Published : 10 Mar 2020, 03:24 PM
খুব ছোটকাল থেকেই শুনে আসছি, বনের বাঘে খায় না কিন্তু মনের বাঘই খায়। আসলেও, আমি-আপনি যখনই কোনও কিছু নিয়ে ভয়-উৎকন্ঠা আর হতাশার মাঝে থাকি, তখন আমাদের সুন্দর চিন্তা-ভাবনাগুলো লোপ পায়। অত্যন্ত সহজ কাজটিও নিজেরাই কঠিন করে তুলি। সুস্থ ও সময় উপযোগী পরিকল্পনা-সিদ্ধান্ত থেকে আমরা দূরে সরে যাই। আর বিপদ থেকে উত্তরণে দিগবিদিক ছুটে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু অজানা, অচেনা রাস্তার শেষ কোথায়, এটা নিশ্চয়ই বলা কঠিন। তাই আগে জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং পরিকল্পনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শুধু করোনাভাইরাসই নয়, যেকোনো সংকট মোকাবেলা করা সহজ, মসৃণ হয় উত্তরণের পথ-পদ্ধতিও।
নভেল করোনাভাইরাস বা কোভিট-১৯ নিয়ে প্রাথমিক বিশ্লেষণে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের 'সাউথ চায়না সিফুড হোলসেল মার্কেট' থেকে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। ওই বাজারে বাদুড়, বনবিড়াল, সাপের মতো বন্য প্রাণীগুলো খাওয়ার জন্য রীতিমত জীবন্ত সাঁজিয়ে বিক্রি করত। বেশ কয়েকটি গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, বাদুড় থেকে মানুষের শরীরে এ ভাইরাস ছড়িয়েছে।
আর করোনাভাইরাসের আরেকটি রূপ হলো সার্স ভাইরাস (সেভার একিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম), যা ২০০২ সালে চীনে ছড়িয়ে পড়ার কারণে কমপক্ষে ৭৭৪ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সার্সে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল তখন ৮ হাজার ৯৮ জন। সে হিসাবে কোভিড-১৯ অনেক দ্রুততার সাথে ছড়াচ্ছে। সার্স ভাইরাসও বাদুড় থেকে বনবিড়ালে সংক্রমিত হয়েছিল। পরে তা মানবদেহে ছড়িয়ে পড়েছিল।
এই পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে, নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১ থেকে ২ শতাংশ মারা যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৪৪ হাজার রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেছে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৮১ শতাংশের শরীরে হালকা লক্ষণ দেখা দেয়। ১৪ শতাংশের শরীরের লক্ষণ দেখা দেয় এর চেয়ে মাঝারি আকারে। অন্যদিকে মাত্র ৫ শতাংশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও বলেছে, বিশ্বে প্রতিবছর ১০০ কোটির মতো মানুষ ভাইরাসজনিত ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। এর মধ্যে ২ লাখ ৯০ হাজার থেকে সাড়ে ৬ লাখ পর্যন্ত মানুষ মারা যায়। প্রতিবছরই এসব ভাইরাসের ভয়াবহতার মাত্রা পরিবর্তিত হয়ে থাকে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের তিনজনের শরীরেও এই ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। আর এই খবরে একদল আছে গুজব ছড়াতে আর আরেক দল হুজুগে পাবলিক শুরু করেছে দৌড়ঝাপ। আর এ সুযোগে অন্য আরেক দল অসাধু ব্যবসায়ী বাজারের হেক্সাসল, মাস্ক, স্যানিটাইজারের দামই শুধু বাড়ায়নি; রীতিমত বাজার থেকে উধাও করে দিয়েছে। এই তিন শ্রেণির মানুষ যুগ-যুগ ধরে আছে এবং প্রকৃত শিক্ষা, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং দৃটান্তমূলক শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে তারাও ভাইরাসের মতন দেশ ও জাতির জন্য বিপদজনক।
