Published : 23 Jun 2023, 09:18 AM
বিশেষ করে প্রথমবার মা হওয়ার সময় ভয় এবং সন্তান প্রসবের পরে ব্যস্ততা নারীর শরীরে ও মনে যে চাপ ফেলে, তা থেকে দেখা দিতে পারে বিষণ্ণতা; যার অন্য নাম পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বা পিপিডি।
বন্ধু, সহকর্মী ও পরিবারের আন্তরিকতা তো বটেই, নিজের প্রতি নিজের যত্ন দিয়ে এই মানসিক সমস্যা কাটিয়ে ওঠার পরামর্শ দিলেন কয়েকজন নারী।
নেক্সাস টিভির অনুষ্ঠান লেডিস ক্লাবের এক পর্বে নানা বয়সী ও পেশার প্রতিনিধি এই নারীরা কথা বললেন ’মাতৃত্বকালীন বিষণ্ণতা’ নিয়ে।
তক্ষশিলা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রোখসানা ফেরদৌসী কুইন ৪০ জন নারী সহকর্মী নিয়ে কাজ করেন। কর্মক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা নিয়ে জানতে চান সঞ্চালক নাদিয়া হক।
ফেরদৌসী কুইন বলেন, ”যারা বিবাহিত, তাদের তো মা হওয়ার বিষয় চলে আসে। আর এই সময় চাকরি থেকে কিছুদিনের জন্য যে বিরতি নিতে হয়, তা কিন্তু তাদের জন্য মর্মান্তিক হয়ে ওঠে।
”যখন কেউ এসে বলে, চাকরিটা হয়ত আমি কয়েক মাস কনটিনিউ করতে পারছি না ... তাদের মধ্যে যে বিষণ্ণতা আমি দেখি... সন্তানের জন্য ক্যারিয়ারে এই ত্যাগ তাদের করতে হচ্ছে।”
অনেকের বেলাতে দ্বিতীয় সন্তান হওয়ার পর প্রথম সন্তানের প্রতি মনোযোগ কমে আসার মত পরিস্থিতি দেখা দেয় বলেও জানান এই শিক্ষক।
”হুট করে দেখা যায় কোনো ক্লাসের কোনো শিশু একটু অমনোযোগী হয়ে যায়, উগ্র আচরণ করে; তখন আমরা অভিভাবকদের ডাকি। আলোচনায় দেখা যায় যে পরিবারে দ্বিতীয় সন্তান এসেছে।”
”মা দ্বিতীয় সন্তানকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবার ফলে মায়ের আদর থেকে প্রথম সন্তান বঞ্চিত হচ্ছে।”
রোখসানা ফেরদৌসী কুইনের অভিজ্ঞতা বলছে, এ ধরনের ঘটনায় মা নিজেকেই ‘দোষী’ মনে করেন।
”তারা ভাবে ও বলে, আমি হয়ত ব্যর্থ মা। সন্তানের আচরণের জন্য আমি দায়ী। একজন মা নিজেকে দোষী ও ব্যর্থ ভাবছেন, এমন আসলে মায়ের জন্য নেগেটিভ আবেগ। এই ব্যর্থতার দায়ভার মায়ের না। কিন্তু মা ভেবে নিচ্ছেন।”
আর এই পরিস্থিতিতেও একজন মা বিষণ্ণতায় ভুগতে পারেন।
রোখসানা ফেরদৌসী কুইন বলেন, ”ছয়-সাত মাস বা বছর পেরিয়েও অনেক সময় এই সমস্যা সেরে যায় না।
”… এতে মায়ের স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে। তখন সন্তানের স্বাস্থ্যও খারাপ হতে বাধ্য।”
কর্মজীবী নারীর মা হওয়ার মুহূর্তকে ’অম্লমধুর’ হিসেবে বর্ণনা করেন সৈয়দা নাজমা পারভীন পাপড়ি।
বিজএইড লিমিটেডের চেয়ারম্যান পাপড়ি অনুষ্ঠানে বলেন, ”এ সময় একদিকে আনন্দ, একদিকে ভীতি কাজ করে।”
এক ছেলে ও এক মেয়ের মা পাপড়ির গর্ভে ছিল যমজ সন্তান। তিনি বলেন, যমজ বাচ্চা হবে এই খবর জানা তার জন্য ’শকিং’ ছিল।
”আমি তো আতঙ্কিত হয়ে গেলাম। আমি ছোটখাটো একটা মানুষ। টুইন বেবি আমার পেটে বড় হবে, আমি তো আর বাঁচব না...ওজনটা নিতে পারব কি না..। আমি ভয়ঙ্কর কান্নাকাটি শুরু করলাম।”
সঞ্চালক নাদিয়া হক বলেন, ”অনেক মাকেই দেখেছি তারা মনে করেন, ‘এই যে হাসপাতালে যাবো আর তো ফিরে আসব না...’।”
গর্ভকালের সেই ভয় কি কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন সৈয়দা নাজমা পারভীন পাপড়ি?
