বৃহৎ বৃহৎ করপোরেশনগুলো তার পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য স্বাভাবিকভাবেই একজন ‘জনপ্রিয়’ ‘সাধারণ’ ‘খেলোয়াড়’ ইমেজটিকেই চাইবেন। কোনো প্রতিবাদী, কিংবা বিতর্কিত ইমেজ পণ্যের প্রসারের ক্ষেত্রে অন্তরায়। আর ব্যালন দ’র পুরস্কারের মাধ্যমে ‘ফ্রান্স ফুটবল’ ওই ইমেজটাকেই নির্বাচন করে।
Published : 26 Nov 2024, 04:33 PM
প্যারিসের থিয়েটার দু শাতলেতে গত ২৮ অক্টোবর ব্যালন দ’রের ৬৮তম আসরে বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কারটা দেওয়া হয় স্প্যানিশ মিডফিল্ডার ও ম্যানচেস্টার সিটির রদ্রিগো হার্নান্দেজকে। এই ঘোষণার কিছু আগে সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল পুরস্কারের অন্যতম দাবিদার ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার রিয়েল মাদ্রিদের খেলোয়াড় ভিনিসিউস জুনিয়র প্যারিসে আসেননি! আর তার ক্লাব রিয়েল মাদ্রিদ অনুষ্ঠানটা বয়কট করেছে।
পুরস্কার হাতে পাওয়ার পর রদ্রি তার প্রতিক্রিয়ায় জানান, “সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমার কোনো অ্যাকাউন্ট নেই। আমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ। আমি খেলা উপভোগ করি। আমি খুবই ধীরস্থির প্রকৃতির একজন মানুষ।”
অন্যদিকে পুরস্কার না পাওয়া ভিনিসিউস তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেন, “আমি এটা আরও ১০ বার করব। তারা এখনো প্রস্তুত নয়।” জানতে পারা যায়, এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তার প্রকাশ্য লড়াইয়ের কথা বুঝিয়েছেন। আর তিনি মনে করছেন, এই কারণেই তাকে ব্যালন দ’র দেওয়া হয়নি। ৬৮তম ব্যালন দ’র-কেন্দ্রিক বিতর্কটা এখানেই।
প্রশ্ন ওঠে, ২০০৭ সাল থেকে বৈশ্বিক হওয়া ব্যালন দ’র কি আসলেই কোনো ফুটবলারের জন্য বৈশ্বিক স্বীকৃতি? নাকি সুনির্দিষ্ট কাউকে স্বীকৃতি দেওয়াই ব্যালন দ’রের কাজ? আর ব্যালন দ’র কর্তৃপক্ষ কেনইবা নির্দিষ্ট কাউকে নির্বাচন করতে চাইবেন? তাহলে পুরস্কৃত নির্বাচনের জন্য যে ১০০ সাংবাদিক ভোট দেন, তারা কি নিরপেক্ষ নন? নাকি কর্তৃপক্ষের দেওয়া সুরটাই তাদের গলায় বেজে ওঠে?
