Published : 18 Sep 2013, 01:34 AM
১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাতে টেলিভিশন চ্যানেলের স্ক্রলে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে চলমান লেখাটা পড়লাম। পরদিন, অর্থাৎ ১৭ তারিখে কাদের মোল্লার আপিলের রায় প্রদান করা হবে। ভিতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করলাম রায় প্রদানের সময় উপস্থিত থাকার।
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ৫ সদস্যের আপিল বোর্ড রায়টি দেবেন। গত ফেব্রুয়ারি থেকে যে রায়টি প্রত্যাশানুযায়ী হবে বলে আমরা অপেক্ষা করছি। মনে নানা সংশয়। বিজ্ঞ আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে চেয়েছি কী হতে পারে আপিলের রায়ে। অধিকাংশের মত ছিল, ৫ ফেব্রুয়ারির রায়ই অপরিবর্তিত থাকবে। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেছেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বাড়িয়ে ফাঁসির রায় সাধারণত আপিলে হয় না।
তারপরও হৃদয়ের গভীরে প্রবল প্রত্যাশা– মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসি যেন হয়। সকাল সাড়ে সাতটায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা অভিমুখে রওনা হয়েছি। ন'টার মধ্যে পৌঁছাতে হবে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির এজলাসে। ড্রাইভার মমিনকে বার বার তাগাদা দিচ্ছি আরও দ্রুত গাড়ি চালাতে। পথের যানজট গতি শ্লথ করে দিচ্ছে।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান সমন্বয়ক জানিয়েছিলেন, ঠিক ন'টায় আপিল বোর্ড রায় দেবে। ন'টায় পৌঁছাতে পারিনি। অনেকটা দৌঁড়ে যখন দোতলায় সুপ্রিম কোর্টের এজলাসে প্রবেশ করতে পারলাম তখন ন'টা পনের বেজে গেছে। পিছনের দিকেই বসলাম। বিশাল আকারের এজলাস। কালো গাউনে আচ্ছাদিত আইনজীবীরা ঠাসাঠাসি করে বসেছেন। সাংবাদিকরাও আছেন।
মন আনন্দে ভরে উঠল এই দেখে যে একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধকালের স্পর্ধিত মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল হক মামা বসেছেন কাছেই। সে সময়ে মিরপুরের মামা বাহিনীর অধিনায়ক শহীদুল হক কালের সাক্ষী হয়ে আছেন। নরঘাতক কসাই কাদের মোল্লার নৃশংস হত্যাযজ্ঞের জীবন্ত সাক্ষী তিনি।
আমরা অপেক্ষা করছি। সাগ্রহ সবগুলো চোখজোড়া মহামান্য বিচারকদের আসনের পিছনের দরজার দিকে– কখন সেগুলো খুলে যাবে। একটু কাছে দু'জন বিদেশিনীকে দেখলাম। তাদের দৃষ্টিও সম্মুখপানে। ন'টা বেজে ছত্রিশ মিনিট। আমাদের অপেক্ষার পালা শেষ হল। দরজাগুলো খুলে গেল। মহামান্য প্রধান বিচারপতি আরও চারজন বিচারককে সঙ্গে নিয়ে আসন গ্রহণ করলেন।
পিনপতন নিরবতা চারদিকে। সরকারপক্ষ ও আসামীপক্ষের কয়েকজন আইনজীবী উঠে দাঁড়ালেন। মহামান্য প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কী কথা হল তা ঠিক বোঝা গেল না। কারণ মাইক্রোফোনের বাতি তখনও জ্বলেনি। দ্রুতই তাঁদের কথোপকথন শেষ হল। মহামান্য প্রধান বিচারপতি তাঁর সহযোগী বিচারপতিদের দিকে এক নজর তাকালেন, তারপর মাইক্রোফোনের বোতামে চাপ দিলেন। লালবাতি জ্বলে উঠার সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেললাম, আমরা পেতে যাচ্ছি একটি ঐতিহাসিক রায়।
ইংরেজিতে আপিলের যে রায়টি তিনি পড়ে শোনালেন তার জন্য সময় নিলেন মাত্র কয়েক মিনিট। বিয়াল্লিশ বছরের অপেক্ষার সকল মিনিটের সমান ছিল সেই ক'টি মিনিট। পুরো আদালতে উপস্থিত সবাই আমরা মহামান্য প্রধান বিচারপতির রায়টি শুনলাম। রায়ের বাংলা করলে যা দাঁড়ায় তা হল–
