Published : 06 Feb 2020, 04:42 PM
এ উপমহাদেশে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সমাজ সংসার এবং বৃহত্তর সভ্যতা বিনির্মাণে নারী ও পুরুষের সমগুরুত্ব সম্যকভাবে বোঝাতে একটি গাড়ি চলার জন্য দুটি চাকার সমান ভূমিকার কথা বলেছিলেন। সেটাও বহুবছর আগে। কিন্তু সেটা যে নারী-পুরুষকে সমান চোখে দেখবার জন্য প্র্যাগমেটিক এবং মানবিক তেমন উদাহরণ খুব একটা মেলে না। কবি নজরুলের কথা- ''এ বিশ্বে যা কিছু মহান চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার গড়েছে নারী অর্ধেক তার নর'' যেমন নারী-পুরুষকে মহান এক ভূমিকায় দেখতে শেখায় তেমনি বেগম রোকেয়ার কথাও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়-নারী ও পুরুষের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানের গুরুত্বও।
নারীর অন্যন্য ভূমিকার অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয়তার কথা বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক নেপোলিয়ন বোনাপার্টও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন। তিনি বলেছেন- সুসভ্য ও শিক্ষিত জাতি গঠনে নারীর ভূমিকার কথা। শুধু কাব্য-সাহিত্যে খুঁজলেই এমনতরো আরও অনেক বলিষ্ঠ উচ্চারণ পাওয়া যাবে, যা নারীকে পুরুষের সমান সক্ষমতায়, মর্যাদায়, ক্ষমতায়, প্রয়োজনীয়তায় দেখতে সাহায্য করে।
আমরা প্রত্যেকেই আজ যে যতদূর এসেছি, সেখানে মায়ের, বোনের এবং জীবনসঙ্গীনির ভূমিকাকে মূল্যায়ন করলেই নারীর অন্যন্যতা পরিদৃষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু এতোসব জ্বাজ্বল্য দৃষ্টান্ত এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সত্ত্বেও মায়ের, বোনের, কন্যার, ভগ্নির একি দূর্দশা আজ! দিকে দিকে শুধু আহত, বিধ্বস্ত আর অধস্তন নারীর মুখ! তাহলে নরীর অধিকার, মর্যাদা আর অবস্থানগত পরিবর্তনে জন্য গৃহিত হাজার রকম চেষ্টা কি ব্যর্থ হলো তবে? আমরা কি তাহলে নারীর ক্ষমতায়ন বা ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত না করেই তথাকথিত উন্নয়নের গাড়ি জুড়েছি, যার দুটি চাকা অসমান?
এই প্রেক্ষাপটে আসুন আবারও স্মরণে নেওয়া যাক বেগম রোকেয়ার সেই বিখ্যাত তত্ত্বটি। তার বক্তব্য ছিল- কোনও শকটের (গাড়ির) দুটি চাকা যদি সমান না হয়, তাহলে সেই গাড়ি চলতে পারে না। অসমান চাকা নিয়ে গাড়িটি চালাতে গেলেই সেটি একই চক্রে শুধু ঘুরপাঁক খেতে থাকবে। এ তত্ত্বে তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন- এই আমরা যে দুটি চাকায় ভর করে সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের গাড়িটি চালাচ্ছি বা চালাতে চাচ্ছি সেটা তো সামনে এগোতে পারবে না!
