বরেন্দ্র অঞ্চলে এমন কোনো গ্রাম নেই, যেখানে সাপ নেই। আবার এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে সাপে কাটার ঘটনা ঘটেনি। তবে সাপে কাটার তুলনায় মৃত্যুর হার নগণ্য বলতে হবে।
Published : 06 Jul 2024, 07:36 PM
চন্দ্রবোড়া সাপকে মূলত বরেন্দ্র অঞ্চলের সাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। চন্দ্রবোড়া সাপকে বরেন্দ্রের মানুষ চিনে বোড়া সাপ হিসেবে। বোড়া সাপের কপালে কবে ‘চন্দ্র’ শব্দ যুক্ত হয়েছে তা এ বিষয়ে হৈহুল্লোড় না হলে জানতাম না। বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ মূলত গোখরা (স্থানীয় ভাষায় গোহামা), দাঁড়াশ, বোড়া (চন্দ্রবোড়া), ঢোড়া এবং ভ্যামটা সাপের সঙ্গে পরিচিত।
মাঝে মাঝে নিম, পাইকড় বা তেঁতুল গাছে একধরনের সবুজ-হলুদের মিশেলে ছোট অথচ দুর্দান্ত সুন্দর এক সাপ দেখা যেত। এই সাপ কাউকে কামড় দিয়েছে শুনিনি। ভ্যামটা সাপের কাপড়ের কথাও শোনা যায়নি। নির্বিষ ঢোঁড়া সাপ বেশ রাগী। জমির আইলে কোল ঘেঁষে থাকে। অল্পপানিতে থাকতে পছন্দ করে। আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করলে কামড় দেয়, অনেক জায়গায় কামড় দেয়। ঢোড়া সাপের কামড়ে কেউ মারা গেছে এমন তথ্য পাওয়া যায়নি।
দাঁড়াশ অনেক লম্বা সাপ। দ্রুতগামী। গাছের ওপর ও নিচে থাকতে পছন্দ করে। গাছের ওপর উঠে মূলত পাখির বাসা থেকে ডিম খাওয়ার জন্য। দাঁড়াশ সাপ গরুর দুধ খায় বলে লোকশ্রুতি রয়েছে।
গোখরা প্রসঙ্গে আসি। গোখরাও মূলত মানুষের গৃহবাসী। হাঁস-মুরগির কুঠি, ধানের গোলা, গোয়ালঘর, খড়ের পালায় গোখরার বাস। বোড়া বা চন্দ্রবোড়া সাপ কিছুটা গৃহবাসী হলেও মূলত বাস করে মাঠে-ঘাটে, উঁচু ডিবি, জমির চওড়া আইল, বড় গাছ যেমন– বট, পাইকড় ইত্যাদির গোড়ায়। গোখরা সাপকে সবচেয়ে বিষধর হিসেবে বরেন্দ্রের মানুষ জানে, তারপর বোড়া বা চন্দ্রবোড়া।
বরেন্দ্র অঞ্চলে এমন কোনো গ্রাম নেই, যেখানে সাপ নেই। আবার এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে সাপে কাটার ঘটনা ঘটেনি। তবে সাপে কাটার তুলনায় মৃত্যুর হার নগণ্য বলতে হবে। সেটা ঘটেছে মূলত মানুষের আধুনিক চিকিৎসার ব্যাপারে মনোযোগী না হওয়ার কারণে। গ্রামে বিদ্যুৎ গেছে যা সাপ ভীতি রোধে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। রাতে চলার ক্ষেত্রে মানুষ সর্তকতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আজও টর্চলাইট ব্যবহার করে। যাহোক, সাপে কাটা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়।
সাপ ঘিরে ভয় ছিল, আজও আছে। সাধারণ গরমকালে সাপের চলাফেরা বেড়ে যায়। গোখরা সাপের মাজা ভেঙ্গে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে মানুষকে তার তেজ দেখতে দেখেছি। সাপের চলার গতিতে রয়েছে মৌলিকত্ব। সাপ যে রাস্তা দিয়ে যায় সেই রাস্তা নাকি চিনতে ভুল করে না (এলাকার ওঝা ও সাপুড়েদের কাছে শোনা)। শীতকালে সাপে কাটার ঘটনা কখনও শুনিনি।
বরেন্দ্র অঞ্চলে সাপের রয়েছে দীর্ঘ সামাজিক ইতিহাস। ভূ-প্রকৃতির গঠন ও সাপের বংশগতি তার এক বিশেষ দিক। সাপ বিশেষ সামাজিক চলক। সমাজের নানাস্তরে তার অবস্থান। বরেন্দ্রভূমির সন্তান হিসেবে সাপ ও মানুষের যৌথজীবন দেখার সুযোগ হয়েছে। অ্যাকাডেমিক গবেষণা পদ্ধতি অটোএথোনোগ্রাফিক (ব্যক্তির একক জীবনাভিজ্ঞতার বিবরণ) অনুসরণে সেসব ঘটনার কয়েকটি নিচে তুলে ধরা হলো:
