বড় হতে হতে যখনই শুনেছি ট্রেনে শিলিগুড়ি নিয়ে যাওয়ার নাম করে সৈয়দপুরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তখনই আতঙ্কের শিহরণ অনুভব করেছি, একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের ঘটানো জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে বড় উদাহরণ হতে পারে এটা।
Published : 16 Dec 2023, 07:47 PM
দিনাজপুর শহরের পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে যাওয়া পুনর্ভবা নদী ঠিক যেন ‘আমাদের ছোট নদী’। শহর থেকে ১২ কিলোমিটারের মতো পথ পাড়ি দিয়ে নদীটি প্রবেশ করেছে ভারতীয় সীমানার ভেতরে। বর্ষায়, বৃষ্টিতে, ঢলে এই নদী ভরে যায় কানায় কানায় আর জল বইয়ে সীমানা পেরিয়ে চলে গেলে হাঁটু জল আর বালুচর রয়ে যায় বছরের বাকিটা সময়। যুদ্ধের বছর ১৯৭১ সালের শরতের কোনো এক দিন নদীতে হাঁটুজল, কোথাও বা তার চেয়ে কিছুটা গভীর ছিল। আমরা গরুর গাড়ি করে নদী পার হয়ে দিনাজপুর শহরের দিকে আসছিলাম।
গরুর গাড়িতে টোপর দেওয়া ছিল।মা-দাদি-ফুপুদের সঙ্গে আমাকে এক রকম জোর করে টোপরের ছাউনির ভেতর বসিয়ে রাখা হয়েছিল। নদী পার হবার সময় গরু গাড়ির চাকার সঙ্গে আটকে মানব কঙ্কালের কোনো অংশ উঠে এসেছিল। আমি এমনটাই বুঝেছিলাম অন্যদের কথায়, আলোচনায়। কিন্তু সে সময় চার বছর কয়েক মাস বয়সী কৌতূহলী শিশু আমাকে তা দেখতে দেওয়া হয়নি। আমার কৌতূহল দমন করতে হয়েছিল বকা খেয়ে। না দেখা সেই মানব অস্থি হতে পারে কোনো শহীদের, যার না দেখা অবয়ব অসংখ্যবার ভেসে এসেছে আমার মানসপটে।
যুদ্ধ দিনের স্মৃতি মনে করতে গেলে মনে আসে সৈয়দপুরের কথাও। দিনাজপুর থেকে গাইবান্ধা পালাবার আশি মাইল পথে ছিল এই সৈয়দপুর। মাত্র আশি মাইল যুদ্ধের দিনে আমার মনে হয়েছিল দূরতম কোনো দেশ বুঝি। পরে বড় হতে হতে যখনই শুনেছি ট্রেনে শিলিগুড়ি নিয়ে যাওয়ার নাম করে সৈয়দপুরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তখনই আতঙ্কের শিহরণ অনুভব করেছি, এই ‘ট্রেন টু শিলিগুড়ি’ একাত্তরে বাংলাদেশে ঘটানো জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে বড় উদাহরণ হতে পারে। কেননা, এটি ছিল ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করার একটি চেষ্টা।
আমার জন্মের আগে থেকেই দিনাজপুর শহরের কালীতলার বকুল গাছতলার বাড়িতে ছিল আমাদের যৌথ পরিবারের বাস। বাবা তখন ছিলেন গাইবান্ধা কলেজের বাংলার শিক্ষক। বয়সে যুবক। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকের কয়েকদিন ছাড়া পুরো নয়টা মাসই আমাদের কেটেছে দেশের দুই কোটি অভ্যন্তরীণ শরণার্থীর একটি পরিবার হয়ে। একাত্তরের মধ্য এপ্রিলে আমরা পুনর্ভবা নদীর ওপারে গিয়ে বিরল উপজেলার বাজনাহার গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেখান থেকে আরো দূরে টাঙ্গন নদী পেরিয়ে ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার চন্দরিয়া গ্রামে একেবারে সীমান্তের কাছে। সেখানে যুদ্ধাবস্থা খুব বোঝা না গেলেও ডাকাত-সন্ত্রাসীর উপদ্রব ছিল প্রকট। চন্দরিয়ার সেই স্মৃতি-বিস্মৃতির কিছু লেখা হয়েছে আগে, যা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত হয়েছে ২৬ মার্চ,২০২৩।
ইতোমধ্যে বাবা কোনোভাবে তাঁর কর্মস্থল গাইবান্ধা গিয়ে ঘুরে আসেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে গাইবান্ধায় আশ্রয়ের একরকম ব্যবস্থা করে আসার পর আমাদের এই ফিরতি যাত্রা দিনাজপুর শহর হয়ে। উদ্দেশ্য গাইবান্ধা পৌছানো। ইতোমধ্যে আমাদের কালীতলার বাড়ি অবাঙালিদের দখলে চলে গেছে। কালীতলায় কিছু অবাঙালির বসতি ছিল আমাদের বাড়ির কাছেই। ২৬ মার্চের পরে কোনো এক সন্ধ্যায় তারা ব্যাপক শোরগোল করে হাতে তৈরি বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। সেদিন বাবাকে দেখেছি রাস্তার দিকের বাড়ির সীমানা প্রাচীরের ভেতরে দেয়াল ঘেঁষে একটি টেবিল পেতে সেই টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে তাঁর একনলা বন্দুকটির নল দেয়ালের উপর রেখে আক্রমণ প্রতিরোধ করবার জন্য সতর্ক অবস্থান নিতে।
যুদ্ধের কয়েক বছর আগে থেকেই আব্বা লাইসেন্স করে সেই পুরোনো বন্দুকটি কিনেছিলেন গাইবান্ধাতে। যুদ্ধের পুরোটা সময় তিনি বন্দুকটি তাঁর সঙ্গেই নিয়ে বেড়িয়েছেন, কখনো হাতছাড়া করেননি। বাজনাহার থেকে গাইবান্ধা যাওয়ার কালে আমরা দিনাজপুর শহরে অবস্থান করেছিলাম কিনা— সে কথা আমি স্মরণ করতে পারি না, আর জিজ্ঞেস করে জানবার মতো পরিবারের কেউই আজ আর এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই।
দিনাজপুর থেকে গাইবান্ধা যাওয়ার একটিই পথ ছিল তখন। আমরা বাসে করে যাচ্ছিলাম। সেই সময়ের মুড়ির টিন মার্কা বাস, ভেতরে লম্বালম্বি বেঞ্চের মতো আসন, কোনোরকমে বসে আছি সকলে, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে। আতঙ্ক বৃদ্ধির আরোও কারণ—বাস বর্তমান নীলফমারী জেলার সৈয়দপুর শহরে প্রবেশ করেছে।
সৈয়দপুর অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকা এবং সেখানে সেনানিবাস আছে। বাবা তার বন্দুকটির বাট বাসের পাটাতনে রেখে নল ধরে বসে আছেন। বাস থামানো হলো রাস্তার মাঝে। পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল উঠে আসলো এবং বন্দুকসমেত আব্বাকে নামিয়ে নিয়ে গেল। আম্মাও আমাকে নিয়ে বাস থেকে নেমে পড়লেন সঙ্গে সঙ্গে। আমাদের মা-ছেলেকে ঘিরে রাস্তায় ভিড় জমে গেল। ততক্ষণে বাবাকে নিয়ে মিলিটারির গাড়ি চলে গেছে। ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন বলেছিলেন, “ঐ যে রুস্তম ভাই আসছেন। তাকে বলুন, তিনি কিছু একটা করতে পারেন।“ সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত অভিজাত দর্শনের একজন মাঝবয়সী অবাঙালি মানুষ রুস্তম আলী। শুনলেন বাবাকে পাকিস্তানি বাহিনীর ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা। তারপর একটি রিকশা ডেকে মা এবং আমাকে উঠিয়ে দিয়ে নিজে আরেকটি রিকশায় উঠে আমাদেরকে তার পিছু নিতে বললেন। এভাবে তিনি আমাদের যেখানে নিয়ে গেলেন সেটি একটি বাঙালি পরিবারের বাসা। সম্পূর্ণ অপরিচিত আরোও একটি পরিবারে আমরা সাদরে আশ্রয় পেলাম। সেই বয়সে আমার আশঙ্কা উৎকণ্ঠা সর্বোপরি ভয় আমি আজ আর অনুমান করতে পারি না, অনুধাবন করতে পারি মায়ের কথা। সন্ধ্যার কিছু পরে আব্বা ফিরে আসলেন রুস্তম আলীর সঙ্গে। তার হাতে তখনও বন্দুকটি ছিল। সেই রাতে আমরা রুস্তম আলীর বাসায় নিমন্ত্রিত হয়ে রাতের খাবার খেয়েছিলাম। বাড়িটি বেশ আলো ঝলমলে ছিল। আব্বা সেদিন ছিলেন খুবই গম্ভীর এবং মৌন। পাকিস্তানি বাহিনীর আস্তানায় বন্দী হয়ে কাটানো তার ঐ দিনের কয়েক ঘণ্টা সময় সম্বন্ধে কখনোই বিস্তারিত তেমন কিছু জানতে পারিনি। শুধু এটুকু জেনেছি যে, পুরোটা সময় তাঁকে কাটাতে হয়েছে বন্দুকের নলের মুখে, সাক্ষাৎ মৃত্যুর সামনে। খুব সম্ভবত আব্বা তখনই অনেকটা জানতেন সৈয়দপুরের জেনোসাইডের ভয়াবহতার কথা। আগেই বলেছি, আমার জানা হয়েছে অনেক পরে।