অবশ্য মনে রাখতে হবে পৃথিবীর কোনো পুরস্কারই বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। সেখানে যৌক্তিক প্রশ্ন তোলার সুযোগ সবসময় থাকে। যেমন মেসি ৮ বার ব্যালন দ'র জিতেছেন কিন্তু এর সবগুলোই বিতর্কিত নয়। এ ধরনের পুরস্কারের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা, স্পন্সর প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রভাব রাখে বটে। তবে এবারের ব্যালন দ'র যেন বিতর্কই উসকে দিয়েছে বেশি করে।
আমরা যারা সারা বছর ফুটবল লিগের খেলাগুলো দেখি কিংবা এ সম্পর্কিত সংবাদ পাঠ করি, আমাদের প্রত্যেকের কাছেই ভিনিসিউসের দুইটা ইমেজ— এক) তিনি অসাধারণ একজন খেলোয়াড় এবং, দুই) ফুটবল মাঠে সংগঠিত সব ধরনের বর্ণবাদী আচরণের একজন দৃঢ় প্রতিবাদকারী। পক্ষান্তরে রদ্রিকে আমরা চিনি একজন দক্ষ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। তাহলে কি ব্যালন দ’র কর্তৃপক্ষ কোনো খেলোয়াড়ের প্রতিবাদী ইমেজ পছন্দ করেন না?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ব্যালন দ’র-এর উত্থানের প্রেক্ষাপট এবং বিভিন্ন বছরে পরিবর্তন করা খেলোয়াড়দের মানদণ্ডগুলোর সঙ্গে ওই বছরগুলোতে পুরস্কারবিজয়ীকে দেখলে বিষয়টা অনেকটাই স্বচ্ছ হয়ে যাবে।
এই পুরস্কার উদ্ভবের পেছনে আছেন ফ্রান্সের সাংবাদিক গ্রাবিয়েল হ্যানোট এবং জ্যাক ফেরান। হ্যানোট ছিলেন ফ্রান্সের খেলোয়াড়, কোচ, পরে তিনি সংযুক্ত হন সাংবাদিকতায়। ছিলেন ফ্রেঞ্চ দৈনিক পত্রিকা লে’কিপ-এর সম্পাদক। ওই পত্রিকাতেই প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন ফেরান। ওই সময়ই তারা লে’কিপের পাশাপাশি কাজ করতেন ‘ফ্রান্স ফুটবল’ নামের এক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে। ১৯৫৬ সাল থেকে এই ‘ফ্রান্স ফুটবল’ সাময়িকী ব্যালন দ’র পুরস্কার প্রদান করছে। এই দুই পত্রিকা, লে’কিপ এবং ‘ফ্রান্স ফুটবল’-এর মালিক ফ্রান্সের বেসরকারি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান আমাউরি গ্রুপ। অর্থাৎ, ব্যালন দ’র মিডিয়া হাউস-প্রবর্তিত একটা স্বীকৃতি।
যাই হোক, শুরুর পর থেকে ইউরোপিয়ান ফুটবলারদেরই কেবল ব্যালন দ’র দেওয়া হতো। দীর্ঘ ৩৮ বছর পর ১৯৯৫ সাল থেকে জাতীয়তা ভিন্ন দেশের হলেও ইউরোপীয় ক্লাবে খেলা খেলোয়াড়দেরকে এই পুরস্কারের আওতায় আনা হয়। ২০০৭ সাল থেকে এটি বৈশ্বিক রূপ লাভ করে এবং এরপর থেকে পৃথিবীর সব খেলোয়াড়কে পুরস্কারের জন্য বিবেচনায় নেওয়া হয়। ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত এ পুরস্কার প্রদানে যুক্ত হয় ফিফাও। ফিফার সঙ্গে অংশীদারত্ব শেষ হওয়ার পর ২০১৬ সাল থেকে আবারও এককভাবে এ পুরস্কার দিয়ে আসছে ফ্রান্স ফুটবল। এই বছর থেকে ফ্রান্স ফুটবল এবং লে’কিপ- আমাউরি গ্রুপের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে পুরস্কারটা দেওয়া হয়।