দীর্ঘদিন ব্যাংকার পেশায় কাজ করা এই নারী বলেন, ”এই যাত্রা খুব সহজ ছিল তাও না। আমার কিছু শারীরিক জটিলতা ছিল।
”তখন আমি ব্যাংকে চাকরি করি। এটা ছিল আমার জন্য টাফ ব্যাপার। বাচ্চা পেটে যখন পাঁচ মাস, আমাকে দেখলে মনে হত তখনই ডেলিভারির সময় হয়ে গেছে।”
ওই সময় সহকর্মীদের সহযোগিতার কারণে নিজেকে সামলে নিতে পেরেছিলেন বলে জানান তিনি।
জাকিয়া সুলতানার প্রযোজনায় ওই লাইভ অনুষ্ঠানে বাইরে থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমেও যোগ দেন অনেকে; তাদের একজন সাজিয়া আরিফ।
গর্ভকালে নিজের মানসিক দশা নিয়ে তিনি বলেন, ”১০ মাসের সময় মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকত।
”কেউ ভালো কথা বললেও ভালো লাগত না। ঘরে অনেক বাসন ভেঙেছি।"
ওই সময় বাড়িতে রাগারাগি করার কথাও বলেন তিনি।
কম বয়সে বিয়ে হয় তাহমিনা সুলতানা রিক্তার।
তিনি বলেন, “তখন কিছু বুঝতাম না। বাচ্চা (পেটে) নিয়ে আমি ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছি।
”মাতৃত্বকালীন সময়টা আমি অনেক অসুস্থ ছিলাম। হাসপাতালে স্যালাইনের উপর ছিলাম আমি। আমি এক গ্লাস পানিও খেতে পারতাম না। কেউ আমার সামনে থাকলে আমি অস্বস্তি বোধ করতাম।”
প্রসব বেদনা নিয়ে তিনদিন পার করে সন্তান প্রসব করতে হয়েছিল বলে জানান এই নারী।
সন্তান সামলাতে গিয়ে নিজের যত্ন আর নেওয়া হচ্ছিল না ইশরাত জাহানের। নিজের মনেরও পরিবর্তন ঘটছিল তার।
সেসব নিয়ে তিনি বলেন, ”দুই বেবি হওয়ার পরেই আমি সাফার করলাম। বেবি হওয়ার পরে ওকে নিয়েই সবাই কনসার্ন থাকে। আমার দিকে খুব একটা মনোযোগ নেই কারো। তখন মেজাজটা খারাপ হয়।
”প্রথম সন্তান হওয়ার পরে এক বছরের মাথায় দ্বিতীয় সন্তান হওয়াতে একটু ভুক্তভুগীও বটে। মনে হত, বাচ্চা রেখে যদি একটু কোথাও যেতে পারতাম। একটু যদি সময়মত গোসলটা নিতে পারতাম।”
”কাউকে ভালো লাগত না। মনে হত বেবিটা আমার, আমার কাছেই থাকুক। আর কাউকে দেখতে চাই না। এটা করতে গিয়ে আমার হঠাৎ করে উপলব্ধি হল, আমি তো ঘরকুনো হয়ে গেলাম। আমি তো কারো সাথে ঠিক মত কথা বলছি না। ভালো কাপড় পরছি না।”
কিন্তু এই বিষণ্নতা কেন জাঁকিয়ে বসে?