মুখে মাস্ক পরা নিয়ে ব্রিটিশ লাং ফাউন্ডেশন বলছে, 'ভাইরাসটি থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য আমরা মাস্ক পরার সুপারিশ করি না। এগুলো যে খুব একটা কার্যকর তার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। এছাড়াও যাদের ফুসফুসের সমস্যা আছে তারা মুখে মাস্ক পরলে শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।'
অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, আমরা অনেকেই না জেনে, না বুঝে সুস্থ থাকার পরেও মাস্ক সংগ্রহ করতে দৌড়াচ্ছি। আর এ সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু মুনাফালোভী মহল কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। আর সরকারের সমালোচনা করছে। অন্যদিকে, শেখ হাসিনা চাইলে ঝুঁকি নিয়ে তিনি মুজিববর্ষের পূর্বনির্ধারিত সমাবেশটি করতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে যেখানে সামাজিকদেশ ও দেশের জনগণের নিরাপত্তা এবং জনস্বাস্থ্যকেই তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সেখানে এক শ্রেণির বিতর্কিতগোষ্ঠী মুজিববর্ষকে ঘিরে নভেল করোনাভাইরাসের উপর ভর করে নানাবিধ গুজব ছড়াতে উঠেপড়ে লেগেছে-এটি সত্যিই দুঃখজনক। আশাকরি অতীতের ন্যায় সকল গুজবের বিরুদ্ধে সচেতন নাগরিক ঘুরে দাঁড়াবে।
আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সোমবারের (৯ মার্চ) বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'জন্মশতবার্ষিকী বিশাল আকারে করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম, সেখানে লাখ মানুষ জমায়েত হবে। সেই জমায়েত বন্ধ করে দিয়েছি, তার কারণ কোনোভাবে মানুষের যেন ক্ষতি না হয়। মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে সেটা আমি চাই না।'
করোনাকে ভয় করবেন না, কারণ করোনাভাইরাস থেকে নিজেকে এবং অন্যদের রক্ষা করার জন্য আপনিই যথেষ্ট। শুধু আপনাকে সভ্যতার আদলে থাকতে হবে। গতানুগতিক পুরোনো অভ্যেস পরিবর্তন করতে হবে। আপনি সাবধান-সতর্ক থাকলে আপনার সাথে সাথে আপনার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব সবাই সুস্থ থাকবে। যেমন আমরা সচরাচর হাঁচি, কাশি দেওয়ার সময় পাশের লোকের কথা মোটেও চিন্তা করি না। আমাদের এই প্রবণতা দূর করতে হবে। আমার-আপনার হাঁচি, কাশি থেকে যে জলীয় পদার্থ নির্গত হয় এটি কি ভাইরাসমুক্ত? আবার একটু অন্যভাবে চিন্তা করে দেখুন আমার হাঁচি, কাশি থেকে আপনার শরীরে জলীয় পদার্থ পড়লে এটা কেমন দেখায়? আবার আপনার শরীরে না পড়ুক, পাশে থাকা অন্য কোনও জড় পদার্থ চেয়ার, টেবিল, বাড়ির সিঁড়ি বা অন্যের হাত এখানে পড়বে এমন বস্তুর উপর পড়াও নিশ্চয়ই সভ্যতার অংশ হতে পারে না। তাই এই জায়গায় আমাদের একটু সাবধান এবং সতর্ক হতে হবে। হাঁচি, কাশি দেওয়ার সময় অবশ্যই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে টিস্যু ব্যবহার করতে হবে। আর সেই টিস্যু যেখানে-সেখানে না ফেলে ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলুন। ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলুন। সাবান ও পানি কাছে না থাকলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা হাত জীবাণুমুক্ত করার জেল ব্যবহার করুন। অথবা হাত পরিস্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত আপনি আপনার নাক, কান, মুখ ও চোখে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন। আর ইতোমধ্যেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত-এমন অসুস্থ লোকজনের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