শুরু হওয়ার পর ১৯৫৬ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট নিয়ম পরিবর্তনগুলো কীভাবে সুনির্দিষ্ট কিছু খেলোয়াড়ের প্রতিনিধিত্ব করে এবং একজন খেলোয়াড়কে জয়ী ঘোষণা করে— এটা দেখতেই বিগত পাঁচ বছরের ব্যালন দ’র-এর বিজয়ী এবং সেই সময়ের নিয়মগুলো জানার চেষ্টা করি।
‘সেরা স্ট্রাইকার’: ২০২১ সালে সংযোজিত নতুন পুরস্কার
২০২১ মৌসুমে অনবদ্য পারফরম্যান্সের পর ব্যালন দ’র জিতবেন বলে আশা করেছিলেন পোলিশ স্ট্রাইকার রবার্ট লেভানদোভস্কি। কিন্তু ফরাসী সংস্থার পক্ষ থেকে সপ্তমবারের জন্য ওই পুরস্কার তুলে দেওয়া হয় আর্জেন্টাইন তারকা লিওনেল মেসির হাতে।
কোভিড মহামারীর কারণে ২০২০ সালে এই পুরস্কার প্রদান করায় ২০২১ সালে ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে আগ্রহটা অনেক বেশিই ছিল। ওই বছর মেসি তার রেকর্ড সপ্তম ব্যালন দ’র পুরস্কার জয়ী হন। ১৭০টি দেশের সাংবাদিকদের ভোটে মেসি জয়লাভ করেন। ২০২১ সালে একজন খেলোয়াড়ের পুরো বছরে, মানে একটা পঞ্জিকাবর্ষে তার পারফরমেন্স বিবেচনা করা হতো। অর্থাৎ, জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ ছিল বিবেচ্য বিষয়। ওই সময় সাংবাদিকদেরকে যে তিনটা মানদণ্ড বিবেচনায় নিতে বলা হয়েছিল, সেগুলো ছিল— ১) ব্যক্তিগত এবং দলের পারফরমেন্স, ২) খেলোয়াড়ের মান (মেধা এবং ফেয়ার প্লে) এবং ৩) খেলোয়াড়ের সম্পূর্ণ ক্যারিয়ার বিবেচনা।
তিন নম্বর মানদণ্ডটি কীভাবে এখানে প্রাসঙ্গিক, সেটা বোঝা দায়। কিন্তু এটাই মেসিকে অনেক এগিয়ে দেয়। অথচ প্রথম দুটি মানদণ্ডে স্পষ্টতই মেসি থেকে অনেক এগিয়েই ছিলেন লেভানদোভস্কি। মনে প্রশ্ন আসে, কোন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ব্যালন দ’র কর্তৃপক্ষ মেসিকে নির্বাচন করেছিলেন? কোনো ধরনের প্রাসঙ্গিকতা ছাড়াই শুধু ব্যক্তিগত পরিসংখ্যান বিবেচনায়? নাকি এটা আর্জেন্টিনার কোপা আমেরিকার জয়ের জন্য?
পরিসংখ্যান বিবেচনায় লেভানদোভস্কির এগিয়ে থাকা স্পষ্ট ছিল। পোল্যান্ডের হয়ে ট্রফি না জিতলেও ক্লাবের হয়ে মোট গোল করেন ৪০ ম্যাচে ৪৮টি। গোল করান নয়টি। বুন্দেসলিগায় ৪১ গোল করে সর্বাধিক গোল স্কোরারের খেতাব পান তিনি। এমনকি বায়ার্ন মিউনিখের চ্যাম্পিয়ন হওয়াতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এই স্ট্রাইকার। ২০২১ সালে সেরার উপাধি পাওয়ার যোগ্য দাবিদার ছিলেন তিনি। অন্যদিকে, মেসি ক্লাবের হয়ে মোট ৪৭ ম্যাচে ৩৮টি গোল এবং ১৪টি অ্যাসিস্ট করেন। লা লিগায় সর্বাধিক ৩০টি গোল করেন তিনি। কোপা আমেরিকাতে চারটি গোল এবং পাঁচটি অ্যাসিস্ট ছিল তার নামের পাশে।
জানা যায়, ওই বছর ‘ফ্রান্স ফুটবল’ সাময়িকী ‘সেরা স্ট্রাইকার’ নামে একটা নতুন পুরস্কারের সংযোজন করে। আর ২০২১ সালের ‘সেরা স্ট্রাইকার’ লেভানদোভস্কি। অর্থাৎ লেভানদোভস্কি ক্লাব এবং দেশের জন্য সেরা স্ট্রাইকার হলেও তিনি ব্যালন দ’র পুরস্কারের তালিকায় ছিলেন দ্বিতীয় স্থানে!
২০২২ সালে প্রথমবার বাদ পড়েন মেসি!
