Published : 20 Jul 2013, 01:26 PM
যে ব্যক্তি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস পাকিস্তানি সামরিক হন্তারকদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গণহত্যা ও ম্যাসাকার পরিচালনার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, বেসামরিক ধর্মবাদী হন্তারক হয়ে উঠেছিল, মুক্তিযুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করে সৌদি আরব থেকে যুক্তরাজ্য পর্যন্ত দৌড়ে বেরিয়েছিল সদ্যমুক্ত রাষ্ট্রটিকে বিপন্ন করতে, যার অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধের সংজ্ঞাভুক্ত অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত, ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে মোট সাতবার যে সৌদি আরবের রাজদরবারে লিখিতভাবে ধর্না দিয়েছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে– ১৫ জুলাই, ২০১৩ রবিবার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সেই গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে।
কিন্তু এই রায় আমাদের কাউকে আশ্বস্ত করেনি। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যে লক্ষ্য ও স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন, এ রায়ে তার প্রতিফলন ঘটেনি। সিভিলিয়ান সুপরিয়র রেসপনসিবিলিটি বলে একটি কথা আছে, এ রায়ের মধ্যে দিয়ে তারও প্রতিফলন ঘটেনি। ৮ জুলাই, ২০১৩ যখন জানা গিয়েছিল, ড্যান মজিনার অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জন ড্যানিলোইজের বাসায় মহাজোট সরকারের দুই গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীর প্রধান আইনজীবী আবদুর রাজ্জাকের বৈঠক হয়েছে, তখন অনেকেরই ধারণা হয়েছিল, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ সরকার হয়তো আপোসের পথ খুঁজছে– যার জন্য সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হবে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়াকে। অনেকেরই আশঙ্কা, এ রায়ের মধ্যে ওই বৈঠকের ভূত নাচানাচি করছে। এ রায় আমাদের আশ্বস্ত করছে না, বরং আতঙ্কিত করে তুলেছে, নিরাপত্তাহীনতার বোধ জাগিয়ে তুলেছে।
কী ব্যক্তিক, কী সামাজিক, কী রাজনৈতিক– সবক্ষেত্রেই এ রায় প্রভাব ফেলবে। যে মানুষেরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, স্বাধীনতার পর প্রতিদিন তারা নৈতিকভাবে শক্তিহীন হয়েছে– কেননা আইনের শাসন তাদের স্বজন হারানোর, নির্যাতিত ও ধর্ষিত হওয়ার ও ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হওয়ার গ্লানি ও অপমান থেকে মুক্ত হওয়ার আস্বাদ দেয়নি। আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের প্রক্রিয়া এসব মানুষদের আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকানোর শক্তি যুগিয়েছিল। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা কী ব্যক্তিগতভাবে, কী সামাজিকভাবে, কী রাজনৈতিকভাবে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছিল ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে; কেননা ওইদিন দালাল আইন বাতিল করে, সাজাপ্রাপ্ত, গ্রেফতারকৃত অথবা পালিয়ে থাকা সকল দালালকে ক্ষমা এবং মুক্ত করে দিয়ে সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান পাকিস্তান মডেলের রাষ্ট্রচিন্তার দুয়ার উন্মুক্ত করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার বিচারপ্রত্যাশী জনগণকে প্রত্যাখ্যাত করার এ ঘোষণাটি ছিল আসলে জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবলয় থেকে বেরিয়ে আসার রাখঢাকহীন ঘোষণা। তারপর থেকে তার অনুসারীরা তার সেই অবস্থান ক্রমশ বিস্তৃত করেছেন।
আর এখন তা এত বেশি বিস্তৃত যে মানুষ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে তেমন আলাদা করে দেখে না। মানুষকে তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া উদ্দীপিত করেছিল। কিন্তু প্রথমে কাদের মোল্লা, এবার গোলাম আযম-এদের আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের রায়ের মধ্যে দিয়ে সেসব মানুষ স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে।