কারণ, তার দুটি চাকা অর্থাৎ নারী ও পুরুষ ভীষণভাবে অসমান। তার নিবেদন ছিল- যদি সত্যিকার অর্থে আমরা সামনে এগুতে চাই, তাহলে, সর্বাগ্রে নারী-পুরুষকে সমানভাবে সক্ষম করতে হবে, এগিয়ে যাবার অনুকূল পরিবেশ দিতে হবে। তাছাড়া সমঅধিকারভিত্তিক প্রগতি অসম্ভব। ঠিকই, এতো বছর পরেও বিদ্যমান বাস্তবতা বলছে- আমরা ওই কথার অর্থ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি। উন্নয়ন চিন্তক এবং নীতি-নির্ধারকরা যদি সে কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পারতেন তাহলে- নারীকে অধিকারে, সম্মানে আর সক্ষমতায় পুরুষের সমহিস্যা দিতে সেভাবেই উদ্যোগ নিতেন। কিন্তু আজ অবধি তেমন মৌলিক উন্নয়ন উদ্যোগ কী নেওয়া সম্ভব হয়েছে? যে সকল উদ্যোগ এ লক্ষ্যে গৃহিত হয়েছে সেগুলো মূল সমস্যা অর্থাৎ পুরুষতন্ত্র এবং সনাতনী সামাজিক মানসকে দূর করার বা চ্যালেঞ্জ করার বদলে বরং পাশ কাটানোর প্রবণতাই দেখা গেছে।
ভাবে ভঙ্গিতে মনে হয়েছে ওইসকল মূল সমস্যা জিঁইয়ে রেখেই নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বহুমাত্রিক বৈষম্য দূর হয়ে যাবে। ফলে যা হবার তাই হয়েছে, তার অবধারিত ফলও আমরা পাচ্ছি। সমঅধিকার, মর্যাদা ও ক্ষমতায়নের মতো অতি আবশ্যিক বিষয়ে নারীর জীবনে যে অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা তৈরি হয়েছে তা অতীতের যেকোনও সময়কেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নারী আজ সর্বদায় আতঙ্কগ্রস্ত, নারীদের জীবনে নিত্যই তৈরি হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত সব ঘটনা।
বিভিন্ন মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতার যে চিত্র উঠে আসছে তা শুধু আতঙ্কিতই করে না বরং জাতীয় অগ্রগতির প্রশ্নে অত্যন্ত হতাশাব্যাঞ্জক। এক্ষেত্রে কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরছি-
গত ২০১৯ সালে এক হাজার ৭০৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার ২৩৭ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৭৭ জনকে। ধর্ষণের ঘটনায় আত্মহত্যা করে ১৯ জন। এছাড়া ২৪৫ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে আর সব মিলিয়ে সারাবছরে ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় ৪ হাজার ৬২২ জন নারী ও শিশু।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদ ১৪টি দৈনিক পত্রিকা সংবাদ বিশ্লেষণ করে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। পরিষদের এক বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, গত বছর শ্লীলতাহানির শিকার হয় ৯১ জন। যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ১৮৫ জন। পাচার করা হয়েছে ১৭ জন নারী ও শিশুকে। এর মধ্যে যৌনপল্লীতে বিক্রি করা হয় ৭ জনকে। অ্যাসিড আক্রমণের শিকার হয় ২৪ জন। বিভিন্ন কারণে ৬৩২ জন নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে ২৬৪ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। ২৮৭ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। ফতোয়ার শিকার হয় ২৪ জন। বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে ৯৭টি ও বাল্যবিবাহ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে ১৬৯ জনকে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে গত বছর প্রথম ছয়মাসে ৬৩০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এ সময় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৭ নারীকে। আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতন, অ্যাসিড নিক্ষেপসহ নারী নির্যাতনের এমনসব ঘটনা শুধুই বেড়েছে। এছাড়া গত কিছুদিন আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর (বিবিএস) জাতীয় পর্যায়ের এক জরিপে নারীর প্রতি সংঘটিত নির্যাতনের একইরকম চিত্রই উঠে এসেছে। ইউএন উইমেনের তথ্য অনুসারে প্রতি তিনজনে একজন নারী ও কন্যা তার নিকট সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক অথবা যৌন হয়রানির শিকার হন। প্রতি দুজনে একজন নারী হত্যার শিকার হন নিকটতম সঙ্গী দ্বারা। এখনও ৪৮ শতাংশ নারী তার প্রজনন স্বাস্থ্য, জন্ম বিরতিকরণ ওষুধ গ্রহণ ও সন্তান জন্মদান ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
শুধু পরিসংখ্যান নয়, সাদাচোখেও নির্যাতনের ভয়াবহতা দেখতে হচ্ছে। ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত, কুমিল্লার তনু, চলন্তবাসে গার্মেন্টস কর্মী অথবা বাস থেকে নেমে কুর্মিটোলার মতো আরবান এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর ধর্ষিত হওয়া চোখে আঙ্গুল দিয়ে করিয়ে দেয় নারীর বিপন্নতার কথা। শুধু কি তাই, যে সকল নারী আয় বাড়িয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বিদেশ-বিভুঁইয়ে গিয়েছেন তারাও চাকরিদাতা অথবা তাদের সহযোগীদের দ্বারা নির্যাতনে হয় আত্মহত্যা করছে নয়তো সর্বস্ব হারিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন। ইতিমধ্যে কয়েক হাজার নারীর লাশ দেশে ফিরেছে। যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বৈকি!