২০০৫ সালের পর প্রথমবার মেসির নাম ৩০ জনের তালিকা থেকে বাদ পড়ে। ২০২২ সালে পুরস্কার দেওয়ার মানদণ্ডে কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু পরিবর্তন করে। নতুন নিয়মে বছর নয়, বিবেচনায় আনা হয় এক মৌসুমের পারফরম্যান্স। অর্থাৎ অগাস্ট থেকে জুলাইয়ের মধ্যে, যা মূলত ইউরোপিয়ান ফুটবলের পুরো একটি মৌসুম। তখন থেকেই শুরু হয় ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ ১০০ দেশের সাংবাদিকদের ভোট দেওয়ার নিয়ম। ব্যালন দ’র প্রদানের তালিকা প্রস্তুতিতেও লে’কিপের সাংবাদিক ছাড়াও যুক্ত হন ২০২২ সালে ব্যালন দ’র অ্যাম্বাসেডর আইভরি কোস্টের সাবেক স্ট্রাইকার দিদিয়ের দ্রগবা। পরিবর্তিত নিয়মে প্রথমে একজন খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত পারফরমেন্সকেই বিবেচনায় নেওয়া হয়। এরপর বিবেচিত হয় দলগত সাফল্য। সর্বশেষ ওই ফুটবলারের দক্ষতা এবং সততার দিকে নজর দেওয়ার কথা বলা হয়।
ওই বছর সেরা পারফরমার হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন করিম বেনজেমা। ২০২১-২২ মৌসুমে ক্লাব এবং জাতীয় দল মিলিয়ে বেনজেমা ৪৮ গোল করেছিলেন, করিয়েছিলেন আরও ১৫টি। জিতেছিলেন লা লিগা, চ্যাম্পিয়নস লিগ, উয়েফা ন্যাশন্স লিগ এবং সুপারকোপা।
এই বছরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে নিয়ম বাদ দেওয়া হয়, সেটা হলো ভোট দেওয়ার সময় খেলোয়াড়ের খ্যাতি এবং পূর্ববর্তী বছরগুলোতে পারফরম্যান্স বিবেচনায় না নেওয়া। আর এতেই বাদ পড়েন মেসি।
২০২৩ সালে মেসির অষ্টম ব্যালন দ’র
২০২৩ সালে মেসি রেকর্ড অষ্টম ব্যালন দ’র জেতেন। ২০২২ সালের শেষে তিনি কাতারে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। বিশ্বকাপে গোলদাতার তালিকাতেও ছিলেন দুই নম্বরে। যদিও ক্লাব পর্যায়ে মিশ্র মৌসুম কাটে তার। মেসি ২০২২-২৩ মৌসুমের পর পাড়ি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব ইন্টার মায়ামিতে। সেবারের বিবেচিত সময়ের মধ্যে তিনি গোল করেছিলেন ৪২টি আর অ্যাসিস্ট করেছিলেন ২৬টি। সাবেক ক্লাব পিএসজির হয়ে লিগ ওয়ানসহ দু’টি শিরোপা জিতেছিলেন তিনি। এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক, যে অষ্টম ব্যালন দ’র জয়ের জন্য মেসির শুধু বিশ্বকাপ জয়ই দরকার ছিল।
কারণ এই সম্ভাবনার তালিকায় দ্বিতীয়তে থাকা নরওয়ে ও ম্যানচেস্টার সিটির স্ট্রাইকার আর্লিং হালান্ডের পারফরমেন্স দেখলেই এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। হালান্ড জাতীয় দলের হয়ে সাফল্য না পেলেও ক্লাব পর্যায়ে দুর্দান্ত সময় কাটিয়েছিলেন। তিনি ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে ৫৩ ম্যাচে গোল করেছিলেন ৫২টি। আর সিটি জিতেছিল ‘ট্রেবল’ চ্যাম্পিয়নস লিগ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ও এফএ কাপ।
অথচ ২০১০ এবং ২০১৪ সালে একই ধরনের পরিস্থিতিতে দেখা গিয়েছিল ভিন্ন দৃশ্য। যদি বিশ্বকাপ জয়কেই মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে ২০১০ সালে স্পেনের হয়ে বিশ্বকাপের ফাইনালের জয়সূচক গোল করা আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা কেন ব্যালন দ’র পেলেন না? উল্লেখ্য, ইনিয়েস্তা ছিলেন মেসির সতীর্থ, তারা প্রত্যেকেই বার্সেলোনার হয়ে লা লিগা ও ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপাও জয় করেছিলেন। কিন্তু জিততে পারেননি ব্যালন দ’র! মেসি সেবার দ্বিতীয়বারের মতো জেতেন এই পুরস্কার।
আবার ২০১৪ সালে ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো পান ব্যালন দ’র। ওই বছর রোনালদোর পরেই ছিলেন মেসি এবং তৃতীয় স্থানে ছিলেন জার্মানি ও বায়ার্ন মিউনিখের ম্যানুয়েল ন্যয়ার। ন্যয়ার বুন্দেসলিগা জিতেছিলেন। তার দল জার্মানি জিতেছিল বিশ্বকাপ। আর ওই টুর্নামেন্টে ন্যয়ারের পারফরমেন্স ছিল অসাধারণ। কিন্তু টানা দ্বিতীয়বারের মতো ব্যালন দ’র জিতেছিলেন রোনালদো।
তাহলে ব্যালন দ’র কি মিডিয়া-স্বীকৃত ‘ইমেজ’-এর স্বীকৃতি?
মূলত বিতর্ক এড়ানোর জন্যই ব্যালন দ’র জয়ীকে নির্বাচনের জন্য এমন একটা কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, যেটা আপাতদৃষ্টে অনেক স্বচ্ছ মনে হলেও কাঠামোটা পুরোটা বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার মতোই! জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক পর্যায়ের সকল সুন্দরী প্রতিযোগিতার সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট থাকে মিডিয়া হাউস। আর এই আয়োজনের পেছনে তাদের যুক্তি থাকে— ১) এটি নারীর ক্ষমতায়ন ঘটায় এবং ২) এখানে দৈহিক সৌন্দর্যই মূল কথা নয়, তার বুদ্ধিমত্তা বা ট্যালেন্টই তাকে জিতিয়ে দেয়। (ফাহমিদুল হক, ২০১০)। উপরিতল থেকে দেখলে, ধারণাটিকে এমনটাই দেখায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিষয়টা এতটা সহজ নয়। মিডিয়া হাউসগুলোর মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে ‘সুন্দরী’ নারী বাছাই করে আর্ন্তজাতিক প্রতিযোগিতায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। এবং সেখানে থেকে ওই নারীকেই বাছাই করা হয়, যার ইমেজ আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত। কারণ তাদের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট পণ্যের প্রসার ঘটানো সহজ হয়। ব্যালন দ’রের কনসেপ্টটাও ঠিক এটার মতোই।
ব্যালন দ’র বিজয়ীরা কোনো আর্থিক পুরস্কার পান না। বরং প্রতিষ্ঠিত হয় খেলোয়াড়ের বলিষ্ঠ ‘ইমেজ’। আর এই ইমেজের জন্যই পণ্যের সর্বাধিক প্রসার ঘটানো সহজ হয়। অন্যদিকে বিজয়ী খেলোয়াড় বড় বড় অংকের স্পন্সরশিপের প্রস্তাব পান। এ কারণেই সুনির্দিষ্ট সংখ্যক সাংবাদিকরা তাকেই নির্বাচিত করেন, যার ইমেজ বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত। আর এই কাজটিকেই নিরপেক্ষ রাখতে তারা কিছু মানদণ্ড তৈরি করে রাখেন যেন কোনোভাবেই এই প্রক্রিয়াটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা না যায়।
২০১৪ সালে ন্যয়ার যে ব্যালন দ’র পাবেন না— এটা তিনি আগেই বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এখানে “...যে দু’জন আছেন (রোনালদো ও মেসি), তারা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড। দুনিয়াজুড়ে ওদের পরিচিতি। সুখ্যাতি। ওরা মহাতারকা। তাই ওরা এগিয়ে আমার চেয়ে।”
২০০৩ সালের যোগ্য দাবিদার হয়েও ফ্রান্স এবং আর্সেনালের কিংবদন্তি স্ট্রাইকার থিয়েরি অঁরি ব্যালন দ’র জেতেননি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “মতামত নিয়ে আপনি বিতর্ক করতে পারেন না। সাংবাদিকরা যখন ভোটদান প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকেন, তখন তারা যা চায় তাকে ভোট দেয়।” উল্লেখ্য, অঁরি-ও একজন কৃষাঙ্গ খেলোয়াড়। খেলোয়াড়ি জীবনে তিনি বহুবার হাঁটু গেড়ে বসে বর্ণবাদের প্রতিবাদও করেছেন।
