Published : 16 Dec 2010, 02:55 PM
পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছে ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর সামরিক হামলার পর পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসন কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে; আর প্রদেশ চালানোর ভার গিয়ে পড়ে সেনা প্রশাসনের ওপর। পরিস্থিতি সামাল দিতে চিফ সেক্রেটারিসহ বেশ কজন জ্যেষ্ঠ বেসামরিক আমলাকে পশ্চিম থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যোগ দেন পশ্চি পাকিস্তানি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এবং অন্তত দুজন বিভাগীয় কমিশনার।
শেষ রক্ষা হয়নি পাকিস্তানের। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের আত্মসমর্পণ ও পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের অস্ত্র সমর্পণ এবং পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে অস্ত্রবিরতির গ্লানিকর অবস্থার তদন্ত করতে গঠিত হয় 'ওয়ার এনকোয়ারি কমিশন'। প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর আদেশে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি জাস্টিস হামুদুর রহমানকে প্রধান করে তিন সদসস্যের কমিশন তদন্তের দায়িত্ব গ্রহণ করে। দুজন সদস্য হচ্ছেন পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এস আনোয়ারুল হক এবং বেলুচিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি তৌফিক আলী আবদুর রহামন। কমিশনের সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আলতাফ কাদির এবং সচিব হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের সহকারী রেজিস্ট্রার এম এ লতিফ।
কমিশন ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ রাওয়ালপিন্ডিতে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করে এবং ১২ জুলাই ১৯৭২ প্রেসিডেন্টের কাছে রিপোর্ট দাখিল করে। ইস্টার্ন কমান্ডের কর্মকর্তারা সে সময় যুদ্ধবন্দি থাকায় পুনরায় কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ১৬ জুলাই ১৯৪৪ থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। সাক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় যে ১৯৭১-এর পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনে সামরিক প্রভাব নিরবচ্ছিন্নভাবে বাড়তে থাকে।
ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এম এ কে চৌধুরী কমিশনের কাছে দেয়া সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন, '১৯৭১এর মার্চ এপ্রিলের সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্বে ছিলেন একজন মিলিটারি গভর্নর আর বেসামরিক প্রশাসনসংক্রান্ত গভর্নরের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন একজন মেজর জেনারেল। আবার সকল স্তরেই ছিল সমান্তরাল সামরিক আইন প্রশাসন। প্রাদেশিক সদর দপ্তরে পুলিশের আইজির সঙ্গে বৈঠক করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত একজন পশ্চিম পাকিস্তানি ডিআইজিকেও স্থানীয় সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ আসার অনুমতি দেয়নি।'
ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার সৈয়দ আলমদার রাজা বললেন, সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে ও তত্ত্বাবধানে অন্তত রুটিন কাজগুলো করাতে বেসামরিক কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীল করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তেমন কোনো বস্তুগত ফল পাওয়া যায়নি। যেসব বাঙালি অফিসারকে কাজে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, তাদের আস্থার অভাব ছিল এবং তাদের আনুগত্য নিয়ে যে সন্দেহ করা হচ্ছে না, এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত ছিলেন না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছিল, এমনকি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে কাউকে কিছু না জানিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছিল।
