Published : 28 Feb 2009, 03:34 PM
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার প্রায় ৪০ বছর হতে চললো, আমরা এখনও ভাষা আন্দোলনের মর্ম অনুধাবন করতে পারি নি। ভাষা আন্দোনের তাৎপর্য স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয় নি। অনেক ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায় নি। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা পেশার মানুষদের মধ্যে প্রয়োজন ব্যতিত ইংরেজি নির্ভরতা কি বাংলা ভাষার প্রতি অমর্যাদা নয়? যদি অমর্যাদা-ই হয় তবে ভাষার মর্যাদা রক্ষায় কঠোর হওয়া জরুরি বৈকি!
চিকিৎসকরা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সাধারণ মানুষ, বিশেষত যারা ধর্ম বিশ্বাসী তাদের কাছে সৃষ্টিকর্তার পূর্বে শেষ আশ্রয় হলেন চিকিৎসক। বাংলাদেশে বর্তমানে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর যিনি জীবনের কোন না কোন সময়ে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হন নি। নানা কারণেই মানুষ অসুস্থ্য হয় আর অসুস্থ্য হলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। রোগী দেখে চিকিৎসকরা যে ব্যবস্থাপত্র দেন সেটা বাংলাবর্জিত। নিরক্ষর, স্বল্পশিক্ষিত কী শিক্ষিত–সবার ক্ষেত্রেই একই নীতি, ইংরেজি ব্যবস্থাপত্র। চিকিৎসকরা এমনভাবে লিখেন তা শিক্ষিত মানুষের পক্ষে বোঝাও দুঃসাধ্য। ব্যাপারটা যেন এমন, তিনিই বড় চিকিৎসক যার হাতের লেখা ব্যবস্থাপত্র সাধারণের কাছে সর্বাধিক দুর্বোধ্য। এর কি কোন বিকল্প নেই? বাংলাদেশে কি রোগীর ব্যবস্থাপত্র বাংলায় লেখার নিয়ম করতে পারি না? পৃথিবীর আর কোন দেশে তাদের মাতৃভাষা ব্যতিত অন্য ভাষায় ঔষুধের ব্যবস্থাপত্র লেখে কিনা আমার জানা নেই।
গণমাধ্যমকে বলা হয় সমাজের আয়না। গণমাধ্যম মানুষকে খুব সহজেই প্রভাবিত করতে পারে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রধানত তিনভাগে বিভক্ত। দেখা ও শোনার দূরদর্শন (টেলিভিশন) ও চলচ্চিত্র, শ্রবণনির্ভর বেতার (রেডিও) ও প্রধাণত পাঠনির্ভর সংবাদপত্রও প্রায় একই গোত্রের আধুনিক সংস্করণ অনলাইন সংবাদ।
প্রথমেই যদি আসি টেলিভিশন প্রসঙ্গে, তবে হতাশা দিয়েই শুরু করতে হয়। নাটকে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার দোষের নয়। কিন্তু সাম্প্রতিকালের নাটকে এমন এক ভাষার প্রচলন শুরু হয়েছে যা বাংলা ভাষার কথ্যরূপকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। বিশেষ করে, নাটক দেখে নাটকে ব্যবহৃত কথ্য ভাষার প্রয়োগে উৎসাহী হচ্ছে কিশোর-তরুণ প্রজন্ম, যা সুখবর নয়। বাংলায় নামের যেন এমন আকাল, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামকরণের ক্ষেত্রেও আমরা ইংরেজির আশ্রয় নিচ্ছি। প্রতিবেদন, আলোচনানুষ্ঠানের কথাপোকথন ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় সংশ্লিষ্টরা প্রায়শই ইংরেজির আশ্রয় নিচ্ছেন। ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা এবং ইংরেজির সঙ্গে আমাদের কোন বিরোধ নাই। কিন্তু যখন অপ্রয়োজনেই অন্য ভাষা নির্ভরতা কিংবা ভাষার অপপ্রয়োগ বা বিকৃতি ঘটে তখন মনে হয় ভাষা শুদ্ধ প্রয়োগে আইন থাকা জরুরি।
এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, বাংলাদেশের কোন চ্যানেল পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে দেখা যাক বা না যাক বলা যায় তাদের সব চ্যানেল আমরা দেখতে পাই। এটা একটা আগ্রাসন, এর ফলে শুধু বাংলা ভাষাই যে প্রভাবিত হচ্ছে তা নয়, আবহমানকালের সংস্কৃতি, পারিবারিক-সামাজিক ঐতিহ্যও হুমকির মুখে পড়ছে। হিন্দী টিভি চ্যানেলগুলোর আগ্রাসনের কবলে পরেছে শিশু থেকে বৃদ্ধ, প্রায় সবাই । কখন কোন হিন্দী সিরিয়াল দেখানো হবে সেটা বাসার বৃদ্ধ থেকে শুরু করে শিশুরও জানেন। অনেকে হিন্দী ভাষাটা দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে রপ্ত করে ফেলেছেন।
কিন্তু আমাদের দুর্বল চিত্তের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এসব বিষয়ে কোন ভাবনা আছে বলে মনেই হয় না। বরং শাহরুখ খান যখন এসে আমাদের হিন্দীতে গালি দিয়ে যান তাই দেখে আমরা সন্তুষ্টচিত্তে বাসায় ফিরি। শাহরুখের বোম্বেটে নাচ দেখার জন্য, হিন্দী গালি শোনার জন্য সবাই মাঠের মধ্যে ঘাস কিংবা ত্রিপলের উপর বসে পড়েন। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কত বিষয়ে আলোচনা হয়, চুক্তি হয়। কখনও আমাদের টিভি চ্যানেল তাদের দেশে দেখানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে শুনি নি। যতদিন বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে দেখানো হচ্ছে না ততদিন কি ভারতের চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে দেখানো উচিত?
