Published : 03 Sep 2019, 04:39 PM
কত শত রাত পড়ার টেবিলে একাডেমিক পড়াশোনার জন্য নির্ঘুম কাটালে, একজন শিক্ষার্থী বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে, তা আমি জানি। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আমিও অজস্র রাত পার করেছি বইয়ের পাতায়। স্বপ্ন দেখেছিলাম আমিও একদিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবো। সেজন্য প্রয়োজনীয় পরিশ্রমও করেছিলাম। ফলশ্রুতিতে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২৫ বছরের ইতিহাসে রেকর্ড সংখ্যক নম্বর পেয়ে স্নাতকোত্তরে প্রথম স্থান অর্জন করি।
কিন্তু, যে স্বপ্নকে নিয়ে আমার এত সাধনা, এত শ্রম এক শর্তের বেড়াজালে পড়ে তা আজ ভেস্তে যেতে বসেছে। ভেস্তে গেছেও বলা চলে। এ জটিলতার কারণ আমাদের স্নাতকের ফলাফল। সর্বোচ্চ ফলাফলধারী হয়েও আমিসহ আমাদের ব্যাচের কেউই স্নাতকের ফলাফলে সিজিপিএ-৪ এর মধ্যে ৩.৫০ পায়নি। আমার স্নাতকের (সম্মানের) ফলাফল ছিল ৩.৪৪। কিন্তু, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগের বিজ্ঞাপনে আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়, প্রার্থীকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে অন্তত ৩.৫০ পেতে হবে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এর চেয়েও বেশি সিজিপিএ চাওয়া হয়। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয় ফলাফলে কারও মেধাস্থান ছিল কিনা, তা বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয় না। ফলশ্রুতিতে, দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম স্থান অর্জন করেও কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক পদে আমি আবেদনই করতে পারছি না।
শুধুই কি আমি? এমন করুণ অবস্থা আমার বিভাগের অনেকগুলো ব্যাচের। সোজা ভাষায়, আমার বিভাগে ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে শুরু করে সর্বশেষ ফলাফল পাওয়া ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত কোনো শিক্ষার্থীই স্নাতকের (সম্মান) ফলাফলে ৩.৫০ পায়নি। একই জটিলতায় পড়ে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ধুলিস্মাৎ হয়ে যেতে বসেছে চবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ইংরেজি বিভাগসহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর। অথচ এমনও দেখেছি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফলাফলে ২য় শ্রেণী পেয়েও অনেকে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শুধুমাত্র তাদের মেধাস্থান ছিল বলে।
মেধাস্থানের বিষয়টি কেন উল্লেখ করছি এরও ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার বলে মনে করছি। ধরি, কোনো বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের জন্য ন্যূনতম শর্ত হিসেবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ফলাফল ৩.৫০ চাওয়া হলো। দেখা যায়, অনেক বিভাগে কোন ব্যাচে ৫০ জন শিক্ষার্থীর ৩০ জনই এই সিজিপিএ পেয়ে থাকে। এক্ষেত্রে, নিয়োগ পাওয়ার জন্য প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীর সাথে ৩০তম স্থান অর্জনকারী শিক্ষার্থীটির কোনো পার্থক্য থাকে না। কারণ, উভয়েই ন্যূনতম সিজিপিএর শর্ত পূরণ করছে। এই ফাঁকটিকে কাজে লাগিয়ে মেধাস্থানে না থেকেও পেছনের সারির অনেক শিক্ষার্থী আজকাল অহরহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন। আবার যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগগুলোতে ফলাফল ৩.৫০ ওঠে না, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম, দ্বিতীয়সহ মেধাস্থান অর্জনকারীরা আবেদনও করতে পারছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগগুলোতে ফলাফলে এ তফাৎ দেখা যায় কেন, তাও আলোচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সিলেবাস প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফল প্রদানের ক্ষেত্রে বেশ স্বাধীন এবং এ পদ্ধতিগুলোও প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। এমনকি বিভাগ, অনুষদ ভেদেও এই বিষয়গুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। ফলশ্রুতিতে, একই ডিসিপ্লিনে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ফলাফলে বেশ পার্থক্য দেখা যায়। এমনকি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাবর্ষেও ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল দেখা যায়। উদাহরণস্বরুপ, আমরা যদি ঢাকা, রাজশাহী বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের কোনো একটি নির্দিষ্ট শিক্ষাবর্ষের ফলাফলের তালিকাটা দেখি, তাতে যে ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়, তা চাক্ষুস প্রমাণ হিসেবেও দাবি করা যায়।
সম্প্রতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের অভিন্ন নীতিমালার বিষয়টি নিয়ে আবারও আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্য যে অভিন্ন নীতিমালা নিয়ে কাজ করছে, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে কেউ যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হতে চায়, তাকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফলাফলে ন্যূনতম ৩. ৫০ পেতে হবে। কোনোটিতে এর কম থাকলে হবে না, এমনকি পিএইচডি ডিগ্রী থাকলে না। এর চেয়ে হাস্যকর ও বেদনাদায়ক আর কী হতে পারে! তাহলে, বলা যেতে পারে, এই অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা, এমনকি বর্তমানে বিদ্যমান নীতিমালা অনেকেরই তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নকে, নীতি নির্ধারণীমহলের অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের কারণে কবর দিতে হচ্ছে কোনো রকম আওয়াজ ছাড়াই।
হ্যাঁ, মেধাস্থান অর্জনকারী ন্যূনতম সিজিপিএর জটিলতায় ভোগা এইসব শিক্ষার্থীদের অনেকেই হয়তো বিসিএস দিবে, অন্য কোনো চাকুরির চেষ্টা করবে, ভালো কোনো সরকারি চাকুরি করবে। কিন্তু, তার কাছ থেকে জাতির যা পাওয়ার কথা, জাতিকে যা দেওয়ার জন্য সে প্রস্তুত ছিল, তা আর হবে না। কারণ, তার বন্ধুরা যখন তৃতীয় বা চতুর্ষ বর্ষে এসেই দরজা-জানালা বন্ধ করে বিসিএস ও অন্যান্য সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঐ ছেলেটি অত্যন্ত যত্ন করে বিভাগ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান-সাধনায় ব্যস্ত ছিল, স্বপ্ন বুনছিল শিক্ষক হওয়ার। বাধ্য হয়ে অন্য কোনো পেশায় এসব মেধাবী শিক্ষার্থীরা যাবে হয়ত, তবে সেটা তার স্বপ্নের পেশা হবে না, ভালোবাসার পেশা হবে না। যে কাজে ভালোবাসা নেই এর ফলও খুব বেশি সুখকর হয় না। ফলে, একদিকে স্বপ্নের যেমন মৃত্যু ঘটবে, তেমনি ভুক্তভোগী ব্যক্তিটিও কাউকে স্বপ্ন দেখাতে ভুলে যাবে। আজীবন স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়বে।
আমার বিশ্বাস, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা একজন শিক্ষার্থীর বহু দিনের লালিত স্বপ্ন। এই স্বপ্নের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। পড়াশোনা ও জ্ঞান অর্জন করে সে স্বপ্নকে গড়ে তুলে অনেক শিক্ষার্থী। পরিশ্রম করেই তাকে মেধাস্থান পেতে হয়। এজন্য প্রকৃত মেধাবী ও আগ্রহীদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আনতে একটা উপায় হতে পারে এমন যে, যারা অন্তত নিজ নিজ বিভাগে ১ম থেকে ৫ম স্থান অর্জন করেছে, তারা শিক্ষকতায় নিযুক্তির ক্ষেত্রে সুযোগ ও অগ্রাধীকার পাবেন। এবং তাদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সিজিপিএর শর্তটি শিথিলযোগ্য। আমি আশাকরি, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অভিভাবক হিসেবে ইউজিসি এ বিষয়ে একটি তড়িৎ ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা রাখবে।