আসামীপক্ষের আপিল খারিজ করা হল। সরকারপক্ষের আপিলের জবাব এক এক করে তিনি উচ্চারণ করলেন। গত পাঁচ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কর্তৃক প্রদত্ত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের প্রদত্ত রায় অপরিবর্তিত রাখার সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের কথা জানালেন।
তারপর এল সেই কাক্ষিত ক্ষণ। ৪:১ বিভক্তির রায়ে ৬ নং অভিযোগ, মিরপুরের ১২ নং সেকশনের হযরত আলী লস্কর, তার স্ত্রী, দুই কন্যা এবং দুই বছরের এক ছেলে হত্যা ও অপর এক কন্যাকে ধর্ষণের অভিযোগের দায়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির কথা উচ্চারিত হল।
লক্ষ্য করলাম, নীরব চাঞ্চল্য চারদিকে। সবাই বাইরে ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইছিলেন। আমিও বেরিয়ে এলাম। ৫ ফেব্রূয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে যখন বেরিয়েছিলাম তখন মন ছিল বিষণ্ন। এক গভীর হতাশা এবং হাহাকারের ছাপ ছিল অবয়বে। আর আজ ভেতর থেকেই অপার আনন্দ আমাকে আপ্লুত করছে।
এখন আমি হাইকোর্টের দোতলার ব্রিজে। সেখানে অপেক্ষায় টিভি চ্যানেলের উৎসুক সাংবাদিকদের মুখগুলো। অজান্তেই আমার হাত উত্তোলিত হল, বিজয় চিহ্ন প্রদর্শন করলাম আমি। মনের আয়নায় ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখের চিত্রগুলো এক এক করে ভেসে উঠতে লাগল। সেদিন কসাই কাদের মোল্লা বিজয় চিহ্ন দেখিয়েছিল। আর আমি বিষণ্ন মুখে বলেছিলাম, এই রায় মেনে নেওয়া যায় না।
শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দৃশ্যপটগুলোও যেন সামনে দেখতে পেলাম। সেই ফেব্রুয়ারিতে অল্প ক'জন তরুণ-তরুণী অসাধ্য সাধনে নেমে পড়েছিল। শাহবাগ চত্ত্বরে তারা রচনা করল এক মহাকাব্যের। ক'দিনের মাথায় ওরা ক'জন পরিণত হল কয়েক লক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় পুনর্জাগরণের সৃষ্টি করল নতুন প্রজন্ম।
"ধিক্কারে, ঘৃণায়, ক্ষোভে কখনও যেও না বনবাসে"– ১৯৭২ সালে কবি শামসুর রাহমানের সেই অমর পংক্তি যেন উচ্চারিত হল আমাদের নতুন প্রজন্মের মুখে। মনে পড়তে থাকল সেই উজ্জ্বল মুখগুলোর কথা যারা উচ্চারণ করেছিল সেইসব শ্লোগান– 'ক' তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার। বাংলা ভাষার বর্ণগুলো কী দারুণ শক্তিমান হয়ে রাজাকার -যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে এক একটি অগ্নিগোলক হয়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল অগ্নিঝরা ওই ফেব্রুয়ারিতে।
মুক্তিযুদ্ধের বিয়াল্লিশ বছর পর নতুন প্রজন্মের মুখে আমরা শুনলাম একাত্তরের রণধ্বনি 'জয় বাংলা'। মনে পড়ল এই জয়বাংলা রণধ্বনি উচ্চারণ করেই তো আমরা মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুনিধনে এগিয়ে গিয়েছি। শত্রুর বাঙ্কারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছি। স্তব্ধ করে দিয়েছি পাকিস্তানের মেশিনগান।
একসময় সেই 'জয় বাংলা' নির্বাসনে পাঠিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি। তাই দীর্ঘসময় 'জয় বাংলা' শুধু উচ্চারিত হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মুখে, এমনকি দেশের প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিতরাও 'জয় বাংলা' ধ্বনি উচ্চারণে আড়ষ্ট রইলেন। যেন এক জগদ্দল পাথর আমাদের বুকের উপর চেপে বসেছিল। নতুন প্রজন্ম 'জয় বাংলা' ধ্বনি উচ্চারণ করে সে পাথর অপসারণ করল।