রেডিও চ্যানেলগুলোর কথা কী বলব! যতদূর শুনেছি এবিসি রেডিও বাংলার সঠিক প্রয়োগ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু অন্য চ্যানেলগুলোর অবস্থা এক্ষেত্রে হতাশাজনক। এফএম রেডিও নামক এসব চ্যানেলের জকিরা জোকারের মত ভাষা ব্যবহার করেন। সেটা না হয় বাংলা, না হয় ইংরেজি! এটাও তরুণ প্রজন্মকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশ বেতার এবং সংবাদপত্রগুলো তুলনামূলকভাবে ভাল অবস্থায় আছে।
বিচার বিভাগ, আইন ও আদালত মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। কিন্তু রায় যখন ইংরেজিতে লেখা হয় তখনই সমস্যা। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ নিরক্ষর। পাশপাশি যারা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন, তাদেরও বড় অংশ ইংরেজি পড়তে সক্ষম নন। আর যারা পড়তে সক্ষম তাদের অনেকে বুঝতে সক্ষম নন। ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে মনে হয়, দেশের ৫ভাগ মানুষও পরিপূর্ণভাবে ইংরেজি বুঝতে সক্ষম নন। অনেক আদালতই ইংরেজিতে রায় লেখেন সেটা আদালতের রায় দেখে নিশ্চিত হয়েছি। আদালত তো মানুষের জন্য, সেই মানুষের ভাষাই যদি আদালত ব্যবহার না করেন তবে সেটা মানুষের বলে প্রতীয়মান হয় কি? আদালতের সকল পর্যায়েই কি বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়?
গত জানুয়ারি মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানলাম, বগুড়ার অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন এক যান-উদ্ভাবকের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ইংরেজি চুক্তিনামা ও এ বিষয়ক প্রতারণার খবর। এরকম হাজার হাজার উদাহরণ রয়েছে। তাই চুক্তিনামা বা সমঝোতাপত্র অবশ্যই বাংলায় করা উচিত। এরও একটা নিয়ম থাকা উচিত। শুধু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা বা চুক্তি অন্য কোন ভাষায় হতে পারে।
শিক্ষাক্ষেত্র আমাদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। যারা উচ্চশিক্ষা লাভ করেন তারাই কেউ আইনজীবী, কেউ বিচারক, কেউ চিকিৎসক, কেউ শিক্ষক, কেউ প্রশাসক–এরকম বিভিন্ন পেশায় সম্পৃক্ত হন। তাই ছাত্রসমাজকে যদি শৈশব থেকেই ভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে অনুপ্রাণিত করা যায়, তবে তারা পরবর্তী সময়ে কর্মজীবনেও ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সক্রিয় থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। বাংলা ব্যকরণ পড়ালেই ভাষার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ভাষা শহীদের মর্যাদা রক্ষা হয় না। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের বিবেচনায় নেয়া দরকার।
এটা হয়ত খুব হাস্যকর শোনাবে যে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় আইনের কথা বলছি। কিন্তু বাস্তবতা আসলেই তাই। আইন থাকলে চিকিৎসকরা ইংরেজিতে ব্যবস্থপত্র লিখতেন না, আদালত ইংরেজিতে রায় দিতেন না, এফএম রেডিওর জোকাররা বাংলা ভাষার বারোটা বাজাতে সাহস পেত না। আশাকরি, ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সংশ্লিষ্টরা আইন প্রণয়নের বিষযটি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবেন।