পুনর্ব্যবহারযোগ্য স্যানিটারি প্যাড: স্বস্তিকার ভিডিও উসকে দিল বিতর্ক

স্বস্তিকা বলছিলেন হাতে বানানো সুতি কাপড়ের স্যানিটারি ন্যাপকিনের সুবিধার কথা। কিন্তু অনুসারীদের মন্তব্যে এল সম্ভাব্য সমস্যার কথাও।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Nov 2022, 12:59 PM
Updated : 15 Nov 2022, 12:59 PM

কাপড়ের বানানো বারবার ব্যবহার উপযোগী স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রচারে সোশাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও পোস্ট করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন টালিগঞ্জের অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখার্জি।

কলকাতার একটি এনজিওর পক্ষে ওই ভিডিওতে তিনি হাজির হয়েছেন গ্রামীণ নারীর মাসিকস্বাস্থ্য সচেতনার বার্তা নিয়ে। কিন্তু অনুসারীদের মন্তব্যে দেখা গেছে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

এপার-ওপার বাংলা থেকে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন– এই সময়ের ব্যস্ত জীবনে স্যানিটারি ন্যাপকিন ধুয়ে-শুকিয়ে আবার ব্যবহার করার সময় কি নারীর আদৌ আছে?

এক সময় মাসিকের দিনে ঘরের পুরনো কাপড় ব্যবহার করতেন নারীরা, গ্রামের বা দরিদ্র পরিবারের অনেক নারী এখনও তাই করেন। কিন্তু তাতে যে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে, সেই একই ঝুঁকি অনেকে দেখছেন স্বস্তিকার প্রচার করা স্যানিটারি ন্যাপকিনে।

এক মিনিট ২২ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে আকাশি রঙের জামা পরে বাগানে বসেছিলেন স্বস্তিকা। বলছিলেন গ্রামাঞ্চলের নারীদের হাতে বানানো সুতি কাপড়ের স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে।

ফুল ছাপা পাতলা একটি রঙিন ন্যাপকিন হাতে ধরে দেখিয়ে স্বস্তিকা বলেন, “এই স্যানিটারি ন্যাপকিন বারবার পরা যায়। এটি সুতি কাপড় দিয়ে বানানো, তাই র‌্যাশ বা ইরিটেশনের কোনো সম্ভাবনা নেই। এটি একেবারেই পরিবেশ-বান্ধব।”

আনাহাত ফর চেইঞ্জ ফাউন্ডেশন ‘উন্নতি‘ নামের ওই স্যানিটারি প্যাড তৈরি করেছে। তাদের একটি ‘ইউজার ম্যানুয়াল’ দেখিয়ে স্বস্তিকা বলেন, এই স্যানিটারি ন্যাপকিন ধুয়ে ও শুকিয়ে আবারও মাসিকের দিকে পরা যাবে এবং এভাবে তিন-চার বছরও ব্যবহার করা যাবে।

কিন্তু পায়েল ব্যানার্জির ওই সোশাল পোস্টে মন্তব্য করেছেন: ”সেই তো ঘুরেফিরে কাপড় ব্যবহার করার মতনই হয়ে গেল।”

কর্মজীবী নারীর কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি লিখেছেন, “সুতির কাপড়ের বেশিক্ষণ শোষণ ক্ষমতা থাকে না এবং সেটি আবার ভালো করে ধুয়ে দ্বিতীয়বার ব্যবহার করাটা আমার মনে হয় না খুব একটা ভালো। এটা কোনোভাবেই ১০০% জীবাণুমুক্ত করা যায় না।

“আর তার থেকেও বেশি হচ্ছে, যাদের অনেক বেশি ফ্লো, তারা তো বেশিক্ষণ ব্যবহারই করতে পারবে না অথবা যারা অফিসে যায়, বাইরে যাচ্ছে, কলেজে যাচ্ছে, স্কুলে যাচ্ছে, তারা তখন কী করবে? কোথায় বা ধোবে আর কোথায় বা শুকাবে?”

শতরূপা ভৌমিকও লিখেছেন, নারীর ব্যস্তজীবনে এ ধরনের স্যানিটারি ন্যাপকিন ‘মোটেও সুবিধাজনক নয়’।

“আমাদের তো ভীষণ ব্যস্ত দিন যায়। এর মধ্যে ধোয়া ও শুকানোর কাজ সম্ভব নয়। তাছাড়া বারবার একই প্যাড পরা... আমি নিশ্চিত এটি স্বাস্থ্যকর নয়... আমার এটি মোটেও ভালো লাগেনি।”

এ ধরনের স্যানিটারি ন্যাপকিনকে ‘পুরোপুরি অস্বাস্থ্যকর’ বলে ভিডিও পোস্টে মন্তব্য করেছেন অঙ্কিতা চ্যাটার্জি।

তিনি লিখেছেন, “এটি খুবই ভুল বার্তা দিচ্ছে মানুষকে। এভাবে একই প্যাড বারবার পরার কথা বলে আমাদের নারীমৃত্যুর হারকে আরও বাড়িয়ে তোলার প্রচারণা করা ঠিক হবে না। এসবে ইউটিআই (ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন) এবং ডেডলি শক হতে পারে।”

স্বস্তিকা মুখার্জির এই ভিডিওটি দেখা হয়েছে পাঁচ লাখ বারের বেশি। তারপরও তাকে এ ধরনের প্রচারে না জড়াতে পরামর্শ দিয়েছেন উসসশ্রী দাস।

তিনি লিখেছেন, “ম্যাম, আপনি অনেক ভালো মানুষ। কিন্তু আমার মনে হয় এটা অনেক অস্বাস্থ্যকর। প্রতিদিন ধোয়ার জামাকাপড় আলাদা আর প্যাড অনেক আলাদা।... তাই প্লিজ এইসব বিজ্ঞাপন করে মহিলাদের ভয়াবহ রোগের দিকে ঠেলে দেবেন না।”

স্বস্তিকার আরেক অনুসারী গার্গি দত্ত লিখেছেন, “তোমার সব ভালো লাগে দিদি। কিন্তু এটা মানতে পারলাম না। সেই তো তাহলে আমরা কাপড়ে ফিরে যাচ্ছি আর তার সাথে কাপড় ব্যবহার করার ক্ষতিকর দিক।” 

পাতলা ওই কাপড়ের ন্যাপকিন নিয়ে রিমা দাসের মন্তব্য, এতে জামায় দাগ লেগে যাবে।

“যাদের অতিরিক্ত রক্তপাত হয়, তাদের বেলায় ১০ মিনিটেই লিকেজ হওয়ার সম্ভবনা এক হাজার শতাংশ।”

ধুয়ে বারবার পরার উপযোগী বলা হলেও তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সুদিপ্তা চৌধুরী। তিনি লিখেছেন, “আমার একটাই প্রশ্ন, মেলে শুকাব কোথায়?”

খায়রুন নাহাব শারমিন এই উদ্যোগকে ‘খুব ভালো’ বললেও তার অভিমত, “এটা মেইনটেইন করা অনেক কঠিন। ক্লিন করতে হবে ভালোভাবে, রোদে দিতে হবে। সব মিলিয়ে কঠিন ব্যবহার নিয়ম।”

স্বস্তিকা মুখার্জির ভিডিও পোস্টের ক্যাপশনে গ্রামাঞ্চলের নারীর উন্নত জীবন যাপনে সবাইকে অবদান রাখার আহ্বান রয়েছে।

তবে খায়রুন নাহাব শারমিন মনে করেন, ”এমনেই গ্রামের মহিলা যারা কাপড় ব্যবহার করে তারা আন-হাইজেনিকভাবে ব্যবহার করে কাপড়। সরাসরি রোদেও দেয় না। লুকিয়ে শুকাতে দেয়। সেখানে কাপড়ের প্যাড তো সরাসরি রোদে শুকাতে দেবে না।

“তবে নিয়ম মেনে ব্যবহার করতে পারলে খারাপ না। বিশেষ করে পিরিয়ডের শেষের দিকে এই কাপড়ের প্যাড ব্যবহার করা যায়। এতে করে বাজারের প্যাডের খরচ কমিয়ে আনা যাবে।”

স্বস্তিকা মুখার্জির হাতে যে হালকা পাতলা কাপড়ের স্যানিটারি ন্যাপকিন দেখা যাচ্ছিল, তা আসলে ‘লাইট প্যাড’। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন আনাহাত ফর চেইঞ্জ ফাইন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালক পুরভি তানওয়ানি।   

তিনি বলেন, মাসিকের দিনে যাদের স্রাব কম হয়, এ ধরনের প্যাড তাদের উপযোগী; যাদের বেশি স্রাব হয়, তাদের জন্য আলাদা প্যাড রয়েছে।

