বিষাক্ত সম্পর্কের লক্ষণ

স্বাভাবিক ঝগড়া আর অস্বাস্থ্যকর বিবাদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 August 2022, 07:49 AM
Updated : 1 August 2022, 07:49 AM

সঙ্গীর আচরণ যদি সাপের মতো হয়, তবে সেই সম্পর্ক দুধ কলা দিয়ে না পোষাই হবে মঙ্গলজনক।

যে কোনো সম্পর্কে দুই পক্ষের সমর্থন, সম্মান দেওয়া, একে অপরের অনুভূতি ও ইচ্ছার প্রাধান্য দেওয়ার মতো বিষয়গুলো সুস্থ সম্পর্কের নির্দেশ করে। তবে বেশিরভাগ সময় যদি এই ধরনের বিষয়গুলো এক পক্ষ থেকে হয় তবে সেটা অস্বাস্থ্যকর।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারপার্সোনাল কমিউনিকেইশন অ্যান্ড রিলেশনশিপ’ বিশেষজ্ঞ ডেব্রা রবার্টস রিয়েলসিম্পল ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেন, “অতিমাত্রায় অস্বাস্থ্যকর সম্পর্ক অবশ্যই বিষাক্ত।”

সম্পর্ক কি বিষাক্ত?

সঙ্গীর সঙ্গে থাকলে কী রকম বোধ করেন? সঙ্গী কি জীবনে নাটকীয়তা তৈরি করছে? আপনার কথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অন্য অর্থ করে ঝগড়া করে?

প্রশ্নগুলোর উত্তর অন্যর দিতে পারবে না, বরং নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তরগুলো পেয়ে যাবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘কমিউনিকেইশন অ্যান্ড বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’ বিশেষজ্ঞ লিলিয়া গ্লাস’য়ের ভাষায়, “যে আপনাকে ভালো বোধ দিতে পারবে না সেই হতে পারে বিষাক্ত সঙ্গী। সেটা যেই হোক না কোনো।”

‘টক্সিক পিপল: টেন ওয়েজ অফ ডিলিং উইথ পিপল হু মেইক ইউর লাইফ মিজারেবল’ বইতে এই লেখক আরও লিখেছেন, “বিষাক্ততা’ মানুষ ভেদে ভিন্ন হতে পারে। আমরা সবাই কোনো কোনো ভাবে অন্য কারও কাছে কম বেশি ‘টক্সিক’ হতে পারি। কারও কারও কাছে একজন নার্সিসিস্টকে অসহ্য লাগতে পারে। আবার ওই মানুষই কোনো আড্ডায় দারুণ সঙ্গী হয়ে যায়।”

তবে টেকসই সম্পর্কের জন্য সঙ্গীর কাছ থেকে কী আশা করছেন সেটা বোঝা জরুরি। বিষাক্ত সম্পর্ক কখনও সম্পর্কের ভিত্তি হতে পারে না। সাধারণ ঝগড়া আর সঙ্গীর সঙ্গে থাকলে নিজের মধ্যে বাজে অনুভূতি কাজ করার মধ্যে পার্থক্য আছে।

তাই আপনার সম্পর্ক আসলেই বিষাক্ত কি-না সেটা বোঝার জন্য কিছু লক্ষণ বিশ্লেষণ করা যেতেই পারে।

সঙ্গীর সঙ্গে স্বস্তি না পাওয়া: সঙ্গীর সামনে থাকলে যদি কথার ধরন বা ব্যবহার পরিবর্তন হয়ে যায় তবে হয়ত আপনার ভেতর এক ধরনের ভয় কাজ করছে, সেটা হতে পারে ‘জাজমেন্ট’ বা পরিহাসের ভয়। আর এর থেকে আপনার জীবনে তৈরি হচ্ছে চাপ।

গ্লাস বলেন, “এর মানে হতে পারে নিজেকে সঙ্গীর নিয়ন্ত্রেণে ভাবা, অসুখী কিংবা নিজেকে আকর্ষণীয় না ভাবা। বিষয় যেটাই হোক, সঙ্গীর সামনে যদি নিজের সবচেয়ে ভালো দিকটা নিয়েও অনুশোচনায় ভুগতে হয় তবে সেই সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজন আছে।”

শারীরিক বা পেটে অদ্ভূত অনুভূতি: কোনো খারাপ কিছু ঘটলে বা বিপদ টের পেলে আমাদের পেট বা মেরুদণ্ড ‘শিরশির’ করে ওঠে।

