Published : 26 Feb 2020, 01:10 PM
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন বিশ্ব রাজনীতিতে সমাজতন্ত্র শব্দটি আর শোনা যাবে না। সমাজতন্ত্র এবং কমিউনিস্ট পার্টি হবে ইতিহাসের বিষয়।
১৯৯২ সালে ফ্রান্সিস ফুকিয়ামা কার্ল মার্কসের কমিউনিজমে ইতিহাসে অবসান, এ ধারণাকে ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করে লিখলেন তার বিখ্যাত বই, "The End of History and the Last Man"। এতে তিনি বললেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্যে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের চির বিদায় ঘটেছে। ইতিহাসের এখানেই সমাপ্তি। পশ্চিমা উদারনৈতিক গণতন্ত্র এবং পুঁজিবাদই হচ্ছে মানব ইতিহাসের শেষ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
ফুকিয়ামার তত্ত্বে পশ্চিমা এলিটরা খুশি হলেন। তাদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমর্থনে একটা জোরালো তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া গেল। সারা বিশ্বের বামপন্থীদের মাঝে তখন প্রবল হতাশার কাল। কেউ কেউ তারা যাদেরকে বুর্জোয়া দল বলেন, সে সমস্ত দলে ভিড়লেন।
বাংলাদেশের মত দেশগুলিতে যেখানে ডান বাম নির্বিশেষে জ্ঞানচর্চার মানে হচ্ছে পশ্চিম ইউরোপ, আমেরিকা, নিদেনপক্ষে ভারতীয় বুদ্ধিজীবিরা কী বলছেন সেগুলি বোঝার চেষ্টা, সেখানকার বামপন্থীদের অবস্থা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বাম রাজনীতি দুনিয়াতে টিকে থাকবে এটা ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে খুব কম বামপন্থীই বিশ্বাস করতেন; বিশেষতঃ বাংলাদেশের মত বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতার দেশগুলিতে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বামদের অবস্থাও তখন অনেকটা সেরকম। যুক্তরাষ্ট্রে কখনই শক্তিশালী বাম আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। তদুপরি ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কমিউনিস্ট পার্টিকে সব সময় যেতে হয়েছে নানা দমন পীড়নের মধ্যে দিয়ে।
সমাজতন্ত্রের ধারণা কোনো অবস্থায় যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিকাশ না ঘটে, তার জন্য চল্লিশের দশকের শেষের দিকে সিনেটর ম্যাকার্থির প্রস্তাবনায় করা হয় কুখ্যাত ম্যাকার্থি আইন। এ আইন বলে মুক্তচিন্তার দেশ দাবিদার যুক্তরাষ্ট্রে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে বহু অধ্যাপককে মার্কসবাদী তকমা দিয়ে বহিষ্কার করা হয়। নিশ্চিত করা হয় বামপন্থার সাথে যুক্ত কেউ যাতে সরকারি/বেসরকারি চাকুরী না পায়, সে ব্যবস্থাও।
নানা রকম দমন, পীড়ন, হুলিয়া, জেল, জুলুম ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি চেষ্টা করেছে তাদের সংগঠন টিকিয়ে রাখবার। প্রতিকূলতার মাঝেও তারা মাঝখানে পরপর দুইবার বাদ দিয়ে ১৯২৪ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত একটানা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। তাদের সর্বোচ্চ নির্বাচনী সাফল্য ছিল ১৯২৪ সালে। ওই নির্বাচনে দলের প্রার্থী উইলিয়াম ফস্টার প্রদত্ত ভোটের ০.২৬% পান।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এ দলের সামনে আরো দুর্দিন নেমে আসে। দলে দেখা দেয় ভাঙন। ছোট একটা অংশ দল থেকে বেরিয়ে যায়। দলের লাইব্রেরির বিশাল সংগ্রহ একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে দেয়া হয় অর্থ সঙ্কটের কারণে। কিন্তু তারপরেও একটি ক্ষুদ্র দল হিসাবে, নানা অঙ্গ রাজ্যে শাখা বজায় রেখে তারা টিকে থাকতে সমর্থ হয়।
