Published : 11 Jan 2014, 11:34 PM
দেশে-বিদেশে প্রবল সমালোচনা, অসন্তোষ, আস্থাহীনতা, বৈরিতা আর নজিরবিহীন অশান্তির মধ্য দিয়েই শেখ হাসিনার সরকার তৃতীয় মেয়াদে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছে। কাগজে-কলমে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় থাকার 'ম্যান্ডেট' অর্জন করলেও এই ম্যান্ডেট নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরাই সন্তুষ্ট হতে পারছেন না।
এই নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা বিএনপিসহ প্রতিদ্বন্দ্বী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি ভোটদানের সুযোগবঞ্চিত সাধারণ ভোটারদেরও প্রতিপক্ষ বানিয়েছেন। অনেকেই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এমন একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়াটা আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন যে কোনো ব্যক্তি বা দলের জন্যই অস্বস্তির।
এদিকে ক্রমাগত হরতাল-অবরোধ-সহিংসতার মধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের খাঁড়া না কাটতেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছে হিন্দু নির্যাতন। এসব নির্যাতনের ঘটনা ঠেকাতে না পারার দায় বর্তমান সরকারকেই নিতে হচ্ছে। কেননা নির্বাচনকালীন সরকারে তারাই ছিল।
নির্বাচনের পর হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন-লুটপাট, হামলা-নির্যাতন-ধর্ষণ আমাদের দেশে এখন 'প্রথায়' পরিণত হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। হিন্দু পরিবারগুলোতে হামলা-নির্যাতনের কোনো কোনো ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের লোকজন জড়িত রয়েছে– এমন অভিযোগ জোরে-শোরে উঠেছে।
এ ব্যাপারে সরকারকে দলনিরপেক্ষ কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। হামলাকারী যেই হোক, তারা যেন শাস্তি পায়-তা নিশ্চিত করতে হবে। আক্রান্ত মানুষ কে হামলাকারী, সেটা বড় বেশি জানতে চায় না। তারা চায়, হামলাকারী অপরাধীদের যেন বিচার হয়, তারা যেন শাস্তি পায়।
বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় যেভাবে ছাত্রলীগের লোকেরাও রেহাই পায়নি, দোষী সকলকেই বিচারের আওতায় আনা হয়েছে, হিন্দু-নির্যাতনের ঘটনাগুলোতেও তেমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হলেই কেবল সরকার এ ব্যাপারে সব রকম দায় থেকে রেহাই পেতে পারে।
বর্তমান সরকারকে সীমাহীন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই টিকে থাকতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার কতটা কঠোর ও লাগসই কৌশল গ্রহণ করতে পারে, তার উপরই নির্ভর করছে একই সঙ্গে সরকার ও দেশের ভাগ্য।
স্বভাবতই গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে নতুন সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন তাদের অনাস্থা ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারকে আগাগোড়া সমর্থন দিয়ে আসা ভারতও স্বস্তিতে নেই। পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ এবং সংগঠনের পক্ষ থেকে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য চাপ আসা শুরু হয়ে গেছে। সরকারকে অগণতান্ত্রিক অ্যাখ্যা দিয়ে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি হতে পারে–এমন একটা কথাও বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
এখন সরকারকে টিকে থাকতে হলে এই প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ প্রতিহত করার জন্য মিত্র খুঁজতে হবে। যা ঘটেছে, যেভাবে ঘটেছে, তার অনিবার্যতা অন্যদের কাছে তুলে ধরতে হবে। আপাতত ভারতকে ছাড়া তেমন কোনো মিত্র সরকারের আছে বলে মনে হচ্ছে না।
নানা মহল থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ভারত শেখ হাসিনা সরকারের পাশেই থাকছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হওয়ার আগে থেকেই আমেরিকার সঙ্গে ধারাবাহিক তৎপরতা চালিয়ে এসেছে ভারত। যদিও জামায়াতে ইসলামী প্রশ্নে তাদের মধ্যে বিভেদ এখনও দূর হয়নি। আমেরিকা এই দলটিকে মূলস্রোতে প্রতিষ্ঠার পক্ষেই সওয়াল চালিয়ে গেছে এবং এখনও যাচ্ছে। আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিএনপি-ঘেঁষা অবস্থান এখনও অব্যাহত রেখেছে।
অবশ্য ভারত তাদের নিজস্ব হিসেব থেকেই শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন করছে। 'আনন্দবাজার' পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, যাবতীয় জঙ্গি কার্যকলাপের মাথা কট্টর মৌলবাদী এই জামাতকে সমাজের সর্বস্তরে ডালপালা ছড়ানোর সুযোগ দিলে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ধ্বংস হবে। এ ক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা বড়সড় প্রশ্নের মুখে পড়বে।
এমনিতেই এ বছর আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, সেই আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে রয়েছে গোটা অঞ্চল। তার উপর বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্র ইসলামিক উগ্রপন্থার হাতে চলে গেলে পরিস্থিতি যে ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে এটাই পশ্চিমা বিশ্বকে বোঝাতে চাইছে ভারত (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ জানুয়ারি ২০১৪)।
