Published : 23 Oct 2019, 04:55 PM
সাতচল্লিশ সালে দেশভাগের অব্যবহিত আগে জামায়াতে ইসলামীর আমীর মওদুদী 'জামায়াত-ই-ইসলাম কী দাওয়াত' নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন। সেই পুস্তিকাটিতে ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে তৈরি রাষ্ট্র পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মুসলমান কিভাবে ভারতে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষা করবে এবং তার বিনিময়ে ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দুরা কিভাবে পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করবে– তার একটি ফর্মুলা দিয়েছিলেন।
বস্তুত গত সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক হিন্দু ও রাজনৈতিক মুসলমানেরা সেই ফর্মুলারই অন্ধ অনুকরণ করে চলেছে। ভারতবর্ষে যখন সংখ্যাগুরু রাজনৈতিক হিন্দুরা সংকটাপন্ন হয়েছে, তখন পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু রাজনৈতিক মুসলমান, বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু রাজনৈতিক মুসলমানেরা তাদের অভিন্ন শ্রেণির স্বার্থের তাগিদে পরস্পরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে এতোটুকু কুণ্ঠাবোধ করেনি।
বিভাগ পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু রাজনৈতিক মুসলমানেরা যুদ্ধ উন্মাদনার ভিতর দিয়ে সে দেশের সাধারণ মানুষ, যারা ধর্মে মুসলমান হয়েও ধর্মের রাজনৈতিক কারবারি নন, তাদেরকে ধর্মের কারবারি করে তুলেছেন ভারত বিদ্বেষের জুজু দেখিয়ে। অপরপক্ষে ভারতবর্ষে সব রকমের শাসকেরা চিরকাল দেশপ্রেমের নামে উগ্রতাকে এমন একটা জায়গায় স্থান দিয়েছেন, যার জেরে রাজনৈতিক সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে বল্গাহীন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।
ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের উপর দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশের মানুষদের উপরে এক ধরনের ছায়া ঔপনিবেশিকতা চালাতে, ভারতবর্ষের তৎকালীন শাসকেরা দ্বিধাবোধ করেনি। ফারাক্কা বাঁধ তৈরির মধ্যে দিয়ে গঙ্গার মতো আন্তর্জাতিক একটি নদীর জলধারার ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশে ইসলামী ও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মাথা তুলবার মতো সুযোগ একদিন ইন্দিরা গান্ধী করে দিয়েছিলেন।
বস্তুত, বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শাহাদাত বরণের পর মওলানা ভাসানী যে ফারাক্কা লংমার্চের ডাক দিয়েছিলেন, সেই ডাকের ভেতর দিয়ে একদিকে যেমন ভারতবর্ষে সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজ একটা বড় রকমের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে চলে গিয়েছিল, তেমনি ভারতের সংখ্যালঘু রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি প্রচণ্ড রকমের উৎসাহিত হয়েছিল। মওলানা ভাসানীর এই কার্যক্রম বাংলাদেশ ইসলামীয় মৌলবাদকে নতুন করে মাথা তোলবার সুযোগ মুক্তিযুদ্ধের পর অনেক ব্যাপকভাবে করে দিয়েছিল।
দেশভাগের সময় কাল থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু অভিজাত সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ ভারতবর্ষের সম্পদ স্থানান্তর করতে থাকে। ব্যাপক আকারে সম্পদ স্থানান্তরের ফলে, সদ্য স্বাধীন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান বড় রকমের আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়। আর্থিক সংকটের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের দিকে পরিচালিত করার তাগিদ সে দেশের সংখ্যাগুরু, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি কখনো ছেড়ে দেয়নি।