সমাজতন্ত্র এবং কমিউনিজম এ দুটো প্রত্যয় সম্পর্কে মার্কিন জনগণের ধারণা কখনই ভালো ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর সে ধারণা আরো খারাপ হয়। বাংলাদেশে রাজাকার এবং আলবদর শব্দ দুটি যেভাবে ব্যবহার করা হয়, আমেরিকার প্রেক্ষাপটে তা প্রতিস্থাপন করা হলে শব্দ দুটি দাঁড়াবে সমাজতন্ত্রী এবং কমিউনিস্ট। অর্থাৎ, বাংলাদেশে রাজাকার এবং আলবদররা যেমন "অচ্ছুৎ" হিসাবে গণ্য হয়, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কমিউনিস্টরা।
রাজাকার, আলবদররা যেমন পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে, তেমনি কমিউনিস্ট পার্টিকে মনে করা হতো, এরা দেশের স্বার্থের বিপক্ষে যেয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে কাজ করছে। ফলে তাদেরকে সোভিয়েতের এজেন্ট বা দালাল হিসাবে দেখা হতো। এটা বুঝতে পারলে বোঝা যাবে আমেরিকাতে বামদেরকে কী চোখে দেখা হয়।
এ পর্যন্ত এভাবেই চলে আসছিল। সবসময় এভাবেই চলবে বলে অনেকে ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ গোলমাল বাঁধিয়ে দিয়েছেন ভারমন্ট অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত ৭৮ বছর বয়স্ক স্বতন্ত্র সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। তিনি নিজেকে পরিচয় দেন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী হিসাবে।
অনেক ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রীর মত তিনি সমাজতন্ত্র প্রত্যয়টির আগে গণতন্ত্র প্রত্যয় ব্যবহার করেন এটা বোঝাতে যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনের সমাজতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্রের ধারণা আসলে সমাজতন্ত্রের মৌল নীতিরই পরিপন্থী। বামপন্থী চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কিও বিষয়টাকে এভাবেই দেখেন।
নিজেকে প্রকাশ্যে সমাজতন্ত্রী পরিচয় দিয়েই বার্নি একটানা নির্বাচনে জিতে চলেছেন আমেরিকার মত রাষ্ট্রে, যেটা অনেকের কাছেই বিস্ময়কর একটা ব্যাপার। বার্নি ১৯৯১ সালে প্রথম প্রতিনিধি পরিষদে নির্বাচিত হন। মাঝখানে এক টার্ম বাদ দিয়ে ২০০৭ পর্যন্ত একটানা ১৬ বছর প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য ছিলেন তিনি। আর ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ক্রমাগত নির্বাচিত হয়ে আসছেন সিনেটে।
তবে একটা বিষয় বার্নি বুঝতে পেরেছেন, স্বতন্ত্র হয়ে সিনেটে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারলেও তার পক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে আসা সম্ভব হবে না। আবার কমিউনিস্ট পার্টির প্ল্যাটফর্ম থেকে নির্বাচন করলে রাজনৈতিক দৌড়ে ছিটকে পড়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও রাজনৈতিক চিন্তা, চেতনার জায়গার দিক থেকে এ দলটির সাথেই তার সবচেয়ে বেশি সাযুজ্য রয়েছে।
আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যাতে তৃতীয় কোনো দল সেখানে উঠে আসতে না পারে। এ রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে মূলধারার প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।
বাংলাদেশে সিপিবির রুহিন হোসেন প্রিন্স বা গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকী আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতৃবৃন্দের সাথে এক টেবিলে বসে ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে টক শোতে অংশ নেন। মার্কিন প্রেক্ষাপটে কমিউনিস্ট পার্টি তো দূরের কথা, তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের পক্ষে এটা কল্পনাতীত একটা ব্যাপার।