নারীর প্রতি নির্যাতনরোধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অঙ্গীকার ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও তো কম নেওয়া হলো না এযাবত। ১৯৮১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালিত হচ্ছে। ১৯৯৩ সালে ভিয়েনা মানবাধিকার সম্মেলনে নারী-পুরুষের অসমতা ও বৈষম্য ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা বিবেচনায় দিবসটি বৈশ্বিকভাবে পালনের ওপর জোর দেয়া হয়। ওই সম্মেলনেই 'নারীর অধিকার মানবাধিকার এবং নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন' হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৯৯৯ সাল থেকে জাতিসংঘ এ দিনটিকে কেন্দ্র করে ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ' পালন করতে শুরু করে।
আন্তর্জাতিক ওই সব অঙ্গীকার, আইনি বাধ্যবাধকতা এবং দেশের সংবিধানসহ নারীর সম-উন্নয়নে বিশেষ বিশেষ পদক্ষেপ সত্ত্বেও অধস্তনতা ঠেকানো যাচ্ছে না। যে দিকেই তাকানো যাক না কেনো সামাজিক অগ্রগতির নানা সূচকে নারীর অবস্থানের এক চরম বৈপরিত্য চোখে পড়ে। চাকরি বা আর্থিক দিক থেকে নারীর কিছুটা অগ্রসরতা আসলেও ব্যক্তি নারীর ন্যায্য অধিকারের ক্ষেত্রগুলো এখনো বৈষম্যপূর্ণ। রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাপনাগত দিকে নারীর অবস্থান এখনও পুরুষের তুলনায় নগন্য। তারা এখনও সম্পত্তিতে সমঅধিকার পায়নি। সিডও সনদের ২ নং ও ১৬ (১) (গ) ধারার উপর আপত্তি এখনো তুলে নেওয়া হয়নি।
সরকারি-বেসরকারি সংগঠন বেশ কয়েকটি প্যারাডাইমে কাজ করেছে। দান-দক্ষিণার পরে কল্যাণমূখী অ্যাপ্রোচ হয়ে একটা দীর্ঘ সময় নারীর জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে উন্নয়নের চেষ্টা চলেছে। পরবর্তিতে নারীর ক্ষমতায়নকে কেন্দ্রে রেখে যে উন্নয়ন প্যারাডাইম সেটাও কম-বেশী সবক্ষেত্রেই প্রয়োগের চেষ্টা হয়েছে। নারীর সক্ষমতা বৃদ্ধি, সংশ্লিষ্ট সেবা ও সুবিধায় অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা এবং সিদ্ধান্তগ্রহণে স্বাধীনতা দেওয়ার বিষয়গুলো প্রাধান্য দিয়ে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও সরকারের সনাতনী শাসন কাঠামো সেটাতে খুব বেশি সায় দিয়েছে বলে দাবি করা যায় না। এছাড়া স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর অর্থবহ অন্তর্ভূক্তিও নানা চেষ্টা সত্ত্বেও সফল হয়নি। বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী- নারী প্রতিনিধিত্ব বর্তমান পর্যায় থেকে অনেকখানি বাড়ানোর কথা বলা থাকলেও, এখনও সে বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
যদিও এ বিষয়ে কথা উঠলেই অনেকেই বলে থাকেন পরিস্থিতি আগের চেয়ে এখন অনেক বদলেছে। নারী আজ চেনা চৌহদ্দির বাইরে এসে বৃহত্তর সমাজে মিলছে, দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে দুইজন নারী নেত্রী সরকারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, শিক্ষায়-কর্মসংস্থানে তাদের সংখ্যা আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি ইত্যাদি। কিন্তু সেটা সংখ্যার দিক থেকে হয়তো ঠিক কিন্তু নারীর মোট সংখ্যার তুলনায় সেটাও কি খুব বেশি কিছু?
এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের পাঠ্যপুস্তক বদল হয় রাজনীতি আর ধর্মের অপূর্ব মিশেলে, মূলধারা-সামাজিক মিডিয়া নির্বিশেষে নিরন্তর চলে নারীকে নিয়ে অবৈজ্ঞানিক আর অসম্মানজনক বয়ান। প্রশাসন,উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী, মিডিয়া, প্রাইভেট সেক্টর এবং এনজিও কোথাও নারীর প্রতিনিধিত্ব এখনও আনুপাতিক করা যায়নি। শুধু তাই নয়, যারা ইতিমধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদায়ন হয়েছেন তাদেরও জীবন কতোটা স্বচ্ছন্দ হয়েছে সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। বিরাট সংখ্যক নারী শ্রমিক তৈরি পোশাক শিল্পে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে, কৃষিতে নিয়োজিত থাকলেও তাদের তেমন কোনও অ্যাসোসিয়েশন এখনও গড়ে ওঠেনি। ফলে তারাও জীবন-জীবিকা বাঁচাতে অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সেভাবে দৃপ্তকণ্ঠ হতে পারছে না। পদে পদে হয়রানি, বঞ্চনা, শ্লীলতা হারানোর ঘেরাটোপে অতিবাহিত হচ্ছে তাদের প্রতিটি দিন। গৃহস্থালী কাজে লক্ষ লক্ষ নারী, কন্যাশিশুর নিযুক্তি কোনও প্রাতিষ্ঠানিকতা ছাড়াই চলছে যুগের পর যুগ। সে কাজে গৃহস্থ বা গৃহকর্ত্রীর দয়ায় নির্ধারিত হয় তাদের ভাগ্যলিপি! সড়কদ্বীপে, ফুটপাতে, ফুটওভারব্রিজে কতো কতো নারী, শিশুর পাশবিক জীবন চলছে বছরের পর বছর। কেউ দেখার নেই।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু, সংখ্যায় লঘিষ্ঠ নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী, ইনডিসেন্ট কাজে সম্পৃক্ত দলিত-হরিজন নারী ও কন্যাশিশুর জীবন আগের চেয়ে অনেক বেশি নাজুক। তথাকথিত মূলধারার গরিষ্ঠ সামাজিক শক্তি তাদের ভূমি, বাসস্থান, চলাচল, অবৈধ কাজে জড়ানো ইত্যাদি নানা মাধ্যমে তাদের জীবনে বয়ে আনছে অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা।
এতো এতো উন্নয়ন প্যারাডাইম, অর্থ, জ্ঞান, শ্রম কী ফল আনল তবে? যে সকল ফলাফল নিয়ে আমরা পরিসংখ্যানের ডালি সাজিয়ে চলেছি-সেগুলো কী অবস্থা না অবস্থানগত ইতিবাচক পরিবর্তনের গল্প? নাকি নারীর অবস্থাগত পরিবর্তনই আমাদের কমফোর্ট জোন? নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে যে চিন্তা-উদ্যোগকে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে, জাতীয় শিক্ষা-কারিকুলামে যে পরিবর্তন আনা হচ্ছে এবং যে সকল দীর্ঘমেয়াদী পার্সস্পেক্টিভ পরিকল্পনা ধরে এগুনো হচ্ছে সেখানেও কী একই সংকট থেকে যাচ্ছে? এ সকল প্রশ্নের সুষ্পষ্ট উত্তর দরকার। বিগত চার যুগেরও বেশি সময় ধরে বাস্তবায়িত জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় উন্নয়ন কর্মসূচির সফলতা-বিফলতার সুরতহাল তৈরি হওয়া দরকার। যার নির্মোহ বিশ্লেষণ সাপেক্ষে নয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর অধিকারভিত্তিক প্রগতির পথ নকশা প্রয়োজন।
নারীর অবস্থানগত পরিবর্তনকে কেন্দ্রে নিয়ে উন্নয়ন-সংস্কৃতি তথা সমাজ মানস তৈরি করতে না পারলে শুধু প্যারাডাইম থেকে প্যারাডাইমে শিফটিং, প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বরাদ্দ আর টপ-ডাউন উন্নয়ন কর্মসূচির চুইঁয়ে পড়া ফলাফল নারীর অবস্থানিক প্রগতি নিয়ে আসবে না। এ বিষয়ে দীর্ঘ মাঠ অভিজ্ঞতা, উন্নয়নের তাত্ত্বিক পুনর্পাঠ এবং প্রাসঙ্গিক সৃজনশীল দৃষ্টান্ত বিশ্লেষণ করে নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয় জাতীয় নীতি-নির্ধারকদের চিন্তার খোরাক হিসেবে হাজির করে নিবন্ধটি শেষ করছি-
১. প্রাথমিক ও বুনিয়াদি পর্যায় থেকে উচ্চশিক্ষা স্তরে পাঠ্যসূচিতে নারীকে সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুসারে উপস্থাপন যা নারী-পুরুষের সামাজিক লৈঙ্গিক বৈষম্য দূরীকরণে ভূমিকা রাখবে;
২. সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মূল-কাঠামোয় নারীর ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব ও অর্থপূর্ণ অংশ নেওয়া নিশ্চিতে উদ্যোগ গ্রহণ;
৩. শিক্ষা, সরকারি চাকুরি ও অন্যান্য খাতের কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ ও আনুপাতিক হিস্যা নিশ্চিত করতে অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন হিসেবে কোটা পদ্ধতি গ্রহণ করা;
৪. সরকারি গণমাধ্যম, প্রাইভেট মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীর প্রতি বৈষম্য, বিদ্বেষ ও অসম্মানজনক প্রচারণা বন্ধ এবং তা নিরীক্ষণে স্থায়ী কমিশন বা কর্তৃপক্ষ গঠন করা;
৫. নারীর প্রতি বৈষম্য নিরোধ, সহিংসতা প্রতিরোধ এবং ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এখন পযন্ত প্রণীত সকল আইন ও নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিশ্চিতকল্পে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে প্রশিক্ষিত করা।