একদিন গোলাম আযম– শেষ পর্ব

গণমানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে দাঁড়াবার ফলেই ইতিহাসে গোলাম আযম চিহ্নিত হয়েছেন গণশত্রু হিসেবে।

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 2 Jan 2023, 08:05 AM
Updated : 2 Jan 2023, 08:05 AM

নির্বাচনের কয়েক মাস পর ওই বছরই গোলাম আযমের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল তার নিজের বাসায়। আমার তখন সবে মাস্টার্স পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। যাকে বলে পুরোপুরি বেকার, আমার অবস্থা তখন সেরকম। ওই সময় আমার খালা (আম্মার খালাতো বোন) ড. তাজিন মুরশিদ বাংলাদেশে আসেন আটকে পড়া বিহারীদের বিষয়ে মাঠপর্যায়ে গবেষণা করবার কাজে। যতটুকু মনে পড়ে, এ গবেষণাকর্মটি হয়েছিল ইউরোপিয়ান কমিশনের ফান্ডিংয়ে।

খালা তখন পড়াচ্ছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে। তার একটি বিখ্যাত বই হলো ‘The Sacred and the Secular: Bengal Muslim Discourses, 1871-1977’। বইটিতে তিনি বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক-সামাজিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের ধারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন।

খালা দেশে এসে আমাকে বললেন, তোর যখন আপাতত কোনো কাজ নেই, তুই গবেষণাকর্মে আমাকে সাহায্য কর। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। খালার সাথেই তখন প্রথম মোহাম্মদপুরে বিহারী ক্যাম্পে যাই। কথা হয় তাদের সাথে। ক্যাম্পে তাদের মানবেতর জীবন-যাপনের অবস্থা চোখে পড়ে। মনে পড়ে অদেখা পাকিস্তানের অলীক স্বপ্ন নিয়ে তাদের অনেকে সেখানে বাস করছেন। বাংলাদেশের সাথে মিশে যাবার আকাঙ্খাও প্রকাশ করেন কেউ কেউ। খালাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ যাই তাদের নেতা মরহুম নাসিম খানের সাথে কথা বলবার জন্য।

সিভিল সোসাইটি এবং রাজনৈতিক দলের নানা নেতাকর্মীদের সাথেও আমরা দেখা করি। বাসদ অফিসে বসে সংক্ষিপ্ত কথা হয় প্রয়াত মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর সাথে। গাজীপুরে দলীয় কর্মসূচিতে যাবার তাড়া থাকায় তিনি আমাদের বেশি সময় দিতে পারেননি। তবে বারবার অনুরোধ করেছিলেন, আরেকবার এসে যেন দেখা করি, দীর্ঘসময় ধরে কথা বলি।

বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার সাথে দেখা করবার জন্য এক সন্ধ্যায় আমরা যাই নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসে। বিএনপি তখন সদ্য ক্ষমতাহারা। সন্ধ্যাবেলা কর্মীদের আনাগোনায় অফিস বেশ সরগরম। আগে থেকে অ্যাপয়ন্টমেন্ট করা ছিল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর ভেতরে ডাক আসল। দেখলাম বেশ সাজানো-গোছানো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত করপোরেট ধাঁচের অফিস মান্নান ভূঁইয়ার।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার তখন বিলাসীতার প্রতীক ছিল। কেবল উচ্চবিত্ত পরিবার, কিছু করপোরেট অফিস, বিদেশি দূতাবাস এসব জায়গায় এর ব্যবহার দেখা যেত। ঢাকার বাইরে তেমন একটা ব্যবহার ছিল না বললেই চলে।

মান্নান ভূঁইয়ার অফিসে ঢুকে অবাক হলাম এ ভেবে যে, যেখানে বাইরে তার সামনেই কর্মীরা গরমে ঘামছেন, সেখানে তিনি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বসিয়ে অফিস করছেন। কিছুদিন আগেও মন্ত্রী ছিলেন, হয়ত সে কারণেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ঘরে থাকবার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। আমাদের দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে তিনি ঘরের এক পাশে রাখা সোফায় বসে খালার সাথে কথা বললেন।

