অনেকগুলো সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে দ্রুতগতিতে গ্রিডে যুক্ত করে নেওয়ায় দিনের বেলায় পার পেলেও রাতে এই সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না।
Published : 09 Mar 2023, 02:47 PM
নতুন কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে উৎপন্ন বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতে বিলম্ব হওয়ায় চলতি গ্রীষ্ম ও আসছে বছরগুলোতে রাতের বেলায় লোডশেডিংয়ের উচ্চ ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে ভারত।
দেশটির বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা সীমিত হয়ে আসাও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
অনেকগুলো সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে দ্রুতগতিতে গ্রিডে যুক্ত করে নেওয়ায় দেশটি দিনের বেলার ঘাটতিটুকু পুষিয়ে নিতে পারলেও রাতে এই সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না।
কয়লাচালিত ও জলবিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর সেই ঘাটতি মেটানোর সক্ষমতা না থাকায় শতকোটির বেশি জনসংখ্যার দেশটির কোটি কোটি মানুষ রাতে লম্বা সময়ের জন্য লোডশেডিংয়ের ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে বলে দেশটির সরকারি তথ্য ও অভ্যন্তরীণভাবে পর্যালোচিত নথির বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
এ বছরের এপ্রিলে ‘সৌরবিদ্যুৎহীন সময়ে’ ভারতে বিদ্যুতের প্রাপ্যতা সর্বোচ্চ চাহিদার চেয়ে এক দশমিক ৭ শতাংশ কম হতে পারে বলে দেশটির কেন্দ্রীয় গ্রিড নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের পর্যালোচিত এক অভ্যন্তরীণ নোটে দেখা গেছে।
আসছে এপ্রিলে রাতের বেলায় বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা হতে পারে ২১৭ গিগাওয়াট। গত বছর এপ্রিলে রাতের বেলায় পাওয়া সর্বোচ্চ বিদ্যুতের তুলনায় যা ৬ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি।
“পরিস্থিতি খানিকটা দুশ্চিন্তার,” ৩ ফেব্রুয়ারির এক নোটে এমনটাই বলেছে গ্রিড কন্ট্রোলার অব ইন্ডিয়া লিমিটেড (গ্রিড-ইন্ডিয়া) ।
গ্রীষ্মের গরমকে হারাতে ভারতীয়রা তাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ চাইবেনই, এদিকে রাতের বেলায় বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিলে তা অটো, ইলেকট্রনিকস, স্টিল বার ও সার উৎপাদন কারখানার মতো সারাক্ষণ সচল থাকা শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
“যদি এমনকী এক মিনিটও বিদ্যুৎ না থাকে, কাগজের মণ্ড আটকে যাবে, পুরো প্রক্রিয়াতেই গণ্ডগোল বেঁধে যাবে, ক্ষতি হতে হাজার হাজার রুপি। সামান্য সময়ের বিদ্যুৎ বিভ্রাটও বিপর্যয় সৃষ্টি করবে,” বলেছেন প্রায় তিন দশক ধরে কাগজ উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকা ভারতের কাগজ খাতের সাবেক প্রধান পিজি মুকুন্দন নায়ার।
এবারের গ্রীষ্মে বিদ্যুতের ঘাটতি ধারণার চেয়েও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভারতের আবহাওয়া কার্যালয় মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে দেশটির ওপর দিয়ে একাধিক তাপদাহ বয়ে যেতে পারে বলে পূর্বাভাসে বলেছে; তারও কয়েক সপ্তাহ আগেই গ্রিড-ইন্ডিয়া এবার যে ভালোরকমের বিদ্যুৎ ঘাটতি দেখা যেতে পারে সে ব্যাপারে ধারণা দিয়েছিল।
জরুরি পদক্ষেপ
ভারতের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ সচিব অলোক কুমার অবশ্য তীব্র বিদ্যুৎ ঘাটতির আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, লোডশেডিং এড়াতে ‘সব পদক্ষেপ’ নিয়েছে সরকার।
গ্রিড-ইন্ডিয়ার ওই প্রতিবেদনের পর সরকার লোডশেডিং এড়াতে বেশকিছু কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি অগ্রাধিকার তালিকায় এনেছে এবং গ্যাসচালিত কেন্দ্র থেকে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ নিশ্চিত করেছে বলে অন্য এক সরকারি কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন।
এবারের এপ্রিলে কয়লাচালিত কেন্দ্রগুলো থেকে ১৮৯ দশমিক ২ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার আশা করা হচ্ছে বলে গ্রিড-ইন্ডিয়ার ফেব্রুয়ারির নোটে বলা হয়েছে। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ গত বছর কয়লাচালিত কেন্দ্রগুলো থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ১১ শতাংশের চেয়েও বেশি, বলছে গ্রিড-ইন্ডিয়ার তথ্য থেকে প্রাপ্ত হিসাব।
কয়লা, পারমাণবিক ও গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো একসঙ্গে রাতের সর্বোচ্চ চাহিদার ৮৩ শতাংশের মতো মেটাতে পারবে।
সেক্ষেত্রে জলবিদ্যুৎ হয়ে উঠবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এই বিদ্যুৎকে কেবল চাহিদার বাকি অংশের বেশিরভাগ পূরণ করতে হবে, তা-ই নয়, একে ফ্লেক্সিবল জেনারেটরের ভূমিকাও পালন করতে হবে। কেননা কয়লাচালিত কেন্দ্রগুলো চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন দ্রুত বাড়াতে-কমাতে পারবে না।
তবে গ্রিড-ইন্ডিয়ার হিসাব বলছে, এ বছর এপ্রিলে জলবিদ্যুৎ সর্বোচ্চ যা পাওয়া যাবে, তাও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ শতাংশ কম। সুবিধাজনক আবহাওয়ার কারণে গত বছর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন বেড়ে গিয়েছিল।
“বাড়তি চাহিদার বোঝা টানতে হবে কয়লা আর গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোকেই, যা করতে পারাটা হবে খুব কঠিন,” বলেছেন সিআরআইএসআইএল মার্কেট ইন্টিলিজেন্স অ্যান্ড অ্যানালিটিকসের পরিচালক-গবেষক হেতাল গান্ধী।
দরকার আরও বিদ্যুৎ
রাতের ঘাটতির সঙ্গে দিনের অমিল আকাশ-পাতাল। কার্বন নিঃসরণ কমাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতিশ্রুতির সঙ্গে মিল রেখে গত পাঁচ বছরে সৌরবিদ্যুত প্রায় ৪ গুণ বেড়ে যাওয়ায় দিনে বিদ্যুতের সরবরাহ বেশ বেড়েছে।
গত এপ্রিলেও দিনের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১৮ শতাংশও এসেছে সৌরবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য খাত থেকে।
কিন্তু চাপ বাড়ে সূর্য পড়ে গেলে, কেননা গত ৫ বছরে কয়লাচালিত কেন্দ্রের বিদ্যুৎ বেড়েছে মাত্র ৯ শতাংশ।
গত বছরের এপ্রিলের রাতগুলোতেও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদ্যুৎ চাহিদার ৫ ভাগের একভাগ দিতে পারেনি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো, বলছে ইন্ডিয়ান এনার্জি এক্সচেঞ্জ থেকে পাওয়া তথ্যের বিশ্লেষণ।
বিস্তৃত চাহিদার বিপরীতে সরবরাহের এই ঘাটতি সামনের কয়েক বছর লোডশেডিং এড়াতে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার দিকেই আলোকপাত করছে।
১৬ দশমিক ৮ গিগাওয়াট সক্ষমতার ২৬টি কয়লাচালিত বিদ্যুৎ ইউনিটের নির্মাণে দেরি এরই মধ্যে এক বছর ছাড়িয়ে গেছে বলে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের তথ্যে দেখা যাচ্ছে; কোনো কোনো কেন্দ্রের ক্ষেত্রে এই দেরি ১০ বছরেরও বেশি লাগতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পরিবেশগত বিপর্যয় নিয়ে উদ্বেগ থেকে স্থানীয় পর্যায়ে বিক্ষোভ, ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ নিয়ে নানান আইনি প্রতিবন্ধকতা এবং পর্যাপ্ত শ্রমিক ও সরঞ্জাম না পাওয়ার কারণে এসব প্রকল্পের কাজ থমকে আছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কর্মকর্তারা।
আর বিদেশি বিনিয়োগের ঘাটতি এবং নিরাপত্তা ও পরিবেশগত নানান বিষয়ে সমালোচনার কারণে জলবিদ্যুৎ ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করাও মুশকিল হয়ে পড়ায় কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ সরবরাহ চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন বাড়াতে পারছে না।