ভারতের আরেকটি আশঙ্কার দিক হচ্ছে, বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় এলে শুধু হিন্দুই নয়, এ দেশ থেকে ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ঢল নামবে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের দিকে। ফলে বাংলাদেশের নতুন এই সরকারকে আপাতত স্থিতিশীল রাখতে ভারতের কূটনৈতিক সমর্থন হাসিনা সরকার পাবে বলেই ধরে নেওয়া যায়।
এই মুহূর্তে 'কমনওয়েলথ মিনিস্টারিয়াল অ্যাকশন গ্রুপ'-এর সদস্য ভারত। বর্তমান নির্বাচনকে অগণতান্ত্রিক অ্যাখ্যা দিয়ে কমনওয়েলথভুক্ত কোনো দেশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর্থিক বা অন্য কোনো নিষেধাজ্ঞা জারির চেষ্টা করলে নিঃসন্দেহে ভারত হস্তক্ষেপ করবে। কারণ গত পাঁচ বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যে যথেষ্ট এগিয়েছে– এ কথা বিভিন্ন সময়ে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছে ভারতের পররাষ্ট্র দফতর।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মাটিতে ভারতবিরোধী জঙ্গি অবকাঠামো ধ্বংস করা– সবকিছুতেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে হাসিনা সরকার। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং প্রতিশ্রুতি দিলেও ঘরোয়া ঐকমত্যের অভাবে তিস্তা চুক্তি অথবা স্থলসীমান্ত চুক্তি ভারত সম্পন্ন করতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু নানাভাবে শেখ হাসিনার পাশে থেকেছে। সেই অবস্থান হাসিনা সরকারের পরের মেয়াদের জন্যও বহাল রাখতে চাইবে ভারত।
যদিও এ ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা রয়েছে। সামনে ভারতের জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে অবসর নেবেন বলে ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। ভারতের সব দলই এখন ব্যস্ত নির্বাচনী রণকৌশল নিয়ে। ফলে ভবিষ্যতে হাসিনা সরকারের পক্ষে ভারতের অব্যাহত সমর্থন পাওয়াটা অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে।
তবে সবকিছু ছকমতো ঘটবে–এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কার্যকর কূটনীতি অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারে। মনে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশকে ঘিরে আন্তর্জাতিক রশি-টানাটানি অনেকদিন ধরেই চলছে। এটা বংলাদেশের স্বার্থে যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি সেই সব দেশের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে।
তাদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে। বাংলাদেশকে ঘিরে বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বৃদ্ধির জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ঘোর প্রতিযোগিতা চলছে।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির সংকটের মুখে মার্কিন অর্থনীতির নেতৃত্ব ও আধিপত্য আজ নিম্নগামী ও চ্যালেঞ্জের মুখে। অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষকেদর মতে, ২০৪০ সাল নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতিতে ইউরোপ ও আমেরিকাকে পেছনে ফেলে BRICS অর্থাৎ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা এগিয়ে যাবে। তার সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ উন্নয়নের সিঁড়িতে এগোতে থাকবে। বিশ্বে অর্থনৈতিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী বলে অনেকেই মনে করছেন।
এটা স্পষ্ট যে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিনীদের মূল কৌশল চীনকে ঘিরে ফেলা। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশকে নিয়ে চীনের পূর্বদিকে আমেরিকার অবস্থান বেশ শক্ত। আফগানিস্তান, পাকিস্তান নিয়ে চীনের পশ্চিমে মার্কিন ঘাঁটি শক্ত করতে আমেরিকা সচেষ্ট। চীনের দক্ষিনে বেষ্টনী গড়তে ভারত, মায়ানমার, বাংলাদেশকে সঙ্গে নেওয়াটা আমেরিকার জন্য খুবই প্রয়োজন। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে রণনৈতিক ও পারমাণবিক চুক্তি রয়েছে।
তবে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের রয়েছে নিজস্ব স্বার্থ। এই স্বার্থের সঙ্গে আমেরিকার স্বার্থের সমন্বয় করাটা কঠিন হতে পারে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ অভিলাষী, 'বিগ পাওয়ার শাইনিং ইন্ডিয়া' এ অঞ্চলে তার আধিপত্য এত সহজে ছাড়তে চাইবে না–এটাই স্বাভাবিক।
এইসব বহুমুখী টানাপড়েনের মধ্যে 'বাংলাদেশের স্বার্থে' কূটনীতি জোরদার করা এবং সেই কূটনীতিতে জয়ী হওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়।
কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তো বটেই, অন্য অনেক ক্ষেত্রেই সরকারকে এখন অনেক বেশি ইতিবাচক, সাবধানী এবং কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। চোরাগোপ্তা বোমা হামলা বন্ধ করে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার হতে হবে। পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা, রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মূল্যস্ফীতি কমানোর মত জনপ্রিয় কর্মসূচি গ্রহণের পাশাপাশি, নিজ দলের নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম-সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর হতে হবে।
অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করতে হবে।দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান উদ্যোগ থাকতে হবে। সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। সামনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করার ইস্যু আছে। আছে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার প্রবল দাবি। এ সব ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে না পারলে যে কোনো মুহূর্তে সরকারের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
তবে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা। বিরোধী দলের লাগাতার সহিংস হরতাল-অবরোধে দেশের স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। মানুষের জীবন-জীবিকা, চলাচল সব কিছুই থমকে আছে।
এ অবস্থায় হরতাল-অবরোধ অগ্রাহ্য করে দেশে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনাটাই সরকারের প্রধান কর্তব্য। এ কর্তব্য পালনে সরকার কঠোর শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিচ্ছে বটে, কিন্তু এভাবে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে–এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রায় এক বছর ধরে মাঠে থাকা ক্লান্ত-শ্রান্ত পুলিশ দিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া 'গেরিলা বোমাবাজ'দের শায়েস্তা করা যাবে কি-না তা ভেবে দেখতে হবে।
এ জন্য প্রশাসনিক করণীয় নির্ধারণের পাশাপাশি অবশ্যই বৈরিতা ঘুচিয়ে যে কোনো মূল্যে বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারি দলের সদ্ভাব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সর্বোচ্চা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে সরকারকে বর্তমান অচলাবস্থা নিরসনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে।
একতরফা এবং অনেক ক্ষেত্রে ভোটারবিহীন নির্বাচন করে সরকারি দল অতি অবশ্যই খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে গণতন্ত্রের নীতি অনুযায়ী অন্য একটি প্রশ্নও এ ক্ষেত্রে উঠে বৈকি।
ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বিরোধী দলেরও কিছু ন্যূনতম দায়দায়িত্ব থাকবার কথা। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের কাজ। কিন্তু সরকারবিরোধিতার নামে নিরীহ মানুষের ওপর পেট্রোল বোমা হামলা কোনো সভ্য রাজনৈতিক দলের কাজ হতে পারে না। ক্রমাগত অনুরোধ-উপরোধ সত্ত্বেও রাজনৈতিক জেদবশত ভোট বয়কট করে ভোটের প্রেক্ষিত রক্তাক্ত হিংসাদীর্ণ করে তুলবার অধিকারও গণতন্ত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।
ক্ষমতাপ্রাপ্ত সরকারের বৈধতার প্রশ্নটি যেমন জরুরি, সরকার প্রতিষ্ঠা তথা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি স্পষ্টত অসহযোগ দেখাবার জন্য বিএনপি-জামাতের গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নটিও সমধিক জরুরি। শেখ হাসিনারও যেমন সরকার-চালনার জন্য আরও 'বৈধ জনভিত্তি' দরকার– বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ারও উচিত প্রয়োজনীয় শর্তসাপেক্ষে নির্বাচনের মতো গুরুতর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করা। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সরকারপক্ষ ও বিরোধীপক্ষের এই পরস্পর-সংযুক্ত 'দায়'-এর প্রতিফলন থাকা আবশ্যক।
বলাবাহুল্য, এ ক্ষেত্রে দুপক্ষই ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা মোচন করে আগামী দিনে সুন্দর গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার শপথ উভয় পক্ষকেই নিতে হবে। যা হয়েছে, তা-'এনাফ ইজ এনাফ'। রাজনীতিতে একগুঁয়েমি আর জেদ কখনও কাউকে ভালো কিছু দিতে পারে না।
বিরোধী দলকে ঠ্যাঙানো যেমন সরকারের একমাত্র দায়িত্ব নয়, সরকারকে বিপাকে ফেলাও বিরোধী দলের একমাত্র কাজ নয়। সরকারের অযৌক্তিক কাজের সমালোচনা হতে পারে, সেটা করাও উচিত। সরকার যেভাবে বিরোধী দলের উপর শক্তি প্রয়োগ করছে, নেতানেত্রীদের জেলে ঢোকাচ্ছে–এসব বিষয় নিয়ে সরকারের সমালোচনা যুক্তিযুক্ত।
কিন্তু যে কাজের দায় সরকারের নয় সে কাজের জন্য সরকারের সমালোচনা গ্রহণযোগ্য নয়। এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কেন্দ্র করে সারাদেশে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের শরীক দল জামায়াত-শিবির তাণ্ডব চালিয়েছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর একাত্তরের স্টাইলে হামলা-নির্যাতন চালিয়েছে।
অথচ বিএনপির নেতানেত্রীরা এর দায় সরকারের ওপর চাপিয়ে কেবল সত্যের অপলাপই করেননি, জঙ্গি-সন্ত্রাসী জামাত-শিবিরের ঘৃণ্য কাজে নৈতিক সমর্থনও জুগিয়েছেন। বিএনপির নেতানেত্রীদের এমন ভূমিকা দেশের এ সংকটময় মুহূর্তের প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে। চলমান সংকট থেকে দেশের যদি উত্তরণ না ঘটে তবে এর দায়-দায়িত্ব বিরোধী দলকেও বহন করতে হবে। শুধু সরকারের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে পার পাওয়া যাবে না।
চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।