Published : 26 Nov 2019, 07:00 PM
আওয়ামী লীগের সম্মেলন শুধু মাত্র আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গুরুত্ব রাখে না, জাতীয় রাজনীতিসহ দেশের ইতিহাসেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, ইতিহাসের নানান বাঁক পেরিয়ে এখন বাংলাদেশের জনগণের ভেতর দিয়ে উঠে আসা রাজনৈতিক দল একটাই, সেটা আওয়ামী লীগ– যাদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাবার ও থাকার সক্ষমতা আছে। এছাড়া জনগণের ভেতর দিয়ে উঠে আসা মুসলিম লীগ অনেক আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে গড়ে তোলা রাজনৈতিক দল ন্যাপ । আবার ওই ন্যাপ থেকে বেরিয়ে গিয়ে গড়ে তোলা রাজনৈতিক দল মোজাফফর ন্যাপ এখন নামমাত্র টিকে আছে। সর্বোপরি কমিউনিস্ট পার্টি এখন অনেক দুর্বল একটি রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি বড় যে রাজনৈতিক দল আছে– বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি ( বিএনপি) ও জাতীয় পার্টি এ দুটোই সামরিক সরকারের সৃষ্টি। দুটো দল যে দুই সামরিক সরকারের হাত ধরে জন্ম নিয়েছে এ দুই সামরিক সরকারই বাংলাদেশের স্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বেনিফিসারি ও সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের সংবিধানকে পরিবর্তন করে পাকিস্তানি ধারায় নিয়ে যাবার কাজ করেছে। মূলত তাদের মূল চরিত্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে। তাই এমতাবস্থায় শত দোষ ত্রুটি সত্ত্বেও একমাত্র আওয়ামী লীগই বাংলাদেশের জনগণের ভেতর দিয়ে উঠে আসা, স্বাধীনতার চেতনার ধারার রাজনৈতিক দল– যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে পারে। তাই স্বাভাবিকই তাদের নেতৃত্বের ওপর দেশের অনেক কিছু নির্ভর করে।
আওয়ামী লীগ যে সময়ে এবারের সম্মেলন করতে যাচ্ছে এই সময়ে বাংলাদেশে ও পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যেমন বাংলাদেশের সবক্ষেত্রে এখন তরুণরা সামনে চলে এসেছে। আবার বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। শুধু গড় আয়ু বাড়েনি, সঙ্গে সঙ্গে সুস্বাস্থ্যও নিশ্চিত হয়েছে। যার ফলে সিনিয়র সিটিজেনরাও কাজের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সক্ষম। সিনিয়র সিটিজেনরাও এখন অনেক কাজে তরুণদের সঙ্গে সমান তালে করতে পারেন। তাই শুধু অভিজ্ঞতা শেয়ার নয়, মাঠ পর্যায়েও তাদের পক্ষে এখনও কাজ করা সম্ভব। পাশাপাশি তরুণ নেতারা সবসময়ই তরুণদের চিন্তার সঙ্গে থাকেন এটাও সত্য। এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা। এই যোগাযোগ ব্যবস্থা বাড়ার ফলে কেন্দ্রের সঙ্গে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের রাজনীতির দূরত্ব কমে গেছে। তেমনিভাবে তথ্য প্রযুক্তি ও গ্লোবালাইজেশানের ফলে পৃথিবীর সঙ্গেও কমেছে বাংলাদেশের দূরত্ব। অন্যদিকে গত এগারো বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ফলে সারা পৃথিবীতে অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি আলাদা অবস্থান তৈরি করেছে। এই অবস্থান এমন একটি সময়ে তৈরি হয়েছে যে সময়ে পৃথিবীতে বড় ধরনের একটা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন হচ্ছে। অর্থাৎ পৃথিবীর রাজনীতি ও অর্থনীতি ধীরে ধীরে পশ্চিম থেকে মুখ ফিরিয়ে পূবের দিকে অর্থাৎ এশিয়ার দিকে আসছে। ধরে নেয়া হচ্ছে আগামী পৃথিবী এশিয়ার। আগামীর এই এশিয়ার পৃথিবীতে পুরানো এশিয়ান অর্থনৈতিক শক্তি জাপানের বাইরে নতুন দুটি অর্থনৈতিক শক্তির উত্থান এখন বাস্তবতা। এর ভেতর