Published : 17 Aug 2016, 11:58 PM
যেখানে সব ক্ষেত্রে আজ নারীরা পুরুষের সমকক্ষ হয়ে ভূমিকা পালন করে চলেছে, জঙ্গি তৎপরতায় নয় কেন! শেষ পর্যন্ত নারী জঙ্গিরও খোঁজ মিলল! সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির চার সদস্যকে র্যাব গ্রেপ্তার করেছে।
গ্রেপ্তার হওয়া সবাই বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলের ছাত্রী। তাঁদের মধ্যে মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের ছাত্রী আকলিমা রহমান, মৌ ও মেঘনা এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ঐশী। এই উচ্চশিক্ষিত মেয়েরা জিহাদি-জোশে নিজেদের উৎসর্গ করতে তৈরি হয়েছেন।
আমরা যে বলি, শিক্ষার আলো জ্বাললেই সমাজের অন্ধকার দূর হবে, তবে কি তা মিথ্যে? নাকি আমাদের শিক্ষার মধ্যেই এখন আর আলো নেই?
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোই কি কূপমণ্ডূকতার আড়ত? আমাদের ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ, আলগা পরিবারিক বন্ধন, সমাজ-রাজনীতিতে উদগ্র ধর্মমুখী অভিযাত্রাই কি এমন পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে ছেলেমেয়েদের?
গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পর দেশজুড়ে যে জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালিত হচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ধরা পড়া জঙ্গিদের প্রায় সবাই টগবগে যুবক।
এই অল্পবয়সী তরুণ-তরুণীরা যেখানে জীবনের জয়গান গাইবে, বেপরোয়া তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে মাতিয়ে তুলবে সমাজ-সংসার, সৃজনে-নির্মাণে ভরে তুলবে বসুধাকে– সেই তারা আচ্ছন্ন হচ্ছে 'ধর্মরাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার এক মায়া-মরীচিকায়! অবলীলায় খুন করছে, খুনি হচ্ছে। নিজ হাতে রচনা করছে এক-একটি অসীম সম্ভাবনাময় জীবনের সমাধি! তারা এটা কেন করছে? কিসের মোহে?
এই কচিকাঁচার দল, টিন-এজার, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। অসময়ে 'প্রাপ্ত-বয়স' ছোঁয়ার জন্য ওরা যত ব্যাকুলই হোক না কেন, ওদের মুখগুলি সদ্য ফোটা সাদা গোলাপের মতো ঝলমলে! দেখলেই মায়া জাগে।
এরা লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হতে চায় না? পরিবার, দেশ, সমাজের মুখোজ্জ্বল করতে চায় না? চায় না বড় কিছু, ভালো কিছু, মহৎ কিছু করতে? এদের জীবনের প্রতি ভালোবাসা, মানুষের প্রতি মমত্ব শেখানোর কেউ নেই? এদের বাড়িতে অভিভাবক বলে কিছু নেই?
আমাদেরই সন্তান-সন্ততিদের অনেকেই কি একটু একটু করে অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে না? এখন কজন তরুণ-তরুণী মা-বাবার কথা শোনে? মা-বাবাও হাল ছেড়ে দিয়েছেন। আর না ছেড়েই বা উপায় কী? শাসনের করতে গেলে হিতে বিপরীত হয়ে যাওয়ার ভয়, কিছু একটা করে বসার ভয়!
আজকের সন্তানেরা প্রত্যেকেই বেড়ে উঠে, গড়ে উঠে 'নিজস্ব' নিয়মে। যেখানে শৃঙ্খলাহীনতা বা স্বেচ্ছাচারই একমাত্র নিয়ম!
প্রায় তিন দশক আগে আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, তখন কালেভদ্রে চার আনা-আট আনা মায়ের কাছ থেকে বাগাতে পারলে নিজেকে বিল গেটস মনে হত! টিফিনের সময় স্কুল-গেটের বাইরে দাঁড়ানো বুট-বাদাম-চানাচুরওয়ালাদের কাছে থেকে সেসব কিনে খাওয়া হত। কখনও কখনও আইসক্রিম; লাল-হলদে রঙের। আট আনা দিলে মিলত স্পেশাল আইসক্রিম, যেটার লাঠির আগার দিকে একটু নারকেলের প্রলেপ দেওয়া থাকত। এর চেয়ে লোভনীয় কিছু থাকতে পারে কিংবা ওই বয়সে ইহজগতে তদতিরিক্ত প্রত্যাশাও থাকতে পারে, এমনটা আমাদের কল্পনারও অতীত ছিল।
সুযোগ পেলে দু-একটা বিড়িও যে ফুঁকতাম না, এমন তো নয়। কিন্তু বিড়ি খাওয়ার পরেই হয় তেজপাতা কিংবা পেয়ারার পাতা চিবিয়ে মুখের গন্ধ দূর করার কী মরিয়া চেষ্টাই না করতে হত আমাদের। সে যুগে কি কেবল আনস্মার্ট-আহাম্মকগুলোই স্কুল-কলেজে পড়তে যেত? আর এখন?