১. স্যার, কিসে জানি কামড় দিল: আব্বা স্কুল শিক্ষক ছিলেন। এলাকাজুড়ে তার অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। এটি রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার পলাশী গ্রাম। আশির দশকের মাঝামাঝি। বর্ষাকাল। জমিতে ধান লাগানোর জন্য কৃষাণরা লাঙ্গল দিচ্ছেন। আব্বা জমির আইলে বসে আছেন। আমি আব্বার সঙ্গে। পাশের জমিতে আব্বার ছাত্র মজিবুর রহমান চৌধুরী পা দিয়ে টিপে টিপে জমির আইলের ছিদ্র বন্ধ করছেন যাতে জমির পানি পাস করতে না পারে। হঠাৎ চৌধুরী চিৎকার দিয়ে উঠলেন। আব্বা বলছেন কী হলো তোর? চৌধুরীর উত্তর, স্যার আমাকে কিসে জানি কামড় দিল। পা আগুনের মতো জ্বলছে।
আব্বা অনুমান করলেন কিছু একটা ঘটছে। কৃষাণ কবিরাজ মাঝিকে বললেন, দড়ি দিয়ে পা শক্ত করে বাঁধ। চৌধুরীর বাড়িতে খবর দে। চৌধুরী তুই দ্রুত রাজশাহীতে মেডিকেল কলেজে যা। চৌধুরীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে না নিয়ে নেওয়া হলো তানোর উপজেলার চাপড়া গ্রামের ওঝা বাবুলের (ওঝা বাবুল নন্দী– এখনও জীবিত ও চিকিৎসা দেন) কাছে। চৌধুরীকে বাঁচানো যায়নি। ওঝার কাছে নেওয়ার পথেই চৌধুরী মারা যান।
চৌধুরীকে যখন জমি থেকে বাড়িতে নেওয়া হচ্ছিল। আব্বা কৃষাণদের বললেন, সর্তকভাবে খুঁড়ে দেখ তো গর্তের ভিতর কী আছে? খুঁড়া শুরু হলো, দেখা গেল প্রায় দু থেকে আড়াই হাত মাপের পাকা বোড়া সাপ। খরা ও বর্ষায় শরীর কুচে কুচে কালো হয়ে গেছে। সবাই নিশ্চিত হলো চৌধুরীকে এ সাপে ছোবল মেরেছে। সাপের পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়েছিল।
বরেন্দ্র অঞ্চলে একটি কথা চালু রয়েছে, ছোবল মারা সাপ মেরে ফেললে সে রোগীকে বাঁচানো যায় না। অদৃশ্যবাদীরা হয়তো বলবেন, সাপের ছোবলেই চৌধুরীর মৃত্যু ছিল। কিন্তু আমার প্রতীতী চৌধুরীকে যথাসময়ে আধুনিক চিকিৎসা দেওয়া গেলে বাঁচানো যেত।
৯০-এর দশক পর্যন্ত ওঝারাই সাপের ছোবলে আক্রান্ত রোগীদের বাঁচনোর দাওয়া দিতেন। সাপের কামড় থেকে সুরক্ষায় মানুষ আধুনিক চিকিৎসার দিকে ঝুঁকেছে গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য, জমিতে ব্যাপক পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহারের কারণে পোকামাকড়ের পাশাপাশি সাপেরও প্রজননের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
২. এটাই আমার শেষ সাপ খেলা: বরেন্দ্র এলাকার একটি বৃহৎ হাটের নাম হলো কাঁকনহাট। প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার এ হাট বসে। এ হাটে নিয়মিত সাপ খেলা দেখাতেন অভিজ্ঞ সাপুড়ে সোলাইমান। শৈশবে হাটে গিয়ে গরুহাটায় এ সাপ খেলা দেখতাম। সোলাইমানের যোগাযোগীয় দক্ষতা ছিল অসাধারণ। তিনি চুম্বকের মতো দর্শকদের ধরে রাখতে পারতেন। দর্শকদের মাঝে মাঝে সর্তক করতেন ‘পকেট সাবধান’।
