ট্রেনের ফার্স্ট এইড বাক্সে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা নিয়ে মোরশেদুল হকের লাগাতার নানা প্রচেষ্টা রেল কর্তৃপক্ষের নজর কাড়তে ভূমিকা রেখেছে।
Published : 10 Nov 2022, 12:04 PM
ট্রেন যাত্রায় হঠাৎ মাসিকের রক্তপাত শুরু হওয়াতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন এক নারী। আর তা বুঝতে পেরে অপর এক নারী যাত্রী ও ট্রেন পরিচালকের সহায়তায় স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করে দিতে এগিয়ে আসেন ওই ট্রেনেরই এক পুরুষ যাত্রী।
বিশেষ এই দিনগুলোতে ট্রেন যাত্রায় বিব্রত না হতে নারীর জন্য মোরশেদুল হক নামের এই পুরুষ এরপর প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়েছেন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে; ট্রেনেও।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে তার দাবি ছিল, দেশের আন্তঃনগর সব ট্রেনে রেলের নিজস্ব ব্যবস্থাপনাতেই যেন স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা হয়।
এই মানবিক উদ্যোগে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
সোমবার বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিম অঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদারের সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ট্রেনে স্যানিটারি ন্যাপকিন সুবিধা চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এতে বলা হয়, এখন থেকে পশ্চিমাঞ্চলে চলাচল করা সব ট্রেনের ফার্স্ট এইড বাক্সে কমপক্ষে দুটি স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা হবে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের এই নির্দেশনায় বিষয়টিকে ‘জরুরি বিবেচনা’ করতেও বলা হয়।
যার কারণে ট্রেনে নারীর বিশেষ মুহূর্তের জন্য এই বিশেষ সুবিধা যোগ হলো সেই মোরশেদুল হক রংপুরের বদরগঞ্জ এলাকার একজন উন্নয়নকর্মী।
গত ২৪ অক্টোবর ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে ফ্যান গ্রুপ’ নামে ফেইসবুক গ্রুপে ও নিজের প্রোফাইলে তিনি একটি পোস্ট দেন। এতে এক নারীর ট্রেনে হঠাৎ মাসিক শুরু হলে তা নিয়ে বিব্রত হওয়ার অভিজ্ঞতার কথা পোস্ট করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
ফেইসবুকে এই পোস্ট প্রকাশের আগের দিন তিনি প্রথম শ্রেণির যাত্রী হিসেবে ঢাকা থেকে পঞ্চগড়গামী একটি ট্রেনে ভ্রমণ করছিলেন। তার পাশে ছিলেন একজন নারী সহযাত্রী।
এক পর্যায়ে নারীকে দেখে ’আনইজি’ ও ’গম্ভীর’ মনে হয় তার। অপরিচিত ওই নারীকে ফোনে কথা বলার সময় কাঁদতেও দেখেন তিনি।
তখন ট্রেনে আরেক নারী যাত্রীর সহায়তা নিয়ে জানা যায় ওই নারীর মাসিকের দিন শুরু হয়েছে; কিন্তু তার কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না।
মোরশেদুল হকের কাছে মনে হয়, ওই নারী ‘মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন’।
ফেইসবুকে দেওয়া পোস্টে মোরশেদুল হক লিখেছেন, ”চলন্ত ট্রেনে দ্বায়িত্বরত টিটিই ও আরো দুই-একজনের সাথে কথা বলে জানলাম ট্রেনে স্যানিটারি ন্যাপকিনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব খোঁজ খবর নিতে নিতে সেতুর পূর্ব পার্শ্বে এসে ট্রেন দাঁড়াল। ট্রেন থামার সাথে সাথে দৌড়ে গিয়ে ট্রেন পরিচালকের কাছে গিয়ে খোঁজ নিলাম এখানে ট্রেন কতক্ষণ দাঁড়াবে। বললেন, ২০ মিনিট দাঁড়াবে।