বিচার যখন চলছিল, তখনও নানাভাবে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। কেউ কেউ এমনকি গোলাম আযমের নিযুক্ত আইনজীবীরাও বলেছেন, ১৯৯৪ সালে তার নাগরিকত্ব মামলার সময়েই নাকি দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে তার ১৯৭১-এর সময়কার ভূমিকার মীমাংসা হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তার বয়সের কথা বিবেচনা করেই তাকে বিনা জামিনে গ্রেফতার করে কারাগারে রাখা বা বিচার করা ঠিক হচ্ছে না।
অথচ এর কোনো যুক্তিই ধোপে টেকে না। গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল তার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা ও অপরাধের নিরিখে, কিন্তু তার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে গিয়ে সর্বোচ্চ আদালত যুক্তি দিয়েছিল, ''নাগরিকত্ব কোনো প্রাপ্ত অধিকার নয়, এটি একটি প্রাকৃতিক অধিকার।''
তারপরও এরকম একটি বিভ্রান্তি ছড়ানোর ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী ও যুদ্ধাপরাধের বিচারবিরোধীদের যুক্তির উৎস ছিল হাইকোর্টের দুজন বিচারপতির একজন বিচারপতি ইসমাইল উদ্দিন সরকারের করা বিচার্য বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি বিচ্ছিন্ন উক্তি।
হাইকোর্ট বিভাগে দেওয়া রায়ের ১৪ নং অনুচ্ছেদে তিনি বলেছিলেন, "সামরিক জান্তার সঙ্গে সময় সময় মাখামাখি করা ছাড়া আদালত গোলাম আযমের বিরুদ্ধে এমন কোনো পর্যাপ্ত আলামত খুঁজে পায়নি যা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কিংবা তাদের সহযোগী রাজাকার আল-বদর আল-শামসকৃত মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধসমূহে তার সংশ্লিষ্টতা প্রতীয়মান হয়।"
মজার ব্যাপার হল, এসব যারা বলেন, তারা বলেন না যে, এরপর এ বিচারটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যায়। আপিল বিভাগের চার বিচারপতির একজন এটিএম আফজাল একে একটি উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করেন এবং সেটিও করা হয় বিচ্ছিন্নভাবে।
বিষয়টি দাঁড়ায় এরকম যে, চার বিচারপতির একজন আপিল বিভাগে বিচ্ছিন্নভাবে উদ্ধৃতি আকারে হাইকোর্টের বিচারপতির কথাটিকে ব্যবহার করলেও বাকি তিনজনের কাছে সেটি বিবেচ্য ছিল না– কেননা মন্তব্যটির সঙ্গে বিচার্য নাগরিকত্ব মামলার কোনো সম্পর্ক ছিল না, মামলার রায় নির্ধারণের ক্ষেত্রেও সেটি নির্ধারণের কোনও ভূমিকা ছিল না।
কিন্তু তারপরও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মোস্তফা কামাল তার রায়ে বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দেন এবং মন্তব্য করেন, ''যে পক্ষই এ মামলায় গোলাম আযমের অপরাধের বিষয়গুলো নিয়ে আসুন না কেন, সেগুলো বাংলাদেশের কোনো আদালতেই পরীক্ষিত হয়নি এবং এইসব অপরাধের অভিযোগ যদি এমনকি সত্যও হয়, তা হলেও নাগরিকত্ব মামলায় সেগুলোর কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই।''
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মতো আদালতই হল আইন অনুযায়ী গোলাম আযমের অপরাধ বা অপরাধসমূহ বিচারের সঠিক আদালত– যেটি তখনও ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আদালত পাওয়া গেলেও এবং গোলাম আযমের সিভিলিয়ান সুপরিয়র রেসপনসিবিলিটি সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার মতো অপরাধ হয়ে উঠলেও তার বয়সটাই বড় হয়ে উঠল! অথচ গোলাম আযমের বয়স ইস্যুটি যে কত হাস্যকর, সেটি সবাই জানেন। ৯১ বছর বয়সী নাৎসি যুদ্ধাপরাধী জন দেমইয়ানযুককেও বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ২০০৯ সালে জার্মানির আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে, ওই বছরই যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় জার্মানিতে। বিচার চলার পুরো সময় তাকে জামিন ছাড়াই থাকতে হয়েছে জার্মানির স্টাডেলহেইম জেলখানার মেডিক্যাল ইউনিটে। ২০১১ সালের মে মাসে বিচারকাজ শেষ হয় তার, দোষী দেমইয়ানযুককে শাস্তি দেওয়া হয়।
এ রায়ের পাশাপাশি কাকতালীয়ভাবে মনে হচ্ছে, গেল জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ারই আরেকটি দেশ কম্বোডিয়ায় প্রণীত নতুন এক আইনের কথা। এখন থেকে সেখানে কেউ খেমাররুজদের শাসনামলের বা গণহত্যার কথা অস্বীকার করলে সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। মাস দুয়েক আগে কম্বোডিয়ার বিরোধী দল কম্বোডিয়া ন্যাশনাল রেসক্যু পার্টির নেতা কেম সোখা সেখানকার তুওল স্লেঙ্গ জেনোসাইড মিউজিয়ামে সংরক্ষিত যুদ্ধাপরাধের বিভিন্ন নিদর্শনকে ভুয়া বলে বসে।