অক্ষর শেখার আগেই হাতে স্মার্টফোন, বছর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে যে মডেলগুলো ওদের কাছে পুরনো হয়ে যায়। ব্র্যান্ডেড জামা-কাপড়-জুতো না হলে বন্ধু-বান্ধবী মহলে ওদের জাত থাকে না। হাতের ঘড়িটা রোলেক্স বা ট্যাগ হয়ার না হলেও পাতে দেওয়ার মতো কোনো বিদেশি ব্র্যান্ডের হওয়া চাই-ই।
এদের জীবনে খেলাধুলা নেই, বই পড়ার নেশা নেই। মামাবাড়ি, চাচাবাড়ি গিয়ে টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো নেই। চায়ের দোকানের বেঞ্চিতেও কোনো দিন পেছন ঠেকায়নি, বন্ধু-বান্ধবসহ আড্ডার মানে হল হয় কোনো শপিং মল, নয় কোনো দামি রেস্তোঁরা বা ক্লাবে যাওয়া।
বাপের যদি কোনো ক্লাব-মেম্বারশিপ না থাকে সেটা সন্তানের কাছে বিরাট বেইজ্জতির ব্যাপার! থাকলে বিলে সই করার ক্ষমতায় অগাধ স্বেচ্ছাচার। এদের লেখাপড়ার পেছনে মা-বাবার খরচ যত, সারা মাসের পকেট মানির পরিমাণ তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি তো নিশ্চয়ই। ঘরে ঘরে প্রায় হাতি পোষার মতো ব্যাপার, তবু থাক সন্তান তো! আহা! সে যখন চাইছে তখন না বলতে যে বুকটা ভেঙে যায়!
ঈশ্বর পাটনীরা সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখতে পারলেই জীবন সার্থক বলে মনে করত।
আর আমরা? অল্প বয়সে উচ্ছন্নে যাওয়ার যাবতীয় রসদ তার হাতে তুলে দিয়ে, জানি মস্ত ভুল করছি, অন্যায় করছি। তবু চারদিকে তাকিয়ে যখন দেখি অন্যায় করাটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছে, তা থেকে সন্তানকে বঞ্চিত রাখাটা 'পেরেনটাল অপ্রেশন', প্রায় দানবীয় ব্যাপার! তখন ভেতরে ভেতরে উচিত-অনুচিত বোধটা ঘোলাটে হয়ে আসে, সংখ্যাগরিষ্ঠের নিয়মের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসি। হিতাহিত জ্ঞান ভোলা ক্রীতদাসত্বই তখন মনে হয় জীবনের একমাত্র অমোঘ বাস্তবতা।
"আমাদের সময়টা অনেক ভালো ছিল", বলে যেসব প্রবীণ হা-হুতাশ করেন, সন্তানের মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়ে বিস্মিত হন, আমি তাদের দলে নই। সম্ভবত আরও পরিণত বয়সেও থাকব না। কেননা, অপ্রতিরোধ্য সামাজিক বিবর্তনের সামনে ব্যক্তি মানুষ সর্বদাই অসহায়। পেছন ফিরে তাকিয়ে অলক্ষ্যে বুক চাপড়ানোর তাই কোনো অবকাশ নেই।
আমরা কত ভালো ছিলাম, বাবা-মাকে কতটা মান্য করতাম, সন্ধ্যার আজান শোনা মাত্র কীভাবে পড়ি-মরি করে বাড়ি ফিরতাম বাবার ঠ্যাঙানির হাত থেকে বাঁচতে, কীভাবে ঘুমে দুচোখ বুজে এলেও জলের ঝাঁপটা দিয়ে বইয়ের সামনে সজাগ হয়ে বসে থাকার মরিয়া চেষ্টা করতাম– এই সব কাসুন্দি ঘেঁটে আমাদের সন্তানদের অধঃপতনের তুলনা টানাটাও নিরর্থক।
ভালো কিংবা মন্দের বিষয়টি সরিয়ে রেখে তার চেয়ে বরং দেখা যাক, এমন চোখ-ধাঁধানো বদলটা হয়ে গেল কেন এবং তা কীভাবে।
দেশের স্বাধীনতার পর একদল মানুষ ফুলে-ফেঁপে বড়লোক হল। যখন যে দল ক্ষমতায় সেই দলের ছাতার তলায় আশ্রয় নিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে এরটা মেরে, ওরটা কেড়ে দিব্যি সব গুছিয়ে নিল।
আরেকদল গেল মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে, সেখানে গতর-খাটানো উপার্জন নিয়ে দেশে বাড়িঘর, জমিজমা করল। তারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে রিয়াল-দিনার ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এল সেখানকার ধর্মীয় কৃষ্টি-কালচার।
এদিকে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা পেয়ে রাজনৈতিকভাবেও সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হল। জাতীয়-আন্তর্জাতিক উসকানিতে পুষ্ট হতে থাকল ধর্মীয় উগ্রবাদ।
