Published : 29 Jan 2019, 08:34 PM
সুবর্ণচরে ভোটের দিন নারীকে গণধর্ষণ। ধানের শীষে ভোট দেওয়ার কারণে এই অপরাধ সংঘঠিত হয়েছে- এমন কোনও প্রমাণ খুঁজে পায়নি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এই না-পাওয়া কোনো দার্শনিক, তাত্ত্বিক না-পাওয়া নয়। একেবারে হাতে-কলমে না-পাওয়া।
কমিশনের তদন্ত দল তদন্ত করেছে। করে জেনেছে গণধর্ষণটির সাথে ভোটের কোনও সম্পর্ক নেই। কমিশনের ভাষায়: "একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাথে ভিকটিম পারুল বেগমের মারপিট ও ধর্ষণের শিকার হওয়ার কোনও সম্পর্ক তদন্তকালে তদন্ত কমিটির সামনে উন্মোচিত হয়নি। বরং, ভিকটিমের স্বামীর দায়েরকৃত এজাহারের ভাষ্য মতেই এটি আসামিদের সাথে পারুল বেগমের পূর্ব শত্রুতার জের।" উদ্ধৃত অংশের কয়েকটি শব্দ বেশ অর্থবহ। প্রথমত, কমিটি অপরাধের সাথে সংসদ নির্বাচনের কোনও "সম্পর্ক" পায়নি। দ্বিতীয়ত, ভিকটিমের স্বামীই বলেছেন ধর্ষণের ঘটনা হলো 'পূর্ব শত্রুতার জের'।
২.
কেন অর্থবহ? সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটি খবরের কিছু অংশ পড়ে নেয়া যাক।
সেই খবর, যেটি পড়েছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। পড়ে সংবাদটিকে অভিযোগ আকারে গ্রহণ করেন। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের বাংলা সংস্করণের সেই খবরটি:
গুরুতর আহত অবস্থায় নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৩৫ বছরের ওই নারীর অভিযোগ, নির্বাচনে বিএনপি'র ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দেওয়ায় তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। চর জুবিলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য রুহুল আমীনের নেতৃত্বে এই পাশবিক কাজ করা হয়েছে বলে জানান ওই নারী। তিনি বলেন, "তারা আমাকে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার জন্য জোর করেছিলো, কিন্তু আমি তাদের কথা না শুনে ধানের শীষে ভোট দিয়েছি।
অপরাধের ওই অভিযোগ অস্বীকার করেন রুহুল। তার এই অস্বীকৃতির কথা ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনটিতেই প্রকাশ হয়। কোন্ অভিযোগ? ধর্ষণের অভিযোগ, নাকি ধানের শীষে ভোট দেয়ার কারণে ধর্ষণের অভিযোগ। এমন কোনও সুস্পষ্ট উত্তর খবর পড়ে পাওয়া যায় না। এই না-পাওয়া অস্বাভাবিকও নয়। তবে সংবাদ পাঠকের এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ধর্ষণের ঘটনাটি অস্বীকার করেছেন রুহল।
রুহুল ও তার সঙ্গীরা অস্বীকার করলেও ধর্ষণের সত্যতা তদন্তে ঠিকই পেয়েছে মানবাধিকার কমিশন। ভিকটিম, ভিকটিমের স্বামী, থানায় অভিযোগকারীসহ সাত জনের সাথে কথা বলে অপরাধের সত্যতা পায় কমিশন। ভিকটিম যে হাসপাতালে ছিলেন তার তত্ত্বাবধায়ক, গাইনি চিকিৎসক, ভিকটিমের কাছে উপস্থিত মানুষদের সাথে আলাদা আলাদা কথা বলে কমিশনের তদন্ত দল।
তবে এত এত মানুষের সাথে কথা বলেও ধর্ষণের সাথে নির্বাচনের কোনও 'সম্পর্ক' পায়নি কমিশন। এই না-পাওয়ার ঘটনাটি আসলে লিখিত শব্দের সাথে বাস্তব জীবনের মিথষ্ক্রিয়ার এক বেদনাদায়ক দৃষ্টান্ত। কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে আগাগোড়া এটা স্পষ্ট যে কমিশন ডুবে ছিল ডেইলি স্টারের খবরের শিরোনাম আর মামলার এজাহারের টেক্সটের ভেতর। ভিকটিমের কাছে কমিশনের প্রত্যাশা ছিল "আমি ধানের শীষে ভোট দিয়েছি, তাই আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে" ধরনের বাক্য সম্বলিত জবানবন্দি।! এজাহার বা জবানবন্দিতে এরকম কোনো বাক্য বলেননি ভিকটিমের স্বামীও। তাই ধর্ষণের সাথে নির্বাচনের 'সম্পর্কে'র প্রমাণ পায়নি কমিশন।
৩.
