দুর্দিনে পাকিস্তান যখন ভারতের সহযোগিতা চাইছে, তখন তাদের সবচেয়ে মিত্র চীনের কোনও খবর নেই।
Published : 23 Jan 2023, 07:27 PM
বর্তমানে পাকিস্তানে গড়ে এক ডজন ডিমের দাম সাড়ে তিন শ টাকা। মুরগির মাংস প্রতি কেজি সাত শ টাকা ছুঁইছুঁই। আলু ৬০ আর দুধ ১৯০ টাকা প্রতি লিটার। সাপ্তাহিক মূল্যবৃদ্ধি গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩১ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে কার্যত নাকাল পাকিস্তানবাসী।
জ্বালানি ভাণ্ডারও তলানিতে। জ্বালানি বাঁচাতে 'ন্যাশনাল এনার্জি কনজারভেশন প্ল্যান' করেছে পাকিস্তান। এ পরিকল্পনার আওতায় রাতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই মার্কেট, শপিং মল ও বিয়েবাড়ি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। জ্বালানি সংকটে পাকিস্তানের ট্রেন চলাচলও বন্ধ হওয়ার পথে। দেশের কিছু স্থানে গ্যাস সিলিন্ডারের অভাবে, প্লাস্টিকের বেলুনে এলপিজি ভরে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এখনেই শেষ নয়। বিশ্ব ব্যাংক যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তাতে চিন্তার ভাঁজ গাঢ় হচ্ছে পাকিস্তানিদের। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির মাত্রা কমে মাত্র ২ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার কারণে পাকিস্তানের অর্থনীতি তুমুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছরের বন্যায় পাকিস্তানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। ২০২৪ সালে চিত্রটি কিছুটা বদলাতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পাকিস্তানের ভবিষ্যত ঠিক কেমন হবে, তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারছেন না।
চরম আর্থিক ও খাদ্য সংকটে এই মুহূর্তে পাকিস্তানে আমজনতার নাভিশ্বাস উঠেছে। সর্বত্র শুধুই হাহাকার। পাকিস্তান জুড়ে চলছে ক্ষোভ, বিক্ষোভ। ক্রমেই শ্রীলঙ্কার পথে এগোচ্ছে পাকিস্তান। গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে বিশ্বের দরবারে সাহায্য চাইছে পাকিস্তান। এমনকি ভারতের কাছেও।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্য়ম আল আরাবিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেছেন, 'ভারতের সঙ্গে আমাদের তিনটি যুদ্ধ হয়েছে এবং তার জেরে আমাদের সমস্য়া, দারিদ্র এবং বেকারত্ব- সবই বেড়েছে। আমরা শিক্ষা পেয়েছি এবং শান্তিতে থাকতে চাই। কিন্তু তার আগে আমাদের আসল সমস্য়াগুলো সমাধান করে দেখাতে হবে।'
পাকিস্তানের বর্তমানে যে অবস্থা তাতে শ্রীলঙ্কা হতে বেশি দূরে নয় এক সময়কার পশ্চিম পাকিস্তান। তাই তারা বৈরিতা ভুলে ভারতের সহযোগিতা চাইছে। এজন্য পাকিস্তানের গণমাধ্যমে ভারতের উন্নয়নের প্রশংসা করা হচ্ছে, গাওয়া হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গুণগান।
পাকিস্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন- এ রাজনৈতিক বিশ্লেষক শাহজাদ চৌধুরী এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ভারতের বিদেশ নীতি খুব সুন্দর ও কৌশলগতভাবে ধরে রাখা হচ্ছে। আর জিডিপি ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে ছড়িয়েছে গেছে। তিনি লিখছেন, ‘নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত তার বিদেশনীতির সবচেয়ে ভালো সময়ে দেখছে। ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন মানুষের বসবাসের ভারতে যেভাবে চাষাবাদ হচ্ছে, তা বিশ্বের সেরাদের সঙ্গে তুলনীয়।’
পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মাঝেও জনপ্রিয় হচ্ছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার একটি ভাষণ এখন পাকিস্তানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভারতের গত লোকসভা নির্বাচনী প্রচারে রাজ্যস্থানে এক জনসভায় নরেন্দ্র মোদি কঠোর সমালোচনা করেছিলেন পাকিস্তানের। সেটিই এখন মিলে যাচ্ছে পাকিস্তানে। নরেন্দ্র মোদি ওই জনসভায় বলেছিলেন, “পাকিস্তানের হুমকি খাওয়া নীতি ভারত ছেড়ে দিয়েছে। তারা শুধু বলতো পারমাণবিক বোমা আছে। সংবাদপত্র এ হুমকি নিয়ে বড় বড় খবর ছাপতো। পাকিস্তানের কাছে পারমাণবিক বোমা আছে আর আমাদের কাছে কী আছে? এসব কী দীপাবলির জন্য রাখা আছে? আমরা পাকিস্তানের মুখোশ খুলে দিয়েছি। হাতে থালা নিয়ে তাদের বিশ্ব দরবারে হাত পাততে বাধ্য করেছি।”
দুর্দিনে পাকিস্তান যখন ভারতের সহযোগিতা চাইছে, তখন তাদের সবচেয়ে মিত্র চীনের কোনও খবর নেই। শাহবাজ শরিফ প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসেই ছুটে গিয়েছিলেন চীনে। খুশি করেছিলেন চীনকে। শি জিনপিং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে সাহায্যের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। এর মধ্যে কয়েক মাস কেটে গেছে। কিন্তু শরিফের ভাগ্যে একটি টাকাও জোটেনি। বালুচিস্তান থেকে পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর পর্যন্ত চীনের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। ফলে সাধারণ মানুষও চীনের ওপর ক্ষেপে আছে। তাই চীন পুরোনো বন্ধুত্ব ভুলে এখন হাত গুটিয়ে রয়েছে।
একই ভাগ্য ঘটেছিল শ্রীলঙ্কারও। জোঁকের মতো শ্রীলঙ্কাকে শুষেছে চীন। যখন চরম সঙ্কটে দিউলিয়া শ্রীলঙ্কা তখন হাত গুটিয়ে নিয়েছিল ড্রাগনের দেশ। উল্টো ঋণ শোধ করার তাগিদ দিয়েছিল চীন। দুই বছরের মধ্যে ঋণ শোধ করার তাগাদা দিয়েছিল জিনপিং সরকার। বাইরে থেকে শক্রকে ঘিরে নাও এবং ভেতর থেকে শক্রকে ধ্বংস করো- এই হলো চীনের নীতি। এতেই কুপোকাত শ্রীলঙ্কা। এখন পাকিস্তানও সে পথে হাঁটছে।
ভারত-পাকিস্তান 'শত্রুতার' রাজনীতি দীর্ঘ দিনের। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছিল ভারত-পাকিস্তান। সময়ে পাতায় পাতায় লেগেছে রক্তের দাগ, ঘৃণা। আবার ভালোবাসার নজিরও আছে অসংখ্য। সীমানা আলাদা হলেও মাটি-বাতাস-গন্ধ ভাগ হয়নি ভারত-পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে। ভারতের ৯০ বছরের বৃদ্ধা রিনা ৭৫ বছর পর পাকিস্তানে গিয়ে রাওয়ালপিন্ডি শহরে তার আদি ভিটা ঘুরে দেখেছেন। হাতড়ে বেড়িয়েছেন স্মৃতি। তেমনি নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী পাকিস্তানের নাগরিক মালালা ইউসুফজাই মনে করেন, ভারত-পাকিস্তানের প্রধান শত্রু হলো দারিদ্র্য, ভেদাভেদ ও বৈষম্য। একে অন্যের বিরুদ্ধে নয়, দারিদ্র্য-বৈষম্য মোকাবিলায় দুই দেশকে একজোটে লড়াই করার তাগিদ মালালার।
যতই বৈরিতা থাকুক না কেন, ইতিহাস বলছে সঙ্কটের সময় প্রতিবেশি দেশের পাশে দাঁড়ায় ভারত। সম্প্রতি বিশ্ব করোনাভাইরাসের ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখেছে। মহামারি মোকাবিলায় বন্ধু-শত্রু বিবেচনা করতে চায়নি ভারত। ভ্যাকসিন নিয়ে পশ্চিমারা যখন নিজের নিয়ে ব্যস্ত, তখন প্রতিবেশী দেশে টিকা পৌঁছে দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কা পেয়েছে ভারতের ভ্যাকসিন।
অর্থনৈতিক মন্দায় যখন দেউলিয়া শ্রীলঙ্কা, তখনও তাদের পাশে দাঁড়ান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। জ্বালানি আমদানির জন্য ক্রেডিট লাইন এবং প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহের জন্য ১০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি সহায়তা পাঠিয়ে প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়ায় নয়াদিল্লী। শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা এবং বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণের পুনর্গঠন ও আর্থিক সহায়তার জন্য আলোচনার শেষ পর্যায়ে পৌঁছনোর মধ্যেই ভারত তার 'প্রতিবেশি প্রথম নীতি '-র ওপর জোর দেয়।
পাকিস্তানের এ সঙ্কটের সময় ভারত কী শ্রীলঙ্কার মতো 'প্রতিবেশি প্রথম নীতি ' প্রয়োগ করবে? এখন এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে নানা বিশ্লেষণ করছেন বিশেষজ্ঞরা। দীর্ঘদিন থেকে দুই দেশের মধ্যে অবিশ্বাস আছে; কিন্তু মানবতার কাছে সব শক্রতাই ম্লান হয়ে যায়। সেভাবে কোভিড মোকাবেলার সময় ভারত ভুলে গিয়েছিল বৈরিতা। আবার পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যার সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশ্বের কাছে বিচক্ষণ নেতা হিসেবে পরিচিত। ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অঘোষিত এবং অপ্রত্যাশিত পাকিস্তান সফর সবাইকে চমকে দিয়েছিল। ২৫ ডিসেম্বর ছিল পাকিস্তানের তখনকার প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরিফের জন্মদিন। এদিকে রাষ্ট্রীয় সফরে আফগানিস্তানে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
কাবুল থেকে ফোনে নেওয়াজ শরিফকে জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানান মোদি। এসময় পাকিস্তানে এসে শুভেচ্ছা জানানোর প্রস্তাব দেন শরিফ। রাজিও হয়ে যান মোদি। সব প্রটোকল ভেঙ্গে পাকিস্তানের লাহোরে গিয়ে নেওয়াজ শরিফকে শুভেচ্ছা জানান। নওয়াজের বাসভবনে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে মোদি সন্ধ্যায় ফিরে যান নয়াদিল্লী। তাই সব হিসাব-নিকাশ ভুল প্রমাণ করে এই দুর্দিনে পাকিস্তানের পাশ দাঁড়িয়ে চমক দেখাতে পারেন নরেন্দ্র মোদি, ইতিহাস তাই বলে।