অপরপক্ষে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন রকমের রাজনৈতিক কারণে, নিজেদের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে শক্তিশালী করবার তাগিদে, হিন্দু সম্প্রদায়ের যে অংশ ভারতবর্ষের চলে এসেছেন, তারা শাসকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা পাতিয়ে ভারতবর্ষের বুকে নিজেদের অবস্থানকে বৈধ করে নিয়ে, বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি, সেখানকার নাগরিকদের, সর্বিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে একটা ভয়াবহ অসত্য অপবাদ ছড়িয়ে ভারতবর্ষে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি আরএসএস ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে শক্তিশালী করেছে।
একটা সময় পশ্চিমবঙ্গের বুকে বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলন যথেষ্ট শক্তিশালী থাকার সুবাদে, নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশ থেকে চলে আসা হিন্দুদের বেশিরভাগ অংশই বাংলাদেশের মুসলমান সম্প্রদায় সম্পর্কে অপবাদ ছড়ানোর কাজ টি প্রকাশ্যে করবার সাহস পেত না। বিগত নয় বছর ধরে শাসন ক্ষমতায় পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা নেই। বামপন্থীদের রাজনৈতিক বাঁধনটা সামাজিক স্তরে অনেকটা আলগা হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ বাংলাদেশের গোটা নাগরিক সমাজ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গে তথা ভারতবর্ষে ভয়ঙ্কর প্ররোচনামূলক গুজব ছড়িয়ে আরএসএস বিজেপিকে নানাভাবে সাহায্য করে চলেছে।
এই কাজটি কার্যত গত শতাব্দীর নয়ের দশকের প্রথম পর্ব থেকে শুরু করেছিলেন তসলিমা নাসরিন, সালাম আজাদের মত বেশ কিছু বাংলাদেশের নাগরিক। হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি কর্তৃক ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অব্যবহিত পরে বাংলাদেশের ঘটনাক্রমকে কেন্দ্র করে 'লজ্জা' নামক একটি ভয়ঙ্কর প্ররোচনামূলক, অসত্য কাহিনীনির্ভর উপন্যাস রচনা করেছিলেন তাসলিমা নাসরিন।
সেই উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র 'সুরঞ্জন'কে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক হিন্দুদের মধ্যে একটা ভয়াবহ ভাবাবেগ তৈরি করে দেওয়ার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলেছিল। এই ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান কারিগর ছিলেন বাংলাদেশের সেই সময়ের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন বিএনপি-জামাত জোট এবং ভারতে আরএসএস বিজেপি সহ তাদের নানা ধরনের রাজনৈতিক সঙ্গী-সাথীরা। এই সময়কালে আরএসএসের উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গের শহরতলীর ট্রেনগুলোতে পর্যন্ত পাঁচ টাকা ছয় টাকা করে তসলিমার লেখা 'লজ্জা ' বইটির নকল সংস্করণ বিক্রি হয়েছে মুড়ি মিছিলের মতো।
পবিত্র ইসলামকে কলঙ্কিত করবার লক্ষ্যে, বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশের মানুষকে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় হেয় করবার লক্ষ্যে খ্রিস্টান মৌলবাদের অত্যন্ত বিশ্বস্ত দালাল হিসেবে তসলিমা নাসরিন সেদিন পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের বুকে যে অপরাধমূলক কাজ করেছিলেন, তার জেরে ভারতবর্ষে বিজেপি যথেষ্ট শক্তি অর্জন করে। সেই শক্তি অর্জনের ইনাম হিসেবে তসলিমা নাসরিন আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষের শাসক বিজেপির আতিথ্যে ভারতবর্ষে অবস্থান করছেন। একজন বিদেশী নাগরিক হয়েও ভারতবর্ষের আভ্যন্তরীণ বিষয় সম্পর্কে অত্যন্ত নিম্নমানের, কুরুচিকর, সাম্প্রদায়িক প্ররোচনামূলক, মৌলবাদী বিদ্বেষ পরায়ণ প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
স্বৈরাচার এরশাদের শাসনকালে একবার বিবিসি (সাম্প্রতিক 'ভোলা' জেলার কর্মকাণ্ড নিয়েও একই কাজ তারা করছে) অসত্য প্রচার চালিয়েছিল; যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে। সেই প্রচারের জেরে বাংলাদেশে একটা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সেই উত্তেজনার পরিবেশকে ভারতবর্ষে মুসলমান সমাজের উপর শারীরিক-মানসিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সংস্কৃতিক-ধর্মীয় অত্যাচারে পরিণত করবার সব রকমের প্রচেষ্টা আরএসএস ও বিজেপি চালিয়েছিল।
