Published : 09 Nov 2019, 04:30 PM
দেশ ভাঙলে যে ঘর ভাঙ্গে, আর ঘর ভাঙলে মনও ভাঙ্গে– ভাঙ্গাভাঙ্গির, ভাগাভাগির চরম বাস্তবতাকে নিজের জীবনে সবথেকে কঠিন, কঠোর, উদ্ধত অসহায় বাস্তব হিসেবে যে উঠে আসবে, সেটি কি শিশু বয়সেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন? তাই কি ক্ষমতা হস্তান্তরের পর, দেশভাগের পর, স্বাধীনতার সেই পূর্ণ সকালে '৪৭ এর ১৫ অগাস্ট তাদের 'ভালোবাসা' র সামনে কলিম শরাফী যখন গাইছেন; "একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি"– চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে বাবা নরেন দেব, রাধারানীর, মায়ের কোলে বসা শিশুটির চোখেও কেন জলের ধারা নেমেছিল?
নিজের জীবনের বিচ্ছিন্নতাকে, দেশের-রাষ্ট্রের-জাতির বিচ্ছিন্নতা, পরিচিত অপরিচিত যেকোনো মানুষের বিচ্ছিন্নতা, এমনকি পশুপাখির বিচ্ছিন্নতাতে পর্যন্ত অকৃপণভাবে হাত বাড়িয়ে দেবার যে দরাজ হাতটি তিনি গতকাল পর্যন্ত প্রসারিত করে রেখেছিলেন, একবারও ভাবেননি এই স্বভাবের জন্য কোথায় কতখানি নিন্দাবাদ জুটবে, কে কি বলবে, সমাজ মুখ বেঁকিয়ে তাকাবে কিনা, রাষ্ট্র চোখ রাঙাবে কিনা, বটুয়াতে রেস্ত আছে কিনা– এইসব কোনো কথা।
'ভালোবাসা'র বাসিন্দাটি 'ভালোবাসা'কে জীবনের সঙ্গে যেভাবে সম্পৃক্ত করে নিতে পেরেছিলেন, এমনভাবে খুব কম মানুষই পারেন। চেটেপুটে জীবনটাকে উপভোগ করেও, কোনোরকম অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করেও, নিজের এতোটুকুই সুবিধে পাওয়ার জন্য সত্যকে দিনের আলোর মত প্রকাশ করবার সংকল্প থেকে সরে না এসে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে খুব কম মানুষই পারেন।
এই মানুষটি ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস করতে করতে নিজের জীবন নিয়ে যেমন স্যাটায়ার করেছেন, তেমনি গোটা জীবনটাই প্রায় হাঁপানি রোগের সঙ্গে অদম্য লড়াইটাও করে গিয়েছেন । হাঁপানির কষ্টটাকে অনেকটা ক্রিকেট-ফুটবল খেলবার মতন একটা মজাদার ভঙ্গিমায় নবনীতা দেবসেনের লেখক সত্তার বিষয় হয়ে উঠেছিল।
আপামর বাঙালির অনেক রকম ধারণা আছে তাকে ঘিরে। কারো ধারণা; নিজেকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে, চরম সত্যে উপনীত হওয়ার এই ধরনের অভিব্যক্তি তার সমকালে বাংলা সাহিত্যে খুব কম পাওয়া যায়। আবার কারো কারো মনে হয়েছে; তিনি নিছক শিশু সাহিত্যিক। কারো কাছে তিনি শুধুই কবি। হয়তো আগামী দিনে তার সামগ্রিক সৃষ্টি সত্তা নিয়ে দেশে বিদেশে উচ্চমার্গের সন্দর্ভ তৈরি হবে।
কিন্তু এসবের পাশাপাশি আমাদের জানা দরকার; 'আমি, অনুপম'এর মত অসামান্য জীবন সত্যের নির্মাতা, কোন সত্যকে জীবনে ধারণ করে, হৃদয়ে বপন করে একাশিটি বসন্ত অতিক্রম করবার আগেই, আশিটি বসন্তের পর আগামী বসন্তের আগমনের আগে এক 'শীতসাহসিক হেমন্ত লোকে'র নিভন্ত সন্ধ্যায় সীমার থেকে অসীমে বিলীন হয়ে গেলেন।
অন্নদাশঙ্করের পত্নী লীলা রায়ের জীবনাবসান হয়েছিল শারদ উৎসবের দশমীর দিন। নবনীতার জীবনাবসান হলো জগদ্ধাত্রীর দশমীর দিন। দুই আন্তর্জাতিক ভাবনা জাড়কে জাড়িত মানব প্রকৃতিবেত্তার পৃথিবীর জল-মাটি-আগুনে চির বিলীন হয়ে যাওয়ার সময়কালের এই অদ্ভুত সমাপতন দেখে মনে হয়, এই দুই মানবী যে শাশ্বত বাঙালির চিন্তাকে চিরন্তন বাঙালির চিন্তার ভিতর দিয়ে আন্তর্জাতিকতায় স্থাপিত করে দিয়ে গেছেন, তারা যেন জীবনের অলক্ষ্য থেকে কোনো একটা বিনি সুতো দিয়ে, এক রেশমি চাদরের আবরণে এই ত্রস্ত সময় আর ধ্বস্ত সংস্কৃতির বুক ঢেকে দিচ্ছে।
নিজের দুঃখকে, কেবল দুঃখ বলে হাত পা ছড়িয়ে না কেঁদে একগাল হাসি দিয়ে হৃদয়কে সুসংবদ্ধ করে, দুঃখকে জয় করবার সংকল্পে স্থিত হওয়ার নামই ছিল নবনীতা দেবসেন। ব্যক্তি জীবনের চরম সংকটের দিনগুলিতে তিনি দেশের বাইরে নিজের ভবিষ্যতের থেকেও দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় থেকেছেন। রাতে ঘুমাতে পারতেন না সেই বিদেশ-বিভুঁইয়ে। তখন তার একমাত্র সঙ্গী কলিম শরাফীর গাওয়া একটি ইপি রেকর্ডে রবীন্দ্র সঙ্গীত; "বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস না ভাই"। কলিম শরাফীর কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের মন্ত্র একটা ভেঙে পড়া, যন্ত্রণা ক্লিন্ন, ছলনার শিকার হওয়া মানুষের কাছে কি ধরনের মৃতসঞ্জীবনী হয়ে উঠেছিল, তা নবনীতার জীবন না দেখলে বুঝতে পারা যায় না।
অনেককাল পর নয়ের দশকের শেষের দিক। কলিম শরাফী এবং তার পত্নী নওশেবা কলকাতা সফর শেষে ফিরে যাচ্ছেন ঢাকায়। সার্কের কোনো একটা সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে একই বিমানে চলেছেন নবনীতা। অকপটে কলিম শরাফীর কাছে নিজের জীবনের সেই সব রক্তাক্ত হওয়ার দিনগুলির কথা বলে চললেন তিনি। অকপট সারল্য অথচ নিজের যন্ত্রণা প্রকাশ করতে কাউকে অভিযুক্ত না করার একটা অতি উচ্চ মানবিক গুণ, নবনীতার এই যে বৈশিষ্ট্য, এইটা শুধু কেবল বাঙালির কাছে চরম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিষয় নয়, গোটা বিশ্বের মানবজাতির কাছে যেন এক ধরনের দৃষ্টান্ত হিসেবে যুগ যুগ ধরে উপস্থাপিত হয়ে থাকবে।
সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত লোকজন, ব্যক্তি জীবনে দুঃখ যন্ত্রণার ক্ষেত্রে অপরকে অভিযুক্ত করবার বিষয়ে যেন একেবারে মুক্ত কচ্ছ। এই ক্ষেত্রেও নবনীতা যে অসাধারণ সহনশীলতা, অসামান্য রুচিবোধের পরিচয় দিয়েছেন, তার পরিচয় বাঙালি নারী কেন, বিশ্বের যেকোনো জাতিগোষ্ঠী, ভাষাগোষ্ঠীর নারীদের মধ্যে খুব কম দেখতে পাওয়া যায়।
আশাপূর্ণা দেবীর মৃত্যুর পর খুব আবেগঘন হয়ে নবনীতা একবার বলে ফেলেছিলেন; তাদের বিবাহে আশাপূর্ণা একটি অসাধারণ সুন্দর বেডকভার উপহার দিয়েছিলেন। তারপর স্বগতোক্তি করেছিলেন নবনীতা; "আশা পিসীমার জামাই তো এখন অন্যের জামাই"। ব্যস, ওইটুকুই। নিজের যন্ত্রণাকে গোপন করার কোনো চেষ্টা করেননি। অথচ একবারের জন্য রুচি, মননশীলতা, মেধা, ধৈর্যের বাইরে একটি শব্দও তার নিজস্ব পরিমণ্ডলের বাইরে তো দূরের কথা, ভিতরের মানুষেরাও কখনো শুনতে পাননি।
এই প্রেক্ষিতে মাঝে মাঝে মনে হয়; নবনীতার জীবনের এই শিক্ষাটিকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমরা কেউ কখনো নেব না? জীবনের বিপর্যয়কালেও নবনীতা একটিবারের জন্য তার বৃদ্ধা, অসুস্থ মায়ের প্রতি নিজের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে বিস্মৃত হননি। অন্নদাশঙ্কর রায় নবনীতা দেবসেনের যাবতীয় গুণাবলী ব্যতিরেকে তার গর্ভধারিণীর প্রতি এই অসামান্য দায়িত্ববোধের জন্য তাকে অপরিসীম স্নেহ করতেন।
লেখিকা নবনীতা, গবেষক নবনীতা, নারীবাদী নবনীতা, অধ্যাপিকা নবনীতা, সমাজকর্মী নবনীতা তার এইসব বিভিন্ন সত্তাকে সেইসব প্রাঙ্গণে কাজ করা মানুষজন নানা আঙ্গিকে দেখেছেন। সেই দেখার ভিতর দিয়ে তারা শিখেছেন অনেক কিছু, জেনেছেন অনেক কিছু। সেইসব দেখাশোনা, জানা নিশ্চয়ই আগামী দিনে আরও বিস্তারিতভাবে সমাজের কাছে উঠে আসবে। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না; বিদুষী নবনীতা, অধ্যাপিকা নবনীতা, ডাকসাইটে কবি, লেখিকা নবনীতার আড়ালে রয়েছে, যে কোনো রকমের বিচ্ছিন্নতায় ক্লিন্ন প্রানের প্রতি অপরিসীম স্নেহ-মমতা।
হুগলি জেলার কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এক বৃদ্ধা অনেককাল আগে নবনীতার বাড়িতে আসতেন। নবনীতা তখন কর্মরতা। নিয়মিত তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়, ক্লাস নিতে হয়। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে যেতে হয়। সময়ে সময়ে দেশের বাইরেও যেতে হয়। সেই বৃদ্ধাকে ঘিরে পারিবারিক পরিমণ্ডলে একটু যে সমস্যা নবনীতার হতো না তা কিন্তু নয়। তার কারণ; সেই বৃদ্ধার কোনো একটা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা ছিল। যার ফলে তার গা থেকে অত্যন্ত তীব্র একটা কটু গন্ধ বের হতো।
কোনরকম প্রতিবন্ধকতাকে পাত্তা দেননি কিন্তু নবনীতা। সেই বৃদ্ধা দিনের পর দিন প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে নবনীতার বাড়িতে থেকেছেন, খেয়েছেন। এমনকি নবনীতার নিজস্ব বাথরুম পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন। সেই বাথরুম ব্যবহারের পর, সেটি অন্যের ব্যবহারের ক্ষেত্রে দুর্গন্ধজনিত নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হতো। বাইরের পরিচারকেরা বিরক্ত হতেন। নবনীতা কিন্তু একটিবারের জন্য সেই বৃদ্ধার প্রতি কখনো কোনো রকম বিরক্তি, ক্ষোভ প্রকাশ করেননি। বরঞ্চ পরিচারিকাদের অসুবিধার কথা ভেবে, সেই বৃদ্ধার ব্যবহারের পর বাথরুম নিজের হাতে পরিষ্কার করতেন।
এমন যে কত মানুষ জানা অজানা কত ব্যক্তি নবনীতার কাছে মায়ের মত, মেয়ের মত, বড়ো দিদি, ছোট বোন, বন্ধুর মতো সাহচর্য পেয়েছেন তার তালিকা করতে গেলেই একটি গ্রন্থ তৈরি হয়ে যাবে।
ভাটপাড়াতে তার পরিচিত এক ব্যক্তি রেল স্টেশন থেকে শুরু করে লঞ্চঘাটে পড়ে থাকা সহায়সম্বলহীন বৃদ্ধাদের তুলে, খানিকটা নিজের টাঁকের জোরে, খানিকটা বন্ধু-বান্ধবদের সহযোগিতায় একটা ছোট্ট আবাসন করে রাখলেন নাম দিলেন 'শ্রদ্ধা'। নবনীতার ভাতুষ্পুত্রপ্রতিম সেই ব্যক্তিটি এই কর্মকাণ্ডের কথা নবনীতাকে জানালেন। প্রবল উৎসাহ নবনীতার। ইতিমধ্যে হঠাৎ একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেখা গেল সোদপুর রেলস্টেশনে নিজের বৃদ্ধা মাকে বসিয়ে রেখে তার সন্তান কোথাও চম্পট দিয়েছে। বৃদ্ধাটি হাপুস নয়নে কাঁদছে খবরটি জানার পরই শ্রদ্ধার মানুষজন স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে সেই বৃদ্ধাকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো 'শ্রদ্ধা'তে।
