যক্তির পঙ্গুত্বের চিকিৎসাও অনেক পরিবারের জন্য অসহনীয়। তাই, সড়কে অনাকাঙ্খিত অকালমৃত্যু কমাতে দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন।
অন্তবর্তী সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে এবং এ লক্ষ্যে গঠিত বিভিন্ন কমিশন কাজ শুরু করেছে। সড়কসমূহের নির্মাণ ব্যয় কমিয়ে আনা, গণপরিবহন ব্যবস্থা অগ্রাধিকার দিয়ে নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও স্বাচ্ছন্দ্যময় যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য এ খাতেও ব্যাপক সংস্কার করা প্রয়োজন।
সড়ক নির্মাণ প্রক্রিয়া থেকে এ সংস্কার শুরু করতে হবে। সড়ক টেকসই করতে প্রকৌশলীদের ভূমিকাই প্রধান। কিন্তু, কীভাবে সড়ক নিরাপদ হবে, সড়কের সঙ্গে শহর ও গ্রামের সমন্বয়, কোথায় কোন ধরনের সড়ক প্রয়োজন, সড়কের কোথায় মানুষের পারাপারের সুযোগ থাকবে, কোথায় যানবাহনের গতি কত থাকবে ও কোথায় গতিরোধক হবে, কোথায় মিশ্র যান চলবে, কোন সড়কে অযান্ত্রিক যান চলবে কোন সড়কে চলবে না— এসব ক্ষেত্রে স্থাপত্যবিদ্যা এবং নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনার সমন্বয় করতে হবে। পাশাপাশি, সড়ক নির্মাণ ও যাতায়াত পরিকল্পনায় সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কর্মরত একাডেমিক প্রতিষ্ঠান [একসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট-বুয়েট] ও নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর মতো সামাজিক সংগঠনসমূহের যুক্ত থাকা প্রয়োজন।
এছাড়া প্রধান সড়কসমূহে [জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক, শহরের অভ্যন্তরে মহাসড়ক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এবং সংযোগ সড়ক] ফুটপাথ বা হাঁটার পথ থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে, শহরের অধিকাংশ যাতায়াত ৫ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে, তাই শহরে পথচারীদের নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন যাতায়াতে প্রশস্ত, সমান্তরাল ও স্বাচ্ছন্দময় ফুটপাথ খুবই জরুরি। এতে মানুষ হাঁটতে উৎসাহী হবে, যা শহরে বায়ু ও শব্দদূষণ এবং যানজট নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে।
সড়ক পরিকল্পনায় বাইসাইকেল একেবারেই উপেক্ষিত থাকছে। অথচ নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, সুইডেনসহ ইউরোপের দেশগুলোতে অধিকাংশ সড়কে সাইকেলের জন্য আলাদা লেন রয়েছে। ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে যদি সাইকেল লেন করা হয় তাহলে দেশের তরুণ প্রজন্মের বড় অংশ বাইসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহী হবে। এতে মানুষের স্বাস্থ্যও ভাল থাকবে। তাই যানজট ও দূষণমুক্ত যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ দিতে হবে।
সর্বোপরি, সড়ক নিরাপত্তা দেখার জন্য স্বতন্ত্র কোনো প্রতিষ্ঠান নাই। বিআরটিএ যান্ত্রিক যান ও যান্ত্রিক যানের চালকদের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সংস্থা। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে সড়ক নিরাপত্তার কয়েকটি কাজে ভূমিকা রাখছে। এছাড়া বিদ্যমান আইন বাস্তবায়নে পুলিশের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। শহরের মধ্যে সিটি করপোরেশন, মেট্রোপলিটন পুলিশ, ঢাকা রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (ডিটিসিএ), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (রাজউক) বিভিন্ন সংস্থার সম্পৃক্ততা রয়েছে। এসব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করাসহ সড়ক নিরাপত্তার সার্বিক বিষয় তদারকির জন্য একটি স্বতন্ত্র সংস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। তবেই সড়কসমূহ নিরাপদ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফলতা অর্জন করতে পারবে। জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসে এটি হোক আমাদের সকলের প্রত্যয়।