এ সাপ খেলা ছিল আমাদের কাছে বাড়তি আকর্ষণ। সাপুড়ে সোলাইমানের কাছে নানা ধরনের সাপ ছিল। অনেক বিষধর ও বড় আকারের সাপ। তিনি খেলা দেখাতেন এবং ওষুধ বেচতেন। একবার খেলা দেখানোর এক পর্যায়ে এক গোখরা সাপ সোলাইমানের হাতে ছোবল দিয়ে বসে। তিনি কিছুটা বির্মষ হন। একটি ভেষজ ওষুধ খান। দর্শকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, কবে ওর বিষ দাঁত গজিয়েছে টের পায়নি। যা হোক, আমার সময় শেষ হলো। এটাই হয়তো আপনাদের সঙ্গে শেষ দেখা। মাফ করবেন। সোলাইমানের সাগরেদ দড়ি দিয়ে হাত বাঁধলেন। সাপের বাক্সগুলো গুছিয়ে কাঁকনহাটের পাশেই তাদের নিজগ্রাম সুন্দরপুরে চলে গেলেন। পরে এলাকায় মাইকিং থেকে জানা গেল সোলাইমান সাপুড়ে সাপের কামড়ে মারা গেছেন। এ সাপুড়ের মৃত্যু প্রমাণ করল সাপ নিয়ে খেলতে গেলে বিশেষ সর্তকতা প্রয়োজন।
৩. তোদের বন্দুক তাক করা ঠিক হয়নি: আমার নানাবাড়ি রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার শিবরামপুর গ্রামে। তিনি বিত্তশালী গৃহস্থ ছিলেন। তার বাড়িতে তিনটি বড় মাটির ধানের গোলা ছিল। একেকটিতে প্রায় ষোল থেকে আঠারশো মণ ধান ধরত। এ গোলা, গোয়ালঘর, কাঠ রাখার ঘরগুলো ছিল মূলত গোখরা সাপের আস্তানা। একেকটি সাপ আড়াই থেকে তিন হাত লম্বা ছিল।
এ সাপ সম্প্রদায় প্রায় চার প্রজন্ম ধরে নানাবাড়ি ও তার আনাচে-কানাচে বাস করত। কোনো রেকর্ড নেই কাউকে কখনও কামড় দিয়েছে। সাপগুলোর ব্যাপারে নানা ভাইয়ের ছিল সহনশীল মনোভঙ্গি। তিনি সাপ মারতে নিষেধ করতেন। বলতেন, তোরা সর্তকভাবে চলাফেরা করবি, ওদের ক্ষতি না হলে ওরা কখনও কামড় দিবে না। নানা বলতেন, তার দাদার আমল থেকে এ বাড়িতে সাপগুলো রয়েছে।
আমরা ভাই-বোনেরা এতো সাপের বিচরণে অভ্যস্ত ছিলাম না। তাই নানাবাড়ি গেলে খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম। একবার সন্ধ্যারাতে দুটো সাপ গলাগলি করে মূল দরজা দিয়ে বের হচ্ছিল। সাপদের শোঁ শোঁ শব্দে তা টের পাই।এ শব্দ শুনে ছোট মামা বন্দুক বের করলেন। গুলি ছুড়লেন। সাপ দুটি মারা পড়ল। নানা ভাই খুব বিরক্ত হলেন। বললেন, সাপের প্রতি তোদের বন্দুক তাক করা ঠিক হয়নি। আমি নানা ভাইয়ের ভেতর সাপের প্রতি এক দরদী মনের সন্ধান পেয়েছিলাম।
৪. তুমি নেমে এসো: আমি তখন নবম কী দশম শ্রেণির ছাত্র। খুব দুরন্ত শৈশব। পুকুর, গাছ, খাল-বিল দাপিয়ে বেড়ানো স্বভাব। ভাদ্র মাস। গাছে তাল পেকেছে। সমবয়সীরা সবাই বলল, গাছে অনেক পাকা তাল মোচা থেকে ছুটে আটকে আছে। তুমি উঠতে পারলে সেগুলো পাবে। বলা শেষ, আঠার ফিট লম্বা গাছে উঠা শুরু করলাম। কেবল একটা তালপাতার গোড়া হাত দিয়ে ধরেছি দেখি ছোট মার্বেলের মতো চকচকে দুটি চোখ। বিষ্ময়ে আমাকে দেখছে। তালপাতার একটু শব্দ হলো প্রায় সাড়ে তিন হাত দাঁড়াশ সাপ পাশের ছোট্ট একটা তাল গাছে লাফ দিলো। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুরা হৈচৈ শুরু করে দিল। চিৎকার করতে লাগল, তুমি নেমে এসো। সাপের বাচ্চা থাকতে পারে। আমি নামিনি। গাছের মাথায় উঠলাম। আটকে থাকা চার-পাঁচটি তাল ধুপধাপ করে নিচে ফেলে দিলাম।
দাঁড়াশ সাপকে দেখেছি নানাসময়, নানাভাবে। লাজুক প্রকৃতির এক অমায়িক সাপ। মানুষ দেখলেই নিজে থেকে সরে যায়। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল।
নেহায়েত আক্রান্ত বা স্পর্শিত না হলে সাপ কামড় দেয় না। মানুষকে ছেড়ে গেছে অনেক প্রাণী আবার অনেকে মানুষের সঙ্গে রয়ে গেছে; যেমন বিড়াল ও কুকুর। গৃহপালিত হয়ে আছে কবুতর, হাঁস-মুরগি, গরু, ছাগল ও মহিষ। সাপও রয়েছে মানুষের সঙ্গে কখনও কাছে কখনও বা দূরে। বৈচিত্র্যের সঙ্গে বাস করতে হলে পারষ্পরিক সর্তকতা জরুরি, জরুরি পরষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ।