আমি আমার ডাক্তারের সঙ্গে মিলে একটি ক্যানসার সচেতনতামূলক ডকুমেন্টারি নির্মাণ করার চেষ্টা করছি, যাতে মানুষকে অনেক বেশি সচেতন করা যায়— এই রোগ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে।
Published : 03 Jun 2024, 03:59 PM
২০১৯ সালে একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে জানতে পারি যে আমি ফলিকুলা লিম্ফোমাতে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারি। এরপর পরিবারের বন্ধু, আত্মীয় ও আপনজনের মাধ্যমে আমি ভাগ্যক্রমে ডা. টি রাজা এবং অ্যাপোলো ক্যানসার হাসপাতাল সম্পর্কে জানি। আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেট করা হয় ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর। এক সিনিয়র বন্ধু, যিনি একই লিম্ফোমাতে আক্রান্ত ছিলেন, তিনি আমাকে অ্যাপোলো চেন্নাইয়ের কথা জানিয়েছিলেন। আমি চেন্নাইয়ে এসে ডাক্তার দেখাই। প্রথম দিন আমার বায়োপসি করা হয়। এরপরে পাঁচ দিন টানা নানা রকম টেস্ট করিয়ে তাঁরা আমাকে কনফার্ম করেন, আমি ফলিকুলার লিম্ফোমার (নন-হজকিন) পেশেন্ট। এরপর আমি R-CHOP মেডিকেশনে প্রথম কেমোথেরাপি দিয়ে দেশে ফিরে আসি। দেশে আমার চিকিৎসক ছিলেন ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ। ২১ দিনের সাইকেলে চারটি কেমোথেরাপি দিয়ে আমাকে আবার ভারতে ফিরতে বলা হয়। কিন্তু এরপর আমি কোভিডের লকডাউনে পড়ে যাই। ফলে, ছয় সাইকেল পর্যন্ত আমি দেশে দিই। এখন পর্যন্ত নানা ধারাবাহিকতায় আমি ২০টি কেমো শেষ করেছি।
প্রথম থেকেই আমি সুস্থ থাকায় খুব দ্রুত সঠিক চিকিৎসার স্থানে পৌঁছে গেছি। অনেকে রোগ নির্ণয় করতে করতে দেরি করে ফেলে এবং অসহায় অবস্থায় বিদেশে যায়। আমাদের দেশে প্রথম পর্যায়ে দেশে চিকিৎসা করানো নিয়ে অনেক ভ্রান্তি মোকাবিলা করতে হয়, যা ক্যানসার চিকিৎসার সবচেয়ে বড়ো বাধা। নানাজনে নানা মতামত দিয়ে থাকেন। তবে চিকিৎসাকেন্দ্রে একটি সঠিক তথ্য ব্যবস্থাপনা থাকা উচিত। চিকিৎসকদের দিক থেকে স্পষ্ট করে নির্দেশনা থাকা উচিত যে কীভাবে কোথায় চিকিৎসা করালে উপকার পাওয়া যাবে।
আমি যেহেতু সিঙ্গেল ছিলাম, ফলে পারিবারিকভাবে আমাকে খুব চিন্তা করতে হয়নি। তাই আমার ভাই-বোন-মা সকলে খুব যত্নবান ছিলেন। কিছু সমস্যা যে হবে না, তা নয়। তবে বন্ধুবান্ধব মিলে আমাকে নানা রকম সাপোর্ট এখন পর্যন্ত দিয়ে যাচ্ছে। মানুষের ভালোবাসা আমাকে বাঁচিয়ে রাখে।
তবে পেশাগত ক্ষেত্রে অনেক সময় সংকটে পড়তে হয়। কাজ পাওয়া নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হয়েছে আমার। আমি একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা। প্রযোজকদের অনেকেই সংশয়ে থাকেন, আমি কাজ শেষ করতে পারব কি না বা কাজ দিলে অন্য কোনো বিপদ হবে কি না। ফলে পেশাগত ক্ষেত্রে অনেক সময় লুকিয়ে যেতে হয়েছে অসুখের ব্যাপারটা। অনেকে কাজের মাঝে এসব নিয়ে কোনো অজুহাত শুনতে চান না। কিছু কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার বাইরে বিশাল একটি ভালোবাসাময় অভিজ্ঞতা আছে। তাই এসব কিছুই আমার পথচলা থামাতে পারেনি।
আমি আমার ডাক্তারের সঙ্গে মিলে একটি ক্যানসার সচেতনতামূলক ডকুমেন্টারি নির্মাণ করার চেষ্টা করছি, যাতে মানুষকে অনেক বেশি সচেতন করা যায়— এই রোগ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসার সকল রকমের সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা উচিত। এখনো বিভাগীয় শহরগুলোতে, প্রধান শহরগুলোতে পেট-সিটিসহ অনেক জটিল পরীক্ষার কোনো সুযোগ নেই। তার চেয়ে বড়ো কথা, ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো শহরগুলোও মেডিকেল-ফ্রেন্ডলি নয়। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগে। মুমূর্ষু রোগী হলে আরও বিপদ। সে ক্ষেত্রে চেন্নাইয়ের মতো শহরগুলো ওয়ান-স্টপ সার্ভিসের মতো। অর্থ বেশি লাগলেও সেখানে অনেক সহজে ও দ্রুত সব হয়ে যায়। গণমাধ্যম ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ক্যানসার চিকিৎসা নিয়ে অনেক বেশি সচেতনতা তৈরি হওয়া দরকার। যেহেতু এটি একটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা, এখানে অনেক বেশি সহযোগিতা আর আন্তরিকতা প্রয়োজন।
লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিক্ষক
(সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশনের ‘এখানে থেমো না’ বইয়ে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে)