Published : 17 Oct 2013, 09:41 PM
বাংলাদেশের প্রধান দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসবগুলো হয়ে গেল কদিনের ব্যবধানে। উৎসব আর আনন্দের আমেজে এখনও বেশ উচ্ছ্বল গোটা দেশ। যদিও দৈনন্দিন বিভিন্ন মাত্রার সমস্যা আর বিভিন্ন রকমের জটিলতায় এ সব আনন্দ খুব ক্ষণস্থায়ী। উৎসব এলেই মানুষ স্বজনদের কাছে ফিরতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন, এটাই এদেশের রেওয়াজ।
এক শহর থেকে অন্য শহরে, এক নগর থেকে অন্য নগরে, এক গ্রাম থেকে অন্য জনপদে নানা ধরনের যানবাহনে চেপে চলাচল করেন বিপুল সংখ্যক মানুষ। একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে, প্রতি ঘণ্টায় ঈদ-পুজোর আনন্দ ম্লান করে দিচ্ছে অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনা। টেলিভিশনে দেশি চ্যানেলগুলো খুলুন। ক্লিক করুন অনলাইন দৈনিকগুলোতে। দেখবেন শুধুই বাড়ছে লাশ।
যার যায়, তিনিই বুঝেন। অন্য কেউ নন। কারণ আমাদের জাতির মেরুদণ্ডে যে ঘুণপোকা। 'মোরা যাত্রী একই তরণীর', আমরা তা আর ভাবি না। তা না হলে সংকীর্ণ রাজনীতির কারণে আমরা কেন এখনও পর্যন্ত নিরাপদ সড়কের দাবির একটিও বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, সে স্পিরিটের একদম প্রতিকূলে কাজ করছি!
সেই দিনগুলি সেই রাতগুলি
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জের মূলজান এলাকায় ১৪ অক্টোবর আমার গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফেরার পথে একটি দূরপাল্লার কোচে (লালন পরিবহণ, যশোর) দুর্ঘটনায় পড়েন আমার স্ত্রী ও পুত্র। মূলজানের বাঁকের একটি প্রকাণ্ড গাছে লেগে কোচ গাড়িটি দাঁড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী জলভরা খালে ঝাঁপ না দিয়ে। শরীরে চোট পেয়েছেন সামান্যই, তবে আমার শিশুপুত্র ও স্ত্রীর মনে বিষয়টি দাগ রেখে গেছে। কারণ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছিলেন সে দুর্ঘটনায়। চোখের সামনে সেসব দেখেছেন তারা।
মানিকগঞ্জের ঘিওর থানার জোকায় আমার গ্রামের বাড়ি। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ধারে। আমার জ্যেঠামশাইয়ের দীর্ঘ আয়তাকার বাড়ির প্রবেশমুখ-সংলগ্ন জায়গাতেই ২০১১ সালের আগস্টের এক দিনে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে মাইক্রোবাসে করে ঢাকার ফিরতে গিয়ে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর দুর্ঘটনায় নিহত হন। সংঘর্ষের সময় প্রচণ্ড শব্দ হলেও প্রবীণ জ্যেঠতুতো দাদা আর তার প্রতিবেশিরা বৃষ্টির কারণে তা শুনতে পাননি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঘটনার অনেক পরে দুর্ঘটনার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছেন। সে বর্ণনাও আমি শুনেছি।