বাংলাদেশের দাঙ্গা বাধার পরিবেশ তৈরি করে দু'দেশের মৌলবাদী শক্তির ভিতর বোঝাপড়াকে অবলম্বন করতে দু'দেশের মৌলবাদী শক্তিই তৎপর থেকেছে সবসময়ে। সাম্প্রতিক অতীতে ভারতবর্ষের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর সব ধরনের অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে, সামাজিক বিভাজনের পরিবেশকে তীব্র করে তুলে, নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি বিজেপির সংসদীয় গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রসারের কাজটি এভাবেই পাকাপোক্ত করতে শুরু করেছিল আরএসএস।
নব্বুইয়ের দশকের এই প্রবণতা আজ পর্যন্ত দগদগে ঘা হয়ে ভারতবর্ষের বুকে বসে রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর, সে দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়– সব দিক থেকেই অনেকখানি ভালো অবস্থায় আছে। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের এই ভালো অবস্থায় থাকার বিষয়টিকে কোনো অবস্থাতেই ভারতবর্ষের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে প্রকাশিত হতে দেয় না আন্তর্জাতিক সংবাদমাদ্যম এবং বিজেপি।
শেখ হাসিনা দ্বিতীয় পর্যায়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর, পাকিস্তান আমলের কুখ্যাত 'শত্রু সম্পত্তি আইন' অবলুপ্ত করে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু নাগরিকদের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার দিক থেকে অনেকখানি সুনিশ্চিত করেছেন। আজও ভারতবর্ষের বুকে এই ' শত্রু সম্পত্তি আইন' বহাল তবিয়তে রয়েছে। এই আইনের সুযোগ নিয়ে ভারতবর্ষে আজও ক্ষমতাসীনেরা দুর্বল অসহায় অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর চরম অর্থনৈতিক শোষণ, নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।
গোটা বিষয়টি নিয়ে কিন্তু ভারতবর্ষের প্রচার মাধ্যমগুলি কার্যত হিমশীতল নীরবতা অবলম্বন করে চলেছেন। রাজনৈতিক দলগুলি এই নিয়ে তাঁদের যথাযথ ভূমিকা পালন করছেন না। অপরপক্ষে গত বেশ কয়েক বছর ধরে সামাজিক গণমাধ্যম সমাজ জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠার দরুন, এই সামাজিক গণমাধ্যমে সাম্প্রদায়িক শক্তি উভয় দেশেই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে দাঙ্গা সম্পর্কে নানা ধরনের অসত্য প্রচার চালাচ্ছে।
ভারতবর্ষে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে সামাজিক প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশ ঘিরে ভয়াবহ অসত্য প্রচার পর্ব চলে। বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায় সে দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ভয়াবহ অত্যাচার চালাচ্ছে– এমন সব মনগড়া, রোমহর্ষক কাহিনির ভিডিও চিত্র, নানা প্রযুক্তিগত কৌশল অবলম্বন করে ভারতবর্ষের বুকে প্রচারিত হয়। বাংলাদেশের মুসলমান হিন্দুদের মন্দির অপবিত্র করছে। হিন্দু বিগ্রহকে অপমান করছে– এমন ধরনের নানা রকমের ছবি প্রচারিত হয়। এসবের ভিতর দিয়ে ভারতবর্ষের সংখ্যাগুরু রাজনৈতিক হিন্দুরা, ভারতের বুকে নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে প্রসারিত করবার লক্ষ্যে, সামাজিক গণমাধ্যমকে ভয়াবহভাবে ব্যবহার করে দু'দেশেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পারদ কে ছড়াচ্ছে।
বাংলাদেশের ভিতরে সেদেশের সংখ্যাগুরু মৌলবাদী বিপদ সম্পর্কে সে দেশের প্রশাসন ও ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক সমাজ সম্পুর্ণ ওয়াকিবহাল। এ সম্পর্কে কোনো প্রামাণ্য খবর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রায় প্রচারিতই হয় না।
গত বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে একদল দুষ্কৃতী সেখানকার সংখ্যালঘু মানুষদের উপরে কিছু অত্যাচার চালিয়েছিল। এই অত্যাচারের কাহিনী ফলাও করে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হয়েছে। সামাজিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু যারা এই অত্যাচার চালিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার যে কি কঠোর কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন, সে সম্পর্কে একটি কথা ও ভারতবর্ষের কোনো গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়নি। বাংলাদেশের বিশিষ্ট সমাজকর্মী তথা মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে কতখানি আন্তরিক লড়াই করেন, সে সম্পর্কে ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের কোনো ধারণা গড়ে তোলবার কাজে ভারতবর্ষের একটি প্রচারমাধ্যমও এতোটুকু সাহায্য করেনি।