অথচ খেমাররুজদের আমলের একটি বহুল আলোচিত নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রতেই স্থাপন করা হয়েছে তুওল স্লেঙ্গ জেনোসাইড মিউজিয়াম– যে কেন্দ্রটিতে ওই সময় হত্যা ও নিখোঁজ হয়েছিলেন ১৭ হাজার মানুষ। ফলে এ নির্যাতন কেন্দ্র হয়ে ওঠে পরবর্তী সময়ে কম্বোডিয়ার গণহত্যার অন্যতম নির্দশন। ইতিহাসের ওই সত্য উর্ধ্বে তুলে ধরার স্বার্থে কম্বোডিয়ার সংসদকে তাই এগিয়ে যেতে হয় এরকম একটি আইন প্রণয়নের দিকে।
কেবল কম্বোডিয়া নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এমন আইন আছে– গণহত্যা প্রত্যাখ্যানের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। ফ্রান্সের সিনেট ২০১২ সালের জানুয়ারিতেই একটি আইন অনুমোদন করেছে, যার ফলে সেখানকার গণহত্যা ও প্রথম মহাযুদ্ধকালীন সময়ে তুর্কী সৈন্যদের হাতে নিহত ১০ লাখের বেশি আর্মেনিয়কে হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করলে এক বছরের কারাদণ্ড হবে, ৪৫ হাজার ইউরো জরিমানা হবে অথবা দুটো শাস্তিই একযোগে প্রযোজ্য হবে।
আর্মেনিয়দের হত্যার বিষয়টিকে তুরস্ক শুরু থেকেই গণহত্যা হিসেবে অস্বীকার করে আসছে। হলোকাস্ট প্রত্যাখানকে আইনগতভাবেই অপরাধ বলে গণ্য করা হয় অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, বসনিয়া ও হারজেগোভিনা, চেক প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স, জার্মানি, হাঙ্গেরি, ইসরায়েল, নেদারল্যান্ডস, পোলান্ড, পর্তুগাল, সুইজারল্যান্ড এবং রোমানিয়াতে। এসব দেশের কোনো কোনোটিতে কম্যুনিস্ট শাসনামলের অপরাধ অস্বীকার করাও আইনগতভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, একাত্তরের ম্যাসাকার ও জেনোসাইডকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা এ দেশের সংবিধান এখনও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করে না। তাই গত ৪২ বছরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক অপশক্তি বারবার একাত্তরের ম্যাসাকার ও জেনোসাইডকে অস্বীকার করেছে, হালকা করে দেখেছে কিংবা সে সময়ের অপরাধগুলোকে সাধারণ অপরাধের সঙ্গে এক করে দেখার অপচেষ্টা চালিয়েছে।
যদিও একটি দেশের সাধারণ অবস্থায় যে হত্যাকাণ্ড ও নারীধর্ষণের অপরাধ ঘটে, নির্যাতন-নিপীড়ন বা অগ্নিসংযোগ-লুটপাট বা এ ধরনের ঘটনা ঘটে– তাকে আমরা কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধ বা এ ধরসের পরিস্থিতি চলার সময় সংঘটিত একই জাতীয় অপরাধের সঙ্গে এক করে দেখতে পারি না। কারণ তখন এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটানো হয় মুক্তিকামী যোদ্ধা ও জনগণের মধ্যে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা জন্ম দিয়ে তাদের অবনত করার লক্ষ্য থেকে।
একাত্তরেও গোলাম আযমরা চেয়েছে স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মুক্তিকামী জনগণের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে, চেয়েছে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায় থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ে নেতৃত্বশূন্য করতে। তাদের এই চাওয়ার সঙ্গে মিশেছিল এমনকি ব্যক্তিগত লালসা পূরণের ইচ্ছাও। এখন অনেককে বলতে শোনা যায়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করতে।
তারা বলেন না, যুদ্ধাপরাধীরাও একটি রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমানের পরিচালিত রাষ্ট্রশাসনের কল্যাণে এবং এখন সেই রাজনৈতিক শক্তিই বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে বাধা দিতে চাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজে।
একদিকে প্রতিটি বিচারকাজে অংশ নিচ্ছে তারা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক লবিংয়ের মাধ্যমে বিচারপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে; আবার রাজনৈতিক সহিংসতার মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে জনগণকে ভীত করে নিশ্চুপ করে দিতে চাচ্ছে।
সামনের দিনগুলো আমাদের জন্য আরও কঠিন হবে। এ রায় তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেখা গেছে, বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলো সফলভাবে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামি দলের কখনও-ই কোনো সমালোচনা করা হয় না। বরং এ ধরনের দলগুলোর প্রতিটি রাজনৈতিক সংকটে বিএনপি প্রকৃত মিত্রের মতো পাশে দাঁড়ায়।