”পরিচালক সাহেবের সাথে বিস্তারিত শেয়ার করলাম। ভদ্রলোক অভয় দিলেন এবং বললেন, যতক্ষণ আপনার কাজ হবে না ততক্ষণ ট্রেন ছাড়ব না। স্টেশনের অদূরে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে এসে ওই আপাকে সহ ট্রেন থেকে নামিয়ে স্টেশনের ভিতরে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলাম।”
ট্রেনের গার্ড রুমে সংরক্ষিত বইয়ে এই অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করার ইচ্ছে ছিল মোরশেদুল হকের। তবে শেষ পর্যন্ত লিখিত অভিযোগ করতে পারেননি তিনি।
এ নিয়ে মোরশেদুল হক লিখেছেন, ” ...গার্ড মহোদয় একটু গড়িমসি শুরু করলেন ও শেষমেশ আমারও জার্নি শেষ হলো। অভিযোগটা আর লেখা হলো না।”
তবে পরদিন এই অভিজ্ঞতাই ফেইসবুকে লিখে পোস্ট করেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে এখানেই থেমে না গিয়ে ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক বরাবর ডাকযোগে একটি চিঠিও পাঠান মোরশেদুল হক।
ট্রেনে নারী যাত্রীরা যাতে স্যানিটারি ন্যাপকিন পায় তা নিয়ে রেলওয়ে পশ্চিমের মহাব্যবস্থাপকের কাছেও একটি ইমেইল করেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মোরশেদুল হক বলেন, মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে প্ল্যাকার্ড নিয়েও দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।
হাল না ছাড়া মোরশেদুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি উদ্যোগটি নিয়েছিলাম কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য।
”ট্রেনের দীর্ঘ যাত্রাপথে অনেক মা-বোনই এই সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হন। এগুলো নিয়ে কেউ কথা বলে না, ভাবে বিষয়টি লজ্জার।”
ওই ঘটনার পর ২৮ অক্টোবর থেকে নিজ উদ্যোগে শুরু করেন দূরপাল্লার ট্রেনে বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ। বেসরকারি সংস্থায় কাজ করা মোরশেদুল হক নিজ খরচে ছুটির দিনে এই কাজ করতেন।
পার্বতীপুর রেলওয়ে জংশন থেকে তার এই উদ্যোগ শুরু হয়।
সেখান থেকে ছেড়ে যাওয়া আন্তঃনগর ট্রেন পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, রূপসা এক্সপ্রেস এবং দ্রুতযান এক্সপ্রেসের ফাস্ট এইড বাক্সে ৪০টি বেল্ট যুক্ত স্যানেটারি ন্যাপকিন বিতরণ করেন।
রেলওয়ে পশ্চিমের মহাব্যবস্থাপক ও চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজারের সহযোগিতায় গত ৪ নভেম্বর রাজশাহী থেকে ছেড়ে যাওয়া সব আন্তঃনগর ট্রেনে আটটি স্যানেটারি ন্যাপকিন বিতরণ করেন; সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনও করেন তিনি।
এই কাজে আরো অনেকে যুক্ত হতে শুরু করলে, সচেতনতামূলক বার্তা লেখা স্টিকার ছাপিয়ে নেন মোরশেদুল হক।
স্টিকারে লেখা রয়েছে, “ট্রেনে ভ্রমণকালে মা-বোনদের পিরিয়ড সমস্যা হলে, প্রয়োজনীয় উপকরণ (স্যানিটারি ন্যাপকিন) পেতে ট্রেন পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করুন।”
এই স্টিকার পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন ট্রেনের গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হয় যাত্রীদের জানার সুবিধার্তে।
৩৫ বছর বয়সী মোরশেদুল হকের এক ছেলে এবং এক মেয়ে আছে। তিনি ছাড়াও তার আরও দুই বোন আছেন।
পুরুষ হয়েও মাসিক নিয়ে কথা বলতে কোনো দ্বিধা কাজ করেনি তার মধ্যে।
মোরশেদুল হক বলেন, “আমার নিজের মেয়ে আছে, দুই বোন আছে। পিরিয়ড সংক্রান্ত বিষয়টি মোটেও আমার কাছে সংকোচের না।
”বরং নারীদের স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এই বিষয় নিয়ে সচেতনতা এবং আলোচনা জরুরি বলে আমি মনে করি।”
যাত্রাপথে নারীর মাসিকে স্যানিটারি ন্যাপকিন সুবিধার জন্য একজন পুরুষ হয়ে সরব হওয়া কি সহজ ছিল?
শুরুতে ’প্রচুর মানুষ হাসাহাসি করেছে’ বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন মোরশেদুল হক।
”অনেকে ফোন দিয়েও বলেছে এসব তুমি কী করছো? এগুলো লজ্জার বিষয়। অনেকেই বলছে আমি নাকি পাগল হয়ে গেছি।”
এরপরও এই কাজ থেকে সরে যাননি তিনি। এক পর্যায়ে মানুষের সাড়া পেতে শুরু করেন। আর পরিবারের প্রত্যেকেও এ কাজে তাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।
”এতো নেতিবাচকতার পরেও অনেকেই আমার এই উদ্যোগ নিয়ে প্রশংসা করেছেন”, বললেন মোরশেদুল হক।
বিশেষ করে নারী যাত্রীরা যে তার উদ্যোগকে ’অনেক ইতিবাচকভাবে দেখেছেন’ তা জানালেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।
তিনি বলেন, “রাজশাহী স্টেশনে যখন প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখানকার প্রত্যেকেই আমার সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন।
”এমনকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের একজন শিক্ষকও আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।”
মোরশেদুল হকের উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়ে ফেইসবুকে কামাল হোসেন লেখেন, ”ট্রেনে বিভিন্ন রকমের খাবারসহ অনেক কিছুই যখন সহজেই পাওয়া যায়, তবে জরুরি মুহূর্তে মহিলাদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা কেন থাকবে না? এটাও তো প্রয়োজন।”
মোরশেদুল হকের লাগাতার নানা প্রচেষ্টা রেল কর্তৃপক্ষের নজর কাড়তে ভূমিকা রেখেছে বলে জানালেন বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার।
গত ১ নভেম্বর রেলওয়ে অংশীজনের সভায় ট্রেনে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখার বিষয়ে আলোচনা হয়। পরে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল ট্রেনে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখার ঘোষণা দেয়।
অসীম কুমার তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রংপুরের বদরগঞ্জের উন্নয়নকর্মী মোরশেদুল হকের উদ্যোগের পর বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। এটি নিঃসন্দেহে একটি মহৎ উদ্যোগ।
”তার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েই দূরপাল্লার ট্রেনে নারী যাত্রীদের সুবিধার জন্য রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণের ব্যবস্থা করেছে।”
নারীর জরুরি মুহূর্তে ব্যবহারের জন্য ট্রেনের ফার্স্ট এইড বাক্সে দুই পিস করে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা হবে এখন থেকে; যা বিনামূল্যে নেওয়া যাবে।
এছাড়াও প্রত্যেকটি ট্রেনে ক্যাটারার সার্ভিসে বিক্রির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে স্যানিটারি ন্যাপকিন থাকবে।
”ট্রেনে ক্যাটারার সার্ভিসের প্রতিটি ন্যাপকিন বাজার মূল্যের সমপরিমাণ দাম দিয়েই কিনতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতি পিসের দাম পড়বে ১০ থেকে ১৫ টাকা”, বলেন রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার।
ট্রেনের টয়লেটে ব্যবহার করা স্যানিটারি ন্যাপকিন ফেলার ব্যবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের এই কর্মকর্তা বিষয়টি আমলে নিয়ে ’ভালো কথা’ বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যবহৃত ন্যাপকিন মুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলার জন্য প্রত্যেকটি ন্যাপকিনের সাথে একটি করে পলি ব্যাগ দেওয়া জরুরি। শিগগিরই সেটি আমরা তাদের জানিয়ে দেব।”
নারী যাত্রীরা ব্যবহার করা স্যানিটারি ন্যাপকিন সেই পলিথিনে মুড়িয়ে ট্রেনের টয়লেটের ট্র্যাশবাক্সে ফেলতে পারবেন।
ট্রেনে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখার রেলওয়ের নতুন এই নির্দেশনা শুধু পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেনের জন্যই নয়।
বরং রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ট্রেনেও নারী যাত্রীদের জন্য এই সুবিধা চালু করা হবে বলে জানালেন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেন ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পূর্বাঞ্চলের ট্রেনেও স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
”সিদ্ধান্তটি নীতিগতভাবে নেওয়া হয়েছে। তবে পুরো প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে আর কিছুদিন সময় লাগতে পারে।”