সঙ্গীর সঙ্গে থাকলে যদি এরকম কোনো অনুভূতি হয়, সেটা হতে পারে দমবন্ধ ভাব, নিঃশ্বাস নেওয়াতে সমস্যা, খাবার খাওয়া ইচ্ছের পরিবর্তন এমনকি ত্বকে ‘র‌্যাশ’ ওঠা- তাহলে বুঝতে হবে সম্পর্ক নিয়ে আপনি চাপ অনুভব করেন। আর সেটা বিষাক্ত সম্পর্কের লক্ষণ।

অনুভূতি প্রকাশ করতে গেলে ঝগড়া বাঁধা: কথোপকথন, অনুভূতির প্রকাশ ইত্যাদি টেকসই সম্পর্কের ভিত্তি।

তবে কোনো বিষয় নিয়ে খারাপ লাগলে সেটা প্রকাশ করার পর যদি সঙ্গীর উত্তর হয়, “আমি এরকমই”, কিংবা আত্মরক্ষামূলক আচরণ করে বা তার ব্যবহার হয় আপনাকে খেপিয়ে দেওয়া- তাহলে আপনারা দ্বিমুখী সম্পর্কের মধ্যে নেই।

যখন কাউকে ‘কেয়ার’ করবেন- তখন তার কথা মন দিয়ে শোনা, গুরুত্ব দেওয়া, অনুধাবন ও সম্মান করার মতো বিষয়গুলো আপনাতেই চলে আসে।

যখন সঙ্গীর সঙ্গে আপনার খারাপ লাগার বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে যান তখন সে কী রকম ব্যবহার করেন সেদিকে লক্ষ রাখার পরামর্শ দেন, গ্লাস।

তারা কি শুনছে ঠিক মতো আপনার কথা, ক্ষমা চাচ্ছে, আরও ভালো হওয়ার চেষ্টা করছে? নাকি উল্টো আরও রেগে যাচ্ছে, দোষ আপনার ওপরেই ফেলছে আর পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাচ্ছে?

নিজের আত্মরক্ষামূলক আচরণ: রবার্টস এই পন্থার নাম দিয়েছেন ‘ঘুরে দাঁড়ানো’ হিসেবে। যেখানে সঙ্গী দুজনই ‘আমি, আমার’ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না।

অথচ সম্পর্কের অর্থ হওয়া উচিত একে অন্যকে সমর্থন করা; ভারসাম্য রক্ষা। তা না করে একে অন্যর ওপর জোর খাটানো, নিজের অবস্থান ধরে রাখা- এরকম সবসময় চলতে থাকলে মানসিক চাপে ভুগতেই হবে।

রবার্টস বলেন, “এটা কষ্টকর, ক্লান্তিকর এবং বিচ্ছিন্ন করে রাখার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে।”

একে অপরের প্রতি ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে কথা বলা আরেক অর্থ হচ্ছে, ‘তোমাকে বাজে অনুভব করাচ্ছি কারণ আমি নিজে খারাপবোধে আছি’।

সঙ্গী সবসময় নিজেকে বলির পশু হিসেবে প্রকাশ করে: দোষ গুণ মিলিয়েই মানুষ। তবে সঙ্গী যদি সব সময় নিজের ক্ষতির দিকটাই প্রকাশ করতে থাকে, আর আপনাকে সেই কারণে অভিযুক্ত করে তবে সেই সম্পর্কের বিষাক্ততা টের পাওয়া যায় সহজেই।

আর এটা হয় সঠিক যোগাযোগ অনুভূতির অভাবেই।

নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা থেকে সরে আসা: বিষাক্ত সম্পর্কে আছেন কিনা তা যদি বুঝতে না পারেন, তবে বন্ধু ও আত্মিয়দের বরং জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।

রবার্টস বলেন, “অনেকসময় নিজের গণ্ডির ভেতর থেকে কিছু বোঝা যায় না। বরং অন্যরা সেই বিষয়ে আপনাকে জানাতে পারবে।”

অথবা নিজেকেই প্রশ্ন করতে পারেন- এই মানুষটা আপনার ভালোলাগার জায়গাগুলো নষ্ট করে দিচ্ছে কি? বা বন্ধু ও পরিবারের কাছ থেকে কি দূরে সরিয়ে দিচ্ছে?”