বামদলগুলোর তো প্রশ্নই আসে না, তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক দলের সংবাদও মিডিয়া সাধারণত সেখানে প্রকাশ করে না। এমনকি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সর্বমোট কতজন প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন, সে বিষয়টা পর্যন্ত উল্লেখ করা হয় না।
দুই দলের বাইরে কোনো প্রার্থী যদি শেষ নির্বাচনে ৫% এর কম ভোট পান, তার নাম যেমন ব্যালটে থাকে না, তেমনি তাকে ডাকাও হয় না টেলিভিশন বিতর্কে। বস্তুত এ কারণে কমিউনিস্ট পার্টি বা অন্য কোনো বাম দলের টিকেটে প্রার্থী না হয়ে বার্নি বেছে নিয়েছেন ডেমোক্র্যাটিক দলের প্ল্যাটফর্ম।
আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টির নীতি, আদর্শ, কর্মসূচিই বার্নি অবলীলায় বলে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। বার্নির কৃতিত্ব এ জায়গাটিতে যে, যে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমেরিকা এতকাল ধরে লড়াই করে এসেছে, সে সমাজতন্ত্রকেই তিনি জনপ্রিয় করে ফেলেছেন জনগণের একটা বড় অংশের কাছে।
যেটা কমিউনিস্ট পার্টি একশ বছর ধরে করতে পারেনি, সেটা করতে পেরেছেন বার্নি। তিনি চাচ্ছেন সিস্টেম বা ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই ব্যবস্থাকে আমূল বদলে দিতে। পুঁজিবাদী আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটাতে।
বার্নি মনোনয়ন চেয়েছিলেন ২০১৬ সালেও। তখন তাকে ঠেকাবার জন্য সামনে আনা হয়েছিল তার ধর্ম বিশ্বাসের বিষয়টি। সিএনএনের মত মূলধারার মিডিয়া তুলে ধরে যে, বার্নির প্রচলিত কোনো ধর্মে বিশ্বাস না করবার বিষয়টি।
ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণকারী শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বার্নি ছাত্র থাকাকালীন সময়ে প্রভাবিত হন কার্ল মার্কস, ট্রটস্কি এবং আমেরিকান সমাজতন্ত্রী ইউজিন ভি ডেবসের চিন্তাধারা দ্বারা।
মার্কসের মত বার্নিও বিশ্বাস করেন না প্রতিষ্ঠিত কোনো ধর্মে। তবে মার্কসের মত তিনিও মনে করেন প্রত্যেক ব্যক্তির তার নিজ নিজ ধর্ম পালন করবার বা না করবার স্বাধীনতা থাকা উচিৎ। মার্কসের মত তিনিও এমন এক বিশ্বের স্বপ্ন দেখেন, যেখানে প্রত্যেক অবাধ বিকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে, প্রত্যেকের অবাধ বিকাশের স্বার্থেই।
বার্নি নিজেকে নাস্তিক বলে পরিচয় দেন না খুব সম্ভবত মার্কিন রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে। আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা সেক্যুলার উদারনৈতিক না হয়ে খ্রিস্ট ধর্ম প্রভাবিত হবার ফলে, মার্কিন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একজন নাস্তিকের পক্ষে নির্বাচনে জিতে আসা অনেকটাই অসম্ভব।
এ অর্থে রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিক থেকে ভারত বা ইউরোপ যতটা উদার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ততটা নয়। কেননা, সেসব জায়গায় প্রকাশ্যে নাস্তিক পরিচয় দিয়েই অনেক রাজনীতিবিদকে নির্বাচিত হয়ে আসতে দেখা গেছে। ভারতে অনেক বাম রাজনীতিবিদকে ফরমে ধর্মের জায়গায় নাস্তিক লিখতে দেখা যায়।
ধর্ম বিশ্বাসের দিক থেকে বার্নি নাস্তিক বা নাস্তিকতার কাছাকাছি। তার চেয়েও বড় ব্যাপার তিনি সমাজতন্ত্রী। বার্নি যখন এবার আবার ডেমোক্র্যাটিক পার্টি থেকে মনোনয়ন চাইলেন, পার্টির নীতি নির্ধাকরা ধরে নিয়েছিলেন এরকম প্রোফাইলের অধিকারী একজনের পক্ষে অঙ্গরাজ্যে জিতে আসা সম্ভব হলেও জাতীয় রাজনীতিতে উঠে আসা সম্ভব হবে না।
বার্নির সমাজতন্ত্রের আবেদন ইতিমধ্যে যে সমাজের এতটা গভীরে পৌছে গিয়েছে সেটা তারা বুঝে উঠতে পারেননি। তারা ধরে নিয়েছিলেন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সহজেই উঠে আসবেন। এছাড়া রয়েছেন নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গের মত বিত্তশালী হেভিওয়েট প্রার্থী। এদের পাশে তো সমাজতান্ত্রিক বার্নির পাত্তা পাবারই কথা না। কিন্তু বিপত্তি দেখা গেল আইওয়া ককাসে। উল্লেখ্য, আইওয়া ককাসে যিনি জয়লাভ করেন, তিনি সাধারণত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন।
আইওয়া ককাসে যখন দেখা গেল বার্নি জিতে যেতে পারেন, তখনই বাংলাদেশ স্টাইলে ভোটের ফলাফল আটকে দেওয়া হল। বার্নির মত একজন সমজাতন্ত্রী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হবেন এটা মেনে নেয়া এ দলটির পক্ষে অনেকটাই অসম্ভব। এ দলটি সব সময়ই সোচ্চার থেকেছে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। শীতল যুদ্ধের সময় দলটি জোরালো ভূমিকা রেখেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। তাই বার্নিকে ঠেকানো তাদের জন্য জরুরি হয়ে উঠেছিল।
৩ ফেব্রুয়ারি সোমবার ককাসের ভোট হয়ে যাবার পর যখন অনেকের মনে হচ্ছিল বার্নি জিতে যেতে পারেন, তখন সবাইকে স্তম্ভিত করে অ্যাপের কারিগরি ত্রুটির কথা বলে ভোট গণনা স্থগিত করে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, পুরো ককাসের ভোট দুই হাজারের কিছু বেশি।
ভোট স্থগিত করবার ফলে দলটির নীতিনির্ধাকদের উপর চাপ বাড়তে থাকে। ফলে এর পরদিন মঙ্গলবার রাত নয়টা নাগাদ ৬২ শতাংশ ভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। তাতে দেখা যায়, বার্নি পেয়েছেন বা তাকে দেয়া হয়েছে ২৫.১% আর পিটার বুটিগিয়েগকে ২৬.৯%। তারপর বুধবার রাতে ৮২ শতাংশ এবং শেষ পর্যন্ত শুক্রবার বিকাল চারটা নাগাদ ৯৯ শতাংশ ভোটের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, বুটিগিয়েগ পেয়েছেন ৫৬৪ (২৬.২%) এবং বার্নি ৫৬২ (২৬.১%)।
দলীয় নির্বাচনগুলিতে কারচুপি, প্রহসনের যে সমস্ত বিষয় আমরা বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্ব বলে পরিচিত দেশগুলিতে দেখি, তার নজির এবার দেখাল আমেরিকার ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। অর্থাৎ, নিজেদের স্বার্থের বাইরে গেলে শুধু বাংলাদেশের মত দেশগুলিতেই নয়, আমেরিকার মত গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার দাবিদার দেশেও রাজনৈতিক দলগুলি যে অগণতান্ত্রিক আচরণ করতে পারে, ডেমোক্র্যাটিক পার্টির আইওয়া ককাস সে বিষয়টাই তুলে ধরল।
আইওয়া ককাসে বার্নিকে কোনো রকমে ঠেকানো গেলেও, ঠেকানো যায়নি নিউ হ্যাম্পশায়ারে। সেখানে বুটিগিয়েগকে পিছনে ফেলে তিনি বিজয়ী হয়ে উঠে এসেছেন। সর্বশেষ নেভাদাতেও তিনি জয় পেয়েছেন এবং সেটা আরো বিপুলভাবে। বুটিগিয়েগ সেখানে নেমে এসেছেন তৃতীয় স্থানে।
বার্নির ক্রমাগত বিজয় আমেরিকার পুঁজিবাদী এস্টাবলিস্টমেন্টকে এক চরম অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। বার্নির এ অগ্রযাত্রা উদ্যোক্তা শ্রেণির মাঝে তৈরি করেছে আতঙ্ক। অনেকের কাছেই মনে হচ্ছে, বার্নিই শেষ পর্যন্ত ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী হতে যাচ্ছেন। কী করে তার বিজয়ের রথযাত্রা থামিয়ে দেওয়া যায় এ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা পরিকল্পনা। এরই অংশ হিসাবে অভিযোগ তোলা হয়েছে, রাশিয়া বার্নিকে সাহায্য করছে নির্বাচনে জিতে আসবার ব্যাপারে।
