সোনা ও সোনা কারবারির জয়গান

দেশে আকস্মিকই নতুন করে আলোচিত হয়ে উঠেছে সোনা ও সোনার কারবারি। সম্প্রতি দুবাইয়ের নিউ গোল্ড সুকে প্রবাসী বাংলাদেশি আরাভ খানের আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধন করা হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে গেছেন ক্রীড়াঙ্গন ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের বেশ কয়েকজন তারকা। তাই নিয়ে বয়ে যাচ্ছে সোনালি ঝড়!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 19 March 2023, 07:30 AM
Updated : 19 March 2023, 07:30 AM

মানব জীবনে সোনার কদরই আলাদা। সোনার গয়না, সোনার বিস্কুট-বার, সোনার পদক তো বটেই, সোনার দেশ, সোনার মানুষ, সোনার সংসার, স্বর্ণালী ভবিষ্যতের জন্যও মানুষের আকাঙ্ক্ষার কোনো শেষ নেই। এমনিতে সোনা একটি মূল্যবান ধাতু। সোনার অনেক নাম আছে। স্বর্ণ, সুবর্ণ, হিরণ্য, কনক, কাঞ্চন, হেম, হাটক, কলধৌত, জাম্বুনদ, অষ্টাপদ। 

সোনা নিয়ে বাংলা ভাষায় অনেক ধরনের বাক্য আছে। আছে প্রবাদ-প্রবচন। চকচক করলে সোনা হয় না, সোনার আঙটি বাঁকাও ভালো, খাঁটি সোনায় গয়না হয় না। সোনার আরও নানা রকম মানে আছে। সোনার গয়না (তার শেষ সোনাটুকুও খুইয়েছে); পরম ধন (‘খোকা মোদের সোনা’); উৎকৃষ্ট শস্য (সোনা ফলানো, সোনার বাংলা)। স্বর্ণবর্ণ (সোনামুগ)। সোনায় সোহাগা (সোহাগার দ্বারা সহজেই সোনা গলানো যায় বলে)– চমৎকার মিলন। সোনার কাঠি রুপোর কাঠি– বাঁচন-মরণের উপায়। সোনার পাথরবাটি– অসম্ভব বস্তু বা ব্যাপার। সোনার সংসার– সুখৈশ্বর্যপূর্ণ সংসার। সোনামুখ। সোনার মেয়ে। সোনালি দিন, সোনালি জীবন। সোনালি চুল। স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়।

বাংলাদেশের সৃষ্টি লগ্নেই সোনার ব্যাপারটা জড়িয়ে ছিল। সোনার বাংলার স্বপ্ন-সাধ থেকেই সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতাকামী কোটি মানুষের স্লোগান ছিল: সোনার বাংলা শশ্মান কেন আইয়ুব শাহী জবাব চাই! স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালি রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে। একারণেই এইদেশের জাতীয় সঙ্গীত হচ্ছে, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি!

আমাদের দেশপ্রেমের চেতনার সঙ্গেও সোনার একটি নিবিড় যোগ আছে। দেশ ও দেশের মাটিকে সোনার সঙ্গে তুলনা করা হতো। এক সময় ‘সোনা সোনা সোনা/লোকে বলে সোনা/সোনা নয় তত খাঁটি/বলো যত খাঁটি/তার চেয়ে খাঁটি বাংলাদেশের মাটি রে/আমার জন্মভূমির মাটি’-গানটি লোকের মুখে মুখে ফিরত।

সোনা নিয়ে অসংখ্য গান-কবিতা-কাব্য লেখা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সোনার তরী’। জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘হায় চিল, সোনালি ডানার চিল।’ বাংলা গানে সোনা অনেক বড় একটা জায়গা দখল করে আছে। রবীন্দ্রনাথ রচিত একটি বিখ্যাত গানের কলি, ‘দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।’ তালাত মাহমুদ গেয়েছেন, ‘শোনো গো সোনার মেয়ে শোনো গো।’ শ্যামল মিত্র গেয়েছেন, ‘সে দিনের সোনা ঝরা সন্ধ্যা।’

সোনা নিয়ে বাংলা সিনেমারও অনেক জনপ্রিয় গান রয়েছে। ‘সব সখিরে পার করিতে নেব আনায় আনা/তোমার বেলায় নেব সখি তোমার কানের সোনা;’ ‘ও সাগর কন্যারে কাঁচা সোনা গায়’; ‘যে জন প্রেমের ভাব বোঝে না/তার সাথে নাই লেনা দেনা/ আসল সোনা ছাড়িয়া যে নেয় নকল সোনা!’ সোনা নিয়ে এমন অসংখ্য কালজয়ী গান রয়েছে।