আরেকটি বিষয়, বর্তমানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে জনসমাগম এড়িয়ে চলুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এমন মতামত দিয়েছে।
এরপরেও যদি আপনি অসুস্থবোধ করেন কিংবা আপনার কাশি হচ্ছে, শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, আপনি শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্টবোধ করছেন তাহলে প্রথমেই হাসপাতাল, ক্লিনিক, ফার্মেসি কিংবা ডাক্তারখানায় দৌড়ে না গিয়ে ফোনে আপনার পরিচিত চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তার পরামর্শ নিয়ে কাজ করুন। এ ব্যাপারে লন্ডনের রয়্যাল কলেজের একজন চিকিৎসক ড. জনাথন লিচ বলছেন, 'সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে রোগী আতংকিত না হওয়া। হয়তো দেখা যাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ ঠাণ্ডা কাশি বা ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছে, এটি করোনাভাইরাসে নয়।'
আর অসুস্থবোধের বিষয়টি নিয়ে ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশনের একজন সিনিয়র নার্স ফিলিপা হবসন বলছেন, 'আপনার শরীরে যদি উপসর্গ (হাঁচি, শুকনো কাশির সাথে শরীরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মাংসপেশিতে ব্যথা) দেখা দেয়, তাহলে নিজেকে আর সকলের কাছ থেকে আলাদা করে রাখুন। এবং ডাক্তারকে ফোন করে পরামর্শ নিন। ভালো মতো খাওয়া দাওয়া করবেন, খেয়াল রাখবেন শরীর যাতে পানিশূন্য হয়ে না যায় এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম করুন।'
আর করোনাভাইরাসই একমাত্র অসুস্থতার কারণ এটি মোটেও ভাবা যাবে না। আপনি অন্য কোনও কারণেও অসুস্থ হতে পারেন। এর মাঝেও যদি আপনার শরীরে করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা যায় তাহলে আপনি আগে থেকে যেসব ওষুধ খাচ্ছিলেন সেগুলোও আপনাকে সেবন করতে হবে। আর অসুস্থ অবস্থায় আপনার যদি ওষুধ ফুরিয়েও যায় তাহলে বন্ধু-বান্ধব বা পরিবারের অন্য কাউকে দিয়ে হলেও সেসব ওষুধ আনিয়ে রাখতে হবে। এ ব্যাপারে লন্ডনে ইম্পেরিয়াল কলেজের প্রফেসর পিটার ওপেনশ বলছেন, 'এরকম অসুস্থ লোকজনের ঘরে কমপক্ষে চার সপ্তাহের ওষুধ থাকা দরকার।' ঘরে অতিরিক্ত কিছু খাবার দাবার রেখে দেওয়াও ভালো, তবে আতঙ্কিত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
পাঠক! নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিও পরিপূর্ণভাবে সুস্থ হতে পারেন। কারণ, এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকেই জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টের মতো সাধারণ সমস্যা অনুভব করে থাকেন। ফলে আশা করা যাচ্ছে, এই ভাইরাসে আক্রান্ত বেশির ভাগ ব্যক্তিই সুস্থ হয়ে যাবেন। তবে বয়স্ক, ডায়াবেটিস ও ক্যানসারের মতো রোগী বা যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম, তাদের জন্য এই ভাইরাস বিশেষ ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
সর্বশেষ তথ্যনুযায়ী, করোনাভাইরাসে চীনসহ বিশ্বব্যাপী মোট মৃতের সংখ্যা ৪০১৮ জনে ও আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ১৩ হাজার ৯ জনে পৌঁছেছে। চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের এক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি, যাদের রোগের প্রকোপ কম, তাদের সুস্থ হতে এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। আবার করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এই ভাইরাস ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির মাধ্যমেই ছড়িয়েছে, ছড়িয়ে থাকে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে থাকা পরিবারের সদস্য, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সতর্ক থাকতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
