পাকিস্তান: যেন ১৯৭১ সালের দেঁজাভু

পাকিস্তানের বর্তমান চিত্রপট যেন চোরাবালি; আর তাতে পড়ে গেছে সেনাবাহিনী-দুর্নীতিমুখর পরিবারতন্ত্র-মার্সিনারি ধর্মের নামে রাজনীতি। যত বেশি হাত-পা নাড়ছে তারা; ততই যেন তলিয়ে যাচ্ছে...

মাসকাওয়াথ আহসানমাসকাওয়াথ আহসান
Published : 15 May 2023, 10:11 AM
Updated : 15 May 2023, 10:11 AM

ক্রিকেটের সবগুলো ফরম্যাটে ফর্ম হারিয়ে পাকিস্তান ক্রিকেট দলটি এখন টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটটাই খেলছে। পাকিস্তানের রাজনীতিও যেন ঠিক টি-টোয়েন্টির মতো ক্ষণস্থায়ী সব ঘটনার ঘনঘটা আর উত্তেজনা নিয়ে হাজির হয়েছে, হয় সব সময়ই।

এই যে মঙ্গলবারে ইসলামাবাদের আদালত প্রাঙ্গন থেকে প্যারামিলিটারি ফোর্স এসে বিরোধী দলীয় নেতা ইমরান খানকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেল; এরপর ইমরানের মুক্তির দাবিতে পাকিস্তানব্যাপী জনবিক্ষোভ সংগঠিত হলো, বিক্ষুব্ধ জনতা লাহোর সেনানিবাসে হামলা চালাল; পিন্ডির সেনা সদর দপ্তরে ঢুকে পড়ল, পেশোয়ারে রেডিও পাকিস্তান পুড়িয়ে দিল; প্রায় সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরে সেনা মোতায়েন ও ১৪৪ ধারা জারি করা হলো, প্যারামিলিটারি নির্বিচার গুলি করে বিক্ষোভকারীদের হতাহত করল; এ সবই যেন ১৯৭১ সালের দেঁজাভু।

১৯৭১ সালে জননন্দিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর নেতাকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া; পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদী জনতাকে গুলি করে মারা; গণতন্ত্র ও মানবাধিকার হত্যা করার যে সেনা ষড়যন্ত্র; ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায়ে প্রমাণ হয়ে গিয়েছিলো এই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশটির হামারশিয়া আর হুব্রিস; যা দেশটিকে ট্র্যাজেডির কালো ক্যানভাস করে রেখেছে।

পাকিস্তানের ক্ষমতা কাঠামোর ১৯৭১ গণহত্যা অস্বীকারের কারণে; খুনে সেনাবাহিনীর কমান্ডিং পজিশনের যুদ্ধাপরাধীদের কোনো বিচার হয়নি। অনুতাপহীন এই রাক্ষস বাহিনী মানুষ খুনের লাইসেন্স পেয়ে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশে মানুষ হত্যা করে চলেছে আজ অব্দি।

জার্মানিতে ১৯৪০ থেকে ৪৫-এর হলোকাস্টের যুদ্ধাপরাধী নাৎসিদের বিচার হওয়ায়; সেখানে সেনাবাহিনী পরিশোধিত এক সভ্য সেনাবাহিনীতে রূপান্তরিত হয়ে এখন প্রশংসিত সভ্যতার মানচিত্রে।

কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষমতা কাঠামো ১৯৭১-এর বাংলাদেশ জেনোসাইড অস্বীকার করায়; তাদের তৈরি করা ফ্রাংকেস্টাইন সেনাবাহিনী দেশটির জনমানুষকে যেন নিজভূমে পরবাসী করে রেখেছে।

পাকিস্তানে পরিবার তন্ত্র আর দুর্নীতির দুষ্টচক্র ভেঙে দিতে তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত তেহেরিক ই ইনসাফ পাকিস্তান; ইমরানের নেতৃত্বে ২০১৯ সালে ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় এসেই ইমরান খান বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যেমন জন আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছিলো; তেমনি ২০১৯-এর নির্বাচন পাকিস্তানের ইতিহাসে দ্বিতীয় ঘটনা; যেখানে জনমুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রতিভাত।

আওয়ামী ন্যাশনালিস্ট পার্টির  এক বর্ষীয়ান নেতা মিডিয়ায় আলোচনায় বলেছিলেন, শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলন আর অহিংস নীতি অনুসরণ করে ইমরান খান সাফল্য পেয়েছেন।