১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দপুর হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানিদের অন্যতম একটি জল্লাদখানা। সৈয়দপুর শহরে অবস্থিত সেনানিবাসের সৈন্য এবং বিপুল সংখ্যক অবাঙালি মিলে সেখানে ব্যাপক গণহত্যা ঘটিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকেই স্থানীয় সংসদ সদস্য জনপ্রিয় রাজনীতিক ডা. জিকরুল হকসহ বিপুল সংখ্যক রাজনীতিক এবং সাধারণ বাঙালিকে আটক এবং হত্যা করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। উর্দুভাষি অবাঙালিরা হয়ে উঠেছিল বেপরোয়া। তারা পাকিস্তানি সৈন্যদের পথপ্রদর্শক হিসেবে অ্যাডভান্স পার্টির ভূমিকা রাখে। বেশ কিছু সংখ্যক অবাঙালি নেতা ও তাদের ক্যাডাররা পুলিশের পোশাক পরে পাকিস্তানি বাহিনীর মতো গণহত্যায় মেতে ওঠে। প্রথম কয়েকদিনেই কয়েক হাজার বাঙালি গণহত্যার শিকার হয়। সৈয়দপুরে একটি রেলওয়ে ওয়ার্কশপ রয়েছে অনেক আগে থেকে। সেখানকার অধিকাংশ কর্মী ছিল অবাঙালি। সেই ওয়ার্কশপের লোহা গলানোর চুল্লিতে (ফার্নেস) কত বাঙালি নিরীহ মানুষকে যে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয় যে সেই সংখ্যা সহস্রাধিক হতে পারে। আরও একটি নির্মম গণহত্যা—‘সৈয়দপুর গোলাহাট সংখ্যালঘু গণহত্যা’ বা ‘ট্রেন জেনোসাইড’। পাকিস্তানি বাহিনী এই হত্যাকাণ্ডের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন খরচা খাতা’। তারা জেনেছিল যে শহরের আশেপাশে অনেক হিন্দু-মারোয়াড়ি আত্মগোপন করে আছে। দুই-তিন দিন আগে থেকে মাইকিং করে জানানো হয় যে আটকে পড়া সেই সব সংখ্যালঘু মানুষদের ট্রেনে করে ভারতের শিলিগুড়িতে পৌছে দেওয়া হবে।
১৩ জুন সকাল ১০ টায় সৈয়দপুর স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে যাবে। সেই ঘোষণা মোতাবেক সৈয়দপুর রেল স্টেশনে ১৯৭১ সালের ১৩ জুন দাঁড়িয়ে থাকা চারটি বগিসমেত একটি ট্রেনে অনেক বাঙালি হিন্দু এবং মাড়োয়ারিরা উঠে পড়েন। অপরাহ্নে ট্রেন চলতে শুরু করে চিলাহাটির দিকে। কিন্তু মাত্র তিন-চার কিলোমিটার পথ গিয়েই গোলাহাট নামের একটি জায়গায় রেল সড়কের ৩৩৭ নম্বর কালভার্টের কাছে ট্রেনটি থেমে যায়। আগে থেকেই সেখানে গণহত্যার জন্য প্রস্তুত ছিল বহুসংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের অবাঙালি দোসররা। ১৩ জুন ১৯৭১ সৈয়দপুর রেল স্টেশনের অনতিদূরে গোলাহাট নামক স্থানে ৪৪৮জন মানুষকে রামদা, ছোরা ও বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করা হয়। সেদিনের গণহত্যায় ৭৮জন শহীদের নাম পাওয়া যায় একটি অসম্পূর্ণ তালিকায় যাদের অধিকাংশের পদবি ‘আগারওয়াল’ এবং তারা পরিবারসহ গণহত্যার শিকার হন।