ভারতবর্ষের প্রচার মাধ্যমগুলির প্রায় সবটাই বাংলাদেশে সেখানকার সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর কি ধরনের অত্যাচার চালাচ্ছে সে সম্পর্কে তসলিমা নাসরিনের মনগড়া খবরগুলি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে আজ পর্যন্ত পরিবেশন করে। কিন্তু বাংলাদেশের ভিতরে থেকেই সুলতানা কামাল বা অতীতে তাঁর মা সুফিয়া কামাল, কবি শামসুর রাহমান, কলিম শরাফী, কবীর চৌধুরী প্রমুখ মুক্তবুদ্ধির মানুষ জনেরা তাঁদের নিজেদের দেশের সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে কতখানি সচেষ্ট ছিলেন, কতখানি আন্তরিক ছিলেন– সে সম্পর্কে ভারতবর্ষের সংবাদমাধ্যমগুলোতে একটি শব্দ উচ্চারিত হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গে গত প্রায় নয় বছর আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিস্তার জলবণ্টন ঘিরে এক ধরনের অচলাবস্থার তৈরি হয়েছে। এই অচলাবস্থা ঘিরে দুই দেশেই সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানকে জোরদার করবার খুব বড় রকমের সুযোগ পেয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত স্বার্থের কথা তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘদিন ধরে তিস্তার মতো একটি আন্তর্জাতিক নদীর জল বন্টনের ক্ষেত্রে বড় রকমের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এটি বাংলাদেশে যেমন সে দেশের সংখ্যাগুরু, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তিকে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে, ভারতবর্ষের সঙ্গে সুসম্পর্কের প্রশ্নে, বাংলাদেশ সরকারকে বেকায়দায় ফেলার সুযোগ করে দিচ্ছে। তেমনি ভারতবর্ষে সংখ্যাগুরু, রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তিকে বাংলাদেশ সম্পর্কে, বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে, বিদ্বেষী করে তুলছে।
সেই বিদ্বেষকে ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে মুসলিমবিদ্বেষে পর্যবসিত করে, তাদের রাজনৈতিক শক্তি বিজেপিকে পায়ের তলায় জমি শক্ত করবার সবরকমের সুযোগ করে দিচ্ছে আরএসএস। ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশেই সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মৌলবাদী শক্তিকে, তাদের রাজনৈতিক সংগঠনগুলিকে জোরদার করে করার ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি বড় রকমের অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
একদিকে নিজেদের আর্থিক স্বার্থকে সুরক্ষিত করবার তাগিদে বাংলাদেশ থেকে চলে আসা হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ সেদেশের দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিয়ে নানা ধরনের কল্পকাহিনী অর্ধ সত্য বিকৃত সত্য উপস্থাপিত করে ভারতবর্ষে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির প্রতিভূ বিজেপিকে সবরকমের সুযোগ করে দিচ্ছে। অপরদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা', এবং 'ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা'র সুবাদে ভারতবর্ষের মানুষদের একটা বড় অংশকে বাংলাদেশের মানুষদের প্রতি বিদ্বেষ পরায়ন করে তুলছেন।
সেই বিদ্বেষকে মুসলিমবিদ্বেষে পর্যবসিত করে সামাজিক বিভাজনকে তীব্র করে তুলে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থকে প্রসারণৃর সুযোগটিকে কোনো অবস্থাতেই হাতছাড়া করছে না বিজেপি ও তার সঙ্গী সাথীরা। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে এপার বাংলার সংস্কৃতিকর্মীরা ও যে খুব ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছেন– তা কিন্তু বলতে পারা যায় না। অতীতে এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে অন্নদাশঙ্কর রায়, গৌরকিশোর ঘোষ, গৌরী আইয়ুব, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ প্রমুখেরা যে ভূমিকা পালন করতেন, তেমন ভূমিকা আজকের কবি-সাহিত্যিকদের ভিতরে প্রায় দেখতে পাওয়া যায় নাই বলা চলে।