২০১৯ সালের আগে জারদারি ও নওয়াজ পালা করে ক্ষমতায় থাকায়; সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ২০১৮ সালেই সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা নওয়াজের দলের লোকেদের দুর্নীতির ফাইল হাতে নিয়ে উইচ হান্টিং শুরু করে। নির্বাচন সামনে রেখে নওয়াজের মুসলিম লীগ নেতারা আদালতের বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি করতে শুরু করে। জারদারির পিপলস পার্টির ভোট ব্যাংক কেবল সিন্ধু প্রদেশে সীমাবদ্ধ। এই সুযোগে ইমরান খান গোল করেন গোলপোস্টে। সেনাবাহিনীকে মিষ্টি কথায় ভোলান, আমি তোমাদেরই লোক।

কিন্তু ২০১৯ সালে ক্ষমতায় এসেই ইমরান সেনাবাহিনীর মনোপলি ভেঙে দিতে চেষ্টা করেন। ভারতের মোদি সরকারের ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশনে একটি ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভেঙে পড়লে; ভারতীয় পাইলট অভিনন্দন গ্রেপ্তার হয়ে যান। ইমরান তখন কালক্ষেপন না করে অভিনন্দনকে সসম্মানে ভারতে ফেরত পাঠান। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অভিনন্দনকে আটকে রেখে দরকষাকষি করতে চেয়েছিলো। ইমরান তাতে বাধ সাধায়; সামরিক বাহিনীর ইগো আঘাত প্রাপ্ত হয়।

এতদিন রাজনৈতিক প্রশাসনকে পুতুল নাচের ইতিকথা করে রেখে সেনাবাহিনীর যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিলো; ইমরান তা ভেঙে দেন যেন। সেনাপ্রধান নয়; প্রধানমন্ত্রীই জনগণের প্রতিনিধি; ফলে দেশের ভালোমন্দের সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন; এই কথাটি ইমরান স্পষ্ট করেই জানিয়ে দেন।

সেনাবাহিনী তখন ইমরানের কোয়ালিশন সরকারের শরিক দল এমকিউএম-এর সংসদ সদস্যদের নিয়ে হর্স ট্রেডিং করে। ঘোড়াগুলো কিনে নিয়ে মুসলিম লীগ (নওয়াজ) আর পাকিস্তান পিপলস পার্টি যৌথভাবে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হাসিল করে।

ক্ষমতা থেকে ইমরান সরে গেলে শুরু হয় সেই পরিবারতন্ত্র আর সেনাতন্ত্রের ভূতুড়ে নৃত্য। ইমরানের প্রাণনাশের চেষ্টা চলে। 

ইমরান আঙুল তোলেন সেনা গোয়েন্দা সংস্থার দিকে; স্পষ্ট করে বলেন, গোয়েন্দা কর্মকর্তা ‘ডার্টি হ্যারি’ আমাকে হত্যা করে এদেশের মানুষের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা আর ভোটের অধিকারকে হত্যা করতে চায়। 

মুসলিম লীগের  শরিফ পরিবার আর পিপলস পার্টির জারদারি পরিবারের অযুত দুর্নীতির ফাইল ডিপফ্রিজে পাঠিয়ে ইমরানের নামে একের পর এক মামলা করে গোয়েন্দা সংস্থার ক্ষমতা দেখানোর প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল একাউন্টিবিলিটি ব্যুরো। 

ওদিকে প্রতিটি জনমত জরিপের ফলাফল ইমরান খানের জনপ্রিয়তা ৭৮ থেকে ৮০ শতাংশ দেখাতে শুরু করে।

ভয় পেয়ে ক্ষমতাসীন দল দুটো ইমরানকে কারাগারে রেখে নিজেদের ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার চেষ্টা করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে হেরে গিয়ে পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো যেরকম মুজিবকে জেলে রেখে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে লারকানায় শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন; একই ফর্মুলা যেন আরেকবার পিপলস পার্টি প্রধান আসিফ আলী জারদারি আর প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে সেনা প্রধানের সখ্য গত মঙ্গলবার ইমরান খানকে গ্রেফতারের পটভূমি তৈরি করে। 

কিন্তু পাকিস্তানের মানুষের কাছে এ দৃশ্য অনেক চেনা; তাই তারা সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেনি। রাজপথে নেমে এসে দ্রুতই ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে জনযুদ্ধে লিপ্ত হয়। 

অর্থনীতিতে পঙ্গু দেশটির মানুষের ভালো মন্দের দিকে ক্ষমতাসীন সরকার আর সেনাবাহিনীর কোন মনোযোগ নেই। তারা পাওয়ার করিডোরের পাশা খেলায় ব্যস্ত। বাধ্য হয়ে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল বৃহস্পতিবার সকালেই আদেশ দিলেন, এক ঘণ্টার মধ্যে ইমরান খানকে আদালতে হাজির করার জন্য। 

ক্ষমতাসীন সরকার ও সেনাবাহিনী ইমরানকে রিমান্ডে নিয়ে ক্ষমতার স্টিম রোলার চলানোর পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে দেখে মুষড়ে পড়ে। 

প্রধান বিচারপতি বান্দিয়াল পিটি আই নেতা ইমরানকে আদালতে হাজির করা হলে বলেন, ‘আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে খুশি লাগছে। এই মুহূর্ত থেকে আপনি মুক্ত। কাল হাইকোর্টে গিয়ে মামলা নিষ্পত্তি করুন আইনি পথে। আর প্রতিপক্ষের রাজনীতিকদের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে সংকট নিরসনের চেষ্টা করুন।’ 

বিক্ষুব্ধ ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী মরিয়ম নওয়াজ বলেন, ‘এই প্রধান বিচারপতি পিটি আই-এ যোগ দিলেই পারেন।’ তথ্য মন্ত্রী মরিয়ম আওরঙ্গজেব বলেন, ‘মনে হচ্ছে বিচার বিভাগের সঙ্গে ইমরানের প্রেমের সম্পর্ক চলছে।’ 

রাজপথে তখন গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষায় উন্মুখ জনতা শ্লোগান দিচ্ছে, ‘গো ডাইন্যাস্টি গো; গো আর্মি গো।’ 

সব দেশের সেনাবাহিনী থাকে; কিন্তু সেনা বাহিনীর একটি দেশ আছে, সেটির নাম পাকিস্তান। ফলে যে সেনাবাহিনী ধর্মভিত্তিক দলের রাজাকার সমভিব্যহারে ১৯৭১ গণহত্যা চালিয়েছিলো বাংলাদেশে; এরপর গত পাঁচটি দশক সেই রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদের ভূতের নাচন নাচিয়ে নিয়েছে অসংখ্য জীবনের শুল্ক; ঝাঁপি থেকে সেই ভূত আবার বের করেছে তারা; ইমরানকে ঘিরে তৈরি হওয়া পরিস্থিতি সামাল দিতে।

জামায়াতে উলেমা ইসলামী নেতা মওলানা ফজলুর রহমান; যিনি ২০১৯ নির্বাচনে ইমরানের প্রার্থীর কাছে হেরে বিক্ষুব্ধ; তাকে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে গত ৭২ ঘণ্টায়। সেই মওলানার আশীর্বাদধন্য বেশ কিছু মাদ্রাসা রয়েছে ইসলামাবাদের আশেপাশে। ফলে সেনা বাহিনীর যখনই ভূতের নাচন প্রয়োজন পড়ে; তখনই মাদ্রাসার ফুট সোলজার এনে মওলানা শো-ডাউন করেন। ইমরান ক্ষমতায় থাকার কালে তার বিরুদ্ধে মওলানার এমনি এক ফয়েজাবাদ জলসায়; গোয়েন্দা কর্মকর্তা টিভি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে রুপি বিতরণের সময়। আদালত সেসময় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিকে ঢেকে তিরস্কার করেছিলো। 

ইমরানকে প্রতিহত করতে ক্ষমতাসীন সরকার-সেনাবাহিনী আর মওলানার জলসা; এরকমই একটি বিক্ষোভ নাটক মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের সামনে কিংবা সেই ফয়েজাবাদে।

বাংলাদেশ ৩০ লাখ প্রাণ দিয়ে, এক কোটি শরণার্থীর মর্মন্তদ ট্র্যাজেডি; চার লাখ বীর নারীর গভীর আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে যে সেনাবাহিনীর ভূত তাড়িয়েছে; যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে যে রাজাকারদের শাস্তি দিয়েছে; মাত্র চারদিনের জনযুদ্ধ দিয়ে সেই পাকিস্তান ফ্রাংকেনস্টাইন দমন করবে পাকিস্তানের গণমানুষ; এ নেহাত কষ্ট কল্পনা। 

গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লাইটাস বলেছিলেন, একই স্রোতে দুবার অবগাহন করা যায় না। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১-এর পর এই ২০২৩-এ আরেকবার যেন সেই একই স্রোতে অবগাহন করছে। সেটা কী সম্ভব। 

পাকিস্তানের বর্তমান চিত্রপট যেন চোরাবালি; আর তাতে পড়ে গেছে সেনাবাহিনী-দুর্নীতিমুখর পরিবারতন্ত্র-মার্সিনারি ধর্মের নামে রাজনীতি। যত বেশি হাত-পা নাড়ছে তারা; ততই যেন তলিয়ে যাচ্ছে...