আর এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের মতো রোগগুলোর কোনো টিকা আবিস্কার হয়নি। তবে গবেষকেরা যথাস্বাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কারণ, এ ধরনের ভাইরাস এর আগে দেখা যায়নি। ফলে চিকিৎসকেরা এর আগ পর্যন্ত এ ধরনের ভাইরাস সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন। তাই এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যক্তিগত সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
মনে রাখবেন, করোনাভাইরাস ফ্লুর মতো নয়। এটি একেবারেই আলাদা ধরনের ভাইরাস। ফ্লুর কারণেও আপনি অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন এবং কোনো কোনো ব্যক্তির বেলায় এই ফ্লু গুরুতর রূপ নিতে পারে। তবে ফ্লুর টিকা নেয়া থাকলে ভালো। বিশেষ করে যাদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি, শিশু, যাদের আগে থেকেই স্বাস্থ্য সমস্যা আছে, তারা ছাড়াও গর্ভবতী নারীরাও ফ্লুর টিকা (ফ্লু জ্যাব) নিতে পারেন।
আরেকটি বিষয়, আপনার অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট যদি তীব্র হয় এবং আপনার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে তাহলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
আর এ ব্যাপারে অ্যাজমা ইউকে নামের সংস্থা বলছে, ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে প্রতিদিন ইনহেলার (সাধারণত বাদামী) নিন। করোনাভাইরাসসহ অন্য কোনো ভাইরাসেও যদি আক্রান্ত হন তাহলে ইনহেলার অ্যাজমা অ্যাটাক থেকে আপনাকে রক্ষা করবে। তবে নীল রঙের ইনহেলারটিও সবসময় সাথে রাখুন। যদি দেখেন শ্বাস কষ্ট বেড়ে যাচ্ছে তখন এটি ব্যবহার করতে পারেন।
তবে ডায়াবেটিস আক্রান্তদের একটু বাড়তি সচেতন হতে হবে। যারা টাইপ-ওয়ান বা টাইপ-টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের বেলায় করোনাভাইরাসের উপসর্গ মারাত্মক রূপ নিতে পারে। তাদের এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি। ডায়াবেটিস ইউকে নামের একটি সংস্থার কর্মকর্তা ড্যান হাওয়ার্থ বলছেন, 'যাদের ডায়াবেটিস আছে করোনাভাইরাস কিংবা কোভিড-১৯ তাদের শরীরে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।'
ভয়ের কারণ নেই। এখানে আপনাকে যা করতে হবে, 'আপনার যদি ডায়াবেটিস থাকে এবং কাশি, জ্বর এবং শ্বাস কষ্টের উপসর্গ থাকে, তাহলে আপনার রক্তে সুগারের মাত্রার ওপর বেশি সতর্ক নজর দিতে হবে।' চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
আরেকটি বিশেষ দিক হলো, যারা দীর্ঘদিন ধরে নানা কারণে স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ফুসফুসে সমস্যা এবং দেহের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা দুর্বল তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন এবং এই অসুস্থতা মারাত্মক রূপও নিতে পারে। এ বিষয়ে ব্রিটেনে চিলড্রেন্স ক্যান্সার ও লিউকেমিয়া গ্রুপের পরামর্শ হচ্ছে, 'যেসব শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত তাদের পিতামাতার উচিত ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে কী করা উচিত এ বিষয়ে পরামর্শ নেওয়া।'