বাংলাদেশের প্রতিবাদী কন্ঠকে এপার বাংলায় প্রচার দিতেও এপার বাংলার প্রচারমাধ্যমের ভয়ানক কুন্ঠা। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের বৃহত্তর বরিশালের কিছু সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। সেই উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট করার জন্য খ্রিস্টান মৌলবাদ, হিন্দু মৌলবাদ পরস্পর পরস্পরের হাত ধরে চলছে।
গোটা বিষয়টি ঘিরে সাম্প্রদায়িক প্রচারের পারদকে লাগামহীন করে তোলা হচ্ছে। এই প্রবণতা থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে শেখ হাসিনা ও তাঁর ধর্ম নিরপেক্ষ চিন্তাকে অপদস্ত করার যে ষড়যন্ত্র চলছে, সেই ষড়যন্ত্রে ভারতবর্ষের সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় যে অংশীদার নয় তা হলফ করে বলতে পারা যায় না।
এইরকম একটি পরিস্থিতিতে ভোলা জেলার নিন্দনীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে যে ধরনের অর্ধসত্য বিকৃত সত্য পরিবেশিত হচ্ছে, তার জেরে ভারতের গোটা পূর্বাঞ্চল জুড়ে সামাজিক পরিমণ্ডলকে হিন্দু-মুসলমান এই দুই ভাগে ভাগ করে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তপোক্ত করে তোলবার কাজটি বিজেপি খুব জোরদারভাবে করতে শুরু করে দিয়েছে।
গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির দাপটে ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র এখন বড় রকমের সংকটের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। যুগ যুগ ধরে যে বহুত্ববাদী সমন্বয়ী চিন্তা ভারতবর্ষ বুকে ধারণ করে এসেছে, সেই চিন্তাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে। সেই ষড়যন্ত্রেরই একটি অংশ হলো বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপরে নানা ধরনের ঘটনাক্রম। সেই ঘটনাগুলির বিকৃত, অর্ধসত্য প্রচার।
এই প্রচারকে অবলম্বন করেই নির্বাচনী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে ক্ষমতায় আসা বিজেপি চাইছে তাদের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে। ভারত-বাংলাদেশ উভয় দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মানুষকে ঘিরে, দুই দেশের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক, ভাষা ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির এই অপচেষ্টাকে যেকোনো মূল্যে রুখতেই হবে। এই প্রবণতাকে না রুখলে বাংলাদেশে যেমন টিকতে পারবে না, তেমনি ভারতবর্ষ ও টিকতে পারবে না। মানব সভ্যতা ও টিকতে পারবে না।
তাসলিমা নাসরিনকে কেন্দ্র করে আরএসএস অত্যন্ত পরিকল্পনামাফিক একটা ভাবাবেগ ভারতবর্ষের বুকে, পশ্চিমবঙ্গের বুকে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। বুঝে হোক না বুঝে হোক প্রগতিশীল মানুষদের একটা বড় অংশ এই ভাবাবেগের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে রেখে প্রকারান্তে ভারত ও বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির লড়াইকে অনেক কমজোরি করে দিয়েছেন।
অন্নদাশঙ্কর রায় তসলিমার মতপ্রকাশের অধিকারের পক্ষে সরব থাকলেও তাঁর নিজস্ব চেনাজানা জগতের দৌলতে, 'বাংলাদেশের নাগরিক মাত্রই সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছেন', 'হিন্দু বিদ্বেষী হয়ে গেছেন'– তসলিমার তৈরি করে দেওয়া এই সরলীকরণের তত্ত্বের সঙ্গে কখনোই নিজেকে সম্পৃক্ত করেননি। অন্নদাশঙ্কর অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জানতেন তাঁর ভগিনীসমা সুফিয়া কামালকে। তাই তিনি কখনোই বিশ্বাস করেন নি যে, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর বাংলাদেশের বুকে তৈরি হওয়া সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার মধ্যে ' লজ্জা' উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র 'সুরঞ্জন', বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের কাছেই সামাজিক আশ্রয় পাননি– এই বিষয়টি।
