দেশের প্রধান নদী প্রবাহের নকশায় জর্সিতে যেন ফুটে উঠেছে বিজয় উল্লাস।
Published : 20 Mar 2025, 04:38 PM
“বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের নতুন জার্সি ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’ শুধু একটি পোশাক নয় বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং জাতীয় গর্বের প্রতীক”- বলছিলেন নতুন এই জার্সির নকশাকার ডিজাইনার তাসমিত আফিয়াত আর্নি।
এই নকশাবিদের সৃজনশীল চিন্তা এবং অনুপ্রেরণার জায়গা থেকে ‘মিনিমাল ডিজাইন’য়ে তৈরি এই জার্সি ফুটবলের প্রতি বাংলাদেশের আবেগকে নতুনভাবে প্রকাশ করছে।
প্রায় দুই মাস আগে যাত্রার শুরু থেকে এই সময় পর্যন্ত, এই জার্সির নকশা প্রক্রিয়া, রংয়ের বিবর্তন এবং জার্সিতে মিশে থাকা অন্তর্নিহিত বার্তা— সবকিছুই ফুটবলপ্রেমীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় হয়ে উঠেছে।
নতুন জার্সি, নতুন স্বপ্ন
বাংলাদেশের ফুটবল দীর্ঘদিন ধরেই ক্রিকেটের ছায়ায় ঢাকা ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন খেলোয়াড়দের অন্তর্ভুক্তি, বিশেষত ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ফুটবলার হামজা দেওয়ান চৌধুরীর আগমন পুরো দল ও ফুটবল প্রেমীদের কাছে নতুন আশার আলোর মতোই।
২৫ মার্চ ভারতের বিপক্ষে এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বে লড়াইয়ের প্রস্তুতির মাঝেই, খেলোয়াড়দের পাশাপাশি আলোচনায় এসেছে তাদের নতুন জার্সিটিও।
এই ‘অ্যাওয়ে জার্সি’র রূপকার তাসমিত আফিয়াত আর্নি বলেন, “জার্সির নকশা-ই ভিন্নধর্মী নয় বরং এর ফ্যাব্রিকও পরিবেশবান্ধব ও হালকা। খেলোয়াড়রা যেহেতু ঘণ্টার পর ঘণ্টা জার্সিটি গায়ে জড়িয়ে খেলবে তাই আরামদায়ক হওয়া জরুরি। ফ্যাব্রিকটি এমনভাবে করা হয়েছে যেন ঘাম টেনে নেয়। গায়ে যেন কোনো ভাবেই অস্বস্তি না লাগে।”
ডিজাইনের পেছনের গল্প
নতুন জার্সিটির ডিজাইন করা হয়েছে নিদিষ্ট একটি কনসেপ্টে বা বিষয়বস্তু মাথায় রেখে, যা বাংলাদেশের পরিচয়কে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
জার্সির প্রধান আকর্ষণীয় দিক হল- পুরোটা জুড়ে বয়ে চলা বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোর প্রবাহ। দেশের মানচিত্রে যেভাবে নদী বয়ে গেছে দেখা যায়, জার্সির বুকের ওপর সেভাবেই আঁকা হয়েছে নদী। এ যেন মানুষের একতা ও ফুটবলের দলগত শক্তির প্রতীক।
‘স্ট্রাইড ফ্যাশন ওয়্যার’য়ের সিইও এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের মার্কেটিং কমিটির সদস্য, ‘মার্কেটিং প্রফেশনাল অ্যান্ড ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর’ আর্নি, লাল-সবুজের বাইরে গিয়ে ভিন্ন বিষয়ে নকশা করার চেষ্টা করেছেন।
তিনি বলেন, “জার্সি মানেই সবাই বোঝেন লাল আর সবুজ। তবে এই প্রথাগত চিন্তা থেকেই বেরিয়ে আমি কাজটি করেছি।”
নকশায় ফুটবল এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি সমন্বিত রূপ এনেছেন- বলে দাবি করেন তিনি।
জার্সির অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হয়ে উঠেছে জাতীয় ফুল শাপলার মোটিফ। তবে তা প্রিন্ট স্টাইলে বা বহুল ব্যবহৃত কোনো মাধ্যম ও ডিজাইনে করা হয়নি, বরং ব্যবহার হয়েছে জিওমেট্রিক ফর্ম।
জার্সির কাঁধ ও হাতের অংশে হীরার মতো ফর্মে শাপলা ফুলকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একদিকে শাপলা ফুলের কোমলতা অন্য দিকে হীরার তীক্ষ্ণতা দুইটির মিশেল যেন পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, “একজন ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর বা পরিচালক যে কোনো কিছুই ‘বার্ডস আই ভিউ’তে দেখেন। এই ডিজাইন যেন খেলোয়াড়দের দৃঢ়তা ও মানসিক শক্তির প্রতীক হিসেবে উঠে আসে সে চেষ্টাই করেছি।”
আর্নি আরেকটি ব্যতিক্রমী সংযোজনের কথা উল্লেখ করেছেন- আর সেটি হল টাইপোগ্রাফি ডিজাইন।
তিনি বলেন, “খুব সাধারণভাবেই জার্সি মানে দেশের প্রতীক বা মানচিত্র। যেহেতু দেশকে খেলার মাঠে তুলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু খুব গতানুগতিকভাবে মানচিত্রের স্থান দিতে চাইনি, করতে চেয়েছি ভিন্ন কিছু। তাই জার্সির পেছনে ইংরেজিতে ‘বাংলাদেশ’ লিখেছি। তবে সেটা টাইপোগ্রাফি স্টাইলে। বাংলাদেশের প্রতিটি অক্ষর নিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে মানচিত্র। যাতে এটি দেশকে তুলে ধরে আবার সৃজনশীলতার এক নতুন দৃষ্টান্তও তৈরি করে।”
রংয়ের বৈচিত্র্য, ঐতিহ্যের সংযোগ
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার লাল-সবুজ রংয়ের প্রতি আবেগ থাকার পরও, নতুন জার্সিতে ঐতিহ্যগত রংয়ের বাইরে গিয়ে নতুন ধারণা যুক্ত করেছেন এই নকশাকর।
অনেকেই মনে করেন যে জাতীয় দলের জার্সি অবশ্যই লাল-সবুজ হওয়া উচিত। তবে আর্নি, এর যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
“বিশ্বের অনেক দেশের পতাকাতেই লাল ও সবুজ রং আছে। তাই শুধুমাত্র এই রংয়ে সীমাবদ্ধ থাকলে, আমাদের আলাদা পরিচিতি তৈরি করা কঠিন। যদিও এই জার্সিতে লাল রংয়ের ব্যবহার হয়েছে। আর মাঠে দাঁড়িয়ে খেলোয়াড়দের অবস্থান দেখলে বোঝা যায় যে এটি আসলে বাংলাদেশের প্রতীককেই ফুটিয়ে তুলছে।”
“বার্ডস আ ‘ বা ওপর থেকে দেখলে লাল জার্সি পরা খেলোয়াড়রা সবুজ মাঠে দাঁড়িয়ে থাকলে পুরো দৃশ্যটি বাংলাদেশের পতাকার মতোই দেখায়। এটি একটি শক্তিশালী ‘ভিজ্যুয়াল’ বার্তা দেয়, যা অনেকেই হয়ত আগে খেয়াল করেননি।”
জার্সির আরেকটি উপাদান হল ‘ভিক্টরি’ ডিজাইন, যেখানে ‘ওয়াই’ চিহ্নটি জয়ের প্রতীক হিসেবে দুই হাত উঁচিয়ে উদযাপনের ভঙ্গিতে রাখা হয়েছে। এটি শুধু খেলোয়াড়দের জন্য নয়, পুরো জাতির কাছেই জয়ের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের নদীর প্রবাহকে ইংরেজি শব্দ ‘ভিক্টরি’র ‘ওয়াই’ আকারের সাথে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেন এই ধারাতেই নদী বয়ে যাচ্ছে।
আরামদায়ক ও পরিবেশবান্ধব
“শুধু দেখতেই সুন্দর হলেই হয় না, এটি আরামদায়ক এবং পরিবেশবান্ধব হতে হয়” এমনটাই মনে করেন আর্নি।
‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’ জার্সিটিও সেই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছে।
জার্সিটির কাপড়ের মধ্যে ‘অ্যাম্বুস’ ও টেকসই পরিবেশবান্ধব উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে।
জার্সির কাপড় পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান দিয়ে তৈরি। এছাড়া বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন বাংলাদেশের আর্দ্র আবহাওয়ায় খেলোয়াড়রা স্বাচ্ছন্দ্যে খেলতে পারেন।
‘অ্যাওয়ে জার্সি’টি চূড়ান্ত করা হয়েছে, তবে ‘হোম জার্সি’টি সবুজ রংয়ের। সেটি এখনও তৈরির পর্যায়ে রয়েছে।
“এবার আমাদের সবুজ হোম জার্সিটিও অ্যাওয়ে কিটের মতোই আকর্ষণীয় হবে। বাংলাদেশের নিজস্ব সব মোটিফ আর ভিন্ন ভিন্ন ফর্মে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে” বলেন ডিজাইনার আর্নি।
কনসেপ্ট ডিজাইনার তাসমিত আফিয়াত আর্নি দেশের বাইরেও আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ করেছেন। কয়েক মাস আগেই তিনি এশিয়ার বিখ্যাত 'সাংহাই ফ্যাশন উইকে' অংশ নিয়েছেন।
সাংহাইয়ে উপস্থাপিত তার সংগ্রহের একটা বড় অংশের উপজীব্য ছিল বিশ্বজুড়ে আলোচিত জুলাই গণআন্দোলন।
‘সাসটেইনেবল হাইফ্যাশন’ এই থিমে স্থানীয় উপাদানে তৈরি টেকসই ফ্যাশনকে জামদানি, নকশিকাঁথা, গামছা, খাদি, রাজশাহী সিল্ক দিয়ে আর্নি তৈরি করেন তার সংগ্রহ, যেখানে রিকশা পেইন্টের নানা মোটিফও ছিল উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া এই বছরে বাংলাদেশ আর্কা ফ্যাশন উইকে তার ‘স্ট্রাইড’ ফ্যাশন ওয়্যার’য়ের পোশাকও দৃষ্টি আকর্ষণ করে।