অন্যদিকে গর্ভবতী নারীদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি এমন কথা বলার পক্ষে এখনও কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে সংক্রমণ এড়াতে অন্যদের মতো গর্ভবতী নারীদেরও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার নিয়ম মেনে চলা উচিত।
বাংলাদেশে কমবেশি প্রায় অনেকেই ধূমপান করে থাকে। প্রকাশ্যে ধূমপানের বিরুদ্ধে আইন-কানুনসহ সরকারের নানামুখী উদ্যোগ থাকলেও হরহামেশাই জনসমক্ষে ধূমপান করতে দেখা যায়। আর ধূমপান ফুসফুস ও হৃৎপিন্ডের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয় বলে তাদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি থাকে।
ধূমপানের বিষয়ে যুক্তরাজ্যের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক একটি দাতব্য সংস্থা অ্যাশের প্রধান নির্বাহী ডেবোরা আর্নট বলছেন, 'যারা ধূমপান করেন তাদের উচিত করোনাভাইরাসের ঝুঁকি এড়াতে ধূমপান কমিয়ে ফেলা কিংবা পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া। কারণ ধূমপায়ীদের শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। তাদের নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি যারা ধূমপান করেন না তাদের দ্বিগুণ।' তিনি আরও বলেন, 'ধূমপান ছেড়ে দেওয়া নানা কারণেই আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। করোনাভাইরাসের কথা মাথায় রেখেই তাদের উচিত ধূমপান ছেড়ে দেওয়া। এতে তার দেহে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। '
এখানে প্রশ্ন করতে পারেন, বয়স্কদের কী ঝুঁকি আছে। আসলে সাবধান, সতর্ক, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন না থাকলে একটা সময় আমরা সবাই কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ব, আক্রান্ত হয়ে পড়ি এটাই স্বাভাবিক। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এখানে গতানুগতিক জীবন-যাপনের ব্যাপারে পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই সাথে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বেশি। তবে বয়স্ক লোকজনদের আলাদা থাকার বা আলাদা করে রাখার কোনও প্রয়োজন নেই, এটি ব্রিটেনে কর্তৃপক্ষের পরামর্শ। এ বিষয়ে বয়স্ক লোকজনদের নিয়ে কাজ করে এরকম দাতব্য সংস্থা এইজ ইউকের একজন পরিচালক ক্যারোলিন আব্রাহামস বলেছেন, 'পরিবারের সদস্যদের উচিত তাদের বয়স্ক আত্মীয় স্বজনের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখা। তাদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কোন উদ্বেগ থাকলে অথবা এবিষয়ে তথ্যের প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা।'
পাঠক। একটা কথা মনে রাখবেন এবং আমিও ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, প্রকৃতি অনেক সময় বাধ্য হয়েই তার ভারসাম্য রক্ষা করে। প্রকৃতির কাছে তার প্রতিটি জড় পদার্থ থেকে আরম্ভ করে জীব-প্রাণীর গুরুত্ব অনেক বেশি মুল্যবান। কিন্তু আমরা মানবজাতি অনেক সময় ভুলে যাই অথবা এটা মানতে চাই না। কথায় আছে, বন্যেরা বনেই সুন্দর। আপনার পোষ্যপ্রাণীটার জীবন নিয়ে একবারও কি ভেবেছেন, আপনি তাকে বাধ্য করে খাচায় বন্দী করে রেখে আপনার আনন্দময় সময় কাটানোর মাঝে তার দুঃখকষ্টগুলো কেমন? বছরের পর বছর ধরে লালন-পালন করার পরেও আপনার পোষ্যপ্রাণীটি সুযোগ পেলে কেন উড়ে বনেই চলে যায়! হাঁটার সময় আমি-আপনি আমরা অনেকেই বিনা প্রয়োজনে গাছের পাতা টেনে ছিড়ে ফেলে দেই। আমরা কি একবারও চিন্তা করে দেখেছি, গাছেরও যে প্রাণ আছে। গাছও আঘাত অনুভব করে!
