Published : 30 Oct 2019, 02:36 PM
চিলিতে একদিনে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি লোক জড়ো হয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে সরকারকে একটি বার্তা দিয়েছে। বলেছে, অসমতা দূর করো, না হলে সরে যাও।
হংকংয়ের বিক্ষোভের মতো চিলির এ জমায়েত কিংবা কয়েকদিনের আন্দোলন-সহিংসতা পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে অত গুরুত্ব দিয়ে আসেনি। তাতে যে ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে রাখা গেছে তা নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এমাথা ওমাথা লোকে লোকারণ্য সান্তিয়াগোর ছবি এখন বিশ্বজুড়ে ভাইরাল। সমাবেশের কোথাও কোথাও গিটার হাতে একদল বাদকের সুর, সঙ্গে অসংখ্য লোকের কণ্ঠ মিলিয়ে গাওয়া ভিক্টর হারার গান, কিংবা অসংখ্য সহজবোধ্য কিন্তু আক্রমণাত্মক ফেস্টুন, পোস্টার অনেকেরই নজর কাড়বার কথা।
চিলির জনসংখ্যা দুই কোটির কাছাকাছি, আর ২৫ অক্টোবরের সমাবেশেই ছিল ১০ লাখের বেশি মানুষ। আয়োজকরা বলছেন দ্বিগুণ, প্রায় ২০ লাখ। কমটাই যদি ধরি, তাও ওই দিন লাতিন দেশটির মোট জনসংখ্যার অন্তত ৫ শতাংশ রাজধানীতে এসেছিল; মিছিল করেছে, গান গেয়েছে, স্লোগান ধরেছে, প্রাণ খুলে একটা কথাই জানিয়েছে, তারা আর এ বৈষম্যের রাষ্ট্র, বৈষম্যের দুনিয়া পছন্দ করছে না। চায় সবার জন্য সমান সুযোগ, সবার সম্ভাবনার সর্বোচ্চ বিকাশ।
নতুন কোনো কথা না। শতকের পর শতক ধরে অগণিত শোষিত বঞ্চিত মানুষ এই কথাই বলে আসছে। অবশ্য কোটি মুখে বিলিয়ন বিলিয়ন বার বলার পরও বিশ্ব নেতৃত্বের হুঁশ হয়নি, এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তা হবার কথাও নয় বোধহয়। সবার ভোটাধিকারই তো মিললো অল্প কিছুদিন আগে, আর তো সমতা। চিলিতে লাখ লাখ মানুষের বিশাল এ জমায়েতের আগের দিনই একদিনে ৭০০ কোটি ডলার খু্ইয়েছিলেন আমাজনের প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোস। অবশ্য তার জন্য এটা মোটেও তেমন কোনো অর্থ নয়; আজ গেছে, কাল আসবে। বেজোস, বিল গেটসের মতো মাত্র কয়েকজনের হাতে যে সম্পদ, সমগ্র পৃথিবীর কয়েকশ' কোটি মানুষের হাতেও এত সম্পদ নেই। মুদ্রার ঠিক অপর পিঠে, এখনো পৃথিবীর কয়েকশ কোটি লোকের দৈনিক আয় দুই ডলারেরও নিচে। দুনিয়া এত দূর এগিয়ে গেছে, শত শত স্যাটেলাইট মহাকাশে রওনা হচ্ছে; প্রযুক্তির বদৌলতে এক মুহুর্তেই আমরা হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিতে পারছি, অথচ বিশ্বের সংস্থাগুলোকে কিনা এখনও ক্ষুধাসূচক করতে হয়। হিসাব নিতে হয়, এখনো পৃথিবীর কত শত দেশের কী পরিমাণ মানুষ না খেয়ে আছে। কী অদ্ভূত বৈপরীত্য। চিলির জনগণের আন্দোলনের গূঢ় প্রশ্নও সম্ভবত এখানেই।
আমাদের জন্য আচমকা হলেও, আদতে হুট করে সান্তিয়াগোতে এই জমায়েত হয়নি। অসমতার বোধ তো হাজার বছরের। ভুলবে কি করে মানুষ। ভুলেওনি। তাই এই বোধের বিবৃতি হারিয়েও যায়নি দুনিয়া থেকে, কখনো কখনো ভেতরে ভেতরে গুমরে মরেছে, কখনো বিস্ফোরিত হয়েছে। কিন্তু সবসময়ই নানান ফর্মে, নানান প্রকারে হাজির হয়েছে। এই শতকেই কি খোদ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির কেন্দ্রস্থলে এ প্রশ্নের উত্তর চেয়ে ঝাঁকুনি দেওয়া হয়নি। 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিটের' আন্দোলনের স্মৃতি কি খুব পুরনো হয়ে গেছে? না। কেবল কি সম্পদের পুনর্বন্টনের প্রসঙ্গে, অন্যান্য অনেক কিছুর মোড়কেও শেষতক অসমতার বিষয়টিই যেন ফের সারাবিশ্বের সবদেশের নাগরিকদের প্রধানতম জিজ্ঞাসায় পরিণত হয়েছে।