বড় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে চায়না আর তার সঙ্গে আরেকটি স্থিতিশীল অর্থনীতি হিসেবে এগিয়ে আসছে ভারত। এশিয়ার এই তিন বড় অর্থনৈতিক শক্তির চরিত্র ভিন্ন ভিন্ন। জাপান এশিয়ান অর্থনৈতিক শক্তি হলেও সে পশ্চিমা শক্তি আমেরিকার সঙ্গে গাঁটছড়া বাধা। চিন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিলো এতদিন– বর্তমানে সে সামরিক শক্তির দিকেও কিছুটা ঝুঁকেছে। ভারতের অর্থনৈতিক শক্তি চিনের মত বড় নয় তবে তার সামাজিক শক্তি অনেক বড়। ব্রিটিশ শাসনের উত্তরাধিকার হিসেবে শুধু নয় অতীতের ধারাবাহিকতায় ভারত বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাকে গুরুত্ব দেয় বেশি। অন্যদিকে পৃথিবীর সবথেকে বড় সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ ভারত। এই তিন ধরনের চরিত্র নিয়ে এশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তিগুলো এগুচ্ছে। এখনও অনেকে মনে করছে চিন শেষ অবধি আমেরিকার স্থান নেবে। কিন্তু পৃথিবীর অর্থনীতি ও রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বলে দিচ্ছে আগামী পৃথিবী এমন এককেন্দ্রিক আর হবে না। অর্থনীতির বিকাশের ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার কারণে বহুকেন্দ্রিক হবে।
এমন একটি সময়ে চিন ও ভারতের মাঝখানে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশ হচ্ছে। অর্থনীতির বিকাশের ফলে এর রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে অনেক বেশি। এবং শেখ হাসিনা দেশকে যেখানে পৌঁছে দিয়েছেন, তাতে এর গুরুত্ব প্রতি মুহূর্তে বাড়তে থাকবে। তাই আওয়ামী লীগের আগামী নেতৃত্বকে বেশ একটি জটিল সময়ের নেতৃত্ব দিতে হবে। বলা যেতে পারে এটা আওয়ামী লীগের রাজনীতির আরো একটি বাঁক পরিবর্তনের সময়। আওয়ামী লীগ যাত্রা শুরু করেছিলো পাকিস্তানি কাঠামোতে একটি প্রাদেশিক দল হিসেবে। ষাটের দশকে এসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে নিয়ে এর নেতৃত্বে ধীরে ধীরে তাদেরকে নিয়ে এলেন যারা একটি স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে পারবে। এর পরে স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের পাশাপাশি সেই সব যুবকদের নিয়ে যুবলীগ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন যারা মুক্তি সংগ্রামী ছিলেন। এই যুবলীগ থেকেই নেতারা ১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্টের পরে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে চলে আসে। এর সঙ্গে সঙ্গে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের ভার নেবার পর থেকে শেখ হাসিনা দলকে এক দিকে যেমন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের উপযুক্ত আওয়ামী লীগ তৈরি করেন তেমনি তিনি ধীরে ধীরে দেশ গঠনের দল তৈরির দিকে নজর দেন। যে কারণে আওয়ামী লীগে অনেক সংযোজন ও বিয়োজন তিনি করছেন। আর এটা করতে পেরেছেন বলেই আজ তিনি তার আওয়ামী লীগ নিয়ে এগারো বছর টানা ক্ষমতায় থেকে দেশকে এশিয়ার রাজনীতিতে ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে এসেছেন।