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেভাবে পাখি শিকার হচ্ছে, যেভাবে বন উজার করা হচ্ছে, যেভাবে সাগর-নদীর গর্ভে পলিথিনে ভরে যাচ্ছে, যেভাবে বিষাক্ত গ্যাস সবুজ বনাঞ্চলকে গ্রাস করছে, কী হবে ভবিষ্যতে? আর কী অপেক্ষা করছে মানবজাতির জন্য? আজ সামান্য করোনাভাইরাসের কারণে পৃথিবীর শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে তৃতীয় বিশ্বের সম্ভাব্য শক্তিশালী দেশ চীনও সময়ের কাছে নিজেদের সপে দিয়েছে। করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য কৌশল অবলম্বন করেছে। আপ্রাণ চেষ্টা করছে এ ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার করতে। কিন্তু এর মাঝেও বিশ্বের বিভিন্ন মসজিদ-মন্দির থেকে স্কুল-কলেজ বন্ধ করা হয়েছে। সৌদি সরকার ওমরাহ হজ্ব পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে। এক দেশের সাথে অন্য দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ, প্রকৃতির কাছে মানব সভ্যতা সত্যিই অসহায়।
তবে ভয়ের কারণ নেই। মানবজাতি অতীতের ন্যায় ঘুরে দাঁড়াবে। খুব শীঘ্রই এই সংকট থেকে বিশ্বমানব সম্প্রদায় উঠে আসবে। আর বাংলাদেশ আমাদের সকলের। আবেগ নয়, বিবেক দিয়ে একটু চিন্তা করুন। গুজব না রটিয়ে, আতঙ্কিত না করে, বিনা কারণে দোষারোপের সমালোচনা পরিহার করে সবাই মিলে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করার জন্য আমাদের সাবধান, সতর্কতা আর পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন করা-একজন সুনাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব পালন করাই হবে দেশাত্মবোধের পরিচায়ক। অযথা মাস্ক, হেক্সাসল, স্যানিটাইজার নিয়ে বাসায় মজুদ করার দরকার নেই। একটা সময় আপনার কোনও আত্মীয়ের বিশেষ প্রয়োজনেও তখন আপনার-আমার তৈরি কার কৃতিম সংকট তার জীবনকে আরও সংকটময় করে তুলতে পারে।
বর্তমান সরকার বেশ সতর্কতার সাথে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় হাসপাতাল, ডাক্তারদের প্রস্তুত রেখেছে। তাদের প্রশিক্ষণও দিয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মুজিববর্ষের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানমালা স্থগিতসহ ছোটও করা হয়েছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সর্বশেষ তথ্য জানুন। প্রথমসারির গণমাধ্যমের তথ্য ছাড়া তথাকথিত গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলুন। গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছাড়া ফেসবুকের তথ্যকে বিশ্বাস করবেন না। আর ফেসবুকে কোনও কিছু ভাইরাল, শেয়ার করার আগে একটু যাচাই-বাচাই করুন। করোনাভাইরাস বা এ নিয়ে বিশেষ কোনও তথ্য জানার প্রয়োজনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হটলাইনে (১৬২৬৩ অথবা ০১৯৩৭০০০০১১, ০১৯৩৭১১০০১১, ০১৯২৭৭১১৭৮৪, ০১৯২৭৭১১৭৮৫) কল করুন। এ বিষয়ে আইইডিসিআর পরিচালক বলেন, 'অসুস্থ কেউ যদি আইইডিসিআর-এর হটলাইনে যোগাযোগ করেন, তাহলে আইইডিসিআর-এর টিম বাড়ি থেকে তার নমুনা সংগ্রহ করবে।'
সঠিক তথ্য-উপাত্ত আর আপনার সচেতনতাই আপনার ও আপনার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। সরকার দেশের প্রতিটি মানুষের পাশে অতন্দ্র প্রহরীর মত আছে। করোনাভাইরাসের ঝুঁকি কমানোর উপায় হচ্ছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার নিয়ম কানুন কঠোরভাবে অনুসরণ করা' ব্রিটিশ লিভার ট্রাস্টের এই কথাটি তুলে ধরে অবশেষে বলব করোনাকে ভয় নয়, বরং নিজের অভ্যাসে সভ্যতা আনুন।
তথ্যসূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিবিসি, আইইডিসিআর