ক্লান্তিবোধ কাটানোর জন্য এড়াতে হবে কিছু বিষয়।
Published : 23 Mar 2025, 01:46 PM
প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা রোজা রাখার পর ইফতারের শেষে বেশিরভাগ মানুষের ক্লান্তি, অল্পসময়ে ঘুমিয়ে পড়া, মাথাব্যথা এবং শারীরিকভাবে অসুস্থতার অনুভূতি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন ইফতারে খাওয়া-দাওয়ার কারণেই আসলে এমন হয়। খাদ্য-তালিকা থেকে কিছু খাবার বাদ দিলে ও কিছু নিয়ম মানলেই এমন ক্লান্তি বোধ কমে আসবে।
কেনো ইফতারের পর ক্লান্তি হয়?
রোজা রাখার সময় শরীরের প্রয়োজনীয় খাবার না খাওয়াতে শক্তি এবং পুষ্টির অভাব হয়। এই অভাবে শরীরের ভেতর এক ধরনের শারীরিক অবস্থা সৃষ্টি হয়, যাকে বলে ‘ক্যালোরিক ডিফিসিট’ বা ক্যালরির অভাব।
ইফতারে খাদ্য গ্রহণের সময় হজমের কাজ শুরু হয় এবং শরীর সমস্ত শক্তি এই প্রক্রিয়াতে ব্যয় করতে থাকে। একে বলা হয় পাচনতন্ত্রের কাজের জন্য শরীরের অতিরিক্ত শক্তি ব্যয় হওয়া।
শরীরের অন্যান্য অঙ্গগুলো যেমন- যকৃত বা লিভার, বৃক্ক বা কিডনি এবং পাচনতন্ত্রের কাজের জন্য প্রচুর শক্তি লাগে, বিশেষত যখন অনেক খাবার একসাথে খাওয়া হয়।
শরীর তখন সেই শক্তি গ্রহণ করতে থাকে এবং ফলে দ্রুত ক্লান্তি চলে আসে। অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার কারণে পেট বেশি পূর্ণ হয়ে যায়, আর অতিরিক্ত চাপ পড়তে থাকে। এই চাপও ক্লান্তির অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে।
ফিটনেস বিশেষজ্ঞ ও ‘ফিটলাইফ-বিডি ডটকম’য়ের প্রধান আবু সুফিয়ান তাজ এসব তথ্য জানিয়ে আরও বলেন, “ইফতারের পর শরীরে যে ক্লান্তি আসে তাকে বলা হয় ‘পোস্টপ্র্যানডিয়াল সম্নোলেন্স’ বা ভোজন পরিবর্তী নিদ্রাভাব। এই শারীরিক অবস্থায় ব্যক্তি খাবার গ্রহণের পর অতিরিক্ত তন্দ্রা বা ক্লান্তি অনুভব করেন।”
“এই অবস্থা সাধারণত খাবার খাওয়ার পর, বিশেষত বড় বা ভারী খাবারের পর ঘটে। এটি সাধারণত এক ধরনের ‘ডাইজেস্টিভ ড্যাজ’ বা খাবার হজম করার সময় শরীরের অতিরিক্ত শক্তির চাহিদার কারণে ঘটে”- বলেন তিনি।
‘পোস্টপ্র্যানডিয়াল সম্নোলেন্স’য়ের সব থেকে বড় কারণ হল- খুব অল্প সময়ের ভেতরে রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া।
তাই ইফাতারে প্রথমে সাদা পানি না খেয়ে চিনি-ধর্মী ফলের রস বা শরবত পান করলে সাথে সাথে রক্তে চিনি বেড়ে যায়।
ইনসুলিন হরমোন ছাড়া চিনি পেশি কোষে প্রবেশ করতে পারে না। যে কারণে মস্তিষ্ক শরীরকে সংকেত দিতে থাকে প্রচুর ইনসুলিন হরমোন নিঃসরণ করা হোক। এই প্রক্রিয়ার কারণে মশ্তিষ্কের পরিশ্রম বেড়ে যায় এবং ক্লান্তি বোধ বাড়ে।
তাই সাদা পানি খেয়ে রোজা খোলার পরামর্শ দেন আবু সুফিয়ান তাজ। এছাড়াও ইফতারে ‘কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেইট’ বা জটিল শর্করা সমৃদ্ধ খাবার রাখতে বলেন।