আমাদের ছোটবেলায় দেশে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মতো এত চওড়া পিচঢালা সড়ক ছিল খুব কম। তখন যমুনা সেতুও হয়নি। টাঙ্গাইলের ওপর দিয়ে উত্তরবঙ্গের গাড়ি যেত না। তাই ওই বঙ্গের সব গাড়ি ঢাকা-আরিচা সড়ক ধরেই চলত। আরিচা-নগরবাড়ি ফেরি পার হতে হত এসব গাড়িকে। ওদিকে যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, নড়াইল, ফরিদপুর, ঝিনেদা, চুয়াডাঙ্গার গাড়িও মাওয়া দিয়ে যেত না, যেত আরিচা দিয়েই।
ঢাকা-আরিচা সড়কের বিশেষ করে আমাদের গ্রামের অংশটি ছিল ভীষণ রকমের দুর্ঘটনাপ্রবণ। তিনটি মারাত্মক বাঁক ছিল সেখানে। তাই বিশেষ দ্রুতগামী দূরপাল্লার বাসগুলো প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ত। গত তিন দশকে আমাদের গ্রামেরই কমপক্ষে ১৫ জন মানুষ ঢাকা-আরিচা সড়কের আমাদের জোকা বা আশেপাশের অংশে নিহত হয়েছেন। এ সড়ক ধরেই আমরা পার্শ্ববর্তী বানিয়াজুরী গ্রামের একটি বিদ্যালয়ে পড়তে যেতাম।
মানুষের জীবন কি এত সস্তা, ধুলোবালির মতো! বাড়ির কাছে বা স্কুলে যাবার পথে ঘটে যাওয়া নানা দুর্ঘটনা দেখে, আহতদের আর্তনাদ আর বীভৎস সব মৃত্যু দেখে স্কুলগামী আমি রাতের পর রাত ঘুমাতে পারতাম না। মাঝে মাঝে চোখের সামনে নারকীয় ওইসব ঘটনা ভেসে উঠলে খাবার খেতে গেলে বমি করে ফেলতাম।
তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীর নিহত হওয়ার পর আমাদের গ্রামটি বহুবার গণমাধ্যমে আলোচনায় এসেছে। গ্রামের সামনের দিকে অর্থাৎ সবচাইতে পূবে খেলার মাঠ। খেলার মাঠটির একহাতে ছিল ঢাকা-আরিচা সড়ক। অন্যদিকে দিগন্ত-বিস্তৃত ধানক্ষেত। এক বিকেলে ফুটবল খেলছিলাম। খেলার মাঠ-সংলগ্ন একটি বাঁকে ঢাকাগামী একটি দূরপাল্লার বিলাসবহুল কোচের সঙ্গে একটি ট্রাকের সংর্ঘষ হয়। প্রচণ্ড শব্দ। পরক্ষণেই অসহায় যাত্রীদের আর্তনাদ, চিৎকার।
এগিয়ে গেলাম। বাসটি ভাগ্যচক্রে পার্শ্ববর্তী খাদে অথবা আমাদের খেলার মাঠে গড়িয়ে আসেনি, সড়কের মাঝখানেই থেমে রয়েছে। ট্রাকটিও রয়েছে। ট্রাকের চালক পালিয়ে গেল সহজেই। আর আহত বাসের চালক অন্য কোচে উঠে পালিয়ে গেল আমাদেরই চোখের সামনে।
আহত-নিহতের হিসাব তখন জানি না। দেখছি গাড়ির সিটে, জানালার কাঁচে রক্ত। গোঙানি, হৈচৈ। হঠাৎ করেই একটি অভূতপূর্ব বীভৎস দৃশ্য চোখে পড়ল। টলতে টলতে হেঁটে আসছেন একজন আহত যাত্রী। তার থুতনি থেকে গলার নিচ পর্যন্ত শরীরের পাতলা চামড়া ছিলে ঝুলছে পাতলা পর্দার মতো। অসহায় তিনি, সাহায্য চাচ্ছেন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার যে সে কী আকুতি!
সে স্মৃতি আজও মনে পড়ে। এখনও গ্রামের বাড়ি গিয়ে কখনও গভীর রাতে, আবার কখনও ভোরের দিকে ওই মহাসড়ক থেকে ভেসে আসে ভীষণ জোরে গাড়ির চাকা ফেটে যাওয়ার শব্দ। কিম্বা গাড়ির সঙ্গে গাড়ির সংর্ঘষের শব্দ। শিউরে উঠি আতঙ্কে। আবার কি কোনো দুর্ঘটনা! লাশের মিছিল!
দুর্ঘটনা নিয়ে আপাত কঠিন কিছু কথা অবতারণা করার আগে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করলাম দুর্ঘটনার বীভৎসতা বোঝাতে। এগুলো প্রত্যক্ষদর্শীদের মনেও গভীর ছাপ রেখে যেতে পারে।
পরিসংখ্যানে মৃত্যুর মিছিল
বাংলাদেশে দুর্ঘটনার ফলে প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেন। গাড়িচালকের অবহেলা, অদক্ষতা, ফিটনেস ছাড়া গাড়ির কারণে কত শত পরিবার রাস্তায় বসেছে তার হিসেব নেই। নিজের ব্যবহার্য গাড়িচালকদের অদক্ষতাও কত মানুষকে পৃথিবী থেকে কেড়ে নিয়ে গেছে।
তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীর শুধু নন, আরও অনেক বিশিষ্টজনকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি অকালেই। সিলেটের সড়কে সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশকিছু সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের দুর্ঘটনায় হারিয়ে ফেলে তাদের পরিবার।
রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের শিশু শিক্ষার্থীদের গাড়িচাপায় মৃত্যু গণমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত হলে আমাদের আবেগের জায়গায় প্রচণ্ড নাড়া দেয়। মাঝে মাঝে স্কুলপড়ুযা শিশুদের মায়ের মৃত্যু আমাদের কষ্ট বাড়িয়ে দেয়। ঈদের কদিন আগে কমলাপুরের কাছে মাত্র কদিনের ব্যবধানে দুজন মা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। দুজনের মৃত্যুই ঘটেছে সন্তানদের চোখের সামনে।
শিশু অবস্থায় মাকে হারানোর গভীর বেদনা সয়ে এরা কীভাবে বড় হবে সে প্রশ্ন তো থাকছেই, চোখের সামনে মায়ের মৃত্যু দেখার ট্রমা তারা কীভাবে কাটিয়ে উঠবে কে জানে। আমরা কি এসব নিয়ে ভাবি? একটি জাতির ওপর এসব ক্ষতির প্রভাব কতটা সে বিচার করা কি খুব জরুরি নয়?
মনে হয় ভাবি না। কারণ আমরা দুর্ঘটনার কদিন পরই সব ভুলে যাই। কারণ একটি ঘটনার পর নতুন আরেকটি দুর্ঘটনা আমাদের আলোচনায় চজলে আসে, আড়ালে পড়ে যায় পুরনোটি।
এভাবেই আমরা দেখেছি চট্টগ্রামের মিরেরসরাইয়ে গাড়ি উল্টে স্কুলছাত্রদের করুণ মৃত্যু। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে থাইল্যান্ডের কাউন্সিলরের গাড়িচাপায় মৃত্যুও আমাদের আর মনে থাকে না। রাজধানীর রাজপথে সাংবাদিক দীনেশ দাস, বিভাস সাহার করুণ মৃত্যুর তারিখ এখন কে মনে রাখবে তাদের পরিবার ছাড়া। লাশের মিছিল যে অনেক বড়!
ইদানিং একটি জিনিস দেখা যায়। গাড়িচালনার সময় আকছার মোবাইল ফোনে কথা বলেন চালকরা। আবার ফোনালাপ বন্ধের জন্য যাত্রীদের শত অনুরোধও পাত্তা দেন না তারা। অথচ এই অপকর্মের জন্য কত শত দুর্ঘটনা জন্ম নিয়েছে তার হিসেব মেলে না। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা যাবে না বলে পুলিশের সাবধানি বিজ্ঞপ্তিও আছে। কিন্তু চালকদের ফোনালাপ বন্ধ করা যায়নি।
দেশের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব এ ঈদুল আজহায় বাড়ি যাওযা এবং বাড়ি থেকে ফেরা কয়েক কোটি লোকের অতিরিক্ত চাপ পড়ছে দেশের বিভিন্ন মহাসড়কসহ ছোট ছোট সড়কে। তার ফলাফল দেখে নিই।
১৫ অক্টোবর, ২০১৩ মঙ্গলবার সিলেট শহর থেকে ২৫ মাইল দূরে গোয়াইনঘাটে ঢাকাগামী বাসের সঙ্গে সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংঘর্ষে ৫ জন মারা গেছেন। পরদিন ১৬ অক্টোবর, ২০১৩ বুধবার ছিল ঈদের দিন। এদিন দিবাগত রাতে ঈশ্বরদী-নাটোর সড়কের মুলাডুলি এলাকায় দুটি মোটর সাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে মারা যান দুজন। এ রাতেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শান্তিনগর এলাকায় বাসচাপায় মারা গেছেন একজন।
ঈদের দিনেই চট্টগ্রাম বাঁশখালীর চেচুরিয়া গ্রাম থেকে মমিন রোডের একটি কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে নিহত হয়েছেন বাঁশখালীর শিক্ষানবীশ আইনজীবী ও গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় সদস্য পূজন ভট্টাচার্য, আহত হয়েছেন ১২ জন। তাদের বরযাত্রার বাসটি পুকুরিয়ায় একটি পুকুরে পড়ে যায়।
১৭ অক্টোবর, ২০১৩ বৃহষ্পতিবারের খবর। এদিন ভোরে রাজধানীর বারিধারার নর্দা এলাকায় বাসচাপায় বিষতি রক্ষক নামের একজন আদিবাসী নারী নিহত হয়েছেন। সকালেই কুমিল্লার লাঙ্গলকোটে ট্রেনের ধাক্কায় পিকআপ বিধ্বস্ত হয়ে মারা যান পিকআপ চালক ফেনীর পাটগাতি এলাকার মমিন মিয়া।
এ দুর্ঘনাগুলো গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরেও রয়েছে অনেক দুর্ঘটনা যার খবর আমরা পাইনি।
২০১১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরের মৃত্যু সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় তোলে। নিষ্ঠুর পাশবিক ওই ঘটনায় চালকের অবহেলায় মৃত্যু নিয়ে প্রচলিত আইন পরিবর্তনেরও আন্দোলন হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ১২ হাজার প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। বিপুল সম্ভাবনাময় দেশের বিভিন্ন বর্গের বিভিন্ন পেশার গুরুত্বপূর্ণ মানুষ যারা দেশের সম্পদ হিসেবে দেশকে সেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন তাদের মৃত্যুর পরও সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে আইন এবং গাড়ি চলাচলের আইন পরিবর্তন হয় না। এর প্রায় সবই অসৎ দুর্বৃত্ত চালকদের পক্ষেই রয়ে যায়।
কর্তাব্যক্তিরা যা করেন যা ভাবেন
সেলুকাস কী বিচিত্র এ দেশ! প্রায় মাসখানেক আগে, ১৮ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিনা বললেন, ''দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় চেষ্টা করা হবে যেন হত্যামামলা না হয়। তদন্ত ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় কোনো মামলা ৩০২ ধারায় নেওয়া হবে না। তদন্তে যদি প্রমাণ মেলে যে চালক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটিয়েছেন তবে ৩০২ ধারায় মামলা নেওয়া যাবে। ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা না হলে মামলাটি ৩০৪ ধারায় হবে।''
৩০২ ধারায় মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে মন্ত্রী আরও বললেন, "সড়ক দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩০২ ধারায় ৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৫টি মামলার প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। একটি মামলা আদলতে প্রেরণ করার পর আদালত থেকে বলা হয়েছে, মামলাটি ৩০৪ ধারায় হবে।''
এখন দেখা যাক আমাদের প্রচলিত দণ্ডবিধি অনুযায়ী ৩০২ ধারা আর ৩০৪ ধারায় কভিাবে শাস্তির বিধান আছে। ৩০২ ধারার মামলায় দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে। অন্যদিকে, ৩০৪ (খ) ধারা অনুযায়ী, কারও বেপরোয়া বা অবহেলার গাড়িচালনায় অনিচ্ছাকৃতভাবে অন্য কারও মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে দায়ী ব্যক্তির সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা কিংবা উভয় সাজা হতে পারে।
তার মানে কি মন্ত্রী খুনী চালকদের বাঁচাতে এসব পদক্ষেপ নিলেন!
চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন প্রসঙ্গেও মতবিনিময় সভায় কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, পুনরায় পরীক্ষা না নিয়ে শুধুমাত্র চালকের শারীরিক সুস্থতা ঠিক আছে কি না সেটা দেখেই চালকের নিবন্ধন (ড্রাইভিং লাইসেন্স) নবায়ন করা হবে। মোটরযান আইন অনুযায়ী পাঁচ বছর পর ড্রাইভিং লাইসেন্স অর্থাৎ গাড়িচালনার নিবন্ধনপত্র নবায়নে চালকদের পুনরায় পরীক্ষা দিতে হয়। অথচ শ্রমিক নেতাদের আবদারে ওইদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানালেন, এখন থেকে শুধু চোখ পরীক্ষা করেই লাইসেন্স নবায়ন করা হবে!
ইতোমধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় যেসব মামলা ৩০২ ধারায় নেওয়া হয়েছে বৈঠকে তা প্রত্যাহারেরও সিদ্ধান্ত হয়। ওই সব সিদ্ধান্তের পর শ্রমিকনেতারা ২৩ সেপ্টেম্বর আহূত দেশব্যাপী পরিবহণ ধর্মঘট সাময়িকভাবে স্থগিত করেন।
সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, ৩০২ ধারায় দায়ের করা পাঁচটি হত্যা মামলা ৩০৪(খ) ধারায় রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। অথচ সে মামলাগুলোতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়ে গেছে। মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধের জন্য দায়ীদের মামলাগুলো তিন বছরের কারাদণ্ডযোগ্য মামলায় রূপান্তর কীসের আলামত!
কারণ কি এটাই যে, এসব আসামিরা সকলেই প্রায় নৌ মন্ত্রীর স্নেহধন্য এবং তার খাতিরের পরিবহন পাণ্ডা। এদের মধ্যে কেউ চালক, কেউ হেলপার; তবে মূলত সবাই পরিবহণ-ট্যান্ডল।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় মামলা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করার সুযোগ রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, যদি মামলাটি হয় হয়রানিমূলক। প্রত্যাহারের আবেদনটি করতে হয় আদালতে। আদালত শুনানি নিয়ে যৌক্তিক কারণ থাকলে তা প্রত্যাহারের অনুমতি দিতে পারেন।
তার আগে কিন্তু চূড়ান্ত কথা বলা যাবে না। সরকার মানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চাইলেই নিজ থেকে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। শুধুমাত্র প্রস্তাব করতে পারবে। জানা গেছে, এ সব মামলার মধ্যে ট্রাক থেকে ফেলে দিয়ে পুলিশ সার্জেন্ট হত্যা, বাস থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে যাত্রীহত্যার মতো মামলাও রয়েছে।
২০১১ সালে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যুর পর চালকদের প্রশিক্ষণ এবং ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিষয়টি দেশজুড়ে আলোচনায় উঠে আসে। কিন্তু তাতে কী! বেহায়া ও নির্লজ্জ স্তাবকতা শুরু হয় নরঘাতক চালকদের পক্ষে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মতো জায়গায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পক্ষের ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রতিকৃতিতে মন্ত্রীর উস্কানিতে পরিবহণ শ্রমিকরা জুতোর মালা চড়ায়।
যত আইন ব্রিটিশ প্রভুদের রক্ষার জন্য
আমাদের দেশে গাড়ি দুর্ঘটনার হার বিশ্বের সর্বোচ্চ। যেখানে প্রতি ১০ হাজার গাড়িতে মৃত্যুহার সিঙ্গাপুরে ৮ দশমিক ৩, নিউজিল্যান্ডে ৪ ও অস্ট্রেলিয়ায় ৩ দশমিক ৪– সেখানে ইউনিসেফের তথ্যমতে– বাংলাদেশে এ হার ১৬৯ জন।
অথচ এদেশে চালু আছে ইংরেজদের প্রণীত সেই পুরনো, বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন আইন। এখনও বেতাল পঞ্চবিংশতির ভূতের মতো আমাদের কাঁধে চেপে বসে আছে আইনগুলো। ১৮৬০ সালে লর্ড মেকলে দণ্ডবিধি বা পেনাল কোডের মাধ্যমে অধিকাংশ অপরাধ ও তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে বেশিরভাগ অপরাধের ক্ষেত্রে ভারতীয় সংস্কৃতির বিবেচনা থাকলেও, বাবুদের গাড়ি চালানোর ফলে পথ-দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কারও মৃত্যু হলে বা বেপরোয়া চালনার ফলে কারও ক্ষতি বা জখম হলে তার জন্য লঘুদণ্ডের বিধান করা হয়েছিল।
