Published : 20 Feb 2020, 08:25 PM
পৃথিবীর প্রায় ২৮ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলা ভাষার স্থান সপ্তম। বাংলা ভাষার ঐতিহ্য এবং সাহিত্যসম্ভারও বিপুল। অথচ নতুন প্রজন্ম বাংলাভাষার প্রতি উৎসাহী ও মনোযোগী নয়। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে এই বিষয়টি নতুন করে পীড়া দিয়ে যায়।
একটি ভাষার বেড়ে ওঠা, প্রচার-প্রসারের পেছনে বহু ত্যাগ থাকে, থাকে সীমাহীন শ্রম, সাধনা। বাংলা ভাষার জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি বিবর্তন সেই সাক্ষীই বহন করে। ১৯৫২ সালে ২১ ফ্রেবুয়ারি বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছে। সালাম, বকরত, রফিক, শফিউর, জব্বারের সঙ্গে কিশোর অহিউল্লাহও শহিদ হয়েছেন। এরপর দীর্ঘদিনের সংগ্রামের পথ ধরে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে। আর জাতিসংঘ ২১ ফ্রেবুয়ারিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বাংলাভাষা আমাদের অত্যন্ত আবেগ ও মর্যাদার ধন। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাভাষা ক্রমেই মর্যাদা হারাচ্ছে। একটু আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন পরিবার তাদের সন্তানকে বাংলা মাধ্যম স্কুলে বর্তমানে ভর্তি করান না। শহরে-নগরে তো বটেই, শহরতলি এমনকি গ্রামে-গঞ্জে পর্যন্ত বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি শিক্ষার্থীসংকটে ভুগছে। মফস্বলে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থাবা বসিয়েছে। গরিব, প্রান্তিক পরিবারের সন্তানেরা শুধু এখন বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ে। অর্থনৈতিক সঙ্গতিসম্পন্ন ও অভিজাত বাঙালি পরিবারে বাঙালিয়ানা আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে ইংরেজির দাপট। এমনকি, রেডিও-টেলিভিশন, নাটক, টকশো, সভা-সেমিনারে বর্তমানে ইংরেজির দাপট বাড়ছে। বাংলা ক্রমেই হয়ে পড়েছে গরিবের ভাষা।
আমাদের মানসিকতা, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের অভাব তো আছেই, পাশাপাশি এর প্রধান কারণ চাকরি। এখন ভালো ইংরেজি না জানলে চাকরি পাওয়া যায় না। সরকারি চাকরির বাজার ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। উদার অর্থনীতির এই যুগে বিভিন্ন দেশি বিদেশি কোম্পানি ভিড় জমাচ্ছে। জীবিকার প্রয়োজনে সচেতন বাঙালি অভিভাবক সমাজ তাঁদের সন্তানদের আর বাংলা মাধ্যমের স্কুলে পড়াতে বিশেষ আগ্রহী নন। বহু ছেলেমেয়েরই এখন প্রধান ভাষা বাংলা নয় ইংরেজি। ফলে বহু বাঙালি ছেলেমেই এখন বাংলা বললেও লিখতে-পড়তে পারে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরা বাংলা লিখে রোমান হরফে। যা সত্যিই এক বিস্ময়কর প্রয়াস! অথচ এমনটি হওয়ার তো কথা ছিল না। কোনও একটি ভাষায় বিশেষ পারদর্শী হতে গেলে অন্য ভাষাকে অবহেলার প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশে এখনও বহু মানুষ আছেন যারা বাংলা, ইংরেজি, দুটোই ভালো জানেন। তারপরও আমাদের দেশে মাতৃভাষা চর্চা নিয়ে এক ধরনের উন্নাসিকতা রয়েছে।
বর্তমানে বাংলা চর্চার যে অবস্থা তাতে, বাংলা ভাষা অস্তিত্বের সঙ্কটে না পড়লেও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠার যথেষ্ট কারণ আছে। দুটি দিক থেকে বিপদ তৈরি হয়েছে। এক দিকে, সমাজের ক্ষমতাবান শ্রেণির বাংলাচর্চা পরিত্যাগ ও প্রায় একক ভাষা হিসাবে ইংরেজি চর্চা ও ব্যবহারের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। দ্বিতীয় দিকটি হচ্ছে, বাংলা ভাষা ক্রমেই এক ধরনের বিকৃতি ও একটি ক্ষয়ের পর্ব অতিক্রম করছে। কথ্য বাংলা একদিকে আঞ্চলিকতায় পীড়িত, অন্যদিকে, ইংরেজি শব্দের অপপ্রয়োগে ভারাক্রান্ত। পাশাপাশি চলছে বিকৃতি। এফএম রেডিওর হাত ধরে এই বিকৃতি শুরু হলেও এখন তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, এমনকি টেলিভিশনেও ছড়িয়ে পড়েছে। ভাষার প্রতি অনীহা এবং অশ্রদ্ধা থেকেই এই বিকৃতি।
ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি বিকৃতি দেখা যায় 'র' এবং 'ড়' ব্যবহারের ক্ষেত্রে। আমরাকে 'আমড়া', বাড়িকে 'বারি', পরাকে 'পড়া', ঝড়কে 'ঝর', ঝরছে-কে 'ঝড়ছে'। এছাড়া ভার্চুয়াল জগৎ থেকে যেন 'ছ' নামের বর্ণটি হারাতে বসেছে। বলছে হচ্ছে 'বলসে', খেয়েছে বা খাচ্ছে-কে—খাইতাসে, আসছে-কে বলা হচ্ছে আইসে, যাচ্ছে—যাইতাসে। শব্দের সংক্ষিপ্তকরণ করতে গিয়েও বিকৃতি। ঘটছে। 'মন চায়' লেখা হয় 'মুঞ্চায়', আমাকে হয়ে গেছে 'আম্রে'। এছাড়া পোস্ট করা বা লেখাকে পোস্টানো, প্লাসকে পিলাস ইত্যাদি তো আছেই।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা নিরক্ষর-অর্ধ শিক্ষিতদের ব্যঙ্গ করতে গিয়ে এখন নিজেরাই উপহাসের পাত্রে পরিণত হতে চলেছে। তারা বেশ আনন্দ চিত্তে মজা করেই লিখে থাকে ফডু, খিচ্চা, গেবনে, হপে, খিচাইছে এমন সব উদ্ভট শব্দ। মাইন্ড খাইস না, সেইরাম ব্যাপুক বিনুদুন, কাইলকা পরীক্ষা, কিছুই পড়িনাইক্যা, আমারে তুইল্যা নাও, নয়তো উপ্রে থেইক্যা দড়ি ফেলাও, তুমি আবার ভাব মারাস, বেসম্ভব, নাইচ, কিন্যা, গেসে, দ্যাশ, ভাল্যাগসে, মাইরালা প্রভৃতি। আজিব, কুল, মাম্মা, আবার জিগায়, দূরে গিয়া মর, জিনিস, বিন্দাস, রক্স, অসাম, বেইল নাই, অফ যা, ধরে দেবানি, এইডা কিছু হইল, মজা লস, কেউ আমারে মাইরালা, পুরাই অস্থির, ঠিকাসসসে ভায়াআআ, লোল, ওয়াও, ক্র্যাশ, উরাধুরা, পুরাই টাশকি, প্যারা নাই, ফাঁপর লয় ইত্যাদি বিকৃত, দুর্বোধ্য এবং অবোধ্য শব্দের ব্যবহার বাড়ছে। এই বাংলা শব্দ ও বাক্যগুলোকে মজার ছলে বা নিজের অজান্তেই ব্যবহার করছেন অনেকেই। ফলে সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলা ভাষার এমন বিকৃত রূপ প্রায় নিয়মে এসে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধু বাড়ছেই না। বরং নতুন নতুন ঢঙে বিকৃত হচ্ছে মৌলিক বাংলা শব্দগুলো। ভাষার এই বিকৃতি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধরেই নেবে যে এটাই বাংলা ভাষা!
শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, শিক্ষকরাও অবক্ষয়গ্রস্ত হয়ে পড়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, এক সময় প্রত্যন্ত গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকেরাও বাংলা ইংরিজি সংস্কৃত ভাষায় সমান দক্ষ ছিলেন। ছাত্র গড়তে তাঁরা ছিলেন দিকপাল। বিজ্ঞান বা অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করলেও ভাষাচর্চা তখন ছিল বাধ্যতামূলক। এখন শিক্ষাদানে শুধু নয়, শিক্ষা পদ্ধতিতেও ঘটে গেছে বিরাট বিবর্তন। তৈরি হয়েছে দুটো শ্রেণি-ইংরেজি স্কুলে পড়া বাংলা লিখতে পড়তে না জানা 'স্মার্ট' প্রজন্ম এবং বাংলা মাধ্যমে পড়া ইংরেজিতে দুর্বল লজ্জিত, কুণ্ঠিত প্রজন্ম। মার্কেটে, প্রযুক্তিতে, দক্ষতায় ইংরেজি জানা প্রজন্ম এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাওয়ালারা পিছিয়ে পড়ছে।
এর কারণ বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চার কোনও ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা সৃষ্টি হয়নি। অনেকের প্রশ্ন, আমাদের বাংলা ভাষা এখন যে অবস্থায় আছে তাতে পৃথিবীর জ্ঞানচর্চার অনায়াস বাহনে রূপান্তর কী সম্ভব? না কি এই ভাষার যা ক্ষমতা তাতে সাম্প্রতিক জ্ঞানচর্চার এক ভাসা-ভাসা তরলীকৃত আভাসমাত্র দেওয়া যেতে পারে? বিশেষজ্ঞদের মত হলো, বাংলায় জ্ঞানচর্চার ভাষার অস্তিত্ব যেটুকু আছে তা নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই। এই ভাষায় পৃথিবীর সাম্প্রতিকতম জ্ঞানচর্চার কোনও ধারণা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সামান্য কিছু আভাসমাত্র পাওয়া যেতে পারে।