সোনার একটা বিশ্বজনীন মর্যাদা আছে। পৃথিবীর ইতিহাসে মহাত্মাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে। ইতিহাসের মহান অধ্যায় হল স্বর্ণযুগ। সেরা খেলোয়াড়রা ‘সোনা’ জিতে এলে দেশের গর্ব, খেলার দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্মান। স্বর্ণপদক হল যেকোনো বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্বের মূল্য স্বরূপ। কথায় বলে ‘কিসে আর কিসে, সোনায় আর সীসে’ অর্থাৎ ‘সোনা’ হলো উৎকৃষ্ট আর সীসা হলো নিকৃষ্ট। সীসা কেন, যেকোনো ধাতুর তুলনায় ‘সোনা’ হলো মহত্তম। বাঙালির চোখের সামনে ‘সোনার তাল’ বা ‘সোনার বার’ নয় সোনার গহনাই চোখ ঝলসায়। প্রচলিত প্রবাদ আছে, ‘পরের সোনা দিও না কানে, টেনে নেবে হ্যাঁচকা টানে’। বর্তমানে ছিনতাইয়ের যুগে, নিজের সোনাও কানে রাখা দায়। যদিও রূপা, তামা, পিতল, কাঁসা, ব্রোঞ্জ ইত্যাদির গহনাও তৈরি হয়, তবু ‘স্যাকরা’ শব্দটি স্বর্ণকারের অপভ্রংশ। স্যাকরার নামে অপবাদ আছে যে, তারা নাকি মায়ের নাকছাবি তৈরি করলেও তার থেকে সোনা চুরি করে। সোনা এমনি লোভনীয়। বাঁশ, সুতা, পাট, শাঁখ ইত্যাদি সব কিছুর গহনার প্রচলন রয়েছে তথাপি সোনার গহনার কদরই আলাদা। ধনীর সন্তান ‘সোনার চামচ’ মুখে দিয়ে জন্মায়। শিশুসন্তান মানেই ‘সোনার চাঁদ’ সবার প্রিয়। ছোট্ট সোনারা ঘর আলো করে বিরাজ করে। তাদের আদরের ডাক ‘সোনামণি’।

ধনী পিতার কন্যাকে বিবাহের সময় কত সোনা দিয়ে মুড়ে দেওয়া হচ্ছে সেই মানে পূর্বে মেয়ের মূল্য যাচাই হতো। সুন্দরী কন্যার বিশেষণ হল ‘স্বর্ণ-প্রতিমা’। তখন আবার সোনার হাতে সোনার কাঁকন, কে-কার অলংকার! ফর্সা হওয়ার উৎকর্ষে বলা হয় কাঁচা সোনার মতো রং। সঞ্চয়ের মাপকাঠিতে সোনা হলো মূল্যবান ধাতু। সোনার গহনায় খাদ থাকে। সোনার বিস্কুট নিখাদ। স্ত্রীধন বলতে বোঝায় মেয়েদের সোনার গহনা। সোনার গহনা বড়দের তরফে ছোটদের প্রতি আশীর্বাদ বিশেষ। রক্তের সম্পর্কে বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয় পরিমণ্ডলে আজও সোনা দিয়ে মুখ দেখার প্রচলন। গুণের সঙ্গে সৌভাগ্য জুড়ে গেলে বলা হয় ‘সোনায় সোহাগা’। আবার অসম্ভব বস্তু হল ‘সোনার পাথরবাটি’। ত্যাগের মহিমায় গৌরবান্বিত সীতা বনবাসে গেলেন কিন্তু স্বর্ণালঙ্কার পরিত্যাগ করেননি ও সোনার হরিণের লোভ সামলাতে পারেননি। রাবণ যখন সীতা হরণ করেন, পথে যেতে যেতে সীতা একেকটি স্বর্ণালঙ্কার ছড়াতে ছড়াতে গিয়েছিলেন, পথের হদিস দিতে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সোনার হরিণের জন্য আকুল হয়েছেন। এই মনোহরণ চপল চরণ সোনার হরিণ চাওয়া হলো প্রচণ্ড আবেগ।

