চালকল মালিকরা শিল্পপতি, তারা ব্যাংক ঋণ পায়, কেউবা ঋণ খেলাপিও হয়।তথাপি তাদের শান-শওকত বাড়ে।চোখের সামনে দেখছি মিল মালিকদের গাড়ির মডেল বদলায়, কৃষকের ভাগ্য তেমন বদলায় না।
Published : 08 Jun 2024, 05:41 PM
বাঙালি দিনে দু’বেলা ভাত খায়। কিছু মানুষ ডাক্তারের পরামর্শে দিনে এক বেলা ভাত খায়। সেই সংখ্যার চেয়ে অধিক সংখ্যক মানুষ দিনে তিন বেলা ভাত খায়। বাঙালি দিনে দুবেলা দুমুঠো ভাত চায়।
ধান থেকে চাল এবং চাল সেদ্ধ করে ভাত, সে কথা সকলেরই জানা আছে। ধানের রচনা পড়ে আর রেলগাড়ির জানালা দিয়ে ধানক্ষেত দেখে যতটুকু জানা যায়, শহরে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষের ধান সম্পর্কে ধারণা ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ। আমরা রচনায় পড়েছি ধান (মৌসুম ভেদে) তিন প্রকার: আউশ, আমন এবং বোরো। বর্তমানে আউশ ধানের আবাদ আর দেখা যায় না বললেই চলে। উত্তরাঞ্চলে আউশ ধানকে স্থানীয় ভাষায় বলা হত ‘ভাদই’ ধান। এই ধান মূলত শুষ্ক মৌসুমে চাষ করা হতো এবং গ্রীষ্ম বা বর্ষার আগ দিয়ে ঘরে তোলা হতো। সম্ভব হলে প্রাকৃতিক জলাশয় হতে দেশীয় পদ্ধতিজাত (একপ্রকার দেশীয় সেচ ব্যবস্থা), ছিনাই/দুনি দিয়ে সেচ দেওয়া, অথবা সেচ ছাড়াই কম ফলনের এই ধান ফলত। আউশ ধানের বীজ জমিতে ছিটিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তৈরি হতো আউশের ক্ষেত। শিশু বয়সে আউশ ধানক্ষেতে গরু টানা মইয়ে উঠবার স্পষ্ট স্মৃতি রয়েছে আমার। ডাঙ্গা জমিতে আউশের ক্ষেত্রে যেই ধান গাছগুলো ৬/৭ ইঞ্চি বড় হয়েছে, ছিটানো বা অঙ্কুরোদগমের তারতম্যে নিবিড়ভাবে হয়ে ওঠেনি, এমন ধানক্ষেতে মই দিলে ধান গাছের কাণ্ডে ফাটল সৃষ্টির মাধ্যমে সেখান থেকে কুশি গজিয়ে থোপ তৈরি হয় এবং আরো অধিক ধান গাছ, অধিক ফলন হয়। এই উদ্দেশ্যেই চারা আউশ ধানক্ষেতে মই দেওয়া হয়। আর পূর্ণবয়স্ক কৃষক মইয়ে উঠলে ধান গাছ ছিঁড়ে যেতে পারে, তাই শিশু আমাকে মইয়ে উঠতে দিয়ে আমার ইচ্ছাপূরণ করেছিল এক ধানচাষি। তাই বলে পাকা ধানে কখনো মই দেওয়ার নয়।বর্ষায় পাকা আউশ ধানকে নিয়ে কবিগুরু লিখেছেন “আউশের ক্ষেত জলে ভরভর”।সোনার তরী কবিতার নাও ভরা ধানগুলো বোধ করি আউশ ধানের।
আউশ ধানের আবাদ উঠে গিয়ে অনেক ব্যাপকহারে শুরু হয়েছে বোরো ধানের চাষ। সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে এই অঞ্চলে বোরো ধান চাষ শুরু হয়।বেশ দ্রুতই এই ধান চাষে কৃষকেরা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।এখন বোরো মৌসুমেই দেশের সর্বাধিক ধান উৎপন্ন হয়।বোরো ধানেরই আরেক নাম ইরি।ইরি ধান সম্পূর্ণই সেচনির্ভর, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানি গভীর বা অগভীর নলকূপের সাহায্যে তুলে জমিতে সেচ দিয়ে এই ধান চাষ করা হয়। ইরি/বোরো ধান চাষের নিয়ম অনেকটা আমন ধান চাষের মতই, সময়টা ভিন্ন ইরি ধান চাষ শুরু হয় শীতকালে আর আমন বর্ষাকালে।