একজন প্রাবন্ধিক যথার্থই বলেছেন, ''যে ভাষায় জ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়, সেই ভাষা-গোষ্ঠীর মানুষদের জীবন ও চিন্তা, যে-ভাষায় এটা সম্ভব তাদের চেয়ে ভিন্ন হবে। জ্ঞানচর্চার ভাষার দৈন্য প্রতিফলিত হবে চিন্তার ক্ষেত্রেও, দেখা যাবে চিন্তার দৈন্য। যে চিন্তার ভাষা নেই, সেই চিন্তাও সম্ভব নয়। বাংলাভাষাভাষী মানুষদের ক্ষেত্রে এই চিন্তার দৈন্য অত্যন্ত প্রকট। বাঙালি লেখক হিসেবে কাব্য, উপন্যাস লিখতে যতটা আগ্রহী, নিজের ভাষায় মৌলিক চিন্তাসমৃদ্ধ জ্ঞানচর্চায় ততটাই অনাগ্রহী। এত পরিশ্রমও বাঙালির ধাতে সয় না। তাই বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে কোনও রকম ধারাবাহিকতাই খুঁজে পাওয়া শক্ত। কারণ এখানে জ্ঞানচর্চার কোনও ভাষাই তৈরি হয়নি। আরও সঠিক ভাবে বলতে গেলে জ্ঞানচর্চার ভাষার যে অস্তিত্ব আছে, তা অত্যন্ত অপর্যাপ্ত ও প্রাথমিক স্তরের। সুতরাং চিন্তার ক্ষেত্রেও এর প্রতিফলন হতে বাধ্য। বাংলা ভাষাভাষীদের চিন্তার গুণগত মান প্রাথমিক স্তরেই থেকে যাবে।"
সত্য কথাটা হল, জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে শুধু বাংলা ভাষাকে অবলম্বন করে যে খুব একটা এগোনো যাবে না, এটা মোটামুটি সকলের জানা হয়ে গেছে। জ্ঞানচর্চা করতে হলে বাঙালিকে আরও একটি ভাষা ভালোভাবে জানতে হবে, এটাই সকলে মেনে নিয়েছেন। বাংলা ভাষা যাঁদের একমাত্র অবলম্বন তাঁদের যে গাড্ডায় পড়ে থাকতে হবে এ ব্যাপারেও আর কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে মাতৃভাষা বাংলা হওয়ায় কী লাভ হলো আমাদের?
মাতৃভাষা নিয়ে আমাদের সামগ্রিক হতাশার মধ্যে এ বছরের অস্কার পুরস্কার আশাবাদী করে তুলেছে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি লস অ্যাঞ্জেলসে অনুষ্ঠিত হয়েছে পৃথিবীর সবথেকে বড় অ্যাওয়ার্ড শো, ৯২ তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড অর্থাৎ অস্কার। যেখানে সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে শ্রেষ্ঠ পরিচালক, অরিজিনাল স্ক্রিনপ্লে এবং এই বছরের শ্রেষ্ঠ ছবির তকমা পেয়েছে কোরিয়ান ছবি প্যারাসাইট। এই প্রথমবার ইংরেজি ভাষা ছাড়া, কোনো অন্য ভাষার ছবি বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে এতটা সম্মানিত হয়েছে। এই ছবির সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তিই কোরিয়ান ছাড়া কোনো ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ নন। সেই কারণেই মঞ্চে তাদের জন্য সর্বক্ষণ উপস্থিত ছিলেন একজন অনুবাদক বা দোভাষী। সুতরাং, এমন একটি গৌরবের মুহূর্তকে আপন করার পর তাদের কণ্ঠে ঝরে পড়া কৃতজ্ঞতা এবং আনন্দের ভাষা বুঝতেও কারোর কোনো অসুবিধা হয়নি, কোনো বাধা ছিল না।
আদতে, বাধাটা কোথাওই নেই। আছে আমাদের মনে। আমাদের চিন্তায়, মানসিকতায়, হীনমন্যতায়। এই হীনমন্যতাটা বাঙালি জাতির মধ্যেই সবচেয়ে বেশি জোরালো। এই মানসিক সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে। বর্তমান যুগে সকল দ্বার রুদ্ধ করে বাঁচা সম্ভব নয়। তার প্রয়োজনও নেই। শুধু দরকার একটু মেলবন্ধনের। ইংরেজি ভাষা শেখার প্রয়োজন কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, তার দরকারও নেই। ইংরেজি থাকুক কাজের ভাষা হিসেবে, অর্থ উপার্জনের ভাষা হিসেবে। সঙ্গে বাংলা ভাষা থাকুক আমাদের সকলের আন্তরিক চর্চায় —আমাদের খুব ভালোবাসার, আবেগের ভাষা হয়ে।