সবার আগে এগিয়ে এলেন নবনীতা। ছোট্টোখাট্টো সেই বৃদ্ধাটিকে দেখে, নিজেই তার নাম দিয়ে দিলেন 'চড়ুই'। আর সেই 'চড়ুইয়ে'র যাবতীয় আর্থিক দায়-দায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। চড়ুই যতদিন বেঁচে ছিলেন, প্রতি মাসে তার থাকা-খাওয়া এবং চিকিৎসার যাবতীয় খরচ নবনীতা বহন করে গেছেন।
সেই সহায়সম্বলহীন বৃদ্ধাবাসের কথা তিনি লিখেছেন। সেখানকার মানুষদের কাজকর্ম নিয়ে তিনি লিখেছেন। চড়ুই কি করে তার বাসা খুঁজে পেল, তার কথাও তিনি লিখেছেন। কিন্তু একটিবারের জন্যও লেখেননি নিজের সাহায্য করার বিষয়টি। চড়ুইয়ের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সব খরচ জুগিয়ে গিয়েছেন, এমন কি তাকে দাহ করার পর্যন্ত খরচ দিয়েছেন, তার কন্যা শ্রাবস্তী ছাড়া এখবর বোধহয় আর কেউই জানেন না।
আত্মপ্রচার বিমুখতা বিদুষী নবনীতার চরিত্রের একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল। সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, সভ্যতা, মানুষ– সবকিছু সম্বন্ধে তিনি খুঁটিনাটি লিখেছেন। ভালো দেখলে গলা তুলে বলতে দ্বিধাবোধ করেনি। আবার খারাপ দেখলে নিন্দায় সোচ্চার হতে ছাড়েননি। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে তিনি কার প্রতি কতোখানি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, নিজের উপার্জনের ডালি উজাড় করে দিয়েছেন– সেসব কথা কিন্তু একটিবারের জন্য কখনো কাউকে বলেননি। কোথাও লেখেননি। "আমারে না যেন করি প্রচার আমার সকল কাজে"– রবীন্দ্রনাথের আপ্তবাক্যটি যেন নবনীতার জীবনে জ্বলন্ত সত্য হয়ে দেখা দিয়েছিল।
এই সত্যে স্থিত থেকেই নবনীতা তার গোটা জীবনটাকে 'কান্নাহাসির-দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের মেলা'র ভিতর দিয়ে অতিবাহিত করে গেলেন। অথচ সত্য প্রকাশের প্রশ্নে নবনীতার মধ্যে কখনো কোনো রাখঢাকের ব্যাপার ছিল না। এতোটুকু ন্যাকামি ছিল না। এতোটুকু সেফসাইড গেম খেলার মানসিকতা ছিল না।
জীবনের ক্ষেত্রে, রাজনীতির ক্ষেত্রে, সমাজের ক্ষেত্রে, ইতিহাসের ক্ষেত্রে, সাহিত্যের ক্ষেত্রে, সত্য বললে তার পরিণাম কি হতে পারে, তার কতোখানি মাসুল গুনতে হতে পারে– এটা অনেকেই চিন্তা করেন। নবনীতার সমসাময়িককালে এই চিন্তা থেকে সম্পুর্ণ মুক্ত এপার বাংলার মানুষদের ভিতরে অন্নদাশঙ্কর রায়, গৌরী আইয়ুব, গৌরকিশোর ঘোষের সঙ্গে নবনীতা দেবসেনের নামটিও চিরকাল জ্বলজ্বল করবে।
রাজনীতিগত ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য প্রকাশ না করেও, দলীয় আনুগত্যের কোনোরকম বেড়াজাল, বিধিনিষেধের মধ্যে নিজেকে এতটুকুনির জন্য আবদ্ধ না করেও নবনীতা কিন্তু মুক্ত চিন্তা, অসাম্প্রদায়িক মনন, সম্প্রীতি বোধ, নারীর স্বাধিকার, সামাজিক-অর্থনৈতিক শোষণ মুক্তির প্রশ্নে সবসময় প্রগতিশীল শিবিরের পক্ষে নিজের মতামত অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে গেছেন। ভারতবর্ষের সাম্প্রতিক প্রেক্ষিত বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নিজস্ব অসামান্য রসবোধের ভিতর দিয়ে জাতীয় স্তরের 'ইন্টেলেকচুয়াল স্টুপিড' আর রাজ্যস্তরে 'ইললিটারেড স্টুপিড'-এর মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা যখন তিনি করতেন, তখন সত্যিই মনে হতো নবনীতা দেবসেন যেন সর্বকালের সেরা তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপিকা।
মহাকাব্যের কাব্যিক চরিত্রের সঙ্গে ধর্মান্ধতাকে পৃথক করে তিনি কীভাবে তার ছাত্রসমাজকে দীক্ষিত করে গেছেন তা তার প্রত্যক্ষ ছাত্ররা জানেন। সেই জানার ভিতর দিয়ে নবনীতার মুক্ত চিন্তা, স্বচ্ছ সমাজবোধ, লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভাবনাকে তারা নিশ্চয়ই আগামী দিনে আরও সাধারণ মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেবেন।
কিন্তু এর পাশাপাশি একটি কথা বলা দরকার যে, মু্ক্তচিন্তা বোধের প্রকাশের ক্ষেত্রে নবনীতা কিন্তু কখনো কারো উপর কোনোরকম ভাবেই নিজের চিন্তাকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেননি। নিজের পিতৃশ্রাদ্ধে তিনি শ্রাদ্ধকৃত করেছিলেন। সেখানে তাকে মন্ত্রোচ্চারণ করিয়েছিলেন তারই প্রতিবেশী ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। আবার প্রতি শারদ উৎসবের প্রারম্ভে পিতৃপক্ষে পিতৃ-মাতৃ ও শ্বশুরকূলের উদ্দেশে তর্পণ করতে একটিবারের জন্যেও বোধহয় নবনীতার ভুল হয়নি।
এপার বাংলায় সাতের দশকের শুরুর সময়ের রাজনৈতিক চাপান উতোরকে ঘিরে সমকালে বহু সাহিত্য তৈরি হয়েছে, সন্দর্ভ তৈরি হয়েছে। গবেষণার দিকদিগন্ত ঘিরে নানা বাদ-প্রতিবাদ হয়েছে। সেই আলাপ-আলোচনার ধারা আজ একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকেও প্রলম্বিত হয়ে চলেছে। সেই ঘটনাক্রমের শুরুর সময়কে ঘিরে, সময়ের সংকট, মানুষের সংকট, চেতনার সংকট, মানবিকতার সংকট, সর্বোপরি মনুষত্বের সংকটকে 'আমি, অনুপম' গ্রন্থের ভিতর দিয়ে নবনীতা যেভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাতের দশকের সেই সংকীর্ণতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক না থাকা একজন মানুষ, যে অনুপম মুন্সিয়ানায় সূক্ষতা আর নিবিড় সংবেদনের ভিতর দিয়ে একটি মালা গাঁথতে পেরেছিলেন সময়ের, তেমনটা নিবিড়ভাবে কতজন পেরেছেন– তা নিয়ে কিন্তু বিতর্ক চলতেই পারে।
নবনীতা তার নিজের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে যে বলিষ্ঠতার পরিচয় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন, 'আমি, অনুপম' উপন্যাসের প্রায় প্রতিটি শব্দে, সময়ের ঘূর্ণিপাকের মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই বলিষ্ঠতাকেই যেন তিনি বিজয় বৈজন্তীর মতো মেলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন।
নবনীতার বিভিন্ন আঙ্গিকের যে অনুপম সৃষ্টিরাজি, সেগুলোকে বাদ দিয়েও যদি একজন পাঠক কেবল তার 'আমি, অনুপম' নামক উপন্যাসটি পড়েন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে সময়কে, সমাজ, সভ্যতা, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি সর্বোপরি মানুষকে কতখানি মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাচেতনার জাড়কে অণুবীক্ষণিক হৃদয়ে দেখতে পারলে পরে তবেই এই ধরনের উপন্যাস একজন স্রষ্টার পক্ষে সৃষ্টি করা সম্ভব।
সাতের দশকে বাংলার সংকীর্ণতাবাদী আন্দোলন সম্পর্কে সম্ভবত 'আমি, অনুপম' উপন্যাসটি একমাত্র নিরপেক্ষ, স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা একটি উপন্যাস। এই সময়কালকে সেই সময় দাঁড়িয়ে বহু সাহিত্য স্রষ্টা দেখেছেন, লিখেছেন। আগামী দিনেও লিখবেন। কিন্তু প্রত্যেকেই কোনো না কোনো একটা পক্ষ অবলম্বন করে লিখেছেন। আগামী দিনে কি হবে সেটা আগামীদিনই বলবে।
সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতিকদের ধ্বংসলীলাকে কেউ মহত্ত্বের লেবেল সেঁটে দিয়েছেন। আবার কেউ তাকে খুবই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপিত করেছেন। কিন্তু নবনীতা যেভাবে তার অদ্ভুত রকমের দেখার চোখের ভিতর দিয়ে, পরতের পর পরতে মনস্তত্ত্বের পাপড়িগুলিকে সেই সময় এবং আন্দোলনকে ঘিরে উন্মোচিত করে দিয়েছেন, তার নজির বোধহয় সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় না।
রক্তে রাঙানো সময়কে এভাবে হৃদয় দিয়ে অনুভব করে, সেই রক্তের অক্ষরে যথার্থ বিশ্লেষণী প্রতিভার স্ফুরণ ঘটিয়ে, নিরপেক্ষ মন দিয়ে ভাবীকালের সামনে উপস্থাপিত করা– এটা নবনীতা দেবসেন ছাড়া আর কারও পক্ষেই বোঝা সম্ভবপর ছিল না। এই অসম্ভবতাকে নবনীতা সম্ভব করতে পেরেছিলেন, হয়তো তার সেই সময়ের ব্যক্তিজীবনের টানাপোড়েনের বিচ্ছিন্নতার আভাসের ভিতর দিয়েই।
নিজের ব্যক্তি জীবনটা যে ভেঙেচুরে যাচ্ছে, সাতের দশকের প্রারম্ভে সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন নবনীতা। তাই সমাজের ভঙ্গুরতাকে তিনি এভাবে দেখতে সক্ষম হয়েছিলেন। সময়টাকে নিজের জীবন দিয়ে যদি উপলব্ধি করতে না পারা যেত, নিজের জীবনের রক্তের প্রতিটি বিন্দুতে যদি ক্ষরণের চিহ্নগুলি তখন নবনীতা সেভাবে অনুভব না করতেন, তাহলে সংকীর্ণতাবাদী আন্দোলনের সময়কালের সেই টানাপোড়েনের অদ্ভুত নিরপেক্ষ, সহনশীল, বহুত্ববাদী ভাবধারার প্রতি শ্রদ্ধাযুক্ত মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তার পক্ষে করা সম্ভবপর হতো কিনা তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা থেকেই যায়।
আসলে একটা বেপরোয়াভাব নবনীতাকে সবসময় যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো। অথচ সেই বেপরোয়াভাবের মধ্যে কিন্তু এতোটুকুও সমাজ বর্ণিত বেয়াড়াপনা ছিল না। উচ্চশির ছিল, কিন্তু সেই উচ্চশিরে কখনো ঔদ্ধত্যের আভাস ছিল না। উঁচু গলায় দীপ্ত উচ্চারণ ছিল, কিন্তু সেই উচ্চারণে কখনো গলাবাজি ছিল না।
তাই মনস্তত্ত্বের সূক্ষাতিসূক্ষ অলিগলিতে একজন বিদুষী নারী যেভাবে অবাধ গতিবিধির ভিতর দিয়ে, একই পাত্রে হলাহল আর অমৃতকে তুলে এনে মানুষের সামনে মেলে ধরতে পেরেছিলেন, তেমনটা সংকীর্ণতাবাদী আন্দোলনকে ঘিরে সাহিত্য জগতে একটি মানুষও পেরেছেন কিনা তা নিয়ে ঘোরতর সংশয় রয়েছে।
এই কাজের জন্য নবনীতাকে অনেক দায় চুকোতে হয়েছে। যাদের কাছে মনে হয়েছে এই কথকথা তাদের পক্ষে যাচ্ছে, তারা নবনীতার গুণকীর্তন করেছেন। আবার যাদের কাছে মনে হয়েছে, এগুলি তাদের বিদূষণের উদ্দেশ্যে নবনীতা উচ্চারণ করেছেন তারা নবনীতার বিরুদ্ধে কুৎসা করতে দ্বিধাবোধ করেননি।
'আমি, অনুপম' নামক গ্রন্থটিকে এক অর্থে বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষিতে কেবল সাতের দশক নয়, সর্বকালের ছদ্ম বুদ্ধিজীবীদের মুখোশ উন্মোচনের একটি মাইলফলক বলে চিহ্নিত করা যায়। নবনীতা জীবনে কখনো ছদ্ম প্রগতিশীলতা, ছদ্ম বুদ্ধিমত্তার মোড়কে নিজের চিন্তা-চেতনাকে আচ্ছন্ন রাখেননি। তাই ছদ্ম বুদ্ধিজীবীদের ভিড়ে তাকে তার সুদীর্ঘ জীবনের একটি মুহূর্তেও দেখতে পাওয়া যায়নি।
'আমি, অনুপম' গ্রন্থটি তিনি তার আশা পিসিমা অর্থাৎ আশাপূর্ণা দেবী ও তার স্বামী কালিদাস গুপ্তকে উৎসর্গ করেছিলেন, সেখানে এই ছদ্ম বুদ্ধিজীবীদের হাতের তালুর মতো চিনিয়ে দিয়েছিলেন। যুগে যুগে যেকোনো সামাজিক ব্যবস্থাতে একটা উথাল-পাতালের কালে, অদল বদলের সংকেত উপস্থিত হলে যারা জল মাপতে বসে যান, জল মেপে যারা নিজেদের জীবনের সুখ-সুবিধা, সাচ্ছন্দ্য, নিরাপত্তাগুলিকে কেনেন, তাদের এই উপন্যাসে একদম হাতের তালুর মতো নবনীতা চিনিয়ে দিয়েছিলেন।
এই চিনিয়ে দেওয়ার কাজটি যে কেবল সাতের দশকের এপার বাংলার প্রেক্ষিতে সংকীর্ণতাবাদী আন্দোলনের ভিতরেই আবদ্ধ তা কিন্তু নয়। যুগে যুগে যেকোনো সময় সংকেতের নিরিখে নবনীতার নির্দিষ্ট ছদ্মবুদ্ধিজীবীদের চিহ্নিতকরণের কাজটি এক চিরকালীন সম্পদ হিসেবে মানব সভ্যতার সামাজিক প্রেক্ষিতে খোদিত হয়ে থাকবে।
এই ছদ্মবুদ্ধিজীবীরা কিভাবে সাতের দশকে সংকীর্ণতাবাদী আন্দোলনের নিরিখে এপার বাংলার বাঙালি সমাজের সামাজিক জীবনযাত্রার প্রতিটি আঙ্গিককে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করেছেন, সাচ্ছন্দ্য গৃহের রঙিন চিত্রটিকে এলোমেলো করেছেন তার অনুপম সমাজবিজ্ঞান নবনীতা রচনা করেছিলেন এই উপন্যাসে।
সাতের দশকের সেই প্রেক্ষিত কিন্তু আজ এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক, নবনীতার রক্তমাংসের শরীরের চিরবিদায়ের ঠিক একদিন পরেও সমান সত্যি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ছদ্ম বুদ্ধিজীবীদের থেকে নিজেকে আলাদা করে, মাথা উঁচু করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকার মত ঔদ্ধত্য উপনীত করা- এটি কিন্তু আদৌ মুখের কথা নয়। ছদ্ম বুদ্ধিজীবীদের জীবনের ভিতর দিয়ে বাঙালি জীবনের টালমাটাল সময়ের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ যে কিভাবে এক প্রলয়ঙ্কর জীবন সত্যের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়– তাই ই নবনীতা বারবার দেখিয়েছেন।
সেই দেখানোর ভিতরে কখনো হাসি আছে, কখনো মশকরা। কখনো ঠাট্টা, কখনো বিদ্রুপ, কখনো রাগ বা দ্বেষ আছে। কিন্তু নেই হিংসা, নেই বিদ্বেষ, নেই অসূয়া। একটা ভালোবাসার মোড়ক দিয়ে যেন যন্ত্রণা থেকে উত্তরণের এক চিরন্তন সত্যের কথা, যেমনটা নিজের জীবন দিয়ে নবনীতা দেখিয়েছেন তেমনটাই সৃষ্টির ভিতর দিয়ে তিনি তা দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।
নিজেকে কখনো কখনো 'নারীবাদী' বলতে তিনি বেশ পছন্দই করতেন। কিন্তু তার সেই 'নারীবাদ' তাতে কখনো কোনো উগ্রতার লেবাস যুক্ত ছিল না। সুফিয়া কামাল যেমন বলতেন; আমি ঘর ভাঙার নারীবাদী বিশ্বাস করি না। নবনীতা যেন চিরকাল তার জীবন, তার সৃষ্টি, তার কর্ম, তার যাপন– সবকিছুর ভিতর দিয়েই একটা ভালোবাসার ঠিকানার সুলুক-সন্ধান দিয়ে গেছেন।
'আমি, অনুপম' গ্রন্থে নবনীতা লিখছেন;
"খাবার সময়েও কেষ্ট কিছু বলল না। অনুপমও প্রশ্ন করলেন না। কেউ কি এসেছিল? কেউ কি আসেনি? কেউ শুধু পুতুলের মত খেতে দিল।
কেষ্টর বকবকম আজ বন্ধ রয়েছে। অনুপম নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছেন। মা সামনে বসা। তখনই শোনা গেল, দরজাটায় টোকা পড়ছে।
অনুপমের হাত মাছের বাটিতে স্থির হয়ে গেলো। কেষ্ট আসছিল, হাতে ভাতের পাত্র। হঠাৎ চুপ করে দাঁড়াল।
আবার টোকা। অনুপম প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছেন। বুঝতে পারছেন কেষ্টর দৃষ্টি লেজার বিমের মতো তার কপাল ভেদ করে হাড়মাংসের গভীরে ঢুকে মাথার ভেতরটা লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে।
আবার টোকা। আবার জোরালো হচ্ছে। যেন মাথার মধ্যে গোলাবারুদ, কামান ফাটার আওয়াজ। অনুপমের ইচ্ছে করল অনড় হাতদুটোকে সোজা মাথার ওপরে তুলে ধরেন, চিৎকার করে বলেন, কেষ্ট তুমি ওভাবে তাকিয়ে থেকো না, আমি পারছি না। আই সারেন্ডার।
মা বললেন : 'ও কীরে, খাওয়া বন্ধ করলিস যে? কেষ্টা, ভাতটা দে? 'মা টোকা শুনতে পাচ্ছেন না। মা তুমি শুনতে পাচ্ছ না? তোমার বয়স হয়েছে। কানে কম শুনছ আজকাল। তাই বেঁচে গেছ। মা তুমি আমার এই চিৎকার শুনতে পাচ্ছ না? তুমি কেষ্টর বেয়নট চালানোও কি দেখতে পাচ্ছো না? মা? ছেলেবয়স থেকে তুমি আমার কোনো আর্তনাদ শুনতে পাওনি মা কোন অস্ত্রাঘাত দেখতে পাওনি। আমার সব ক্ষত, আমার সব রক্ত, তোমার চোখে অদৃশ্য থেকে গিয়েছে। এবার টোকা আর পড়ল না। সুইচ বন্ধ করে দিলে সিনেমাতে যেমন ক্রিয়া মধ্যস্থলে চিত্রার্পিত হয়ে থাকে মানুষ, ফের যন্ত্র চালালে নড়েচড়ে ওঠে– কেষ্ট তেমনই নড়ে উঠল। ভাতের পাত্র নিয়ে এগিয়ে এল। অনুপম বারণসূচক হাত নাড়লেন। ভাত চাই না। মা বললেন– 'কেষ্ট, তোর কি হয়েছিল রে, আসতে আসতে হঠাৎ অমন দাঁড়িয়ে পড়লি?"
