Published : 15 Dec 2018, 01:40 PM
আগামী ত্রিশে ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়েছে। মাঠে-ঘাটে-রাজপথে-অলিতে-গলিতে এখন কেবল নির্বাচনী প্রচার। মনোনয়নপ্রাপ্ত ও স্বতন্ত্র থেকে আসন্ন নির্বাচনে যে প্রার্থীরা অংশগ্রহণ করছেন, তারা প্রত্যেকেই নিজেদের কর্মপদ্ধতি ও ক্ষমতায় গেলে দেশ ও জাতির জন্য কী কী করবেন— সে বিষয়ে বক্তব্য-বিবৃতি রাখছেন। নির্বাচনের এমন উৎসবমুখর পরিবেশেও গলার কাঁটার মতো যে ক্ষোভটি আটকে আছে, তা হলো— এবারের নির্বাচনেও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী, যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের অনেকেই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছে।
দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিরোধিতা করে যেসব রাজনৈতিক দল পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গণহত্যা, নারী নির্যাতন আর নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছিল বাংলার মুক্তিকামী জনতার ওপরে, তারাই এখন স্বাধীন দেশে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। ব্যাপারটি এমন নয় যে, এটাই প্রথম। এই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে এরাই কলঙ্কিত করেছিল ২০০১ সালের নির্বাচনে। দুইজন কুখ্যাত আল-বদর কমান্ডার এদেশে মন্ত্রী হয়েছিল; সাঈদী, সাকা চৌধুরীর মতো যুদ্ধাপরাধীরা এদেশের পবিত্র সংসদকে কলঙ্কিত করেছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের একেবারে শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন শহিদ পরিবারের সদস্যরা। বঙ্গবন্ধু সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু করলেও পঁচাত্তরের পর এ বিচার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ দিনের সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গটি আনে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিচার কাজও শুরু করে তারা। রাজাকার কাদের মোল্লার লঘুদণ্ডের প্রতিবাদে ২০১৩ সালে জন্ম নেয় শাহবাগ আন্দোলন। কেবল সকল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির রায়ই নয়; যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামাত ও তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিও উত্থাপিত হয় শাহবাগ আন্দোলন থেকে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে আশাব্যঞ্জক ও কার্যকর অগ্রগতি হলেও এখনও বিচারকার্য চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকগুলো সত্য আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে। এই বিচারকার্য পরিচালনার সময়েই আমরা দেখেছি, যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন ও তাদের পরিবারের সদস্যরা কীভাবে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত করেছে এই বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। আমরা দেখেছি, যুদ্ধাপরাধীদের দোসররা রাজনৈতিকভাবে এখনও সক্রিয় রয়েছে এদেশকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ও অর্থায়নে যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যদের সম্পৃক্ত থাকার ঘটনাও নানা সময়ে তথ্য-প্রমাণসমেত গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। সম্প্রতি আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একাত্তরের পরাজিত অপশক্তির নব-উত্থান লক্ষ্য করছি আমরা। যদিও আদালতের আদেশে রাজাকার সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন, তবুও তাদের কেউ 'ধানের শীষ' প্রতীকে, কেউ বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। অর্থাৎ বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন ও পরিবারের সদস্যদের অংশ নেওয়াটা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়।
দুই
যেকোনও নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারের দিকে আমাদের মতো সাধারণ জনগণ তাকিয়ে থাকেন। আসন্ন নির্বাচনে এখনও পর্যন্ত কেবল বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও জাতীয় পার্টির নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষিত হয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহার এখনও ঘোষিত হয়নি। নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর স্পষ্ট বক্তব্য এখন সময়ের দাবি।
