Published : 02 Nov 2016, 02:59 PM
দশম সংসদে ময়মনসিংহ-৭ আসন থেকে নির্বাচিত সাংসদ হচ্ছেন জাতীয় পার্টির এম এ হান্নান। ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে ৩০ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। ১৯৭৩ সালের 'আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল আইন' অনুযায়ী, এর মাধ্যমে এম এ হান্নানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলার ট্রায়ালের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ১ অক্টোবরে যুদ্ধাপরাধী মামলার অভিযোগ সম্পৃক্ততার কারণে সাংসদ এম এ হান্নানকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং অদ্যাবধি তিনি ওই একই কারণে কারাগারে আটক আছেন।
আইনের চোখে একজন ব্যক্তি যতক্ষণ না পর্যন্ত সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হচ্ছেন যে তিনি অপরাধ করেছেন, তাকে অপরাধী বলা যাবে না। এ ব্যাপারটি এম এ হান্নানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রসিকিউশন তাকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারবে যে তিনি অপরাধ করেছেন, তাকে অপরাধী বলা যাবে না।
কিন্তু আমার এ লেখার উদ্দেশ্য হল, এই যে ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর তারিখ থেকে এম এ হান্নান জাতীয় সংসদে একাদিক্রমে অনুপস্থিত আছেন, এর ফলে তার সংসদীয় আসন শূন্য হয়ে যাবে কি না?
সংবিধান হচ্ছে আমাদের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী, সংবিধানের আইনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন বাতিল বলে গণ্য হবে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, সংবিধানকে মেনেই সরকার তার সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। সংবিধান হাতে শপথ নিয়েই আমাদের সাংসদরা সংসদীয় পদে আসীন হন।
সংবিধানের ৬৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, কখন কী পরিস্থিতিতে একজন সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হয়ে যায়, অর্থাৎ তিনি তাঁর সংসদীয় পদে আর আসীন থাকতে পারেন না। সংবিধানের ৬৭(১)(খ) অনুচ্ছেদে বলা আছে–
"কোন সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হইবে, যদি সংসদের অনুমতি না লইয়া তিনি একাদিক্রমে নব্বই বৈঠক দিবস অনুপস্থিত থাকেন।"
সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে 'বৈঠক' শব্দটির অর্থ বলা হয়েছে এভাবে যে, বৈঠক (সংসদ প্রসঙ্গে) অর্থ "মূলতবি না করিয়া সংসদ যতক্ষণ ধারাবাহিকভাবে বৈঠকরত থাকেন, সেইরূপ মেয়াদ।"
এখন প্রশ্ন হল, একজন সাংসদ যদি একাদিক্রমে নব্বই বৈঠক-দিবস অনুপস্থিত থাকেন তবে তার জন্য সংসদের অনুমতি কবে নেবেন? অনুপস্থিতির নব্বই বৈঠক-দিবস অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে না পরে?
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ 'মওদুদ আহমেদ বনাম আনোয়ার হোসেন খান (২০০৮) মামলা'তে বলেছেন, সংসদের অনুমতি নেওয়ার ব্যাপারটি একাদিক্রমে নব্বই বৈঠক-দিবস অনুপস্থিতি কাল অতিবাহিত হওয়ার পরই যৌক্তিক হবে। উল্লেখ্য যে, সংসদের 'রুলস অব প্রসিডিউর'এ কীভাবে নব্বই বৈঠক-দিবস গণনা করা হবে, সে ব্যাপারে কিছু বলা নেই।
তবে ১৯৯৫ সালের 'Special Reference No. 1 of 1995' অনুযায়ী, আপিল বিভাগ বলেছেন, নব্বই বৈঠক-দিবস গণনা করার ক্ষেত্রে সংসদের দুই বৈঠক মধ্যবর্তী কাল এবং একই বৈঠক চলাকালীন সময়ে মুলতবি কাল অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।
এখন প্রশ্ন হল, যদি অভিযুক্ত আসামী এম এ হান্নান ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর গ্রেপ্তার হয়ে থাকেন এবং অদ্যাবধি কারাগারে আটক থাকেন, তবে সংসদীয় বৈঠক থেকে একাদিক্রমে নব্বই বৈঠক-দিবস তিনি অনুপস্থিত থাকলে তার সংসদ আসন শূন্য ঘোষিত করা হবে কি না? আসুন একটু হিসাব মিলিয়ে নিই।
অভিযুক্ত আসামী এম এ হান্নান ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর গ্রেপ্তার হওয়ার পর দশম সংসদের মোট পাঁচটি সংসদীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
অষ্টম সংসদীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর থেকে ২৩ নভেম্বর এবং এই বৈঠক মোট বৈঠক-দিবস ছিল ১২।
নবম সংসদীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি এবং এই বৈঠকে মোট বৈঠক-দিবস ছিল ২৭টি।
দশম সংসদীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে ৫ মে এবং এই বৈঠকে মোট বৈঠক-দিবস ছিল ৯।
একাদশ সংসদীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের ১ জুন থেকে ২৭ জুলাই এবং এই বৈঠকে মোট বৈঠক-দিবসের সংখ্যা ছিল ৩২।
দ্বাদশ সংসদীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত। এ বৈঠকে মোট বৈঠক দিবস ছিল ১০টি।
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, অভিযুক্ত আসামী এম এ হান্নানের গ্রেপ্তারের পর মোট পাঁচটি সংসদীয় বৈঠক বসে এবং ৯০টি সংসদীয় বৈঠক-দিবস ইতিমধ্যে অতিবাহিত হয়েছে।
যেহেতু অভিযুক্ত আসামী এম এ হান্নান ইতোমধ্যে একাদিক্রমে নব্বই সংসদীয় বৈঠক–দিবসে অনুপস্থিত থেকেছেন এবং বর্তমানের দশম সংসদ তার এই অনুপস্থিতির ব্যাপারে কোনো অনুমতি প্রদান করেনি, সেহেতু সংবিধানের ৬৭(১)(খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার সাংসদীয় আসন শূন্য বলেই ধরে নিতে হবে।
এ ব্যাপারে বিনীতভাবে মাননীয় স্পীকার এবং সংসদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।