Published : 14 Mar 2020, 02:31 PM
বিড়িখোরগো 'করোনাভাইরাসের' ডর দেখাইয়া লাভ নাই, ওরা সবসময় ক্যান্সার লইয়া খেলা করে!
-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ট্রল এর ডায়ালগ
দেশে বিদেশে বড় কোনো ঘটনা ঘটবে আর সেটাকে ঘিরে গুজব ছড়াবে না এমন নাকি হতেই পারে না। সারা পৃথিবীতেই গুজবের চরিত্র এক! নির্দিষ্ট কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে গুজব ছড়িয়ে পড়বে এবং বহু মানুষ এর পেছনে ছুটবেই। যেমন ২০১১ সালে ভূমিকম্পের কারণে জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটলে সেখান থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। এটা জানার পর চীনে গুজব ছড়িয়ে পরে যে লবন খেলে শরীরে তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতি কম হয়। সঙ্গে সঙ্গে চীনারা বাজারে হামলে পড়ে লবন কেনার জন্য। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে লবনের দাম হয়ে যায় আগের তুলনায় তিনগুণ। চীনের মতো বাংলাদেশেও ২০১৯ সালের নভেম্বরে গুজব ছড়িয়ে পরে যে লবনের দাম বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। দেশবাসী হুজুগের বশবর্তী হয়ে লবন কিনতে থাকে কিন্ত একদিন পরেই জানা যায় লবনের দাম আদৌ বাড়েনি এবং মজুদ আছে প্রচুর। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে পেঁয়াজ নিয়েও গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল।
সারা আমেরিকা একবার কয়েক মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। তখন গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে বিদ্যুৎ বিপর্যয় নিয়মিত হতে পারে। মানুষ খুব দ্রুত মোমবাতি সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর মোমবাতির সংকট দেখা দেয়, দামও বেড়ে যায়। পরে জানা যায় পুরো ব্যপারটাই গুজব!
যদি বলা হয় যে বাংলাদেশ গুজবের 'চারণভূমি' তাহলে হয়তো ভুল বলা হয় না। এদেশে এমন মানুষও আছেন যারা বিশ্বাস করতেন যে পদ্মাসেতুর জন্য মানুষের কাটা মাথা প্রয়োজন। পদ্মাসেতু নির্মাণের কাজে নিয়োজিত চীনারা নাকি একারণে মানুষের কাটা মাথা সংগ্রহ করছে! নেত্রকোনার প্রত্যন্ত সাওতাল পল্লীতে এক যুবকের ব্যাগে শিশুর কাটা মাথা পাওয়ার পর থেকে এই গুজব খুব দ্রুত ছড়াতে থাকে। আর তাই ২০১৯ এর জুলাই মাসে বাংলাদেশের প্রাইমারি স্কুলগুলোর সামনে অভিভাবকদের ভীড় বেড়ে যায়। শিশু শিক্ষার্থীদের নিয়ে পিতা-মাতার শংকা বাড়ে। ছেলেধরা সন্দেহে তখন কয়েকজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়।
বাংলাদেশে যত গুজব প্রচলিত আছে তার ভেতর চাঁদ নির্ভর গুজব খুব শক্তিশালী। যেমন নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে নামার পর নাকি দেখতে পেয়েছিলেন যে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত, পরে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এই গুজব ছিল বড় ধরনের মিথ্যে প্রচারণা যা এখনও মাওলানা আজাহারী কিংবা তারেক মনোয়ারের মতো মুর্খ লোকেরা ওয়াজের মাধ্যমে বয়ান করে থাকে! বলাবাহুল্য নীল আমস্ট্রং কখনই ইসলাম গ্রহণ করেননি। এখনও অনেকে বলে থাকেন যে আমরা কোরআনের মর্মার্থ বুঝি না কিন্তু ইহুদী খ্রিস্টানরা নাকি এটা বুঝে কোরআন থেকে ফর্মূলা নিয়েই নিত্য নতুন আবিষ্কার করে যাচ্ছে!