গত বছর ফ্রান্সে যে আন্দোলন হয়েছিল, তার কথাও স্মরণে থাকা উচিত পাঠকদের। জ্বালানি তেলের খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রতিবাদে শুরু হওয়া এ আন্দোলনে পরে আরও যেসব দাবি যুক্ত হয়েছিল তার মধ্যে ছিল ন্যূনতম আয় বৃদ্ধি ও সামাজিক খাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির কথা। সেই আন্দোলন মাসের পর মাস ধরে চলেছে, হাজারও টিয়ার শেলের ক্যানিস্টার, জলকামান তাকে দমাতে পারেনি। বঞ্চনার সেই ক্ষোভের আগুনে এরপর একে একে পুড়েছে হাইতি, আলজেরিয়া, সুদান, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া। কোথাও কোথাও জনজীবনের মানবৃদ্ধির দাবির সঙ্গে সঙ্গত কারণেই এসেছে সরকার পতনের ডাক।
সেই ঢেউ থামেনি। বরং অক্টোবরে যেন সুনামি হয়ে আছড়ে পড়ছে। লাতিন থেকে উত্তর ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে এশিয়া। এখনও চলছে; কেবল চিলিতেই নয়, চলছে ইরাকে, লেবাননে। 'কোনো সমাধান' না পেয়ে পদত্যাগ করতে চাইছেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি। ইকুয়েডরে আদিবাসীরা রাজধানীরই দখল নিয়ে নিয়েছে। বেচারা প্রেসিডেন্টকে সরকারি দপ্তর সরিয়ে নিতে হয়েছে অন্য এক শহরে। হাইতিতে সাধারণ মানুষ বিমানবন্দর দখলে নিয়ে এক দফা প্রস্তাব হাজির করল। 'এখানে একটাই বিমান নামবে, আর তা প্রেসিডেন্ট জোভেনেল মোইসকে এখান থেকে নিয়ে যাবে'। হাইতিতে ন্যূনতম মজুরি মাত্র আড়াই ডলার। সবখানেই একই তুষের আগুন। জনগণের স্বপ্নই কেবল চুরি হচ্ছে না; উদ্দাম বেসরকারিকরণ আর সেবা, সম্পদ, শিক্ষা-চিকিৎসা সব কিছু উন্মুক্ত করে দাও- এই তত্ত্বের ফ্যাকড়ায় পড়ে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে একের পর এক দেশ। কেন এগুলো ঘটছে? কাদের উদরপূর্তি নিশ্চিত করতে গিয়ে এমন অনাচার?
পৃথিবীর যে সম্পদ, তার সুষম বন্টন নিশ্চিত হলে, কারওই তো অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চাকরি, চিকিৎসা, সামাজিক নিরাপত্তা কিংবা আরও আরও প্রয়োজনীয় আকাঙ্ক্ষা মেটাতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথচ তাকিয়ে দেখুন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরই এসব নেই। যাদের আছে, তাদের আরও চাহিদা। তাহলে 'অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপলের' সরকার-রাষ্ট্র করছেটা কি?
চিলির সেই লাখ লাখ মানুষগুলোর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলা যায়- কিছুই করছে না। তারা লুটপাটে তাল দিচ্ছে, তেলা মাথায় তেল ঢালছে। না কেবল সহযোগী হিসেবে নয়, পারলে নিজেরাও নেমে পড়েছে। জলবায়ু নিয়ে অশনি সঙ্কেতের মধ্যে সুযোগ পেলেই তারা বন পুড়িয়ে দিচ্ছে (সবাই নন, কেউ কেউ হেলিকপ্টার থেকে পানি ছিটিয়ে আগুন নেভাতেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন), কোটি কোটি ডলারের যুদ্ধাস্ত্র কিনছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির শ্লথগতি নিয়ে অনেক অর্থনীতিবিদই সতর্ক করে যাচ্ছেন; অথচ অস্ত্রের বাজারের দিকে তাকালে তা মনে হবে না। শক্তিধর সবগুলো দেশ যেন বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত, তাই হু হু করে বাড়ছে তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট। কেবল তারাই কেন, কে বাদ যাচ্ছে? কেউ না। এসবের জ্বালানি তারা খুঁজে নিচ্ছে জাতীয়তাবাদে, পপুলারিজমে। এতসব আয়োজনের মধ্যে গ্রেটা থানবার্গের মতো স্কুল শিক্ষার্থীদের কিংবা পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর কথা শোনার সময়ই বা কই?
কোনো কোনো বিশ্লেষক এ দশককে বলছেন নয়া-উদারবাদ বা নিও-লিবারেলিজমের মৃত্যুঘণ্টার দশক। উদারবাদের 'রাষ্ট্রকে দুর্বল করে প্রতিযোগিতাকে উন্মুক্ত' করার মিশন শেষ পর্যন্ত হাসি চওড়া করেছে বৃহৎ পুঁজিকে। এ থেকে উত্তরণের জন্য নানান টোটকা হাজির হচ্ছে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। সে কারণে, 'খোলা হাওয়ার' ওয়াশিংটনকেও এখন নিতে হচ্ছে সংরক্ষণবাদের বটিকা। ডনাল্ড ট্রাম্প, একের পর এক পণ্যে শুল্ক বাড়াচ্ছেন; কিন্তু গত দশকেও কি আমরা তাদেরই কাছ থেকে সারা দুনিয়াকে বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়ার নিরলস বাণী ঝাড়তে দেখিনি?
সান্তিয়াগোর এই উদ্দাম জনজোয়ারের শুরুটাও হয়েছিল, গত কয়েক বছরে অন্য সব দেশে ঘটে যাওয়া তুমুল গণআন্দোলনগুলোর মতোই। ছোট কোনো অসন্তোষ, যা হ্যাচকা টানে এতদিনের জোয়াল সরিয়ে নেয়। চিলির ক্ষেত্রে- এই `টাইট্রেশন পয়েন্ট' ছিল মেট্রোর ভাড়াবৃদ্ধি। সরকারি সিদ্ধান্তে প্রতিবাদে জনগণ রাস্তায় নামলো; পুলিশ তা থামানোর চেষ্টা করলো। লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল, ওয়াটার ক্যানন, কোথাও কোথাও গুলি। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা গেল না। রাস্তায় নেমে মানুষ আরও বেশি অকুতোভয় হয়ে উঠল। লাঠিচার্জ, টিয়ার শেলের পাল্টা জ্বললো আগুন। বিক্ষোভ, সহিংসতা। উপায়ান্তর না দেখে সরকার পিছু হটল; মেট্রোর ভাড়াবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত রদ হলো। কিন্তু মানুষ ঘরে ফিরলো না। এবার তাদের টার্গেট 'অসমতা'।
সান্তিয়াগোর সড়কগুলোতে জনগণের তোড় যত বাড়ছিল, ততই সুর নরম হচ্ছিল সেবাস্তিয়ান পিনইয়েরার সরকারের। সান্তিয়াগোর দেয়ালে দেয়ালে কথা উঠছে- 'ইটস নট পেসো, ইটস থার্টি ইয়ার্স'। কোন ৩০ বছর? গণতন্ত্রের ৩০ বছর? তবে কি চিলি ১৯৯০-র আগের অগাস্তো পিনোশের জমানায় ফিরে যেতে চায়? তার উত্তরও মিলবে সান্তিয়াগোর রাস্তাতেই।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ'র প্রত্যক্ষ মদদে 'চিলির কসাই' খ্যাত পিনোশে ক্ষমতায় এসেই সোশালিস্ট নেতা সালভাদর আলেন্দের অনুসারী ও বামপন্থি-কমিউনিস্টদের নির্বিচারে হত্যায় নেমে পড়েন। ১৯৭৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর চিলি স্টেডিয়ামে আলেন্দের পপুলার ইউনিটি পার্টির কর্মী সমর্থকদের সঙ্গে ধরে বেধে নিয়ে আসা হয় কমিউনিস্ট কর্মী ভিক্টর হারাকেও, যিনি একাধারে ছিলেন কবি, নাট্য পরিচালক, গায়ক, গীতিকার ও শিক্ষক। পিনোশের সৈন্যরা যখন তার নখ উপড়ে ফেলছিল, গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল আঙুলগুলো, হারার কণ্ঠে তখনও ছিল গান। মাথায়, গায়ে ৪০টা বুলেটের ক্ষত নিয়ে পড়ে থাকা তার লাশের আশপাশেও যেন ছিল ফিরে আসার প্রতিধ্বনি।
চিলির রাস্তায় রাস্তায় সেই সুর আবার ফিরে এসেছে। অসমতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সেই সুরের মধ্যেই ছবি হয়ে মিছিলে মিছিলে ঘুরছেন আলেন্দে; বিশ্ব কি এ বার্তা শুনতে পারছে?