কারণ সে সময় যাদের গাড়ি ছিল এবং যারা গাড়িচালনা করতেন তারা সবাই না হলেও, তাদের ৯০ শতাংশই ছিলেন ইংরেজ বেনিয়া বা তাদের অনুগত। ফলে শ্রেণিগত স্বার্থে ইংরেজরা দণ্ডবিধিতে পথ-দুর্ঘটনার শাস্তি নামমাত্র করেছিল।
দণ্ডবিধি বা পেনাল কোডের ৩০৪-খ ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি বেপরোয়াভাবে বা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জনপথে যান বা অশ্ব চালিয়ে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটান, সেই ব্যক্তি যে কোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে, যার মেয়াদ তিন বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
দণ্ডবিধির ২৭৯ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি জনপথে এমন বেপরোয়াভাবে বা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কোনো যান চালায় বা অশ্বারোহণ করে, যাতে মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে, অন্য কোনো ব্যক্তিকে আহত বা জখম করার আশঙ্কা থাকে, তিনি তিন বছর কারাদণ্ড বা এক থেকে তিন হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
৩৩৮-ক ধারায় বলা আছে, যে ব্যক্তি বেপরোয়াভাবে বা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে গণপথে গাড়ি বা অশ্ব চালিয়ে কোনো ব্যক্তিকে গুরুতর আঘাত করেন, যাতে মনুষ্যজীবন ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্ন হয়, সেই ব্যক্তি যে কোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে, যার মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
দণ্ডবিধির ২৮০ ধারায় বেপোরোয়া নৌ-চালনার শাস্তির কথা বলা রয়েছে। হত্যার মতো ঘটনা থাকার পরও এই সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কিত বিধি তিনটির কোথাও অধিক কারাবাস নেই; এমনকি যে কারাবাসের কথা বলা আছে তাও বিনাশ্রম!
উল্লিখিত তিনটি অপরাধই জামিনযোগ্য করে অপরাধীদের মুক্তির পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারণ সে যুগে বিচারক এবং অপরাধী উভয়েই ছিলেন প্রায় একই গোত্রভূক্ত প্রভুশ্রেণির। নিজেদের রক্ষার জন্য সেদিনের প্রণীত আইন আজকের যুগে অচল।
সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গণিকা-সন্তানদের প্রদত্ত এ ধরনের একদেশদর্শী, একপেশে অকার্যকর অহিতকর আইন সমাজে আজও বিদ্যমান। আমাদের এ ভূখণ্ডে দুর্ঘটনার আইনের প্রতি অবজ্ঞা তাই আসলে শুরু থেকেই ছিল। কারণ আইনগুলোর সুদ ও আসল কিছুই নেই। সাজার দিক থেকেও হালকা-পলকা এবং প্রকৃতির দিক থেকে জামিনযোগ্য। তাছাড়া ওই বিধি তিনটিতে কোনো সহযোগী অপরাধীর সাজারও ব্যবস্থা নেই।
এসব কারণে পথ-দুর্ঘটনা নিবৃত্তিতে বিদ্যমান এসব আইন অচলায়তনের প্রাচীন দুর্গে বন্দী। রবীন্দ্রনাথের তোতা কাহিনির মুখস্থ কাগুজে বিদ্যার বারংবার উচ্চারণ মাত্র।
২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় হত্যার শিকার হয়েছেন ৪ হাজার ৩৬৫ জন। আহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৪৫ জন, যাদের অনেকেই হয়েছেন পঙ্গু। আর্থিকভাবেও পর্যুদস্ত হয়েছেন পথ-দুর্ঘটনার শিকার প্রায় ১২ হাজার পরিবার।
এ সংখ্যাটি মোট পথ-দুর্ঘটনার অর্ধেকেরও কম। কারণ সব দুর্ঘটনা থানায় রেকর্ড হয় না। আর পরের বছরের ফিরিস্তি আরও দীর্ঘতর।
কারণ থেকে করণীয়
আমাদের দেশে দুর্ঘটনার ১৭টি কারণ দাঁড় করিয়েছে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট। তার মধ্যে প্রথম কারণটি হচ্ছে, অদক্ষ ও প্রশিক্ষণবিহীন চালক। আবার যে মালিক ফিটনেসবিহীন ভাঙাচোরা গাড়ি জোর করে রাস্তায় নামায়, সে কেন আইনের আওতায় আসবে না? আমাদের যানের মালিকদের আইনের আওতায় আনাটাও এখন জরুরি।
প্রচলিত আইনের সেকেলে দণ্ড বৃদ্ধি করে পথ-দুর্ঘটনায় হত্যার অপরাধকে জামিন ও আপস-অযোগ্য করা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হওয়া উচিত। যে জনপথে ভুয়া ড্রাইভার, অদক্ষ চালক কিংবা ফিটনেসবিহীন গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণহানি ঘটবে, সেসব রাস্তার দায়িত্বে থাকা হাইওয়ে বা বেঙ্গল পুলিশদের এবং ক্ষেত্রবিশেষে যারা ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলতে দিয়েছে তাদেরও সহযোগী অপরাধী হিসেবে আইনের আওতায় নিয়ে আসা দরকার।
সংশ্লিষ্ট যারা দায়িত্ব পালন করতে গাফিলাতি করেছে তাদের গাফিলাতির ফলে যদি কোনো যাত্রী বা পথচারীর ক্ষতি বা মৃত্যু হয়, তবে মালিকসহ তাদের আয় বা সম্পদ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের বিধান করতে হবে।
একই সঙ্গে প্রয়োজন পথ বা রাস্তার সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত বিশাল জনশক্তির মূল্যবোধগত পরিবর্তন, ড্রাইভিং পেশায় শিক্ষিতদের প্রবেশে উৎসাহিতকরণ, এনজিওগুলোর পথ-সার্ভিসের সঙ্গে যুক্তদের বিশেষত ড্রাইভার-কন্ডাক্টর-মালিকদের পেশাগত ও নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া; তাদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করা দরকার। এখানে রাষ্ট্রের আনুকূল্য জরুরি।
আমাদের পথ-দুর্ঘটনার বেশিরভাগ কারণ গাড়িচালকদের অসচেতনতা। যেহেতু বাস ও ট্রাকের ৯৯ শতাংশ চালকই প্রশিক্ষণবিহীন, সেহেতু তাদের প্রশিক্ষণ জরুরি। যে পাঁচ লাখ ভুয়া চালক আছে, তারা রাস্তায় চলমান, তাদের ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ করে যোগ্য করে নিতে হবে।
প্রণোদনাও দুর্ঘটনা বন্ধের আরেকটি উপায় হতে পারে। যে ড্রাইভাররা ২০ বা ৩০ বছরের পেশাগত জীবনে দুর্ঘটনামুক্ত থাকবেন, তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হলে দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। আসলে আমাদের এ মুহূর্তে দুর্ঘটনা সম্পর্কে সমাজে কিছু মূল্যবোধ গড়ে তোলা জরুরি। তাহলে একজন গাড়িচালক মনে করবেন যে অবশ্যই যাত্রীসেবার মধ্যে মালিকের মুনাফা বিদ্যমান থাকলেও, তার নিজের ও যাত্রীর জীবনের চেয়ে তা বড় হবে না।
আমাদের দেশে প্রচলিত যে মোটরযান আইন রয়েছে তাও ব্রিটিশ আমলের, ১৯৩৯ সালে তৈরি। এরপর গত ৭ দশকে দেশের মানুষের আয় বেড়েছে, বেড়েছে ব্যয়ও। কিন্তু এ আইনে বিভিন্ন ইস্যুতে চালক আর অন্য পরিবহণকর্মীদের জরিমানা বা শাস্তির বহর দেখলে আশ্চর্য হতে হয়।
চোখ চড়কগাছ হয়, দুনীর্তিগ্রস্ত বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) কর্মকাণ্ড দেখেও। নিবন্ধিত গাড়ির তালিকার সঙ্গে চালক নিবন্ধনের (লাইসেন্স) পরিসংখ্যানের মিল নেই। পয়সা দিলে এখানে দুনিয়া মিলে, শুধু 'দিল' মানে হৃদয় মিলে না!
ক্ষুদ্র রাজনৈতিক বা সংকীর্ণ স্বার্থে কতিপয় মানুষের অবৈধ কর্মে জলসিঞ্চন করা হলে উপেক্ষিত হন বিপুল জনগণ। যাদের হাতে রয়েছে চরম ও পরম ক্ষমতা, তার অন্তত কিয়দংশ জনকল্যাণে ব্যয় করলে কতশত প্রাণ রক্ষা পায়।
এ প্রেক্ষিতে সরকার ও রাষ্ট্রের কী করা উচিত বিষয়টি এখনই নির্ধারিত হওয়া জরুরি।