২০১৩ সালে বাংলাদেশের সেরা গুজব ছিল– চাঁদে জামায়াত নেতা ও মানবতার দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ছবি দেখা গেছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার এক মসজিদ থেকে এই ঘোষণা দেয়া হয়। সাতকানিয়ার বোয়ালি পাড়া, সামিয়ার পাড়া, খলিফা পাড়াসহ কয়েক গ্রামে এই ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন বেরিয়ে আসে এবং পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ বেধে যায়। এরপর সাতক্ষীরা থেকে শুরু করে আরও কয়েক জায়গায় এই গুজব ছড়ানো হয়। ফলাফল একশ্রেণির উত্তেজিত মানুষের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ এবং কমপক্ষে ষাট সত্তর জন মানুষ নিহত হয়! গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ নিয়েও। বলা হয়েছিল শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। বাস্তবে এমন ঘটেনি, যদিও অনেক মানুষ ঐ গুজবকেই বিশ্বাস করে থাকেন এখনও!
২০১৯-এ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়লেও গুজব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। হারপিক টয়লেট বা বেসিনে ঢেলে পরিষ্কার করলে নাকি এডিস মশা ঘরে আসে না এমন অনেক গুজব ছড়ানো হয়! মেয়রসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিকে রাস্তা ঝাড়ু দিতে দেখা যায়।
২০২০ সালে এদেশে গুজব ছড়িয়েছে নভেল করোনাভাইরাসের হাত ধরে! কত কিছু যে মানুষ বলাবলি করছে! করোনাভাইরাস সংক্রান্ত কয়েকটা গুজব:
এক. খবর বেরিয়েছে মধু দিয়ে মদ খেয়ে নাকি করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পেয়েছেন এক ব্যক্তি। ওয়েলসে জন্ম নেয়া এই ব্যক্তির নাম কনার রীড, যিনি চীনে ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। এরপর মদ খেলে করোনা কমে যাবে বা হবে না এমন ট্রল ছড়িয়ে পড়ে যোগাযোগ মাধ্যমে। তবে বাংলাদেশে মদের দাম বেড়ে গেছে কিনা কিংবা মদ্যপায়ী লোকের সংখ্যা বেড়েছে কিনা তা জানা যায়নি!
দুই. মামুন নামের ইতালিতে কর্মরত এক ব্যক্তির স্বপ্নেপ্রাপ্ত করোনাভাইরাসের সাক্ষাৎকার প্রচার করে বেড়াচ্ছেন 'এন্টারকোটিক' এর আবিষ্কারক খ্যাত কথিত মুফতি ইব্রাহীম! চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণ নাকি উইঘুরের মুসলমানদের ওপর চীনা শাসকদের নির্যাতন। এরপর নাকি করোনাভাইরাস যাবে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা। মুসলমানদের ওপর নাকি এই ভাইরাস চড়াও হবে না। সৌদি আরব ইব্রাহীম সাহেবের এই থিওরী জানে না। জানলে সে দেশে যাবার জন্য ভিসা স্থগিত করা হতো না, সাময়িক সময়ের জন্য ওমরা হজ্জ্ব বন্ধ করা হতো না! ইব্রাহীম সাহেব আরো জানিয়েছেন, বাংলাদেশের ওপর নাকি করোনাভাইরাসের কোনো রাগ নাই। কারণ এই দেশে ইসলাম নিয়ে এতো আলোচনা বা ওয়াজ মাহফিল হয় যে জন্য করোনা বাংলাদেশে আসবে না। তবে যারা মুনাফেক তাদের করোনা ছাড়বে না। এপর্যন্ত যে তিনজন বাংলাদেশি করোনা আক্রান্ত হয়েছেন তারা মোনাফেক কিনা জানা যায়নি! ইব্রাহীম সাহেব অবশ্য করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক পাবারও ঘোষণা দিয়েছেন। 1.Q7+6=13 এমন একটা উদ্ভট তত্ত্ব প্রচার করে বেড়াচ্ছেন!