তাই এবারের সম্মেলনে প্রাথমিকভাবে দুটি বিষয় সামনে আসে; এক, এবারের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যারা আসবেন তাদেরকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এশিয়ার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। দুই, তাদেরকে প্রায় বিশ কোটি মানুষের নেতৃত্ব দিতে হবে। অর্থাৎ তাদেরকে এমন একটি জনসংখ্যার নেতৃত্ব দিতে হবে যার সংখ্যা আমেরিকার জনসংখ্যা থেকে মাত্র ১২ কোটি কম। অর্থাৎ আমেরিকার তিন ভাগের দুই ভাগ জনসংখ্যাকে তাদের নেতৃত্ব দিতে হবে। তাই আওয়ামী লীগ যে সময়ে তাদের সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে এখন তাদেরকে সবথেকে গুরুত্ব দিতে হবে এই দুটি বিষয়কে। অর্থাৎ কীভাবে ও কাদেরকে নিয়ে নেতৃত্ব সাজানো যায় যারা আগামী এশিয়ার এই অর্থনৈতিক বিকাশ ও রাজনীতির পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশকে ও দেশের রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে পারবেন। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই অনেক কিছু চিন্তা-ভাবনা করছে। তবে তাদেরকে অবশ্যই এমন কিছু চিন্তা করতে হবে যাতে পার্টির ফরেন রিলেশান কমিটির ব্যপ্তি অনেক বড় হয়। এবং তাদের অধীনে বেশ কিছু ফাউন্ডেশান বা এনালিসিস কমিটি গড়ে ওঠে যার মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতির ও এশিয় রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দল ও দেশকে এগিয়ে নিতে পারবে। অন্যদিকে আমেরিকার তিন ভাগের দুই ভাগ মানুষকে নেতৃত্ব দিতে গেলে পার্টি কাঠামোর ও নেতৃত্বের কাঠামোর অবশ্যই পরিবর্তন দরকার। এর আগের সম্মেলনগুলোতে শেখ হাসিনা অবশ্য সে পরিবর্তনের সূচনা করেছেন। তবে এবারের সম্মেলনে মনে হয় সেই পরিবর্তনের চূড়ান্ত রূপ দেবার একটা সময় এসে গেছে। আগে আওয়ামী লীগে একজন সাংগঠনিক সম্পাদক থাকতেন। জনসংখ্যা বাড়ার ফলে শেখ হাসিনা সেখানে চার বিভাগের চারজন সাংগঠনিক সম্পাদক দিয়েছেন। এখন মনে হয় এই পরিবর্তনের চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবার সময় এসে গেছে। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই চিন্তা করা যেতে পারে চার জন সাংগঠনিক সম্পাদক কেন্দ্রিয় না রেখে আঞ্চলিক করা যায় কিনা? অর্থাৎ নির্দিষ্ট বিভাগ থেকেই নির্দিষ্ট বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক। এবং তিনি বিভাগে বসবাসকারী হলে আরো ভালো হয়। অর্থাৎ আবাসিক সাংগঠনিক সম্পাদক। এরপরেই সময় এসেছে এই চিন্তা করার যে চারটি সেক্রেটারীর পদ সৃষ্টি করে তাদরে ওপরে একজন জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচন করা। আর চার জন সেক্রেটারীর আওতা বিভাগ অনুযায়ী ভাগ না করে নির্বাচনী আসনের মতো জনসংখ্যা অনুযায়ী ভাগ করে দেয়া যেতে পারে। তাহলে সকলের আওতায় সমান সংখ্যক জনগোষ্ঠী পড়বে। এবং সেখানে তাদের সাংগঠনিক কাজ ও রাজনৈতিক শিক্ষা প্রদানের কাজ করা অনেক সহজ হবে। এবং চার জন সেক্রেটারি যাতে ফুল টাইম হতে পারেন সেজন্য তাদের সে ধরনের ভাতা ও অফিসের ব্যবস্থা করার বিষয়টিও চিন্তা করা যেতে পারে। আর জেনারেল সেক্রেটারির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথই অনুসরণ করা উচিত। এখানে দ্বিতীয় কোনো কিছু ভাবার কোনো সুযোগ নেই।
আওয়ামী লীগের মনে রাখা দরকার, দল হিসেবে তাদের কাজ শুধু তাদের দলকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় নেয়া নয়। আওয়ামী লীগের কাজ একদিন যেমন ছিলো বাংলাদেশ সৃষ্টি। এখন তাদের কাজ হলো শিক্ষিত, উন্নত একটি জনগোষ্ঠীর দেশকে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড় করানো। অন্তত এ মুহূর্তে এশিয়ার অন্যতম উন্নত ও দক্ষ জনগোষ্ঠীর দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। আর তরুণ প্রজম্মের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ বির্নিমাণের জন্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামোর এ পরিবর্তন এনে এ প্রজম্মকে রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল করা এখন সময়ের দাবি।