'ভিশন-মুক্তিযুদ্ধ ৭১'- এর আলোকে ব্যবস্থা বদলের লক্ষ্যে সিপিবি ঘোষিত ৩০ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের নির্বাচনী ইশতেহারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধার ও বাহাত্তরের সংবিধানের মূলভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি থাকলেও, যুদ্ধাপরাধী ও তাদের পরিবারের সদস্য এবং সংগঠনের ক্ষেত্রে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। নেই যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ বিষয়ক কোনো প্রতিশ্রুতি। ফলে আর্থ-রাজনীতির প্রশ্নে কীভাবে এই অপশক্তিকে মোকাবেলা করা হবে— সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, একাত্তরের ঘাতক-দালাল-যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে আমাদের নতুনভাবে ভাবতে হবে। বাহাত্তরের সংবিধানে তাদের রাজনীতি করার কোনও অধিকার ছিল না ঠিকই কিন্তু সাতচল্লিশ বছর পর কেবল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় বিষয়টি আর আটকে নেই। ইতোমধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যরা স্বাধীন বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা বাংলাদেশবিরোধী নানাবিধ আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে, অর্থায়ন করছে জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদকে। সুতরাং তাদের নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে আগামী নির্বাচনে জয়ী রাজনৈতিক দল কী পদক্ষেপ নেবে— তা ইশতেহারে থাকা জরুরি।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অত্যন্ত জোরের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতিটি উঠে এসেছিল। বলাই বাহুল্য, সে সময়ে যারা প্রথম ভোটার ছিলেন, তাদের কাছে এটি ছিল প্রাণের দাবি। গত দশ বছরে এই দাবি বাস্তবায়নের পথে হেঁটেছে বাংলাদেশ। রক্ত দিয়েছেন মুক্তচিন্তার ব্লগার-লেখক-প্রকাশকসহ আরও অনেকে। এই সময়গুলোতে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যুদ্ধাপরাধীদের উত্তরাধিকারদের মদদে সংঘটিত জঙ্গিসন্ত্রাস। জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধ না হবার কারণে বা জামাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত সদস্যদের রাজনৈতিক অধিকার রহিত না হবার কারণে কার্যত বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন ঘটছে না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার সময় বিষয়টি স্মরণে রাখবেন বলেই আমাদের প্রত্যাশা।
তিন
জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রশ্ন এলেই একদল সুবিধাবাদী শাক দিয়ে মাছ ঢাকার নানা গল্প ফাঁদেন। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশের ইতিহাস পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের রাজনৈতিক অধিকার রহিত করা হয়েছে। কেবল সংগঠনের সদস্যরাই নয়, যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যদের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারও রহিত করা হয়েছে। জার্মানিতে নাৎসি নির্মূলকরণের অভিজ্ঞতা এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। জার্মানরা নানা আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করে নাৎসিদের মানবতাবিরোধী দর্শন মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। পার্টি নিষিদ্ধ ও সহ-সংগঠনগুলো অবলুপ্ত করার পাশাপাশি তাদের যাবতীয় সম্পদও বাজেয়াপ্ত করা হয়।
এই উদাহরণের পাশাপাশি জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধের আইনি নির্দেশনাও স্পষ্ট। একাধিক যুদ্ধাপরাধীর রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলা হয়েছে এবং নিষিদ্ধের আর্জিও আছে রাষ্ট্রপক্ষের তরফ থেকে। সুতরাং এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে যদি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন করেন— তবে তা নি:সন্দেহে ভোট বিপ্লবের একটি বড় কারণ হবে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ১০ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮০ জন ভোটার রয়েছেন যার শতকরা ২২ ভাগের বয়স ১৮-২৮ এর মধ্যে। এই বৃহৎ অংশের প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ এবারই প্রথম ভোট দিবেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রতি দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই নতুন ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিল। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারটি এখনও ঘোষিত হয়নি। তাদের কাছে প্রত্যাশা যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিসহ তাদের বংশ ও চেতনাগত উত্তরাধিকারদের রাজনৈতিক অধিকার রহিতকরণের দাবির প্রসঙ্গটি যেন তারা এড়িয়ে না যান।