তাদের ওয়েবসাইটে লাইট প্যাডের পাশাপাশি একই ধরনের কিন্তু আকারে বড় ‘হেভি প্যাড’ দেখা যায়।  

কাপড়ের এই স্যানিটারি ন্যাপকিনের কারণে জামায় দাগ লেগে যাওয়ার শঙ্কাও ‘ঠিক নয়’ জানিয়ে প্যাডের স্তরগুলো নিয়েও বিস্তারিত বললেন পুরভি।

“এই প্যাডগুলো শতভাগ সুতি কাপড় দিয়ে বানানো। প্রথম স্তরে সুতি থাকে। দ্বিতীয় স্তরে থাকে ফ্লানেল। তৃতীয় স্তরে থাকে লিক প্রুফ ফ্যাব্রিক পিইউএল; যাকে পলিইউরেথ্রিন ল্যামিনেট ফেব্রিক বলে।”

পুরভি তানওয়ানি বলেন, “মাসিক পণ্যের জন্য নির্ধারিত ভারতীয় স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিংয়ের মধ্যে দিয়ে গেছে আমাদের এই প্যাডগুলো; প্যাথোজেন ও ফ্লানেলের শোষণ ক্ষমতা এবং কাপড়ের দীর্ঘ মেয়াদের উপযোগিতা, একই সাথে প্যাড ধোয়ার সময় কতটা রক্ত বেরিয়ে আসে এসব পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে।”

তবে ‘রিইউজেবল’ স্যানিটারি ন্যাপকিনের জন্য ভারতে সরকার ঘোষিত নির্ধারিত মানদণ্ড এখনও নেই। সেজন্য বিকল্প হিসেবে মাসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুসরণ করা হয় বলে পুরভি জানালেন।

কিন্তু স্যানিটারি ন্যাপকিন ধোয়ার মত সময় কর্মজীবী নারীর আছে? পুরভি তানওয়ানি বললেন, পাঁচ থেকে সাত মিনিট ব্যয় করেই একেকটি ন্যাপকিন ধোয়া সম্ভব।

“ব্যবহার করার পরপরই প্যাড ধুয়ে ফেলা ভালো। সাধারণ তাপমাত্রার পানিতে ব্যবহার করা প্যাড ভিজিয়ে নিতে হবে কিছুক্ষণ। এতে করে প্যাডে লাগা রক্ত বেরিয়ে আসবে। এরপর সাবানে ধুয়ে নিতে হবে। সেজন্য হাত ব্যবহার করা যেতে পারে, অথবা নরম কোনো ব্রাশ।” 

তিনি বলেন, এই স্যানিটারি ন্যাপকিন গরম পানি দিয়ে একেবারেই ধোয়া যাবে না; এতে রক্ত স্যানিটারি ন্যাপকিনের ভেতরে জমাট হয়ে থাকার সম্ভাবনা থাকে, যা থেকে সংক্রমণ হতে পারে।     

গ্রামের নারীরা মাসিকের কাপড় ভালো করে ধুয়ে নেন না, খোলা জায়গায় রোদে শুকাতেও লজ্জা পান। তাই আনাহাতের প্যাড বিতরণের সময় জানিয়ে দেওয়া হয়, প্রতিবার ধোয়া ন্যাপকিন অবশ্যই সরাসরি সূর্যের আলোতে পুরোপুরি শুকিয়ে নিতে হবে।

“এই বিশেষ ধরনের স্যানিটারি ন্যাপকিন শুধু গ্রামের নারীর জন্য নয়, সবার জন্যই বানানো হয়েছে,” বললেন আনাহাতের সহ-প্রতিষ্ঠাতা পুরভি তানওয়ানি। 

তিনি বললেন, পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলার নারীরা এ কাজে যুক্ত। দার্জিলিং জেলায় দুটি চা বাগানের নারী কর্মীরা বিকল্প জীবিকা হিসেবে বানাচ্ছেন এ ধরনের ন্যাপকিন। সবার কাছে পৌঁছাতে এই ন্যাপকিন আনাহাতের ওয়েবসাইটের পাশাপাশি অ্যামাজন ও ফ্লিপকার্টে বিক্রি হচ্ছে। নারী বিক্রয়কর্মীরা পৌঁছে দিচ্ছেন গ্রামে।

পুরভি তানওয়ানি বলেন, “গ্রামে সচেতনতামূলক কার্যক্রমও নেওয়া হয়। বিভিন্ন ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে গ্রামের স্কুল-কলেজ ও এলাকায় প্যাড বিতরণ করা হয়।”