ক্লেদাক্ত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি শিশুদের মন বিষিয়ে তুলছে। তারা নিপীড়ন ও সহিংসতা প্রত্যাখান করছে। মোটাদাগে ধর্মীয় মূল্যবোধ তাদের ভেতর দৃঢ় হচ্ছে।
Published : 16 Oct 2024, 05:04 PM
শিশুরা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান দেখেছে। আন্দোলন নিয়ে তাদের মনে প্রশ্ন ও উৎকণ্ঠা জেগেছিল। ঢাকার মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী নয়নিকা আলম (১০), রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নার্সারিতে অধ্যয়নরত রায়াত খান (৭) এবং রংপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী মালিহা ইসলামের (৮) সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার ও সন্তুষ্টি পর্যবেক্ষণ করছি প্রায় দেড় থেকে দু-বছর। এই তিন শিশুর সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার ও তার প্রভাব নানামাত্রিক। শিশুরা মূলত মোবাইলে গেম খেলে দিনে গড়ে চার-পাঁচ ঘণ্টা ব্যয় করে। এর বাইরেও তারা বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট উপভোগ করছে, যা তাদের মনোকাঠামোর ওপর ফেলছে বিশেষ প্রভাব।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন যুদ্ধ, জুলাইয়ে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান তারা সোশ্যাল মিডিয়া ও টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছে ও দেখছে। এই বিষয়গুলো তাদের মনে তৈরি করছে গভীর অভিঘাত। আন্দোলন-সহিংসতা দেখে নয়নিকা তার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছে, টেলিভিশনে সবাই এত শাউট করছে কেন? শেখ হাসিনাও খুব শাউট করছেন। বাইরে গুলির শব্দ হচ্ছে। সিটি তো আনলিভেবল হয়ে গেল (মহানগর বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেল)। লেটস লিভ দ্য কান্ট্রি (চলো দেশ ছাড়ি)। অর্থাৎ সহিংতার কারণে শিশুরা ভয় পেয়েছে, দেশ ছাড়তে চাচ্ছে।
শিশুরা নিয়মিত ফেইসবুক, রিল, ইউটিউব ও টিকটক দেখছে। স্কুল বন্ধ থাকায় এবং কমিউনিটিতে বিনোদনের অভাবের কারণে তাদের একমাত্র ভরসা হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন। শিশুদের সোশ্যাল মিডিয়ায় এক্সপোজার দেশের রাজনীতি, ফিলিস্তিন, ভারত ও শেখ হাসিনা ইস্যুতে বিশেষ মনোভঙ্গি তৈরি করেছে— যা কয়েকটি বর্গে নিচে তুলে ধরা হলো:
শিশুদের ফেইসবুক, রিল, ইউটিউব ও টিকটক ব্যবহার
শিশুদের মূল আসক্তি রিল, ইউটিউব ও টিকটকে। ইউটিউব ও টিকটক ঘিরে শিশুদের সোশ্যাল নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হচ্ছে। শ্রেণিকক্ষের বাইরে দুনিয়াজুড়ে তাদের বন্ধুপরিসর বিস্তৃত হচ্ছে। এ সংযুক্তি দুনিয়াদারির খবর নিতে তাদের সহায়তা করছে। ইউটিউব ও টিকটক ঘিরে শিশুদের ভেতর এক বৈশ্বিক মন তৈরি হচ্ছে যা সংবেদনশীল ও সংযুক্তিমূলক।
এর যেমন ইতিবাচক দিক আছে, তেমন রয়েছে নেতিবাচক দিকও। এ নেটওয়ার্কের আওতায় পড়ে শিশুরা বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। নানা ধরনের স্ল্যাং শিখছে। রায়াত খানকে তার এক ফিলিপিনো বন্ধু বারবার পোক করছে যে তুমি অ্যাডপ্টেড বেবি। রায়াত খান তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, এটা ঠিক নয়। তার বাবা-মা আছে। রায়াত ছবিও শেয়ার করেছে। কিন্তু সে কিছুতেই মানতে নারাজ। এতে রায়াত খান মানসিকভাবে আহত হয়েছে। এই ব্যাড ট্রিটমেন্ট সে নিতে পারেনি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগের জন্য আমাদের শিশুদের যে ধরনের দক্ষতা দরকার তার ঘাটতি রয়েছে। ভাষাগত ও ভাবপ্রকাশে কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে মজার ব্যাপার হলো তারা খুব দ্রুত শিখতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সংযোগ শিশুদের ভাবপ্রকাশে দক্ষ করে তুলছে। ক্যাটাগরিক্যালি চিন্তা করতে সহায়তা করছে। শিশুরা নানাসব জটিল অ্যাপ ব্যবহার করে ভিডিও ও কার্টুন বানানো শিখছে। শিশুরা ক্যাপকাট, ইনফিনিট পেইন্টার ব্যবহার করে টিকটক কনটেন্ট বানাচ্ছে। শিশুরা বয়স লুকিয়ে টিকটক ও ইউটিউবে অ্যাকাউন্ট খুলছে।
স্যোশাল মিডিয়া ঘিরে শিশুদের মধ্যে সৃজনশীল চিন্তার নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। শিশুদের অনস্ক্রিন সময় কাটানোর অভ্যাস বাড়ছে, এতে চোখের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। একই সঙ্গে মনোযোগ ও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহের অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিয়মিত খাবার গ্রহণ, রাত জেগে মোবাইল দেখা, খিটমিটে মেজাজ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মোবাইল ছেড়ে দিলেই একাকিত্ববোধ, বিরক্তির মনোভাব ও রেগে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। শিশুরা পরিবারের সদস্যদের চেয়ে দূরের বন্ধুদের সঙ্গে সখ্য গড়তে ও সময় কাটাতে ভালোবাসছে। শিশুরা দীর্ঘসময় মোবাইলে যেসব গেম খেলছে তারমধ্যে রোবলক্স অন্যতম।
ফেইসবুক, রিল, ইউটিউব ও টিকটকের বিনোদন দারুণভাবে উপভোগ করছে শিশুরা। এর প্রধান কারণ ট্রল। ট্রল ভিডিওগুলোতে বিষয়বস্তুকে হেয়, মজাদার ও চটকদার করে উত্থাপন করা হয়। শিশুরা এসব ফানি ভিডিওগুলো উপভোগ করছে। বিনোদন পাচ্ছে। উপস্থাপিত ব্যক্তি সম্পর্কে এক ধরনের মূল্যায়নও তৈরি হচ্ছে। শিশুরা ওইসব কনটেন্ট দেখে নানা রকম পাঠ নিচ্ছে।
স্যোশাল মিডিয়ার কনটেন্টভোগী শিশুদের কাছে আজ সবকিছু হাল্কা ও ফানি ঠেকছে। ফেইসবুক, রিল, ইউটিউব ও টিকটক যা স্পর্শ করছে তা হয়ে উঠছে হালকা। এ হালকাকরণ প্রক্রিয়ার কোনো শুরু নেই, শেষও নেই। ফেইসবুক, রিল, ইউটিউব ও টিকটক ঘিরে ক্লেদের চাষ চলছে। ওই চাষের চারাগাছ হিসেবে বেড়ে উঠছে শিশুরা।
শিশুমনে রাজনীতির অভিঘাত
শিশুরা রাজনীতিকে দেখছে সহিংস তৎপরতা হিসেবে। তাদের মনের গহীনে বিশ্বাস জন্মেছে রাজনীতি মানে খারাপ বিষয়। তাদের বক্তব্য বাংলাদেশে মারামারি হচ্ছে, ফিলিস্তিনে শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। শিশু হত্যার বিষয়টি শিশুদের দ্রুত কানেক্ট করছে। তারা আহত হচ্ছে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়ে। শিশুরা ইসরায়েলি পণ্য বর্জন করতে শিখছে। নয়নিকা, রায়াত, মালিহা এরা কোক খাচ্ছে না, মোজো খাচ্ছে। কিটক্যাট ছেড়েছে। তাদের বিবেচনায় ইসরায়েলি ইহুদি পণ্য তারা খাবে না। সব ধরনের ইহুদি পণ্য বর্জনের পক্ষে তারা।
রায়াত খান তার নানাভাইকে চ্যালেঞ্জ করেছে কেন সে হিরো হোন্ডা কিনেছে। হিরো হোন্ডা তো ইন্ডিয়ান প্রোডাক্ট। তার নানাভাইয়ের এ কাজ ঠিক হয়নি। শিশুদের মনে ইহুদি, খ্রিস্টান ও হিন্দু বিদ্বেষ যে তীব্র মাত্রায় পৌঁছেছে তা এক উদ্বেগের বিষয়। শিশুরা কেবল দেশীয় রাজনীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়। তারা উদ্বিগ্ন বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়েও, যা সহাবস্থানমূলক পৃথিবীর জন্যও বেশ উদ্বেগের বিষয়। শিশুরা মুসলমানদের ওপর আক্রমণে নিজেদের মতো করে প্রতিবাদের কৌশল নির্ধারণ করেছে। ফিলিস্তিনি শিশুদের জন্য তাদের অনেক মায়া। কেবল তাই নয়, রায়াত খানের জিজ্ঞাসা ফিলিস্তিনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন? বাংলাদেশ ফিলিস্তিনিদের জন্য কিছু করছে কিনা?
ক্লেদাক্ত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি শিশুদের মন বিষিয়ে তুলছে। তারা নিপীড়ন ও সহিংসতা প্রত্যাখান করছে। মোটাদাগে ধর্মীয় মূল্যবোধ তাদের ভেতর দৃঢ় হচ্ছে। তাদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মাচ্ছে যে, মুসলমানেরা নিগৃহীত ও নিপীড়িত। শিশুমনে নিপীড়িত মুসলমাদের জন্য এক দরদী আবহ তৈরি হচ্ছে। তারা দরদী মন নিয়ে বসে থাকতে চায় না।
অন্যদিকে রায়াত খান ইতোমধ্যে কোরান শরীফ পড়া শিখেছে এবং যুগপৎভাবে বাবা-মায়ের সঙ্গে জিদ ধরেছে, ভবিষ্যতে সে আরবি লাইনে পড়তে চায়। পরিস্থিতির কারণেই ধর্মীয় মূল্যবোধ সংযোজিত শিশু তৈরি হচ্ছে।
শিশুদের এ ধরনের মনোভঙ্গি ভালো কী মন্দ সেটি আলোচনার বিষয় নয়। বাস্তবতা হলো শিশুদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনাবাহিত বিশেষ মনোভঙ্গি গড়ে উঠছে। দেশীয় ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তারা ধর্মীয় মূল্যবোধের দিকে ঝুঁকতে পছন্দ করছে।
শেখ হাসিনা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
ক্ষমতাত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘিরে যেসব রিল তৈরি হয়েছে সেগুলো মূলত কৌতুক ও হাস্যরসে ভরা, যা দেখে শিশুরা অনেকটা সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। ফেইসবুক, রিল, ইউটিউব ও টিকটকনির্ভর স্যাটায়ার চর্চার বিকাশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। গত ১৫ জুলাই ২০২৪, বস্তিবাসী শিশুদের মুখে ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’ বলতে শুনেছি। ফেইসবুক, রিল, ইউটিউব ও টিকটকে যে ট্রলের ট্রেন্ড শুরু হয়েছে তা স্যাটায়ার চর্চায় নতুন দিক খুলে দিয়েছে।
কেবল, শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে যে পরিমাণ ট্রল হয়েছে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশা বিশেষত শিশুদের ওপর এগুলোর প্রভাব নিয়ে গবেষণা হতে পারে। এসব ট্রল সবসময় যে বিনোদন দিচ্ছে তা নয় শিশুরা এগুলো দেখে যথেষ্ট বিভ্রান্তও হচ্ছে।যেমন, রায়াত খানের প্রশ্ন শেখ হাসিনা ম্যারিড কিনা? বললাম শেখ হাসিনা ম্যারিড। রায়াতের প্রশ্ন, তাহলে রিলে মোদীর সঙ্গে শেখ হাসিনার বিয়ে কেন দেখানো হচ্ছে। অনেক রোমান্টিক সিন দেখাচ্ছে। রায়াতের প্রশ্ন কেনো এটা করা হচ্ছে?
রায়াত খানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কোন রিলটি তার কাছে সবচেয়ে মজার লেগেছে। রায়াতের উত্তর, ওয়াবদুল কাদেরের ওই কথাটা ‘কোথায় পালাব, ফখরুল সাহেবের বাসায় গিয়ে উঠব’। মালিহার উত্তর ওয়াবদুল কাদের যখন বলছিলেন, আমি ছাত্রদের বলতে চাই তোমাদের কাছে স্মার্ট বাংলাদেশ…সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চ ভেঙ্গে পড়েছিল।
শিশুদের মনে শেখ হাসিনা সম্পর্কে তৈরি হয়েছে এক গভীর নেতিবাচক মনোভঙ্গি। শেখ হাসিনার সরকার বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং শেখ হাসিনা সম্পর্কে যে মনোভঙ্গি গড়ে তুলতে চেয়েছিল তা ব্যাকফায়ার হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়া, গণমাধ্যম ও পারিবারিক পরিসর থেকে শিশুরা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরিস্থিতি দেখেছে, প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে এবং প্রকাশ করছে। শিশুদের মনকে কীভাবে পরিচ্ছন্ন করা যাবে? কারণ, ইতোমধ্যে শিশুদের মনে জমেছে অনেক ক্লেদ।