সোনা নিয়ে কত কাহিনি। কত মিথ। সেকালে রাজাদের কলসি বা ঘড়াভর্তি মোহর থাকত। এক রাজা বহু তপস্যা করে বর পেয়েছেন, যাতেই হাত ছোঁয়াবেন, তাই সোনা হয়ে যাবে। রাজা মহা খুশি। কিন্তু নিজের হাতে খেতে পারেন না, খাইয়ে দিতে হয়। খাবারে হাত দিলেই তা সোনা হয়ে যাচ্ছে। পোশাক নিজে পরতে পারছেন না, পরিয়ে দিতে হচ্ছে। অসাবধানতায় রাজকন্যার মাথায় হাত রেখেছেন। ব্যাস রাজকন্যা সোনাতে রূপান্তরিত। সোনার মাথায় পরিশেষে হায় হায়। বর ফিরিয়ে নিয়ে তবে শান্তি। ক্ষ্যাপা পরশপাথর খুঁজে বেড়াচ্ছে। পাথর কুড়িয়ে লোহার মাদুলিতে ঠেকায়, পরখ করে, বিফল হয় ছুড়ে ফেলে দেয়। পরখ করতে করতে বিফল হতে হতে খেয়াল রাখে না কখন সোনা হয়ে গিয়েছে আর, সেই পরশপাথর অজান্তে কখন ছুঁড়ে ফেলেও দিয়েছে। রূপকথার রাজকন্যা সোনার পালঙ্কে ঘুমোন। সোনার থালায় ভাত খান। রাজপুত্র সোনার কাঠি ছুঁইয়ে রাজকন্যার ঘুম ভাঙান। রবীন্দ্রনাথের ‘গুপ্তধন’ গল্পে সোনার ফাঁদে পড়ে মৃত্যুঞ্জয় শেষে সোনার হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে চেয়েছে। মনিহারা গল্পের নায়িকা মণিমালিকা তার সোনার গহনার রাশকে সন্তানের মতো প্রতিপালন করত। ওই সোনার গহনাই তার মৃত্যুর কারণ হয়েছিল।

দেশে আকস্মিকই নতুন করে আলোচিত হয়ে উঠেছে সোনা ও সোনার কারবারি। সম্প্রতি দুবাইয়ের নিউ গোল্ড সুকে প্রবাসী বাংলাদেশি আরাভ খানের আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধন করা হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে গেছেন ক্রীড়াঙ্গন ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের আরও বেশ কয়েকজন তারকা। তাই নিয়ে বয়ে যাচ্ছে সোনালি ঝড়!

সোনার যেমন অনেক নাম, আরাভ খানেরও অনেক নাম। গ্রামের মানুষেরা তাকে চেনেন সোহাগ, রবিউল, আপন ও হৃদিক নামে। পুলিশের ভাষ্য মতে, ওই আরাভ খানই প্রকৃতপক্ষে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার রবিউল ইসলাম। চার বছর আগে ঢাকায় একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার আসামি হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে ভারতে চলে যান সে সময়ের ৩০ বছর বয়সী রবিউল ইসলাম। সেখানে বিয়ে করেন। পরে ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহার করে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। সেই পাসপোর্ট দিয়েই পাড়ি জমান দুবাইয়ে। এখন তিনি দুবাইয়ের বড় সোনা ব্যবসায়ী। এই সোনা ব্যবসায়ীর আমন্ত্রণে যারা দুবাইয়ে গেছেন, তাদের নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সোনার লোভেই তারা সেখানে গেছেন বলে সোনা-বঞ্চিতরা সমালোচনা করছেন! কেউ কেউ বলছেন, আরাভ খান আসলে দেশের প্রভাবশালী কারোর ব্যবসা সামলাচ্ছেন। আরাভ খানের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আছেন ভিন্ন কেউ। এ ব্যাপারে কেউ স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছেন না। তবে কেউ কেউ ‘আমি কলা খাই না’ স্টাইলে জোর গলায় বলছেন, ‘আমি আরাভ খানকে চিনি না। কখনও দেখিনি। নামও জানি না!’

আসলে আমাদের এই সোনার দেশে সোনার নেশায় কতজন কত কী যে করে! সবাই সোনার মানুষ সাজতে চায়। আমাদের বাংলার মাটিতে সোনার ফসল যেমন ফলে সোনার কমলও ফোটে। আকাশ ভরা অরুণ আলোয় মেঘে মেঘে সোনা, ও ভাই যায় না মাণিক গোনা। বাদল দিনের অন্ধকারে মেঘের ছায়ায় সুরের ক্ষেতে জাগে সোনার ধান। ‘আকাশের নীলিমায় ভ্রমর মাথায় বয় অরুণ-আলোর স্বর্ণরেণু’। জীবনের সোনার দিনগুলি আমার সোনার খাচায় ধরে রাখতে পারি না। কবিগুরুর সোনার তরী, তার নিজেরই সোনার ধানে পূর্ণ হয়ে যায়। তারপর তার নিজের ঠাঁই হয় না সেই তরীতে।

বাংলাদেশের হৃদয় হতে যখন দেশ জননী আবির্ভূত হন, তখন তার দুয়ার সোনার মন্দিরে খুলে যায়। বঙ্গদেশের ‘ভালেকাঞ্চন শৃঙ্গ মুকুট কিরণে ভুবনআলা’। এই স্বর্ণ শিখর কাঞ্চনজঙ্ঘা।

সবশেষে বলতে হয়, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। জয় হোক সোনার, জয় হোক সকল সোনা কারবারির! স্বর্ণমুকুটের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাক সব কলঙ্ক!