সেদিন সেই হত্যাকাণ্ড থেকে কোনোভাবে বেঁচে ফেরা ১৮-২০ বছরের যুবক তপন চন্দ্র দাস ওরফে কাল্টু বর্তমানে সত্তরোর্ধব প্রবীণ। তার জরিবুটির দোকান আছে শহরের জিকরুল হক সড়কে। গত ১০ ডিসেম্বর বিকেলে সেই দোকানেই কথা হয় তার সঙ্গে। বর্তমানে ছেলে দোকান চালায়, তিনি মাঝে মধ্যে বসেন। ২৩ জুনের গণহত্যার কথা বলতে গিয়ে এখনো শিউরে ওঠেন। বলেন সৃষ্টিকর্তা তাকে রক্ষা করেছেন বলেই আজ তিনি সেই কথা বলতে পারছেন।
বর্তমান নীলফমারী জেলার সৈয়দপুর থানায় ‘সৈয়দপুর গোলাহাট গণহত্যা’ মামলা দায়ের করা হয়েছিল ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি। মামলায় এজাহারে সৈয়দপুরবাসীর পক্ষে ৬০ থেকে ৭০ জন নাগরিক স্বাক্ষর করেন। এজাহারটির কপি মুক্তিযুদ্ধে চিলাহাটী সাব-সেক্টরের কমান্ডার ফ্লাইট লে. ইকবাল রশিদ(অব.) সংগ্রহ করেছিলেন। পরে সেটি সংগ্রামের নোটবুকের আর্কাইভে সংরক্ষিত হয়। ১৯৭১-এর এই ভূখণ্ডে যে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ; বৃহদার্থে জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের এদেশীয় সহচরদের দ্বারা তা আজও আন্তর্জাতিকভাবে জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে এই দাবির সপক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অনেক সংগঠন। স্বীকৃতি মিলছে কিছু এবং ট্রেন টু শিলিগুড়ি সেই স্বীকৃতি আদায়ের পক্ষে একটি উদাহরণ হতে পারে। বাসে আমাদের পরিবারের অন্য সকলে রংপুর চলে গিয়েছিল। সেখানে জাহাজ কোম্পানির মোড়ের কাছে সেজো ফুপুর বাসায় আমার তিন বছরের বড় ভাই, দাদি, ছোট ফুপু কিভাবে রাত পার করেছিলেন জানি না। পরদিন বাবা-মায়ের সঙ্গে সেখানে গিয়ে তাদের নিয়ে আমরা গাইবান্ধা যাত্রা করি এবং নিরাপদেই সেখানে পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে আমরা একটা ফাঁকা বাড়িতে উঠি। স্টেশনের পশ্চিম দিকে পাটগুদামের পাশে পশ্চিমপাড়া বলে পরিচিত মহল্লার বাড়িটি ছিল পুরোনো।মোটা দেয়ালের উপর টিনের চৌচালা একটি বড় ঘরের সঙ্গে লাগানো আরও দুটি ছোট ছোট ঘর। আঙিনার পরে রান্নাঘর ও টিউবওয়েল পাড়। বাড়ির কিছুটা ছিল ইটের ভাঙা দেওয়াল, আর কিছুটা বাঁশের বেড়ায় ঘেরা। ঐ বাড়িতে ভাড়া থাকতেন বাবার সহকর্মী তানজিমুল চাচা। যুদ্ধের কারণে তারা অন্যত্র চলে যাওয়ায় ঐ ফাঁকা বাড়িতে আমাদের আশ্রয় হয়। গাইবান্ধা জেলায় মোট ৫৫টি গণহত্যা, গণকবর ও বধ্যভূমির তালিকা পাওয়া যায়, যার মধ্যে ১৭টি গাইবান্ধা শহর এবং সদর থানার মধ্যেই অবস্থিত। কিন্তু আমি শহরে যুদ্ধের দামামা তেমন বুঝতে পারিনি। পশ্চিমপাড়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে তখনও ক্লাস চলছিল অনিয়মিত। একদিন আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে আমিও ঐ স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে বসেছিলাম। সেটিই ছিল আমার জীবনের প্রথম স্কুল। আজও বুঝে পাই না সেই সব দিনে কিভাবে অন্নবস্ত্রের সংস্থান হয়েছিল। আমাদের তেমন অভুক্ত থাকতে হয়নি। গাইবান্ধায় আমি নতুন একজন মানুষকে পেলাম অত্যন্ত আপনভাবে। তিনি শফিক চাচা (অধ্যাপক শফিকুর রহমান)। আব্বার সহোদর ভাই নন, তাঁর প্রিয় ছাত্র। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক যে কতটা গভীর হতে পারে, আব্বা এবং শফিক চাচার সম্পর্ক তার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে আমার কাছে। আমাদের খাদ্যের অধিকাংশই শফিক চাচার পরিবার এবং তার অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে আসতো। আর চাচা দিন দিন হয়ে উঠেন আমার আদর-আবদারের জায়গা। আব্বা অধিকাংশ সময় বাড়িতে থাকতেন না। একদিন মাঝরাতে জেগে উঠে দেখি বাড়ির উঠোনে অনেক মানুষ আব্বার সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বলছে। পরে জেনেছি, তারা মুক্তিযোদ্ধা এবং আব্বার ছাত্র। একদিন পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল গাড়ি নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে ব্যাপক তল্লাশি চালায় এবং তারা আমাদের দুপুরের খাবার খেয়ে ফেলেছিল বলে আমরা দুপুরে খেতে পাইনি। একদিন গাইবান্ধা শহরে গোলাগুলির শব্দ শোনা যেতে লাগলো, আকাশে বিকট শব্দ করে যুদ্ধবিমান উড়ে যেতে দেখা গেল । আমাদের বাড়ির টিনের চালে মর্টারের গোলা এসে পড়েছিল। বাড়ির আঙিনায় তখন বাঙ্কার খোড়া হয়, মজুর ডেকে। উঠানে জায়গা কম থাকায় এবং সকলের সেখানে স্থান সংকুলান হওয়ার জন্য বাঙ্কারটি খোঁড়া হয়েছিল ইংরেজী L অক্ষরের আদলে। আকাশে বিমানের শব্দ পেলেই আমরা বাঙ্কারে আশ্রয় নিতাম। রেল স্টেশনের ওভারব্রিজের কাছে একদিন যুদ্ধবিমান থেকে বোমা ফেলা হয়। সেই বোমায় একজন কিশোর এবং তার পোষা একটি গরু মারা যায়। বোমা পড়ার জায়গাটি ছোট একটা শুকনো পুকুরের মতো দেখায়। আমি মায়ের কাছে খুব জিদ ধরে জায়গাটি দেখতে গিয়েছিলাম, এক প্রতিবেশী বড় ভাইয়ের সঙ্গে। বোমা পড়ার দুই একদিনের মধ্যেই শফিক চাচা আমাদের নিয়ে যান গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলার শালাইপুর গ্রামে, তার মামার বাড়িতে। ৮ ডিসেম্ব্র ১৯৭১ পাকিস্তানি সৈন্যরা গাইবান্ধা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। শত্রুমুক্ত হয় গাইবান্ধা। ১০ ডিসেম্বর আমরা আবার গাইবান্ধা শহরে ফিরে আসি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর বিকেলে আব্বার তিন ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিওতে পরিবারের সবাই আমরা পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পনের খবর শুনেছিলাম। মনে আছে সেদিন আমি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম বাংলাদেশের একটি পতাকা পাওয়ার জন্য। শেষ পর্যন্ত মা তাঁর একটি সবুজ শাড়ি কেটে মাঝে লেপের লালসালু কাপড় হাতে সেলাই করে বসিয়ে পতাকা বানিয়ে দিয়েছিলেন। বড় ভাইসহ আমি সেই পতাকা বেশ বড় একটি বাঁশের আগায় বেঁধে উড়িয়েছিলাম চূড়ান্ত বিজয়ের দিনের গোধূলিলগ্নে।
১৮ অথবা ১৯ ডিসেম্বরেই আমরা দিনাজপুরে ফিরে আসি বেশ দ্রুতগতির বড়সড় একটি পিকআপ ট্রাকে করে। পিক আপের পেছনে জবুথবু হয়ে বসে শীতল বাতাসে স্বাধীনতার সূর্যের উত্তাপ গায়ে মেখে আমরা ফিরে আসি দিনাজপুরের নিজ গৃহে। বাড়ি ফিরে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা রান্নাঘরের মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে গরম ভাত খেয়েছিলাম আলুভর্তা দিয়ে। এত দ্রুত অন্নযোগে ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা হওয়ার যে বিষ্ময় ছিল সেকথা মনে হলে আজ ভাবি, কেবল মা-দাদিদের পক্ষেই এমনটা সম্ভব। স্বাধীন দেশের মাটিতে নিজেদের বাড়িতে বসে আলুভর্তা-ভাতের অমৃতসম স্বাদ যেন আজও আমার মুখে লেগে আছে, অন্য যে কোনো খাদ্যের সঙ্গে তার তুলনা করা চলে না।