মান্নান ভূঁইয়ার অফিসে বসে সেদিন দূরবর্তী কল্পনাতেও আসেনি যে, এই তিনিই একদিন তার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যখন জেলে তখন সাইফুর রহমান, মেজর (অবঃ) হাফিজ এবং আরও কয়েকজনকে নিয়ে বিএনপিকে চিরতরে শেষ করে দেবার উদ্যোগ নেবেন। ১/১১-এর কুশীলবদের সাথে হাত মিলিয়ে মান্নান ভূঁইয়ার এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সেদিন খন্দকার দেলোয়ার যদি সাহস করে না দাঁড়াতেন, তাহলে আজ হয়ত বিএনপির ইতিহাস অন্যরকম হতো।

বিএনপির অফিস থেকে বের হয়ে খালা বললেন তিনি গোলাম আযমের সাথে কথা বলতে চান। বছরদুয়েক আগে নাগরিকত্ব পাওয়া গোলাম আযম তখন নির্মূল কমিটির আন্দোলনের ফলে বেশ আলোচিত চরিত্র। খালা আমাকে তার সাথে সাক্ষাৎকারের সময় ঠিক করতে বললেন।

পরদিন আমি জামায়াত অফিসে ফোন করলে তারা আমাকে গোলাম আযমের বাসার নম্বর দিয়ে সরাসরি ফোন করতে বলে। ওই অনুযায়ী আমি দুপুরবেলা ফোন করলে আমাকে জানানো হয় উনি ঘুমিয়ে আছেন, সন্ধ্যার দিকে ফোন করলে পাওয়া যাবে। বিষয়টা খালাকে বললে উনি আমাকে বলেন তিনি ফোন করে সময় ঠিক করে নেবেন। কথা বলে সময় ঠিক করে খালা আমাকে তার ধানমন্ডির বাসায় যেতে বলেন।

গোলাম আযম সময় দিয়েছিলেন দুপর ১২টায়। আমরা একটা রিকশা নিয়ে ধানমন্ডি থেকে তার বাসা মগবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। যেতে যেতে খালাকে জিজ্ঞাসা করলাম বাসার ঠিকানা। খালা বললেন, আমাকে বলা হয়েছে মগবাজার মসজিদের ওখানে। আমি বললাম, “কী বলেন! নম্বর ছাড়া ঢাকা শহরে বাসা খুঁজে পাবেন কীভাবে?” তিনি বললেন, “চল যাই, দেখি কী দাঁড়ায়”।

মগবাজার মসজিদের সামনে এসে রিকশা থামিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না কাউকে জিজ্ঞাসা করব কিনা বা জিজ্ঞাসা করা সমীচীন হবে কিনা। এমন সময় পাঞ্জাবি এবং লুঙ্গি পরিহিত এক যুবক এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা কাউকে খুঁজছি কিনা। আমি বললাম, জ্বি। উনি কাকে খুঁজছেন জিজ্ঞাসা করাতে আমি একটু আমতা আমতা করে বললাম, “গোলাম আযমের বাসা খুঁজছি। উনি বললেন, আসুন আমার সাথে”।

একটু দ্বিধা করে আমরা রিকশা থেকে নামলাম। ভাড়া মিটিয়ে ওনার সাথে হাঁটা শুরু করলাম। তিনি একটু সামনে গিয়ে মসজিদের গা ঘেঁসে একটা গলির মধ্যে ঢুকলেন। তারপর যতটুকু মনে পড়ে মসজিদসংলগ্ন একটা বাড়ির সিঁড়ি ধরে ওপরে ওঠা শুরু করলেন।

সিঁড়িটি ঢালাই করা এবং কোনো রেলিং নেই। দোতলায় উঠে একটি ঘরে ঢুকে আমাদেরকে পাশের ঘরে গিয়ে বসতে বললেন তিনি। পাশের ঘরে ঢুকতেই দেখলাম ২২-২৩ বছর বয়সী এক তরুণ চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে আছে। ছোট ঘরটিতে বেশ অনেকগুলো বই ভর্তি আলমারি।