তিন. গরুর হিসি নিয়মিত খেলে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে না। এই গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে ইন্ডিয়ায়। পাকিস্তান আর বাংলাদেশের গুজবটা এমন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য ওজু করুন আর টাখনুর উপর প্যান্ট পরুন। করোনাভাইরাস পালাবে! ইরানে করোনা কেন পালাচ্ছে না সেটা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না!
চার. লেবানন, মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় চীনাদের দেখলেই বলা হচ্ছে– 'ঐ যায় করোনাভাইরাস'!
পাঁচ. চীনের বাইরে অনেক দেশে নাকি রাস্তায় চীনাদের দেখলেই লোকজন গণপিটুনী দিচ্ছে। তাই চাইনীজরা বাসা থেকে সহসা বের হচ্ছে না!
ছয়. করোনাভাইরাস বানিয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়াচ্ছে রাশিয়া। একারণে রাশিয়ায় কেউ আক্রান্ত হয়নি। রাশান ভদকা খেলে নাকি করোনা হয় না! ভদকাপায়ীদের সংখ্যা বিশ্বজুড়ে বাড়ছে কিনা জানা যায়নি।
সাত. আমেরিকা চীনকে দমাতে এই ভাইরাস বানিয়েছে। চীনা অর্থনীতিতে ধস নামাতে চায় আমেরিকা!
গুজব হয়তো আরো আছে যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখে পড়ে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে চীন, ইতালি, ইরান ও ভারতে অনেকে মারা গিয়েছেন। আক্রান্ত হয়েছেন অভিনেতা টম হ্যাঙ্কস ও তার স্ত্রী, কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর স্ত্রী, ইরানের এক নেতা কাম মন্ত্রীসহ লক্ষ মানুষ। সারাবিশ্বের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়েছে যাকে বলা হচ্ছে করোনাভাইরাস আক্রান্ত অর্থনীতি! হয়তো প্লেগ, গুটি বসন্ত কিংবা ম্যালেরিয়ার মতো মহামারি হতে পারেনি করোনা, কিন্তু কমও কিছু নয়। ২০২০-এর এক আলোচিত চরিত্র হয়ে থাকবে এই করেনাভাইরাস।
কী আর করা? পুরোনো একটা কৌতুক যা আগেও উল্লেখ করেছিলাম, সেই কৌতুকটা পুনরুল্লেখ করে বিদায় নেই।
গুজব আর নভেল করোনাভাইরাসের কারণে এক এলাকার লোকজন খুবই অশান্তিতে ভুগছিল। কীভাবে করোনাভাইরাস থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় তার উপায় খুঁজছিল। এমন সময় এক সাধুবাবার আবির্ভাব ঘটলো। সাধুবাবার পরনে নেংটি আর গলায় গামছা। তিনি এলাকাবাসীকে জড়ো করে বললেন– সমুদ্র স্নাণে যেতে হবে। তার দোয়ায় জলের সাথে ভেসে যাবে গুজব আর করোনাভাইরাস। নির্দিষ্ট দিনে সাধুবাবার পেছনে সমবেত হলো এলাকার সব লোক। সাধুবাবার নেতৃত্বে শুরু হলো প্রার্থণা ও সমুদ্র স্নাণ। স্নান শেষে এলাকার সব লোক তীরে উঠে দাঁড়াল। উঠলেন না শুধু সাধু বাবা। তিনি বুক ডুবিয়ে দাঁড়িয়েই থাকলেন। লোকজন জানতে চাইল– সাধুবাবা উঠছেন না কেন?
সাধুবাবা জানালেন– গুজব ও করোনাভাইরাস বিদায় হয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না। তবে প্রার্থণা ও স্নাণের জলের সাথে আমার পরনের নেংটি ও গামছা যে ভেসে গেছে সেটা বিলকুল বুঝতে পারছি! তাই তীরে উঠতে পারছি না!