প্রথমে ধান বীজ বড় মাটির চারিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। ভেজা ধান খড়ের উপর কলাপাতা বিছিয়ে ছড়িয়ে রেখে তার উপর চট এবং খড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।শীত মৌসুম হওয়ার কারণে অঙ্কুরোদগমের জন্য উষ্ণতার প্রয়োজনে এই ব্যবস্থা। এভাবে ৩-৪ দিনের মধ্যে ধান থেকে শিকড় বের হয়।একে গাজানো বলে। এই গাজানো ধান মই দিয়ে চাষ করে তৈরি বীজতলায় ছিটিয়ে ধানের চারা তৈরি হয়। এই চারা প্রস্তুতকৃত জমিতে কাদার মধ্যে রোপন করা হয়।এরপর গড়ে চার মাস সময় ধরে নিয়মিত সেচ, সার ও কীটনাশক প্রয়োগে আগাছা ঘাস পরিষ্কার করে যত্নআত্তি নেওয়া হয়।অধিক ফলন পেতে এই ধান চাষে প্রচুর সার এবং কীটনাশক ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সেচের জন্য উচ্চ মূল্যে ডিজেল অথবা বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। যদিও সেচের জন্য বিদ্যুতের মূল্য কম ধরা হয়ে থাকে তবে গ্রাম এলাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (আরইবি)।তাদের বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়াও অনেক ব্যয় সাপেক্ষ। ট্রান্সমিটার কৃষককে কিনতে হয় সেই ট্রান্সমিটার আবার কখনো চুরি হয়ে গেলে কৃষককে পুনরায় কিনে দিতে হয়।সার, কীটনাশক, সেচযন্ত্র অনেক মূল্যবান বটে। যদিও সারের উপর সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। বাজেটে সরকার আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে কৃষিতে ভর্তুকি কমিয়েছে, এটা যে করা হবে আগে থাকতেই পরিকল্পনা মন্ত্রীর বক্তব্যে ওঠে এসেছিল। আমাদের দেশে আমরা বিভিন্ন দাবি আদায়ে গার্মেন্ট শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, মাস্টার, ডাক্তারসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে ধর্মঘট করতে দেখি। কিন্তু কৃষক, চাষিদের এমন কোন ধর্মঘটের খবর জানা নেই আমার। কৃষক যদি কখনো পণ করে যে সে তার নিজের পরিবারের জন্য যতটুকু ধান প্রয়োজন হয় সে শুধু ততটুকু ধান চাষ করবে, বাকি জমিতে অন্য কোন অর্থকরী ফসল চাষ করবে, নয়তো জমি ফাঁকা ফেলে রাখবে, তাহলে আমরা বুঝতে পারবো, ‘কত ধানে কত চাল’ হয়।
চাল নিয়ে চালবাজির খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে বিভিন্ন সময়। চালের বাজার, মজুদ, আমদানি, সরবরাহ ইত্যাদি নিয়ে অনেক কারসাজি হয়ে থাকে।ধান নিয়ে ধান্দাবাজিও স্তরে স্তরে নেহায়েত কম হয় না। এই ধান্দাবাজি শুরু হয়েছে ধানবীজ থেকে। ২৫/৩০ বছর আগেও কৃষক তার উৎপাদিত ধান থেকে বাছাই করে শুকিয়ে ধানবীজ রেখে দিত নিজের ঘরে। প্রয়োজন মতো নিজেদের মধ্যে বিনিময় করত। অবস্থাপন্ন কৃষক, জোত দাঁড়ের ঘরে অন্যকে দেওয়ার এবং বিক্রির মতো ধানবীজও রাখা থাকত। মৌসুমের আগে ধানের হাটে বীজের ধান কিনতে পাওয়া যেত। বর্তমানে বীজকে কোম্পানিগুলো নিজেদের পকেটে নিয়ে নিয়েছে, তারা প্যাকেটজাত ধানবীজ বিপনণ করে থাকে।কৃষক সেই বীজ কিনতে বাধ্য হয়।এক কেজি ধান বীজের মূল্য ৪৫০ থেকে ৬৫০ টাকা। এক বিঘা জমির জন্য ৪-৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। ধান বীজের স্বত্ব কৃষকের হাত থেকে চলে গেছে কোম্পানিগুলোর হাতে।