বেসামরিক গভর্নর ও মন্ত্রিপরিষদ গঠনের পরও প্রশাসনে সেনা সম্পৃক্ততার সমাপ্তি ঘটেনি। গভর্নরের সচিবালয়ে বেসামরিক বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী বলেছেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট (জেনারেল ইয়াহিয়া খান) ঘোষিত পুরোপুরি বেসামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানে গঠন করা যায়নি। ডক্টর মালিক (বেসামরিক গভর্নর) দুর্বল ব্যক্তিত্বের একজন বুড়ো মানুষ ও রাজনীতিবিদ। তিনি সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজিকে বিরক্ত করতে চাইতেন না। তা ছাড়া পূর্বাঞ্চলের অবস্থাও ছিল অস্থিতিশীল। অন্যদিকে জেনারেল নিয়াজি পছন্দ ও লালন করতেন ক্ষমতার স্বাদ, কিন্তু রাজনৈতিক গুরুত্ব অনুধাবনের মতো দূরদৃষ্টি কিংবা সামর্থ্য কিছুই ছিল না তাঁর। বেসামরিক গভর্নরকে তিনি তেমন সাহসও প্রদান করেননি।… ফলে কার্যত সেনাবাহিনীই বেসামরিক প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থেকে গেল।
পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পশ্চিম পাকিস্তানি বেসামরিক কর্মকর্তাদের মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফের কথায়: ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে বেসামরিক গভর্নরকে গদিতে বসানো হয় আসলে দেশি ও বিদেশিদের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্যই। বেচারা ডক্টর মারিক ও তাঁর মন্ত্রীরা ছিলেন কেবল শিখণ্ডী মাত্র। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা রয়ে যায় সেনাবাহিনীর হাতেই। নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম ছবিটা আমার মনে পড়ছে, যদিও মন্ত্রিসভার কেউ নন, তবুও গভর্নরের ডান পাশে সবচেয়ে দৃশ্যমান অবস্থানে রয়েছেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী।
পরবর্তী সময়ে এই মনোভাব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন ইয়াহিয়া খান উপনির্বাচনের ঘোষণা দিলেন। নির্বাচনে প্রার্থী কে হবেন তা ঠিক করলেন জেনারেল রাও ফরমান আলী। জেনারেল নিয়াজি ও তাঁর অধস্তন সামরিক আইন প্রশাসকেরা বেসামরিক কর্মকর্তাদের বিভিন্ন স্তরে কাজের পূর্ণ স্বাধীনতা পাওয়ার যত বিবৃতিই দিক না কেন, তারাই আবার বলেছে পূর্ব পাকিস্তানে বিশেষ অবস্থা বিরাজ করার কারণে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া বিশেষভাবে অপরিহার্য, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়, যোগাযোগব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে এবং প্রদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবনে।
পূর্ব পাকিস্তানের ২০৩ (এ) ব্রিগেডের কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার এম সলিমুল্লাহ কমিশনকে জানিয়েছেন, সেনা কর্মকর্তাদের ও সাধারণ সৈনিকদের দীর্ঘমেয়াদি মার্শাল ল ডিউটি তাদের পেশাগত মানকে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। পাকিস্তান নৌবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডিং অফিসার রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শরিফ বলেন, ১৯৭১-এ পাকিস্তানের পরাজয়ের ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৯৫৮ সালে যখন সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে।
যখন নতুন দায়িত্ব নিয়ে রাজনীতি শেখার পাঠ গ্রহণ করতে শুরু করে ধীরে ধীরে তারা সৈনিকবৃত্তির কলাকৌশল ছাড়তে শুরু করে, সেই সঙ্গে শুরু করে সম্পদ অর্জন আর বাড়িয়ে চলে নিজেদের মার্যাদা। কমিশনকে একই কথা বলেছেন কমোডর আই এইচ মানিক (১৯৭১-এ চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান), ইস্টার্ন কমান্ডের আর্টিলারি ব্রিগেডিয়ার এস এ কাসিম, ৯ ডিভিশনের কর্ণেল মনসুরুল মালিক এবং ইস্টার্ণ কমান্ডের কর্নেল ইজাজ আহমদ।
হামুদুর রহমান কমিশন এই উপসংহারে পৌঁছেন যে মার্শাল ল ডিউটিতে ও বেসামরিক প্রশাসনে পাকিস্তান আর্মি দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম করে এবং সেনাবাহিনীকে পেশাগত দায়িত্ব থেকে সরিয়ে ক্রমেই দুর্বল করে ফেলে। এমন সব লোভনীয় ব্যাপারে তারা জড়িয়ে যায় যে তাদের প্রশিক্ষণ গ্রহণের ও প্রদানের সময়ও তাদের থাকে না, পেশাগত বিষয়ে তাদের অনেকের আগ্রহ শূন্যের ঘরে নেমে আসে।
রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফের মুল্যায়নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে ১৯৭১ এ পাকিস্তানের পরাজয়ের ভিত্তি রচিত হয় ১৯৫৮ সালে, যা বিচারপতি কায়ানির ভাষায়-পাকিস্তানের বীর সৈনিকদের নিজ দেশ জয়।
হামুদুর রহমান কমিশন, সম্পুরক প্রতিবেদন থেকে রচিত