এক চিরন্তন মাতৃমূর্তি বিদুষী নবনীতা তার নিজের অন্তরের গহীনে চিরকাল লালন করতে পেরেছিলেন বলেই, সাতের দশকের শুরুর প্রেক্ষিত নিয়ে ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসে মাতৃত্বের কাকুতি এভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ছেলেবেলা থেকে সন্তানের আর্তনাদ শুনতে না পাওয়া মা– এই যে যত্নের ভিতর দিয়ে নবনীতা চিরন্তন মাতৃমূর্তির ছবি এঁকেছেন, তারা যেন দেশ-কাল-সময়-জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কেবল এক গর্ভধারিণীকেই আমাদের সামনে বারবার মেলে ধরছে। এই গর্ভধারিণীর ভিতরে নবনীতার স্বীয় গর্ভধারিণী রাধারাণী যেমন রয়েছেন, তেমনিই রয়েছেন তার শশ্রুমাতা অমিতা সেন, তেমনিই অন্তরা, নন্দনার মা নবনীতা নিজেও যেন কোথায় একটা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছেন। সন্তানের অস্ত্রাঘাত মা দেখতে পান না। সন্তানের শত অপরাধ, অন্যায় যে মা গর্ভ যন্ত্রণার সেই গভীর স্মৃতিকাতরতা, মেদুরতাতে ভুলে থাকতে চান।
সাম্প্রতিককালের এপার বাংলার বাঙালি (হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে) সমাজে কার্যত গৌরী আইয়ুবের মৃত্যুর পর তার নিজের জীবন দিয়ে, নিজের সৃষ্টির ভিতর দিয়ে অত্যন্ত সফলভাবে দেখিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন একমাত্র নবনীতা দেবসেন। যেমনটা বাংলাদেশে সফল হয়েছিলেন বঙ্গ জননী সুফিয়া কামাল, শহিদ জননী জাহানারা ইমামের মত ব্যক্তিত্বরা।
সাহিত্য জীবনের প্রথম পর্যায়ে নবনীতা লিখেছিলেন; 'কুন্তীনদীর গেরুয়া জল তার সবুজ-ছায়া কাঁপাগলায় /
আমাকে বলেছে,
শুকনো সোনালী গোরুর গাড়িগুলো/
ক্লান্ত কাদাতে গলায় আমাকে বলেছে, /
শেষ হেমন্তের বুড়ো সবুজ পাতারা /
আসন্ন মৃত্যুর খস্ খসে গলাতে বলেছে/ তুমি সুস্থ হ'লেই ওরা আবার ফিরবে। / এমনকি /
তুলসী তলায় যে-প্রদীপটি ধ'রে তুমি/
আমার মুখ দেখেছো, তাকেও ভাসিয়ে দিয়ে, /
একটি শুভ্র স্তব হ'য়ে জ্বলবো তোমার শিয়রে /
আসুক, ওরা ফিরে আসুক, যারা চিরকাল/
শুধু চ'লে যাচ্ছে, এখান থেকে অন্যখানে/
উৎপাটিত একগুচ্ছ কচি সবুজ দূর্বার মতো/
তুচ্ছ, উষ্ণ, কাতর/
আমি তোমার যন্ত্রণা মুছে নেবো:/
তার বদলে, ঈশ্বর, তার বদলে আসুক/ তোমার কাঙ্খিত আরোগ্য। '
শীত সাহসিক হেমন্তলোকের বিষন্ন গোধূলিতেই একদিন এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে তিনি চলে যাবেন– এই অনুরণন কি নবনীতার মনের গহীনে কখনো সৃষ্টির একদম কচি সবুজ পর্বে মর্মরিত হয়েছিল? না হলে কেন অপরের সুস্থতার কামনায় তিনি কোজাগরীর চাঁদকে প্রার্থনা করেছিলেন? কেন চেয়েছিলেন 'আগামী বছরের কলা গাছটির স্বপ্ন'?
'চলে যেতে যেতে সবাই তো তাই ব'লে গেলো'– তা যেন নবনীতাকে চিরজীবন পায়ের তলায় সর্ষে দিয়ে এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে সেখানে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। তাই বোধহয় চরম আধুনিক বাস্তববাদী হয়েও কখনো কখনো ব্যাখ্যা না পাওয়া জিনিসকে ঘিরে তাকে আশ্চর্য হয়ে যেতেও আমরা দেখি।
নবনীতার পিতার নরেন দেবের ছাত্র জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন পরবর্তী জীবনে আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠা সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ। নরেন দেব একবার প্রচন্ড অসুস্থ, প্রায় কোমা পর্যায়ে চলে গেছেন। বাড়িতে শয্যাশায়ী। তার জীবনের আশা আত্মীয়-পরিজনেরা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। হঠাৎ কি জানি কি করে খবর পেয়ে সীতারাম দাস চলে এসেছেন 'ভালোবাসা'য়। সীতারাম দাসের সঙ্গে সর্বক্ষণ সংকীর্তনের একটা দল থাকত। সীতারাম যেতে চাইছেন তার বন্ধুর ঘরে। প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী পিতার কক্ষে এই ধরনের ভজন, কীর্তনের হুল্লোড় নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিতে কিছুতেই রাজি নন নবনীতা। সীতারামের বিশেষ অনুরোধে অগত্যা নিমরাজী হতে হল নবনীতাকে।
নরেন দেবের ঘরে প্রবেশ করে সীতারাম প্রায় কোমায় আচ্ছন্ন বন্ধুকে কয়েকবার ডাকলেন;' নরেন, আমি সীতারাম এসেছি, সীতারাম এসেছি' বলে। বিগত কয়েকদিন ধরে একদম সজ্ঞাহীন যে মানুষটি প্রায় মৃত্যুর সাম্রাজ্যে পা বাড়াতে চলেছেন, বন্ধুর আকুল আহ্বানে চোখ তুলে তাকালেন। এক দু'বার চোখ খুললেন। সীতারাম তারপরই তার কীর্তনের দল নিয়ে ধীরে ধীরে' ভালোবাসা' থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে নবনীতাকে বলে গেলেন; তোর কোনো ভয় নেই। নরেন কিন্তু ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবে।