তক্ষশিলা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কুইন বলেন, ”আমাদের যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে এখন একক পরিবার হয়ে যাচ্ছে। একজন মা যখন কনসিভ করছেন তাকে চব্বিশ ঘণ্টা দেখার মত কেউ নেই। সন্তান যখন পৃথিবীতে আসছে, পুরোটা সময় তার সন্তানকে দিতে হচ্ছে।
”একটা কাজে আমরা যদি বিশ্রাম না নেই, কাজটা কিন্তু অনেক টায়ারিং হয়ে যায়। সর্বক্ষণ আমার সন্তান কাঁদছে কি না, গোসলে গেলেও চিন্তা করছি, দুমিনিটের জন্য ওয়াশরুমে গেলেও চিন্তা করছি, রাতে ঘুমাতে গেলেও... আমার সন্তান কি কেঁদে উঠল? এই বিষয়টা কিন্তু পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের অন্যতম কারণ।”
বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করে চিকিৎসক মমতাজ রহমান বলেন, শরীরে হরমোনজনিত পরিবর্তন আসার কারণেই নারীর মনমেজাজে ওই বদল দেখা দেয়।
তিনি বলেন, ”গর্ভকালে মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। তাই কিছু হরমোন বাড়ে, কিছু হরমোন কমে।
”দেখা যায় মেয়েরা স্বামীর অনেক কথাকেও ভালোভাবে নিতে পারে না; এ ধরনের মানসিক বদলও হয়ে থাকে। আবার বাচ্চা হওয়ার পরেও এসব সাইকোলজিকাল চেইঞ্জ আসে।”
মায়ের মনে তৈরি হওয়া ’ভয়’ থেকেই গর্ভকালীন বিষণ্নতা হয় বলে মনে করেন শাহিন সুলতানা।
গর্ভে সন্তান আসার পর বিশেষ করে নতুন মায়ের ভাবনা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি কি পারব নয় মাস বাচ্চা পেটে বহন করতে? আমি কি পারব সুস্থ থাকতে? আমি কি পারব একটা সুস্থ বাচ্চা জন্ম দিতে?
”এসব চিন্তা নানা ভাবে একজন মাকে আঁকড়ে ধরে। এই চিন্তা করতে করতে তখন মা বিষণ্নতার দিকে চলে যায়।”
মাতৃত্বকালীন বিষণ্নতা কাটিয়ে ওঠার উপায় নিয়েও আলাপ হয় অনুষ্ঠানে।
সৈয়দা নাজমা পারভীন পাপড়ি বলেন, ”যারা চাকরি করেন তাদের সহকর্মীদের, আশেপাশে সবার ভালোবাসা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা অত্যন্ত দরকার।
”তবে আমার যত্ন আমাকে করতে হবে, এই সচেতনতা আমার মধ্যে আসতে হবে। যারা মা হতে যাচ্ছেন, তাদের প্রথমে নিজেকে সাহসী হতে হবে। নিজেকে নিজের মানসিক ও দৈহিক যত্ন নিতে হবে।”
শারীরিক ও মানসিক – এই দুই ধরনের যত্নে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ রেখে তিনি বলেন, ”কষ্ট হলেও যত্ন করতে হবে। খেতে ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে। মানসিকভাবে সাহসী হতে হবে। নিজেকে প্রচুর ভালোবাসতে হবে।”
উন্নত দেশে গর্ভকালীন যত্ন নিয়ে কর্মশালার সুবিধা রয়েছে বলেও আলাপ করেন এই নারীরা। বাংলাদেশেও এ ধরনের প্রশিক্ষণ চালু করার পরামর্শ দেন ইশরাত জাহান।
তিনি বলেন, ”যেমন আমি তো আমার বেবির সঙ্গেই শাওয়ার নিতে পারি। কেন আমি বসে বসে মন খারাপ করছি?”
ইশরাত জাহানের মত শাহিন সুলতানাও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ জরুরি বলে মনে করেন।
সবার সচেতন হয়ে ওঠা জরুরি বোঝাতে গিয়ে রোখসানা ফেরদৌসী কুইন বলেন, ”তিন-চার বছর আগেও পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন টার্মটাই কেউ জানত না।
”এখন আমরা জানছি। স্টাডি করছি। এই বিষয়টা ভবিষ্যতে যাতে আমাদের না ভোগায় সেজন্য আমরা সচেতন।”
আর নারীর গর্ভকালীন বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে পুরুষদের কাছে চিকিৎসক মমতাজ রহমানের প্রত্যাশা, ”নারীদের উৎসাহ দেবেন এই সময়ে।”