যেমন, যুদ্ধাপরাধী বিচারের ইস্যুতে বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর হাতে শূন্য চেকবই তুলে দিয়েছে। এখন সারা দেশ যখন আল্লামা শফীর অশ্লীল ওয়াজে সমালোচনামুখর ও বিক্ষুব্ধ– বিএনপি তখন জাতীয় সংসদে পর্যন্ত হেফাজতে ইসলামের বিশ্বস্ত মিত্র হিসেবে উচ্চকিত হয়ে উঠেছে।
সাধারণভাবে হেফাজতে ইসলামের উত্থানের জন্যে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা আওয়ামী লীগকে দায়ী করলেও তাকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে ছায়া দিয়ে চলেছে বিএনপিই।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ তার মিত্র রাজনৈতিক শক্তিদের সঙ্গে বরাবরই দোদুল্যমানতা দেখিয়ে আসছে, অবিশ্বস্ততার দলিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে চলেছে। মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে কোনো ছাড় দিতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। বরং আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশি হামলাকেই তারা সমর্থন যুগিয়ে চলেছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার প্রক্রিয়াধীন হওয়ার পরও যে ধরনের দোদুল্যমানতা দেখিয়েছে, তাদের বিভিন্ন মন্ত্রী ও নেতা বিভিন্ন দায়িত্বহীন কথাবার্তা বলার মধ্যে দিয়ে এ বিচারপ্রক্রিয়াকে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ঐক্যকে দুর্বল করেছে। তাদের বিশ্বস্ত মিত্ররাও তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে।
মাস কয়েক আগেও জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি উভয়েই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে অবৈধ বলে আখ্যায়িত করেছে। এটি বাতিলের দাবিও করেছে তারা। কিন্তু এখন উভয় দলই সেরকম বক্তব্য থেকে দূরে সরে এসেছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রায় তাদের আশাবাদী করে তুলেছে।
তারা হয়তো এখন চিন্তা করছে, নতুন করে সরকার গঠনের পর এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকেই পুনর্গঠন করে তাদের আইনগতভাবে কলঙ্কমুক্ত করার। যেমন, যুদ্ধাপরাধীদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম এর মধ্যেই গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, ট্রাইব্যুনাল বন্ধ করে তারা বিতর্কিত হতে চান না। ভবিষ্যতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করলে এ বিচার নিরপেক্ষ হবে বলে মনে করেন তিনি। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ''যা করার ট্রাইব্যুনাল রেখেই করা হবে। ১৮ দলীয় জোট ক্ষমতায় এলে প্রথমেই পুনঃগঠন করা হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর আইনি প্রক্রিয়ায় সবকিছু হবে।''
বিএনপি-জামায়াত সরকার এলে তারা ট্রাইব্যুনালে যে কটি মামলা যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, সেগুলো নতুন করে শুনানির ব্যবস্থা করবেন! আপিল বিভাগের মামলাগুলোর ব্যাপারেও নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। রায় পুনর্বিবেচনার বিষয়টি উন্মুক্ত থাকার সুবিধাও ভোগ করবেন তারা। এই সুবিধা অনুযায়ী, আপিল বিভাগ থেকে কেউ খালাস পেলে তার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ আর দ্বিতীয়বার তোলার সুযোগ থাকবে না। অতএব ভবিষ্যতে আমরা যতই মাথা কুটে ন্যায়বিচারের আবেদন জানাই না কেন, তাতে কোনো ফল হবে না!
আমরা এখন সত্যিই আতঙ্কিত, উদ্বিগ্ন; গোলাম আযমের রায়কে কেন্দ্র করে আমরা যদি নতুন এক ভিত্তির ওপর না দাঁড়াতে পারি, সেরকম এক পরিণতিই আমাদের বরণ করতে হবে। ট্রাইব্যুনাল থাকবে, তবে ভেতরের সবকিছু পাল্টে যাবে– যুদ্ধাপরাধীরা পার পেয়ে যাবে আর নতুন করে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে হয়তো চিহ্নিত হবেন মুক্তিযোদ্ধারাই!
এ আতঙ্কের পরও আমাদের আশার জায়গা একটাই, এখনও মুক্তিযুদ্ধ আমাদের আন্দোলিত করে। ভয়ের সংস্কৃতিকে একাত্তরে প্রত্যাখ্যান করে এইসব দানবের বিরুদ্ধে এ দেশের জনগণ যুদ্ধ করেছিল। এবারও ওই সংস্কৃতির আগ্রাসন প্রত্যাখ্যাত হবে।
ইমতিয়ার শামীম : লেখক, সাংবাদিক।