আরেক দল মানুষ পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে ক্রমেই নিঃস্ব হতে থাকল। তাদের নিশ্চিন্ত, নিরাপদ জীবন থেকে সমূলে উৎপাটিত করে দেওয়ার জন্য দায়ী সামরিক জেনারেল এবং পরবর্তীকালে তাদের গড়া রাজনৈতিক দলগুলো।
মুক্তবাজার অর্থনীতি, বিরাষ্ট্রীকরণের নামে স্রেফ কিছু মানুষকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধনী বানানো হল। আর একটা বড় অংশকে নিঃস্ব বানানো হল। এই নিঃস্বদের সন্তানরা মাদ্রাসায় পাঠ নিয়ে ধর্মবাদী হয়ে উঠল।
এই রাজনৈতিক 'যন্তর-মন্তর যন্ত্রে' পিষ্ট হয়ে মানুষগুলো কেমন ক্ষ্যাপাটে হয়ে গেল! অনেকেই রাতারাতি ওসামা বিন লাদেন আর জাওয়াহারির শিষ্য হয়ে গেল। যে মাদ্রাসায় পড়ছে সেও ধর্মরাষ্ট্র চায়, যে দেশের সবচেয়ে নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে সেও জেহাদ চায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও চায়, এমনকি মেডিকেল কলেজে পড়ুয়া ছাত্রীটিও ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জেহাদ চায়!
জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন না হলেও চোখে পড়ার মতো পার্থক্য যেটা এসেছে তা আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে। সহজ, সরল, অনাড়ম্বর জীবন যাপন কিন্তু 'হাই থিঙ্কি', এটাই ছিল আমাদের শৈশবে এবং যৌবনে বাঙালি মধ্যবিত্ত অস্তিত্বের বীজমন্ত্র।
এই নিয়মের ব্যত্যয় যে চোখে পড়ত না তা নয়, তবে তাদের আমরা দূরে দূরে রাখতাম, তাদের মনুষ্যপদবাচ্য বলেই মনে করতাম না। সাধ কিংবা আকাঙ্ক্ষা আমাদেরও ছিল, কিন্তু পাথরে খোদাই করা সাধ্যের লক্ষ্মণরেখার ভেতরে সেগুলো ঘোরাফেরা করত।
আমরা জানতাম লেখাপড়া করলে তবেই একদিন গাড়ি-ঘোড়া চড়ার সুযোগ পাব। গাড়ি-ঘোড়া চড়ে কেউ লেখাপড়া করতে যেতে পারে– এমন একটি উদ্ভট চিন্তা মাথায় আনার প্রশ্নই ছিল না। মানে, মধ্যবিত্তের জীবন সে সময় একটা অব্যক্ত আদর্শগত সুস্থিতির বন্ধনে বাঁধা থাকত।
বঞ্চনাবোধের কষ্টিপাথরে অভাবের যাচাই করতাম না আমরা, বরং সেটাকে সহজ রাস্তায় সহজ জীবনের উন্নততর মার্গ বলে বিশ্বাস করতাম। কিন্তু আশির দশকে তথাকথিত ব্যক্তি মালিকানাবাদী সংস্কারমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এমন প্রলয় ঘটিয়ে দিয়েছে যে, আটপৌরে মধ্যবিত্ত জীবনের চালিকাশক্তি হয়ে গিয়েছে ভোগ আর সম্ভোগ।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ধর্ম পালনের আতিশয্য। আমরা ছিলাম যে যার মতো করে দেশের নাগরিক, আমাদের সন্তানেরা পরিণত হয়েছে কেবলই কনজিউমারে।
সামাজিক বিবর্তনের চালু ধারাটি হল, সময় যখন বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিকে এগোয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর ঘটে সুশৃঙ্খলভাবেই, রূপান্তরটাকে স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। কিন্তু আমাদের পরে আমাদের সন্তানদের প্রজন্মের বদলটা যেন নিয়ম বা শৃঙ্খলা কোনোটাই মেনে হয়নি। একদিকে 'আরও চাই', 'আরও চাই' তাড়না, একই সঙ্গে ধর্মবাদ, ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জেহাদি-জোশ নতুন প্রজন্মকে এক খাপছাড়া অবয়ব দিয়েছে।
এই প্রজন্ম অনেকটা যেন কল্পকাহিনির ত্রিশঙ্কুর মতো, যে জীবিতাবস্থায় স্বর্গে যাওয়ার অদ্ভুত সাধ পূরণ করতে ব্যর্থ হয়ে আরেকটি কল্পিত স্বর্গে শরীরটা উল্টো দিক করে ঝুলিয়ে রেখেছিল!
আমাদের ঘরে-ঘরে, পাড়ায়-পাড়ায়, সমাজে-রাষ্ট্রে আজ কেবল ত্রিশঙ্কুদেরই কলরব!