তরুণটি আমাদের সাথের যুবককে বললেন, “বসতে হবে না, উনাদের সরাসরি নিয়ে যান”। সময় ১২টায় দেওয়া হলেও, বাসা খুঁজে পাওয়া সংক্রান্ত জটিলতায় তখন ১২:২০ বেজে গিয়েছে। সাথের যুবকটি আমাদের পাশের আরেকটি ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “যান আপনারা”।

আমি প্রথমে ঢুকলাম। আমার পেছনে খালা। বেশ বড় একটা ঘর। প্রস্থের তুলনায় দৈর্ঘ্যে বেশ বড়। পুরো ঘরের চারদিকে দেয়াল ঘেঁষে সারি সারি বই ভর্তি আলমারি। তবে ঘরটি সাদামাটা। দামি আসবাব বা সোফাসেট, এসব নেই।

এ ঘরটিসহ বাকি যে দুটো ঘর দেখলাম, তার কোনটিতেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নেই। এক কথায় খুব সাধারণ মানের বাড়ি– জেলা শহরের মাঝারি মানের আইনজীবীদের বাড়ি যেরকম হয়, অনেকটা সেরকম। তবে ব্যতিক্রম যেটা তা হলো, বিপুল বইয়ের সংগ্রহ।

দরজা দিয়ে ঢুকে হাতের ডান দিকের শেষ মাথায় একটা সাধারণ মানের অফিসিয়াল টেবিল। তার সামনে দুটো চেয়ার রাখা। দেখলাম এর বিপরীত দিকে একটি চেয়ারে বসে আছেন গোলাম আযম। পরনে সফেদ সাদা পাঞ্জাবি এবং লুঙ্গি।

আমি প্রথমে কাছে গিয়ে সালাম দিলাম। উনি জবাব দিয়ে আমাদের বসতে বললেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “কে কথা বলতে এসেছেন?” আমি খালাকে দেখিয়ে দিলাম।

গোলাম আযম খালার নাম জিজ্ঞেস করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন কী বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। খালা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে পড়েছেন, পরবর্তীতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন।

গোলাম আযম জানতে চাইলেন, কেন তিনি ইংরেজি সাহিত্য ছেড়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গেছেন। তারপর পিএইচডির বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশ্ন করলেন। বিষয়বস্তু বলার পর আবার জানতে চাইলেন, এ বিষয় বেছে নেবার কারণ এবং গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে। লন্ডনে খালা কোথায় থাকেন এ বিষয় নিয়েও তিনি আগ্রহ দেখালেন। জায়গার নাম বলার পর একটা দোকানের নাম বলে বললেন, ওটা এখনো আছে কিনা। ওই জায়গায় একটি পার্কের কথাও জিজ্ঞাসা করলেন।

আমি দেখলাম সাক্ষাৎকার নিতে এসে উল্টো খালার সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে। আমার মনে হলো, গোলাম আযম নিশ্চিত হতে চাচ্ছেন খালা সম্পর্কে। এদিকে খালা কিছুতেই প্রশ্ন করার সযোগ পাচ্ছেন না। এর মাঝে গোলাম আযম জিজ্ঞেস করলেন খালু অর্থাৎ খালার স্বামী সম্পর্কে।

খালু বেলজিয়ামের নাগরিক, উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম ভ্যান ডের জেস্ট। এটা শুনে গোলাম আযম বললেন “আপনি তো সাচ্চা মুসলমান। কিন্তু আপনি যে আমার সামনে মাথায় কাপড় না দিয়ে বসে আছেন এতে তো আমি গুনাহগার হচ্ছি।”

আমি খালার দিকে তাকালাম। মনে হলো কিছুটা নার্ভাস। তিনি মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে বসলেন। এরপর গোলাম আযম বললেন, “আমার বিবিকে বলেছি আজ একজন মহিলা আসবেন কথা বলতে। তবে আজ তাকে অন্দরমহলে আনব না।” এরপর তিনি তার স্ত্রী আফিফা আজম সম্পর্কে দুই-একটি কথা বললেন।