সম্পর্কে একঘরে ফেলা মানে, নিয়ন্ত্রিণ করা। আর তা ‘অ্যাবউসিভ রিলেশনশিপ’য়ের লক্ষণ।

জীবনের লক্ষ্য এক নয়: সবার জীবনের লক্ষ্য এক হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে একসঙ্গে থাকতে গিয়ে যদি সবসময় আলাদা আলাদা লক্ষ্য পূরণ করে যেতে হয় তবে সেটা মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

একজন হয়ত সন্তান নিতে চান, অন্যজনের বেশি ঝোঁক ক্যারিয়ারে উন্নতি। এক্ষেত্রে বিষাক্ত ব্যাপারটা তখনই চলে আসবে যদি একে অন্যের চাহিদা পূরণের ব্যাপারে মনযোগ না দেয়।

সঙ্গী না থাকলে ভারমুক্ত অনুভব: মাঝে মাঝে নিজের মতো থাকতে দেওয়া স্বাস্থকর সম্পর্কের লক্ষণ। তবে নিজের মতো থাকতে গিয়ে যদি মনে হয় ‘পালায় বাঁচলাম’ তাহলে বুঝতে হবে সম্পর্ক মোটেই সুবিধাজনক জায়গায় নেই।

সবসময় ভাবা, সে যদি এরকম হত: একেজন মানুষ একেক রকম। আর এই ভিন্নতার কারণেই একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। আবার দুজনের মধ্যে অনেক কিছু মিল থাকাও স্বাভাবিক।

তবে সম্পর্কে যদি সবসময় মনে হতে থাকে, সে যদি ওইরকম হত বা তার ‘ওই’ বৈশিষ্ট্যটা যদি পরিবর্তন হয়ে যেত- তাহলে বুঝতে হবে সম্পর্কে গণ্ডগোল বেঁধে আছে।

রবার্টস বলছেন, “এটাই সম্পর্কের প্রধান বিপদ সংকেত।”

গ্লাস বিশ্বাস করেন, “একটা নিদিষ্ট বিষয় পর্যন্ত যুগলরা মেনে নিতেই পারে। তবে সেই গণ্ডি পেরিয়ে যাওয়াটা সুস্থ সম্পর্কের লক্ষণ নয়।”

পাওয়ার চাইতে দেওয়ার পরিমাণ বেশি: সারাক্ষণ যদি মনে হয়, আপনি সঙ্গীর চাইতে বেশি দিচ্ছেন তবে জেগে উঠবে নিঃস্ব, অনিরাপদ ও দ্বিধার অনুভূতি।

গ্লাস বলেন, “সব সম্পর্কের দেনা পাওনার সামঞ্জস্য থাকতে হবে। আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা কোনো সম্পর্ককে সুস্থ রাখতে পারে না।”

বিষাক্ত সম্পর্কে থাকলে কী করবেন

এতক্ষণে হয়ত বুঝে গেছেন, আপনি বিষাক্ত সম্পর্কের জালে আটকে আছেন, নাকি নেই। যদি উত্তরটা হয় ‘হ্যাঁ’ তাহলে করবেনটা কী?

রবার্টস বলছেন, “বিষাক্ততা একদিনে হয় না, দিনে দিনে সেটা বাড়তে থাকে। একসঙ্গে এতদিন থাকার পর এই বিষাক্ততা টের পাওয়া দুঃখজনক। তারপর নিজের ভালোর জন্য পদক্ষেপ নিতেই হবে।”

আবেগ থেকে সরে এসে তাই নিজেকে প্রশ্ন করুন, এই সম্পর্কে থেকে আপনি কি নিজেকে হারিয়ে ফেলছেন, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও শক্তি হারাচ্ছেন, মনে হচ্ছে কি ফাঁদে আটকে আছেন?

রবার্টস পরামর্শ দেন যে, “যদি মনে করেন এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন, স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক গড়তে দুজনেই প্রস্তুত তবে একজন পেশাদার ‘থেরাপিস্ট’য়ের সাহায্য নেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।”

মনে রাখতে হবে, নিজের পরিবর্তনটা আপনি করতে পারবেন ঠিক, তবে সঙ্গীর পরিবর্তনে আপনার কোনো হাত থাকবে না, তার ইচ্ছেটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

যদি সঙ্গী নিজেকে পরিবর্তন করতে না চায়, বিষাক্ততার বিষয়গুলো তার কাছে প্রাধান্য না পায় তবে এই সম্পর্ক থেকে সরে আসাটাই হবে মঙ্গলজনক।

আরও পড়ুন

Also Read: একসঙ্গে থাকার যত বাজে কারণ

Also Read: সম্পর্ক ভালো রাখতে ছোটখাট অভ্যাস

Also Read: সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার চিহ্ন

Also Read: সঙ্গীর মন বিচ্ছিন্ন হওয়ার লক্ষণ