হাওর এবং বিল অঞ্চলের ইরি/বোরো ধান শেষ চৈত্র এবং বৈশাখের প্রথম দিকেই কাটা হয়। বৈশাখের মাঝামাঝি সময় হাওর, বিল পানিতে পূর্ণ হতে শুরু করে তাই সেসব অঞ্চলে আগেভাগে মৌসুম শুরু হয় এবং শেষ হয়। আর দেশের উত্তরাঞ্চলে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষভাগ পর্যন্ত এই ধান কাটা হয়ে থাকে।ধানকাটা পর্ব এখনো চলছে উত্তরের মাঠে মাঠে। আগের দিনের মতো ধান কেটে ভারবাহক বা মাথায় ধানের বোঝা বয়ে এনে মাড়াই করার দিনও গত হয়েছে প্রায়।এখন কম্বাইন্ড হারভেস্টার দিয়ে ধানক্ষেত থেকে ধান একেবারে বস্তায় ভরে ফেলা হচ্ছে। এই ধান শুকানোর বা রাখবার তেমন কোন ব্যবস্থাই ক্ষুদ্র বা মাঝারি কৃষকদের নেই।ফলে একরকম ভেজা ধানই কৃষক বিক্রি করে দিয়ে মূল্য নিয়ে বাঁচতে চায়। তাতেও অনেক বিপত্তি। ফলন ভালো তো দাম কম, কখনো বা কম দামেও ক্রেতার অনাগ্রহ।এবারের কথাই ধরা যাক, শুরুতে বিআর-২৮ ধানের দাম ছিল ১৯০০/২০০০ টাকা বস্তা (৭৭.৫) কেজি=২ মণ। এক মাসের ব্যবধানে এই মূল্য কমে এসেছে ১৬০০ টাকায়।অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই লেনদেন হচ্ছে বাকিতে। কৃষক কবে টাকা পাবে তার নিশ্চয়তা নেই। ধানচাল ব্যবসায়ী, মিল মালিকদের পোয়াবারো। প্রসঙ্গত দেশের সবচেয়ে বেশি চালকল রয়েছে কুষ্টিয়া জেলায়, মোট ২৮৭টি আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দিনাজপুর জেলায়, ২৫৭টি ।চালকল মালিকরা শিল্পপতি, তারা ব্যাংক ঋণ পায়, কেউবা ঋণ খেলাপিও হয়।তথাপি তাদের শান-শওকত বাড়ে।চোখের সামনে দেখছি মিল মালিকদের গাড়ির মডেল বদলায়, কৃষকের ভাগ্য তেমন বদলায় না।এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করে সব খরচ মেটানোর পর কৃষকের ১০,০০০ টাকাও টেকানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণীর ‘চাষী’ কবিতার কথা মনে পড়ে যায়, যে কবিতায় জানতে চাওয়া হয়েছে ‘দধীচি কি তাহার চেয়ে সাধক ছিল বড়?’— “ব্রত তাহার পরের হিত, সুখ নাহি চায় নিজে / রৌদ্র দহে শুকায় তনু, মেঘের জলে ভিজে।”
সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের মূল্য নির্ধারণ করেছে প্রতি কেজি ৪৬ টাকা এই ধান শুকানো এবং ধুলোবালি মুক্ত হতে হয়। তবে এই নির্ধারিত মূল্যে প্রকৃত কৃষক সরকারের খাদ্য বিভাগের কাছে ধান বিক্রি করতে পারে খুব কমই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সুবিধাও গ্রহণ করে থাকে ধান চাল ব্যবসায়ী এবং দলীয় মানুষজন। বছরজুড়ে আমরা প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো দিবস পালন হতে দেখি। মা দিবস থেকে চা দিবস পর্যন্ত— এত দিবস রয়েছে যা মনে রাখাই কঠিন।কিন্তু কৃষক দিবস বলে কোন দিবস বা কৃষকদের জন্য কোন দিবস পালনের খবর আমাদের চোখে পড়ে কি? বাস্তবে তেমন কোন দিবস আছে কি? থাকলে আমরা কি তা যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করতে পারি না, আর না থাকলে এমন একটি দিবসকে থাকা উচিত নয়!
এবার আসা যাক আমন ধানের কথায়। এই ধান বর্ষায় রোপন করা হয় আর কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে কেটে ঘরে তোলা হয়। জীবনানন্দের ভাষায় “কার্তিকের নবান্নের দেশ”।এখনো যে ধানের পালা-পুঞ্জ, টাল (টাইল) দেখা যায় সে সকলই আমন ধানের।
আগের কালে আমন ধানই ছিল ধানের প্রধান আবাদ, সেসব দিনে আমন ধানের জাতগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়, যেমন দুধসর, কলম, লতিশাই, কাটারিভোগ ইত্যাদি জাতের ধানগুলো উত্তরাঞ্চলে চাষ হয়ে থাকতো।দিনাজপুর অঞ্চলের সুগন্ধি চাল হিসাবে কাটারিভোগ দেশজুড়ে প্রসিদ্ধ।কার্তিক-অগ্রহায়ন মাসে কাটারিভোগ ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সুবাস পাওয়া যেত। কাটারির বদলে চাষ হয় এখন ফিলিপাইন কাটারি। আরো কিছু জাতের ধানের চাল কে মেশিনের ছেটে কাটারি বলে চালানো হয়।কোন কোন অসাধু ব্যবসায়ী এই পলিশ করা চালে কৃত্রিম সুগন্ধি মিশিয়ে অধিক দামে বিক্রি করে থাকে।তাদের মধ্যে কাউকে আবার ভ্রাম্যমাণ আদালতে ধরা পড়ে জরিমানা দিতেও দেখা গেছে। চিনিগুড়া চাল বলে বাজারে আমরা যে চাল দেখি তা মূলত বৃ-৩৪ জাতের ধান থেকে উৎপাদিত হয়।বোরো এবং আমন মৌসুমে এখন একই জাতের অনেক ধান চাষ করা হয়, যার অধিকাংশই উচ্চ ফলনশীল বা হাইব্রিড ধান। আমন ধান কেটে খড়সহ মাঠে শুকিয়ে এনে মাড়াই করা হয়।আমন ধানের খড় গো খাদ্য হিসেবে এবং ঘরের চালা-ছাউনির কাজে ব্যবহৃত হয়। যদিও এখন খড়ের ছাউনি যুক্ত চালা তেমন একটা চোখে পড়ে না।
বাংলাদেশের কৃষিতে একরকম নীরব বিপ্লব ঘটেছে। ৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে খাদ্যাভাব ছিল বর্তমানে ১৬ কোটির অধিক জনসংখ্যার দেশে খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকে। চাল আমদানি করতে হয় না বললেই চলে । এই নিয়ে আমাদের গর্বও কম নয়।এই কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে কৃষকের এবং সরকারের কৃষি বিভাগের।একজন কৃষক হরিপদ কাপালি একটি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন যার নাম হরি ধান। আর সম্প্রতি বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী এমন একটি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন যেটি একবার রোপনে পাঁচবার ধান ফলবে।এই নিরীক্ষা সফল হলে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে ধনধান্যে ভরা হবে। বছরজুড়ে ভিন্ন ভিন্ন মৌসুমে পাঁচবার ফলন দেওয়া এই ধানের নাম রাখা হয়েছে পঞ্চব্রীহি।পঞ্চ অর্থ পাঁচ ব্রীহি অর্থ ধান।বহুব্রীহি বলতে আমরা সাধারণত ব্যাকরণের একটি সমাসের নাম বুঝি।আর হুমায়ূন আহমেদের একটি জনপ্রিয় নাটকের নাম ‘বহুব্রীহি। বহুব্রীহি শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘বহু ধান আছে যার’।