অন্নদাশঙ্কর সেইসময় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে; আর কেউ থাকুন না থাকুন, আমার বোন সুফিয়া তো আছেন। সুরঞ্জন তো সুফিয়ার কাছে গিয়ে আশ্রয় চাইতে পারত। আইয়ুব খানের মুখের উপরে যে তাঁকে জানোয়ারদের বাদশা বলবার দুঃসাহস দেখাতে পারে, সাম্প্রদায়িক জন্তুদের হাত থেকে যেকোনো পরিস্থিতিতে সে তো সুরঞ্জনের মতো সহনাগরিককে বাঁচাতে চেষ্টার ত্রুটি করত না।
তসলিমার উপন্যাসের চরিত্র' সুরঞ্জন' যেভাবে তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেছিলেন, অন্নদাশঙ্কর কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও তাকে সমর্থন করতে পারেননি।
অপরপক্ষে ইলা মিত্র বা ফরওয়ার্ড ব্লক নেত্রী অপরাজিতা গোপ্পী তাসলিমাকে ঘিরে সেই সময় যে ধরনের কর্মকাণ্ডের পরিচয় দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে একবারও সহমত পোষণ করতে পারেননি কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেত্রী গীতা মুখার্জি। নিজেদের সেদিনের অবস্থান যে আরএসএস নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে শক্তিশালী করার কাজে সব রকমভাবে ব্যবহার করছে– এটা বুঝে ওঠার মত রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ইলা মিত্রদের ছিল না।
ইলা মিত্ররা সেদিন যে রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার পরিচয় রেখেছিলেন, সেই পথ ধরেই কিন্তু বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক শক্তি, সে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে চলতে পারার সাহসকে অনেকখানি সংগঠিত করবার সুযোগ পেয়েছিল।
পরবর্তীতে ঘাতক-দালালদের বিচারের কর্মসূচি সংগঠিত হওয়ার পরেও নিজেদের দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নানা ধরনের নিন্দনীয় ঘটনা ঘটিয়ে জামায়াতে ইসলাম, ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ নানা ধরনের বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠনগুলিকে সংগঠিত হওয়ার বার সুযোগ করে দিয়েছিল।
অপরপক্ষে ভারতবর্ষে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক শক্তি তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে যাতে আরো বিস্তার ঘটাতে পারে, সেজন্য পথ পরিষ্কার করে দিয়েছিল এই ঘটনাক্রমকে ভিত্তি করে।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ভারতে একটি ভারতীয় সংবাদপত্রে এক সাক্ষাৎকারে শামসুর রাহমান প্রকাশ্যেই বলেছিলেন; তসলিমার নারী আন্দোলনের ক্ষতিই করছে।
এই প্রেক্ষিতগুলি ভারতবর্ষে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশ সেদিন যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে থেকে রাজনীতিবিদ প্রদীপ ভট্টাচার্যের মতো মানুষজনেরা তসলিমা নাসরিন বা তার মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতির আকাঙ্ক্ষায় কার্যত পাগল হয়ে যাওয়া সালাম আজাদ– এদেরকে ঘিরে সেই সময়ে যেসব কর্মতৎপরতা দেখিয়েছিলেন, সেই সব কর্মতৎপরতারই ফসল হলো আজকের বিজেপির এই বাড়বাড়ন্ত।
তৃণমূল কংগ্রেসের সুলতান আহমেদ তাসলিমা কে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের বুকে সংখ্যালঘু মৌলবাদকে সংহত হবার সব রকমের সুযোগ করে দিয়ে সংখ্যাগুরু মৌলবাদী শক্তি আরএসএস বিজেপিকে কোমরের বাধন টি কে শক্ত হওয়ার ও সুযোগ করে দিয়েছিলেন একুশ শতকের প্রারম্ভে। তৃণমূল কংগ্রেসের সুলতান আহমেদের অতি তৎপরতাকে ব্যবহার করে তসলিমার প্রতি সহমর্মিতার নাম করে সুযোগ কাজে লাগিয়েছে বিজেপি।
এভাবেই রাজনৈতিক হিন্দু মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিশ্বস্ত দালাল হিসেবে তসলিমাকে ব্যবহারের ভিতর দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তিকে বিজেপি গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ভারতবর্ষের বুকে জোরদারভাবে বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে আরএসএস।