এদিকে এক সমাজতন্ত্রীকে ঠেকাতে যেয়ে বেঁধেছে আরেক বিপত্তি। বুটিগিয়েগ হলেন সমকামী। খ্রিস্ট ধর্ম প্রভাবিত মার্কিন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একজন সমকামীর জিতে আসবার কোনো সম্ভাবনা নেই। এটি হবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে খোলা মাঠে গোল দেবার সুযোগ করে দেওয়া।
সবকিছু মিলে ট্রাম্প রয়েছেন ইংরেজিতে যাকে বলে Win Win অনেকটা সে অবস্থায়। বুটিগিয়েগের এর জায়গায় বার্নি প্রার্থী হলে তিনি বলবেন বার্নি কমিউনিস্ট। এতেই হল। আর অন্য কিছু বলতে না পারলেও হবে। যেমন বাংলাদেশে কাউকে নাস্তিক বলে দিলেই হল, অনেকটা সেরকম।
আর কমিউনিস্টদের নাস্তিক ঘোষণা দিয়েই আমেরিকাকে সেক্যুলার রাষ্ট্র না বানিয়ে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে দেশটিতে খ্রিস্ট ধর্মালম্বী ব্যতিরেকে অন্য কোনো ধর্মালম্বীদের ধর্মীয় উৎসবে যেমন সরকারি ছুটি থাকে না, তেমনি প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে সব নির্বাচিত প্রতিনিধিরই ধর্মগ্রন্থের উপর হাত রেখে শপথ নিতে হয়।
ঈশ্বরের নাম নিয়েই এ দেশটির প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে হয়। প্রতিটি ডলারের নোটে আমেরিকাবাসী যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, সেটি মুদ্রিত করা হয়েছে। স্মরণযোগ্য যে, মার্কিন অনুসরণে স্বৈরশাসক এরশাদও চেয়েছিলেন টাকার প্রতিটা নোটে আল্লাহর নাম মুদ্রিত করতে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি স্তরের নির্বাচিত প্রতিনিধি তাদের বক্তৃতা শেষ করেন ঈশ্বরের নাম নিয়ে। অর্থাৎ, তুলনার বিচারে যুক্তরাষ্ট্র অপেক্ষা বাংলাদেশ অধিক সেক্যুলার রাষ্ট্র। আর এ কারণেই মার্কিন নেতৃবৃন্দকে বিশ্বের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার নিয়ে যতটা উচ্চকণ্ঠ দেখা যায়, সেক্যুলারিজমের প্রশ্নে তারা ততটাই মৌন থাকেন।
বার্নির কৃতিত্ব এ জায়গাটিতেই যে, তিনি এত বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত ধর্মভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে, সেক্যুলার সমাজতন্ত্রী নামাবলী গায়ে দিয়েই উঠে আসছেন। এখন প্রশ্ন হল, বার্নির সমাজতন্ত্রের শ্লোগান কি সাময়িক আবেগ, না কি এ ধারাটিই ক্রমশ হয়ে উঠবে আমেরিকার মূলধারা? বস্তুত, এ মুহূর্তে এটি একটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বব্যাপী যে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল তা উবে যেতে বেশি সময় লাগেনি, গণমানুষের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক আশা আকাঙ্খাকে এ ব্যবস্থা ধারণ করতে ব্যর্থ হবার ফলে।
এ সময়কালে মুসলিম বিশ্বের অনেকের কাছে "ইসলামপন্থার" রাজনীতির প্রতিও একটা ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু নানাবিধ কারণে এ রাজনীতিও তার আবেদন ধরে রাখতে পারেনি। তরুণ সমাজের কাছে মনে হয়েছে, এ রাজনীতি অন্যান্য ধর্মালম্বী তো বটেই, এমনকি মুসলমানদের সকলকেও এর পতাকাতলে অন্তর্ভুক্ত করতে অক্ষম। উদাহারণস্বরূপ বলা যায়, শিয়া "ইসলামপন্থীরা" সুন্নীদের এবং সুন্নীরা শিয়াদের তাদের পতাকাতলে ঠাই দিতে নারাজ।