গণজাগরণ মঞ্চের উদ্দীপ্ত ঘোষণা ছিল– কাদের মোল্লার রায়ের বিরেুদ্ধে আপিলের সুযোগ দিতে হবে। সে জন্য প্রয়োজনে জাতীয় সংসদে আইন পরিবর্তন করতে হবে। তাই হল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দ্বিধাহীন চিত্তে সংসদে বিল পাসের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তটি নিলেন। তারই সূত্র ধরে কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হল। উভয়পক্ষের দীর্ঘ শুনানি এবং বিজ্ঞ অ্যামিকাস কিউরিদের অভিমত শোনা হল। তারপরও ছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষা। সুপ্রিম কোর্টের অবকাশও একসময় শেষ হল। আর আমরা রায়টি পেলাম।
আমার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেন সাংবাদিকরা। বললাম, জীবনে গভীর আনন্দের দিন আজ। শুধু আমার নয়, মিরপুরের আলোকদী (আলব্দী) গ্রামের গণহত্যার স্মৃতি নিয়ে যারা এখনও বেঁচে আছেন তারা– কবি মেহেরুন্নেসার বেঁচে থাকা পরিবারের সদস্যরা– শহীদ সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবের কন্যা– যারা বিয়াল্লিশ বছর ধরে কাদের মোল্লার হত্যাযজ্ঞ, অপমান, লাঞ্ছনার প্রতিকার চেয়ে অপেক্ষা করছিলেন– সেই সঙ্গে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শহীদের পরিবার– সর্বোপরি জেগে ওঠা নতুন প্রজন্ম– তাদের সবার জীবনেই আজ এক গভীর আনন্দের দিন।
বলেছি, এই তাৎপর্যপূর্ণ বিজয় বাংলাদেশের বিজয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিজয় এবং সর্বোপরি নতুন প্রজন্ম ও গণজাগরণের বিজয়। এ বিজয় শাহবাগ চত্ত্বরের নতুন প্রজন্ম যারা 'দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ' সম্পূর্ণ করবার মহাভার নিজেদের স্কন্ধে তুলে নিয়েছিল তাদের। সেই মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয় আজ অর্জিত হল।
এই বিজয়ের তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। এর হাত ধরে নতুন প্রজন্মকে পাড়ি দিতে হবে আরও দুরূহ সংগ্রামের পথ। আমরা যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ করেছি এবং বিজয় অর্জন করে স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি তারা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সৈনিকদের এই বিজয়ে সবিশেষ আনন্দিত।
তরুণদের বলছি– তোমাদের নেতৃত্বে আমরা চলতে চাই। জানি, নানা কারণে বর্তমান সরকারের প্রতি তোমরা ক্ষুব্ধ হয়েছ, মুখও ফিরিয়ে নিয়েছ। তবু তোমাদের প্রতি আকুল আবেদন করছি, দেশের মহাসংকটে ঐক্যবদ্ধ হও। ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তির এই ঐক্য আজ বড় জরুরি।
কাতারবন্দি হয়েছে জামায়াত, হেফাজত ও বিএনপিসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি। নির্বাচনে জয়ী হলে মুক্তিযুদ্ধের সকল মহান অর্জনকে আবার তারা ভুলুণ্ঠিত করবে। অগ্রসরমান বাংলাদেশ আবারও অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। এদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর ঐক্যে সামিল হও। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে দেশের অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, মানবিক শক্তিসমূহের আজ একতাবদ্ধ হওয়া দরকার।
এই শক্তিই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। সামনের জাতীয় নির্বাচনকে দেখতে হবে একাত্তরের রণাঙ্গন হিসেবে। এই রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে জয়ী হতে হবে।
আর সে জয়ের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের সূচিত 'দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ' এগিয়ে যাবে পূর্ণতার দিকে।
অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন: উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।