Published : 27 May 2011, 11:28 PM
অধিক জনসংখ্যার ছোট্ট ভুখন্ডের এ দেশ। খাদ্যের জমিতে তামাক চাষ খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। অপরদিকে তামাক কোম্পানিগুলোর প্ররোচনার কারণে তামাকচাষ আগ্রাসীভাবে বিভিন্ন এলাকায় খাদ্য উৎপাদনের জমি দখল করে নিচ্ছে। বর্তমানে সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে প্রায় ৭৪০০০ হেক্টর জমিতে তামাক হচ্ছে। বিগত ২ বছরে তামাকচাষ প্রায় ৬৮% বৃদ্ধি পেয়েছে। উত্তরাঞ্চলের খাদ্যভাণ্ডার বলে পরিচিত চলনবিল এখন দখল করে নিচ্ছে তামাক চাষ। পাবর্ত্য এলাকায় বিগত ১০ বছরে তামাক চাষ বেড়েছে ৫০০%।
তামাকচাষের কারণে মাটির উর্বরতা কমে যাওয়ায় বৃহত্তর রংপুরে অনেক জমি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে এবং মঙ্গার অন্যতম কারণ তামাক চাষ হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। পার্বত্য এলাকায় নদীর পাড়ে তামাক চাষ করায় তামাকের জমির কীটনাশক ও তামাক গাছের উচ্ছিষ্ট নদীতে নিক্ষেপ করায় নদীর পানি দূষিত হয়ে পড়ছে। ফলে সেখানে মাছের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং পার্বত্য এলাকার মানুষ এ পানি পান করে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তামাক চাষের সময়ে সংশ্লিষ্ট এলাকায় স্কুলে শিশুদের উপস্থিতির হার কমে যায়। তামাকপাতা প্রক্রিয়াজাত করার জন্য অবাধে বৃক্ষনিধন চলছে। যে কারণে পার্বত্য এলাকার অনেক পাহাড় বৃক্ষশূণ্য হয়ে পড়ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৪ সালের গবেষণায় দেখা যায়, তামাক ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশে ৩০ বছরের বেশি বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিবছর ১২ লক্ষ মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত প্রধান ৮টি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে ৫৭,০০০ জন মৃত্যুবরণ এবং ৩,৮২,০০০ লোক পঙ্গুত্ব বরণ করছে। ২০০৪ সালে বাংলাদেশে তামাক সেবনের হার ছিল ৩৭%, বর্তমানে তা ৪৩.৩%। সুতরাং দেখা যায় এ সময়কালে তামাক সেবনের হার যেমন বেড়েছে তেমনি জনসংখ্যাও বেড়েছে। তাই তামাক সেবনজনিত কারণে মৃত্যুসংখ্যাও অনেক বেড়েছে, তামাক সেবনজনিত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও বেড়েছে।
বিড়ি কারখানাগুলোও জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ২০০৮ সালের সরকারি হিসাবে বলা হয়, দেশে বিড়ি শ্রমিকের সংখ্যা ২,৬৬,৮১৮ জন। দূষিত পরিবেশে বিড়ি কারখানায় কাজ করা শ্রমিকরা কম মজুরিতে কাজ করায় একদিকে কখনও দারিদ্র থেকে মুক্তি পায় না, অন্যদিকে অকালে অসুস্থ্য ও মৃত্যুবরণ করে। অথচ তামাক কোম্পানিগুলো শ্রমিকের সংখ্যা ও কর্মসংস্থানকে অজুহাত হিসেবে তুলে কর বৃদ্ধির বিরোধিতা করে থাকে। বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ হলে ১৮.৭% চাকুরি বৃদ্ধি পাবে। তামাক কোম্পানিগুলো মিথ্যাচার করছে। তারা বলছে বিড়ি শিল্পে অনেক শ্রমিক কাজ করে। অথচ বিড়ি শিল্পে যে মারাত্মক শ্রম শোষণ হয় তা তারা বলে না। এখানে প্রতিদিন ১০ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার বিড়ি বানানোর কাজ পায় একজন শ্রমিক। কিন্তু একজন শ্রমিকের পক্ষে এত বিড়ি বানানো সম্ভব নয়। সে তার স্ত্রীকে দিয়ে কাগজে আঠা লাগিয়ে বিড়ির রোল বানানোর কজা করায়, তার সন্তানকে দিয়ে বিড়ি রোল এর মধ্যে তামাকের গুড়া ভরানোর কাজ করায়। কারণ রোল বানানোর জন্য নরম হাত ভাল। নাহলে কাগজের রোল নষ্ট হয়ে যাবে। অন্যদিকে বিড়ির রোল-এ তামাকের গুড়া ভরার জন্য ছোট ছোট আঙ্গুলের ব্যবহার হলে কাজ দ্রুত হয়। কিন্তু এ মারাত্মক পরিবেশে কাজ করেও বিড়ি শ্রমিকের স্ত্রী বা সন্তান কোন পারিশ্রমিক পায় না। স্ত্রী ভাবেন, তিনি তার স্বামীর কাজে সহযোগিতা করছেন, শিশুসন্তান ভাবেন, তারা গরীব, তাই সে তার বাবার কাজে সহযোগিতা করছেন। মারাত্মকরকম ক্ষতিকর পরিবেশে বিড়ি কারখানার শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করে চলেছে।
২০০৯ সালে গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) অনুযাযী, বর্তমানে ৪৩.৩% প্রাপ্তবয়স্ক লোক তামাক ব্যবহার করে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় এবং নিরুৎসাহিত করতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন এবং তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি করা জরুরি। ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের গবেষণায় জানা যায়, প্রতিবছরে বিড়ির পিছনে যে পরিমান টাকা (২৯১২ কোটি টাকা) খরচ হয় তা দিয়ে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থান হতে পারে। বিড়ির বার্ষিক খরচ দিয়ে ৪৮৫ কোটি ডিম অথবা ২৯ কোটি ১ কেজি ওজনের মুরগী, অথবা ২৯ লক্ষ গরু অথবা ১৪ লক্ষ টন চাল অথবা ২৩ লক্ষ রিকশা ক্রয় করা সম্ভব।
তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির মাধ্যমে আদায়কৃত অতিরিক্ত রাজস্ব সরকার প্রয়োজনে দরিদ্র লোকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ব্যয় করতে পারে। প্রায়শই কোম্পানিগুলো অনেক টাকা রাজস্ব দেয় বলে নিজেদের জাহির করতে চায়। আমাদের মনে রাখা দরকার, কোম্পানিগুলো মূলত সংগৃহীত জনগনের টাকা সরকারী কোষাগারে জমা দেয়। বিনিময়ে জনগণ ও সরকারের উপর মানুষের মৃত্যু, রোগ ও অসুস্থ্যতার বোঝা চাপিয়ে দেয়।
বিগত কয়েক বছরে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেলেও তামাকজাত দ্রব্যের দাম সে হারে বৃদ্ধি পায়নি বরং কমেছে। সস্তায় তামাকজাত দ্রব্য (সিগারেট, বিড়ি, গুল, জর্দ্দা, সাদাপাতা) প্রাপ্তির কারণে মানুষের মধ্যে তামাক ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা যায়, গড়ে ১০% মূল্য বৃদ্ধিতে উচ্চ আয় ও নিম্ন আয়ের দেশসমূহে ধূমপায়ী এবং ধূমপানজনিত মৃত্যু উল্লেখ্যযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।
উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। মানুষের জীবন অপেক্ষা কোন কিছুই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১১ এবং অনুচ্ছেদ ১৮ (১) এ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হানিকর মদ ও ভেজষের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের কথা বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)-র আর্টিকেল-৬ নং ধারায় তামাক ব্যবহার হ্রাসে কর বৃদ্ধির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তামাক নিয়ন্ত্রণের যে কয়টি পদ্ধতির কথা বলেছেন, তার মধ্যে করবৃদ্ধি অন্যতম।
তামাক হচ্ছে সর্বগ্রাসী একটি পণ্য। তামাক চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সেবন সকল পর্যায়েই জনস্বাস্থ, পরিবেশ, অর্থনীতির উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এজন্য উন্নত দেশগুলো তামাকের উপর উচ্চহারে কর আরোপ, সিগারেটের প্যাকেটে ছবি ও সতর্কবাণীসহ কঠোর আইন প্রণয়ন করায় তামাক সেবনের হার কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশ রক্ষার স্বার্থেও উন্নত দেশগুলো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করায় তামাক চাষ কমে যাচ্ছে। যে কারণে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তামাক কোম্পানিগুলোর আগ্রাসন বেড়ে গেছে।
জনপ্রতিনিধিরা দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য শপথ গ্রহণ করেন। নীতিনির্ধারনের ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতির উপর তামাকের নেতিবাচক প্রভাবের কথা বিবেচনা এবং তামাকজাত দ্রব্যের উপর উচ্চহারে কর আরোপ করার অর্থ সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন। সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে, বেশ ক'জন সংসদ সদস্য বিড়ির উপর কর না বাড়ানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বরাবর পত্র দিয়েছেন। এটা খুব দুঃখজনক, তার মানে কি আমাদের সংসদ সদস্যবৃন্দ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে উৎসাহিত করছেন?
প্রতিবছর তামাক কোম্পানিগুলো ভ্রান্ত প্রচারণার মাধ্যমে সরকার ও জনপ্রতিনিধিদের বিভ্রান্ত করে তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির বিরোধিতা করে। নিত্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্যের উপর কর বৃদ্ধি হলে তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি হবে না কেন? বরং জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতি রক্ষায় বিড়ি-সিগারেটসহ সকল ধরণের তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি বিষয়ে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংসদ সদস্যদের সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।
আমিনুল ইসলাম সুজন: গ্লোবাল ক্যান্সার এম্বাসেডর ফর বাংলাদেশ।