সেই যাত্রায় নিশ্চিত মৃত্যুকে অতিক্রম করে নরেন দেব কিন্তু শেষপর্যন্ত সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন এবং বেশ কয়েক বছর তার পরেও জীবিত ছিলেন।
নবনীতা তার গোটা জীবনে এই ঘটনার কোন ব্যাখ্যা না পেলেও ঘটনার বাস্তবতাকে কখনো অস্বীকার করেননি। তাই নবনীতার বিশ্বাসের জগতে ধর্ম ঘিরে কোনোরকম অতিরিক্ত বাহ্যিক আবরণ না থাকলেও, লোক দেখানো কোনো নাস্তিকতা কিন্তু তার ছিল না। আবার সেই বিশ্বাসকে বাজারের আলু পটল করে তুলতেও তিনি কখনো চাননি।
হয়তো সেজন্যই 'অজাত প্রেমে' তিনি বলতে পেরেছিলেন;
'কোনো দুরন্ত সম্মান দিয়ে তাকে/ অমন দু'হাতে জড়াতে চেয়ো না, মন–/
মাঠের শস্য বোনা ও তোলার ফাঁকে/ কাটাতেই হবে অনেক, অনেক ক্ষণ।'– এই বাস্তবমুখী চিন্তা-চেতনায় রঞ্জিত নবনীতা কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের একটি অতি প্রয়োজনীয় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন।
নবনীতার নারীবাদী চেতনার মধ্যে যেন ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে রবীন্দ্রনাথের নন্দিনীর সেই সংলাপ; 'আমি নারী বলে আমাকে ভয় করো না! বিদ্যুৎশিখার হাত দিয়ে ইন্দ্র তার বজ্র পাঠিয়ে দেন। আমি সেই বজ্র বয়ে এনেছি। সরদারও বিদ্রুপ করে নন্দিনীকে সম্মোধন করে– 'ওগো ইন্দ্রদেবের আগুন'। '
নবনীতার কথায়; 'কাজেই নন্দিনীর নিজের মুখের কথা থেকেই আমরা ধরে নিতে পারি, কখনো সে রক্তকরবী ফুল, কখনো বা ইন্দ্রদেবের বজ্র। একই নন্দিনী চরিত্রে দুটি দিক আছে, সেই হলো ফুলের হৃদয়ে স্থিত অগ্নি, পদ্মের মাঝকানে বজ্র। '
নন্দিনীর যে চরিত্র নির্মাণ নবনীতা তার, 'ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য প্রবন্ধে' করেছিলেন, সেখানে নিজেই লিখছেন; "আমি বলতে চাই 'রাজা' এবং 'রক্তকরবী'তে একই থিমকে দুইভাবে দুদিক থেকে দেখা হয়েছে। একই মূল বিষয়ে দুই ভিন্ন রূপ এই দুই ভিন্ন চরিত্রের নাটক। কারণ রাজা এবং নন্দিনী একই শক্তি দুই ভিন্ন অভিব্যক্তি, –সেই কেন্দ্রীয় শক্তি, অপরাজেয় পদ্ম যার মাঝখানে আঁকা।"
নবনীতার ক্ষেত্রেও সেই অপরাজেয়তা যেন পরম মমতায় কোনো অদেখা স্রষ্টা সুচারু ভঙ্গিমায় এঁকে দিয়েছিলেন। তাই নারীবাদী নবনীতা, আন্তর্জাতিক সেমিনারগুলিতে প্রাচ্য তথা ভারতবর্ষের যুগ-যুগান্তব্যাপী বহুত্ববাদী, সমন্বয়ী ধারার চিন্তা চেতনার ফসল হিসেবে উঠে আসা নারী চরিত্রের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য একাধারে তুলে ধরছেন, আবার সেই নবনীতাই বিদেশে যাওয়ার পর দেখছেন, আন্তর্জাতিক সেমিনারে যে সন্দর্ভটি তার পড়বার কথা, সেটি কলকাতার বাড়িতেই নিজের ব্যাগে ভরতে ভুলে গেছেন। তাই তড়িঘড়ি বসে স্মৃতি হাতড়ে আবার তৈরি করছেন সন্দর্ভ। আর সেটি আন্তর্জাতিকস্তরে বিদগ্ধ মহলে তুলে ধরবার পর সবাইকে মোহিত করে দিচ্ছেন।
সমস্ত রকম নাগরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে হেলায় ফেলে তাবুতে শীতের মধ্যে রাত্রিবাস করে, কনকনে ঠান্ডায় নদীর জলে অবগাহন করে পিতৃকুল ও শ্বশুরকূলের অতি কুলকোটিনাংস্বপত দ্বীপ নিবাসী নামদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন, সেই নবনীতা কিন্তু স্পর্শ বাঁচায় পুণ্যের পথে হাঁটার শুচিবায়ুগ্রস্থতাকে অস্বীকার করে নদীর জলে ডুব দেওয়ার সময় হাতে ধরে রাখছেন নিজের চটি যুগল, পাছে তা ভিড়ে হারিয়ে না যায়। খালি পায়ে তাকে না ফিরতে হয়।
এইযে অগ্নি পদ্মের মাঝখানের বজ্রের সম্মেলন দিয়ে গড়ে ওঠা মানুষটি, তাকে বোঝা, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা খুব একটা মুখের কথা কিন্তু নয়। কারণ, নবনীতার কোন ভড়ং ছিল না। কেউ হয়তো ভালোবেসে আপ্লুত হয়েছেন তার মুখের কথায়। তার স্পষ্টবাদিতাতে ক্ষুন্ন হয়েছেন। আবার কেউ হয়তো তার সোজাসাপ্টা কথা শুনে তাকে 'ক্যাটক্যাটে' বলে মনে করেছেন।
তবু নবনীতা কিন্তু নবনীতাই থেকেছেন। যেটাকে তিনি সত্য বলে জেনেছেন, বিশ্বাস করেছেন, মেনেছেন, সেটাকে স্পষ্টভাষায় বলতে এক মুহূর্তের জন্যেও দ্বিধাবোধ করেননি। সংকোচ বোধ করেননি। লজ্জাবোধ করেননি। নবনীতা নিজের জীবনের অভিব্যক্তি নির্ভর যে আখ্যানমালা, উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, কলাম, রম্য-রচনা, কবিতায় রেখে গিয়েছেন তার জন্য তার 'শতেক বরষ পরে' প্রবন্ধে শরৎচন্দ্র সম্পর্কে তার নিজের বলা কথারই এক অসামান্য অনুরণন। নবনীতা লিখেছিলেন; 'শরৎচন্দ্র নিজেও কাঁদেন না, চরিত্রদেরও বড়ো একটা কাঁদান না। অথচ পাঠক যদি কাঁদে, সেটা কি শিল্পের ত্রুটি, না গুণ?'