“এমন খাবার শরীরে খুব ধীরে ধীরে চিনি সরবরাহ করে। আবার ইফতারে মাছ, মুরগি, ডিম ইত্যাদি প্রোটিন রাখলে শরীরে চিনির বাড়ার মাত্রা কমায়। কারণ প্রোটিন শরীরে প্রবেশ করে গ্লুকোজ বা চিনিতে রূপান্তরিত হয় না। বরং প্রোটিন রূপান্তর হয় অ্যামিনো অ্যাসিডে; যে কারণে ‘সুগার স্পাইক’ কমে যায়। ফলে ইফতারের পর আর ক্লান্তি বোধ তৈরি হবে না” ব্যাখ্যা করেন এই বিশেষজ্ঞ।
ক্লান্তি বাড়ার আরও কিছু কারণ
রক্তে শর্করা বৃদ্ধি ও হঠাৎ কমা: তিনবেলা খাবারের মধ্যে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার কারণে রোজা রাখার সময় শরীরের গ্লুকোজের (শর্করা) স্তর কমে যায়। ইফতারের পর খাদ্য গ্রহণ করলে বিশেষ করে যে খাদ্যগুলো শর্করা ও চিনি সমৃদ্ধ, তা দ্রুত রক্তে শর্করা স্তর বাড়িয়ে দেয়। এই দ্রুত শর্করা বৃদ্ধির পর শরীর ইনসুলিন উৎপন্ন করে অতিরিক্ত শর্করা সরাতে। তবে এই প্রক্রিয়ার পর আবারও রক্তে শর্করা স্তর দ্রুত কমে যায়, যার ফলে শক্তির অভাব দেখা দেয় এবং ক্লান্তি অনুভূত হয়।
অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে পাচনতন্ত্রের চাপ
অনেকেই ইফতার ও পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত খেয়ে ফেলেন, যা পাচনতন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। শরীর যখন এত বড় পরিমাণ খাবার গ্রহণ করে, তখন পাচনতন্ত্রকে খাবার হজম করতে অধিক শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। ফলে অন্যান্য অঙ্গ, যেমন- মস্তিষ্ক এবং পেশীসমূহে রক্তপ্রবাহ কমে যায় এবং পাচনতন্ত্রে রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি পায়, যা ক্লান্তির কারণ হতে পারে।
সেরোটোনিন নিঃসরণ ও তন্দ্রা
সেরোটোনিন একটি ‘নিউরোট্রান্সমিটার’, যা শরীরের স্বাভাবিক কার্যাবলী এবং অনুভূতির নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। যখন কেউ শর্করা এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খায়, তখন শরীর অতিরিক্ত ‘সেরোটোনিন’ নিঃসরণ করে। ফলে ঘুমের চক্রের ওপর প্রভাব পড়ে এবং তন্দ্রা এবং ক্লান্তির অনুভূতি বাড়ায়।
পানি ও ইলেকট্রোলাইটস’য়ের অভাব
সারাদিন না খেয়ে থাকার কারণে শরীরে পানি ও ইলেকট্রোলাইটস’য়ের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ইফতার করার পর যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি এবং অন্যান্য ‘মিনারেলস’ বা খনিজ গ্রহণ না করা হয়, তবে শরীরে শক্তির ঘাটতি দেখা দেয় এবং ক্লান্তি অনুভূত হয়।
এছাড়া, শরীরে পানির অভাব মাথাব্যথাও সৃষ্টি করতে পারে, যা ইফতারের পর অধিক ক্লান্ত অনুভূতির একটি কারণ।
সঠিক ঘুমের অভাব
রমজান মাসে রাতের সময়সূচী বদলে যায়, বিশেষত তারাবীহ নামাজ এবং সেহরি খাওয়ার জন্য ঘুমের সময়ে হেরফের হয়। ফলে শরীরে ক্লান্তি বৃদ্ধি পায় এবং ইফতারের পর অতিরিক্ত তন্দ্রা ও অলসতা দেখা দেয়।
এ জন্য রাতে পর্যাপ্ত ঘুম দেওয়ার জন্য আগেভাগে বিছানায় যাওয়ার অভ্যাস গড়তে হবে।
আরও পড়ুন
রোজা রেখে হজম শক্তি অটুট রাখার খাবার