কথা বলার মাঝে একজন তরুণ এসে ট্রেতে করে নাস্তা দিয়ে গেছে। ট্রেতে সাজানো রসগোল্লা, বিস্কুট, চানাচুর, কলা ইত্যাদি। গোলাম আযম আমাদেরকে খাবার নিতে বললেন। তারপর বললেন, “এ রসগোল্লার পাকিস্তানে অনেক কদর।” আমি উনাকে বললাম “আপনিও নিন।” তিনি বললেন “আমি আপনাদের সাথে কলাতে শরীক হব।”

একটা বিষয় খেয়াল করলাম, গোলাম আযমের কিছু শব্দ চয়ন সাধারণ বাংলাভাষীর চেয়ে ভিন্ন। খাওয়ার পর্ব শেষ হবার পর উনি বললেন “এবার বলুন আপনার প্রশ্ন কী? কী বিষয় নিয়ে কথা বলতে চান?” উনি আমাদের সময় দিয়েছিলেন ১ ঘন্টা, অর্থাৎ ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত। হাতে দেখি আছে মাত্র ১২-১৩ মিনিট।

খালা আটকে পড়া বিহারীদের বিষয়টি অবতারণা করে প্রশ্ন শুরু করলেন। উনি উত্তর দিলেন একেবারেই জামায়াতের অফিসিয়াল লাইনের আলোকে। এর মধ্যে ১টা বাজতেই তিনি কথা বন্ধ করলেন। খালা আর বাকি প্রশ্ন করার সুযোগ পেলেন না। ইতোমধ্যে মসজিদ থেকে জোহরের আজান ভেসে আসা শুরু হয়েছে।

গোলাম আযম বললেন, “আপনাদের ১ ঘণ্টা সময় দিয়েছিলাম। আপনারা ২০ মিনিট দেরি করেছেন, আবার আমিও গল্পে, গল্পে অনেকটা সময় নিয়ে নিয়েছি। আজ তো কথা শেষ হলো না, আরেকদিন আসবেন, সময় নিয়ে কথা বলা যাবে। আর আমার বিবির সাথেও আপনার পরিচয় করিয়ে দেব সেদিন।”

ইতোমধ্যে আরেক তরুণ ১২-১৩টি বই নিয়ে হাজির। বইগুলি তিনি খালাকে উপহার হিসেবে দিলেন। বইগুলি সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী এবং গোলাম আযমের লেখা। এর বাইরে ২/৩টি বই অন্য কারও লেখা। উনি খালাকে বললেন, বইগুলি পড়ে মতামত জানালে কৃতার্থ হবেন। এরপর বিদায় দেবার জন্য উঠে আমাদের সাথে দরজা পর্যন্ত আসলেন।

দরজার কাছে এসে হঠাৎ আমার পিঠে হাত দিলেন গোলাম আযম। পিঠে হাত দিয়ে বললেন, “হেই মিয়াঁটা কে, হেই মিয়াঁরে তো চিনলাম না।” আমি বললাম, “জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগ থেকে সদ্য মাস্টার্স পাশ করেছি আমি”। শুনে বললেন, “বাহ! খুব ভালো। আপনিও পলিটিক্যাল সাইন্স, আপনার খালাও পলিটিক্যাল সাইন্স, আমিও পলিটিক্যাল সাইন্স। খুবই ভালো হইল। লম্বা সময় নিয়ে গল্প করতে পারব আমরা।”

ইতোমধ্যে যিনি আমাদের ওপরে নিয়ে এসেছিলেন, তিনি একটা রিকশা ডেকে নিয়ে এসেছেন। গোলাম আযমের সাথে কথা বলার মুহূর্ত থেকে শুরু হয়েছিল মুষলধারে বৃষ্টি। এ জন্য উনি নিজে থেকেই রিকশা নিয়ে আসেন। তারপর একদম রিকশা পর্যন্ত এসে আমাদের রিকশায় তুলে দিলেন। ততক্ষণে বৃষ্টি অবশ্য অনেকটা কমে এসেছে।