এটা যে ইমেজকে নির্ধারণ করে তা আরও একটা বিষয় থেকে পরিষ্কার হয়। পুরস্কারটিকে ২০০৭ সালে বৈশ্বিক করা হলেও কর্তৃপক্ষের মনোজগতে এটা এখনো ইউরোপ-কেন্দ্রিক। ২০০৭ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মোট ১৭ জন ব্যালন দ’র জয়ীদের মধ্যে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন এমন খেলোয়াড় হলেন ১১ জন। বলা বাহুল্য, চ্যাম্পিয়নস লিগ হলো ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবগুলোর অংশগ্রহণের মাধ্যমে আয়োজিত একটা বার্ষিক প্রতিযোগিতা। সর্বশেষ বিজয়ী রদ্রিও ২০২৩ সালের ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন, সঙ্গে ফাইনালে ম্যাচসেরা নির্বচিত হয়েছেন। অন্যদিকে ভিনিও ২০২৩-২৪ সালে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছিলেন।
তাহলে ভিনি কেন ব্যালন দ’র জিতলেন না? কারণ ইউরোপ সমাজ-সংস্কৃতির আদি সমস্যা বর্ণবাদ। এজন্য যোগ্যতা থাকলেও ‘কালো চামড়া’, ‘আফ্রিকার’ খেলোয়াড় তাদের কাছে ‘সেরা’-র মর্যাদা খুব কমই পেয়েছেন। ১৯৯৫ সাল থেকে ইউরোপীয় ক্লাবে খেলা ভিন্ন দেশের খেলোয়াড়কে এই পুরস্কারের আওতায় আনা হলে লাইবেরিয়ার জর্জ ওয়েহ প্রথম আফ্রিকান খেলোয়াড় হিসেবে এই পুরস্কার জেতেন। তিনি ২০২১ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এক পোস্টে বলেছিলেন, “আমি ব্যালন দ’র পুরস্কার পাওয়ার পর থেকে এটার জন্য কখনোই গর্ববোধ করি না। কারণ আমি এটার জন্য ইউরোপে বর্ণবাদের শিকার! আমার মনে আছে, পরের দিন লা গ্যাজেটা ডেলো স্পোর্ট (ইটালিয়ান দৈনিক সংবাদপত্র) শিরোনামে লেখা ছিল, ‘ওহ, কালোটাই সোনা জিতলো’। এমনকি মিলানের মধ্যেও, তারা আমাকে এবং আফ্রিকাকে নিয়ে তামাশা করত। সুযোগ পেলেই বলত, ‘তুমি কি এটা বিক্রি করে তাদের জন্য রুটি কিনেছো’?”
প্রকৃতপক্ষে এই সম্পূর্ণ কাঠামোটাই সাজানো হয় মিডিয়া-উপযোগী সর্বজনস্বীকৃত একটা ইমেজের জন্য। এই ইমেজটি তাহলে কেমন হওয়া চাই? খুব সহজ উত্তর! অবশ্যই মেসির মতো! বাডওয়াইজারের ফুটবল-বিষয়ক কনটেন্টের প্রধান অমর সিং মেসির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর বলেছিলেন, “বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের প্রেক্ষাপটে মেসির আবেদন এমন যে— এটা সারা বিশ্বের যেকোনো বাজারের জন্য প্রাসঙ্গিক।” তিনি আরও বলেছিলেন, “তিনি (মেসি) তার খ্যাতি ফুটবলের মাধ্যমেই পেয়েছেন। তিনি অতিরঞ্জিত কোনো কিছুর জন্য পরিচিত নন। চূড়ান্তভাবে তিনি শুধুই ফুটবল খেলাতেই ভালো।”
অর্থাৎ বৃহৎ বৃহৎ করপোরেশনগুলো তার পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য স্বাভাবিকভাবেই একজন ‘জনপ্রিয়’ ‘সাধারণ’ ‘খেলোয়াড়’ ইমেজটিকেই চাইবেন। কোনো প্রতিবাদী, কিংবা বিতর্কিত ইমেজ পণ্যের প্রসারের ক্ষেত্রে অন্তরায়। আর ব্যালন দ’র পুরস্কারের মাধ্যমে ‘ফ্রান্স ফুটবল’ ওই ইমেজটাকেই নির্বাচন করে। সুতরাং ২০২৪ সালের ব্যালন দ’রের ক্ষেত্রেও কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল না। কারণ এই পুরস্কারের সুপরিকল্পিত কাঠামোর মাধ্যমে ‘সাধারণ মানুষ’ ‘খেলা উপভোগ’ করা রদ্রি আর সারাবছর বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা ভিনির মধ্যে একজনকে বেছে নিতে ফ্রান্স ফুটবলকে কোনো কাঠগড়া পেরোতে হয়নি।