এটা যেন নবনীতার জীবন আর সৃষ্টির ভিতরে আমরা বারবার মূর্ত হয়ে উঠতে দেখি। নিজের যন্ত্রণার কথা বলে, সেটা শারীরিক যন্ত্রণাই হোক, আর মানসিক যন্ত্রণাই হোক- একটিবারের জন্যও তিনি কিন্তু চোখের জল ফেলেননি কখনো। অথচ কখনো কখনো তার সৃষ্টির ভিতর দিয়ে ফুটে ওঠা শব্দগুলি যে হৃদয় নিংড়ানো কান্নাকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে, তার জেরে সময়কে অতিক্রম করে, আগের প্রজন্ম থেকে আজকের প্রজন্ম, অর্থাৎ; প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর কিন্তু যদি কাঁদে, সেই কান্নার দায় স্রষ্টার হতে পারে না। সেই কান্নার দায়-দায়িত্ব মহাকালের।
এই দিক থেকে নবনীতার এইসব সৃষ্টিগুলিকে অনেকটা বেগম রোকেয়ার অসামান্য সমাজচিত্র 'অবরোধবাসিনী'র সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সামাজিক অবিচারের জেরে নারীর অবরুদ্ধ অবস্থাকে রোকেয়া যেভাবে তার 'অবরোধবাসিনী'র ভিতর দিয়ে বর্ণনা করেছিলেন, তা যুগ যুগ ধরে মানুষকে কাঁদাচ্ছে। আগামী দিনেও কাঁদিয়ে চলবে। একটা সম্পূর্ণ আকাশের জন্য নারীর কাকুতি রোকেয়ার 'অবরোধবাসিনী'র মতোই নবনীতার সমস্ত সৃষ্টিরগুলির ভিতরেও বারবার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
রোকেয়া বা তার উত্তরসূরি সুফিয়া কামাল বা তাদের পূর্বসূরী নবাব ফয়জুন্নেছার মতো নবনীতা কোনো সংগঠক ছিলেন না। তিনি কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করে নিজের ভাবনাকে একটা সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার দিকে এগিয়ে যাননি। অথচ সংগঠন তৈরি না করেও মানুষের মনকে, বিশেষ করে নারী সমাজের মনকে সংগঠিত করবার কাজে যে ভূমিকা গোটা জীবন ধরে নবনীতা পালন করে গিয়ে চিরবিদায় নিলেন, সেই ভূমিকাকে নিঃসন্দেহে একজন বড় সংগঠনের ভূমিকা বলেই বর্ণনা করতে হয়।
ছদ্মবুদ্ধিজীবীরা যখন তাদের উপার্জিত সম্পদের বাইরে, শাসকের নেক নজরে পড়ে উপার্জনকে বল্গাহীন করতে নানা ছল-বল-কৌশল অবলম্বন করেন, নবনীতা তখন তার পেশাজীবনের অর্জিত অর্থ দিয়ে উত্তরপাড়া গঙ্গার ধারে একটা ফ্ল্যাট কিনে বসেন। ছোট্ট ফ্ল্যাট, বিলাসের সেভাবে রাস্তাই নেই। কিন্তু সেখান থেকে মনের সুখে গঙ্গার বয়ে যাওয়াকে দেখতে পাওয়া যায়। গঙ্গার হাওয়াতে মন প্রাণ হৃদয় জুড়িয়ে দেওয়া যায়।
আমাদের সাধারণ স্বাভাবিক বুদ্ধিতে, অর্থ কৌলিন্যের মাপকাঠিতে গোটা ব্যাপারটাকে পাগলামো বলে হয়তো মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই ছিলেন নবনীতা। যতদিন শরীর ভালো ছিল ছেলেমানুষের মতো বিয়ের কার্ড সংগ্রহ করা ছিল তার একটি অত্যন্ত প্রিয় নেশা। তার প্রিয়জনদের এটা দায়িত্বের ভিতরে পড়তো যে, তাদের বাড়িতে আসা বিভিন্ন রকমের বিয়ের কার্ড নবনীতাকে পৌঁছে দেওয়া।
গত প্রায় ৫০ বছর ধরে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বিবাহের আমন্ত্রণ পত্রের ভিতর দিয়ে বাংলার সমাজ চিত্রের ক্রমবিবর্তন নিয়ে যদি আগামী দিনে কোনো মানুষ গবেষণা করেন, তাহলে তাকে নবনীতার এই ব্যক্তিগত সংগ্রহ ব্যবহার করা ছাড়া গবেষণা কাজ সম্পন্ন করা আদৌ সম্ভব হবে না।
নারীবাদী নবনীতা কি পুরুষ বিদ্বেষী ছিলেন? যারা নবনীতাকে নিয়ে খুব বেশি চর্চা করেননি বা নবনীতাকে ব্যক্তিগত স্তরে দেখবার, জানবার সুযোগ পাননি তাদের মধ্যে এই প্রশ্ন তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক।
কেবল নবনীতার শেষ জীবনের একটি ঘটনা উল্লেখ করলেই বোধহয় এ সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা পাঠক পেতে পারেন। তার পরিচিত একজন মানুষ বিবাহের মাত্র সাতদিন পরে দেখলেন সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে, খবরের কাগজ থেকে সম্বন্ধ করে যে নারীটিকে তিনি বিবাহ করেছেন, তিনি হর্সিটিজমে আক্রান্ত।
কিছু বাদ-প্রতিবাদের পর যখন তাদের বিবাহবিচ্ছেদের সম্ভাবনা তৈরি হলো, নারীবাদী নবনীতা কিন্তু সেই ছেলেটিকে দীপ্ত কণ্ঠে বললেন; কঠোরভাবে আইনি লড়াই লড়তে।
ছেলেটি দ্রুত মীমাংসা চাইলে তার কম্পেন্সেশন বাবদ দেওয়া টাকার একটা বড় অংশ সামরিকভাবে নবনীতা নিজেই দিয়ে দিলেন। সেই ব্যক্তিটি কিন্তু নবনীতার আদৌ আত্মীয় নন। তবে অতি পরিচিত। ছেলেটি অবশ্য কিছুদিন পরেই তার ঋণটি নবনীতাকে পরিশোধ করে দিয়েছিলেন।
এটিই হলেন নবনীতা। তার নিজের বর্ণিত রক্তকরবী নাটকের নন্দিনী চরিত্রের দুটি দিক ফুলের হৃদয় স্থিত অগ্নি আর পদ্মের মাঝখানে বজ্রের সমাহার। অগ্নি আর পদ্মের বজ্র সম্মিলনই হলেন নবনীতা দেবসেন।