তদন্তের সময় দুটি বিষয় বিবেচনা করেছিল মানবাধিকার কমিশন। প্রথমটি ছিল ভিকটিম গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন কি না। দ্বিতীয়, ভিকটিমের ধর্ষণ ও গুরুতর আহত হওয়ার সাথে গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনও 'সম্পর্ক' আছে কি না।
'সম্পর্ক' ও 'প্রমাণ'- দুটি ভিন্ন বিষয়। তবে মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত দল 'সম্পর্ক' ও 'প্রমাণ'কে সমার্থক মনে করে থাকতে পারেন! কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন পড়ে তাই ধারণা হয়! প্রতিবেদনের শুরু থেকেই দেখা যায় ধর্ষণের সাথে নির্বাচনের 'সম্পর্ক' খুঁজছে কমিশন। তবে সেই প্রতিবেদনের শেষে বলা হচ্ছে: "গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষে ভোট দেওয়া বা তদ্রুপ ভোট দেওয়ার কারণে তার [ভিকটিমের] ধর্ষণ ও গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হওয়া বা আসামিগণের আওয়ামী লীগে কর্মী হওয়া বা আওয়ামী লীগের কোনও কর্মী দ্বারা পারুল বেগমের মারপিট ও ধর্ষণের শিকার হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় না।"
বেশ, 'প্রমাণ' নাহয় না-ই পেল কমিশন। কিন্তু 'সম্পর্ক'? এটা পাওয়ার কোনও সুযোগ কি ছিল কমিশনের তদন্ত দলের? কমনসেন্স ও টেক্সট দুটি দিয়েই ধর্ষণের সাথে নির্বাচনের 'সম্পর্ক' খুঁজে পাওয়ার সুযোগ তাদের ছিল। যদি না তারা কেবলই ডেইলি স্টার ও এজাহারের শব্দের অনুরাগে ডুবে না থাকতেন। তাদের সামনে ওই দিনের ঘটনা নিয়ে একাধিক পত্রিকা ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ছিল। সেসব সংবাদে ভিকটিমের উদ্ধৃতি ছিল। কী উদ্ধৃতি: "তারা আমাকে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার জন্য জোর করেছিলো, কিন্তু আমি তাদের কথা না শুনে ধানের শীষে ভোট দিয়েছি।"'
শব্দানুরাগী কমিশনের তদন্ত দল ডেইলি স্টারের ওই খবরের আরো একটি অংশ পড়তে পারত। এতে আছে ভিকটিমের স্বামীর বক্তব্য: "… তার স্ত্রী গত রবিবার সকাল ১১টায় চর জুবিলী প্রাথমিকে বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে যান। সেখানে তিনি সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের কাছ থেকে ব্যালট পেপার নিয়ে বুথে যেতে চান। ওই সময় আওয়ামী লীগের কর্মী রুহুল আমীন তাকে নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য জোর করেন। কিন্তু, তাকে (রুহুল আমীন) যখন বলা হয় যে ধানের শীষে ভোট দেওয়া হয়েছে, তখন তিনি ব্যালট পেপারটি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু, এরমধ্যেই তার স্ত্রী ব্যালটটি বাক্সে ঢুকিয়ে দেন। এতেই রুহুল ক্ষেপে যান এবং দেখে নেওয়ার হুমকি দেন।"
৪.
ফেরা যাক কমিশনের প্রতিবেদনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দবন্ধ 'পূর্ব শত্রুতার জের'-এ। ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছে ভিকটিমের সাথে আসামিদের 'পূর্ব শত্রুতার জের' ধরে। এজাহারের এই শব্দবন্ধটি কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে একাধিকবার এসেছে।
প্রতিবেদন পড়তে পড়তে একটি প্রশ্ন ঘুরছিল মাথায়: সময়ের হিসেবে পূর্ব শত্রুতার পূর্ব শব্দটির ব্যাপ্তি কত দূর? কত আগের শত্রুতাকে (বা বন্ধুতাও) পূর্ব শত্রুতা বলা যেতে পারে? কয়েকদিনের পুরনো বিরোধ হতে হবে তবেই কি তাকে আমরা 'পূর্ব শত্রুতা' বলতে পারব? অথবা কয়েক মাসের? কয়েক বছরের? কত বছরের? কয়েক ঘণ্টা আগের বিরোধকে 'পূর্ব শত্রুতা' বলা যাবে? বলা গেলে কত ঘণ্টা আগের বিরোধকে তা বলা যাবে? না বলা গেলে কেন বলা যাবে না?
এই 'পূর্ব শত্রুতা'র পূর্বের সময়সীমা নিয়ে রীতিমত বিভ্রান্তই হয়ে গিয়েছিলাম। তবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত দল সেরকম কোনও জটিলতায় পড়েনি বোঝাই যায়। কারণ এজাহারে বলাই আছে, 'পূর্ব শত্রুতার জের' ধরে ওই ঘটনা ঘটেছে। এর মানে কি এই যে ভোটের দিন বচসা হয়েছে, সেই দিন গড়িয়ে আসা রাতেই ধর্ষণ হওয়ায় অপরাধটি ওই বচসার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে না?
এজাহারের আরেকটি বক্তব্য কমিশনের মতো শব্দানুরাগী মন নিয়ে পড়েছিলাম। পড়ে মনে হয়েছিল ধর্ষণের ঘটনাটি তো আসলে ভোটের দিন ঘটেইনি! কিভাবে? এজাহারে বলা আছে ভোটের তারিখের দিন শেষে আসা রাতে সাড়ে ১২টার দিকে আসামিরা তাদের বাসায় ঢোকে। তারপর ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটে।
শব্দানুরাগী মন বলল, ভোট হয়েছে ৩০ ডিসেম্বর, রাত ১২টার পর ক্যালেন্ডারে ৩১ ডিসেম্বর। তাহলে এই ধর্ষণ আর ভোটের দিন হয় কী করে!