রিকশাতে উঠে খালা বললেন, “চল, সৈয়দ হাসান ইমামের বাসায় যাই। বাসা এখান থেকে খুবই কাছে।” একটা বিষয় ভেবে অবাক লাগছিল, নির্মূল কমিটির ওই সময়কার অত্যন্ত সরব নেতা হাসান ইমাম আর গোলাম আযম থাকেন একই পাড়ায়।

গোলাম আযম বিষয়ক এ লেখাটি লিখতে গিয়ে মনে পড়ছিল হিব্রু বাইবেলের The Book of Samuel-এ বর্ণিত গোলিয়াথ বনাম ডেভিডের উপমার কথা। উপকথা অনুসারে পরাক্রমশালী গোলিয়াথ পরাজিত হয়েছিল দুর্বল রাখাল ডেভিডের কাছে।

আধুনিক কালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের শক্তিশালী কমিউনিস্ট শাসকরাও দাঁড়াতে পারেনি দুর্বল, নিরস্ত্র ডেভিড বা জনতার সামনে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে মনে করা হয় শোষিত, মেহনতী মানুষের মতবাদ। কিন্তু এ মতবাদের অনুসারীরা পূর্ব ইউরোপে গণআকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে না পারায়, ওইসব দেশের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীর চোখে পরিণত হয়েছেন গণশত্রুতে।

তাত্ত্বিকভাবে একটি রাজনৈতিক মতবাদ যত ভালোই হোক, তার অনুসারীরা যদি জনআকাঙ্ক্ষার বিপরীতে দাঁড়ান, তাহলে জনতার কাছে তারা গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত হন। গোলাম আযমও তাই হয়েছেন।

সমাজতান্ত্রিক মতবাদ নয়, সারাজীবন গোলাম আযম নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করেছেন মওদুদী ঘরানার ‘ইসলামপন্থী’ মতবাদ। অন্যান্য রাজনৈতিক মতবাদের মতো এর ভালোমন্দ নানা দিক নিয়ে তর্কবিতর্ক রয়েছে, এটাই স্বাভাবিক।

মাওবাদী ঘরানার বামপন্থি নেতা সাম্যবাদী দলের মোহাম্মদ তোয়াহার ১৯৭৮ সালের মার্চ সংখ্যার ‘ঢাকা ডাইজেস্টে’ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারকে ভিত্তি ধরে জামায়াত দাবি করে, গোলাম আযম ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। অর্থাৎ, জামায়াতের বয়ান অনুসারে, ১৯৫২ সালে গোলাম আযম গণআকাঙ্ক্ষার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। কিন্তু সেই জামায়াত এমন কোনো বয়ান হাজির করতে পারেনি যে, ১৯৭১ সালে গোলাম আযম গণআকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করেছিলেন। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন।

বাস্তবতা হলো, ১৯৭১ সালে গোলাম আযম বেশিরভাগ মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে হয় বুঝতে পারেননি বা বুঝতে চাননি, অথবা বুঝতে পেরেও এর বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন। শুধু যে দাঁড়িয়েছেন তাই নয়, ১৯৭৮ সালে দেশে ফেরার পর থেকে যে রাষ্ট্রটির নাগরিকত্ব পাবার জন্য তিনি হন্যে হয়ে চেষ্টা করেছেন, ১৯৭১ সালে ওই রাষ্ট্রের অভ্যুদয় রুখে দেবার জন্য ‘ইসলামপন্থার’ রাজনীতির ওপর ভর করে হেন কোনো পন্থা নেই যা তিনি অবলম্বন করেননি। তার এ ভূমিকার কারণে অর্থাৎ গণমানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে দাঁড়াবার ফলেই ইতিহাসে গোলাম আযম চিহ্নিত হয়েছেন গণশত্রু হিসেবে।