সুন্নী "ইসলামপন্থা" যেহেতু ওহাবী চিন্তাধারা নির্ভর, তাই তারা সম্ভব হলে যেন অন্য ঘরানার সুন্নীদেরকেও মুসলমান না বলতে পারলেই খুশি হয়। পাশাপাশি ধর্মের বাতাবরণে "ইসলামপন্থীরা" নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে দেখতে ইচ্ছুক। এ বিষয়টাও অনেকের "ইসলামপন্থার" রাজনীতির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং আদর্শের প্রতি এক ধরণের নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দিয়েছে।
পুঁজিবাদ এবং "ইসলামপন্থার" রাজনীতির ব্যর্থতা আবার নতুন করে সমাজতন্ত্রের প্রতি অনেকের মাঝে আগ্রহ তৈরি করছে। আগ্রহের মূল কারণ, এ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মতবাদ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে এর পতাকাতলে অন্তর্ভুক্ত করে সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ নতুন আগ্রহকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের দ্বিতীয় প্রবাহ বলা যাতে পারে। আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় দ্বিতীয় প্রবাহের ভ্রূণাবস্থা।
প্রথম প্রবাহের সাথে দ্বিতীয় প্রবাহের বড় দাগের একটা পার্থক্যের দিক হলো খোদ যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মাঝে এ বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হওয়া। এ আগ্রহ জাগিয়ে তুলবার মূল কারিগর হলেন বার্নি। প্রথম প্রবাহে কিছু ব্যতিক্রম বাদে আমেরিকার জনগণের সমাজতন্ত্র সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব ছিল।
বার্নির জাগিয়ে তোলা এ আগ্রহ সাময়িক না দীর্ঘস্থায়ী হবে সেটি নির্ভর করছে সমাজতন্ত্রের প্রথম প্রবাহে উদ্ভূত দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দ্বিতীয় প্রবাহে বামপন্থীরা কিভাবে মোকাবেলা করবেন তার উপর।
প্রথম প্রবাহে সমাজতন্ত্র মানে ছিল একনায়কতান্ত্রিক/একদলীয় শাসন আর আমলাদের ব্যবস্থাপনায়, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে অর্থনীতি পরিচালনা। সেই পুরানো মডেলকেই যদি বামপন্থীরা সমাজতন্ত্র বোঝেন, তাহলে এটা নিশ্চিত যে, বর্তমানে তাদের কোনো ভবিষ্যত নেই।
বার্নি ইতিমধ্যে স্পষ্ট করেছেন তিনি গণতন্ত্রী। এ বিষয়ে কারো অবশ্য কোনো সন্দেহ নেই, যদিও তিনি পরিস্কার করতে পারেননি, বহুদলীয় গণতন্ত্রে তিনি কিভাবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন। তার কল্যাণমূলক অর্থনীতির ধারণার সাথে কোনো বিবেকমান মানুষের দ্বিমত থাকবার কথা না। কিন্তু, এখানেও তিনি পরিষ্কার করতে পারেননি, আমলাদের হাত থেকে বের করে বাস্তবে তিনি কীভাবে অর্থনীতিকে জনগণের নিয়ন্ত্রণে আনবেন।
বস্তুত এ দুটো প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত উত্তরের উপর নির্ভর করছে দ্বিতীয় প্রবাহের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনে এগোতে পারবার বিষয়টি। অতীতের রোমান্টিকতা আর আবেগ মুক্ত হয়ে এ দুটো প্রশ্নের সঠিক উত্তর নির্ধারণ করতে পারলে গত শতাব্দীর মধ্য ভাগের মত এ শতাব্দীও হবে বামপন্থীদের শতাব্দী। আর সমাজতন্ত্রের এ দ্বিতীয় অভিযাত্রায় বামপন্থীরা সাথে পাবেন মার্কিনিদেরও।
কিন্তু বর্তমান বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে, শুধু অতীতমুখীতা আর আবেগ নির্ভর হয়ে আন্দোলন দাঁড় করাবার চেষ্টা করলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামজতন্ত্র সম্পর্কে যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে, তা উবে যেতে সময় লাগবে না।