রূপকথার সুন্দরী তরুণীর মধুর সুরে সম্মোহিত হয়ে জাহাজিরা হয়েছেন দিকহারা, ডুবেছে বহু জাহাজ।
Published : 01 Jun 2015, 04:03 PM
কিছুদিন আগে রাইন নদীর তীর ঘেঁষা শিলাপাহাড় অঞ্চল লোরলাইতে ঘুরে এলাম৷ এর আগেও কয়েকবার গিয়েছি মিডল রাইন ভ্যালির সুন্দর এই সুন্দর জায়গায়। রুর অঞ্চল থেকে কোবলেন্স হয়ে লোরেলাই’য়ের শহর বলে পরিচিত ছোট্ট শহর সেন্ট গোয়ার্সহাউসেন পর্যন্ত যাত্রপথটি খুবই মনোরম৷ প্রতিবারই মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেছি সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে আঙুরের খেত, ছবির মতো বাড়িঘর, সুবজ বনাঞ্চল, নানারকম দুর্গ, টলটলে বয়ে যাওয়া নদী৷ সেই সঙ্গে মায়াবিনী লোরেলাই’য়ের আকর্ষণ তো ছিলই৷
আমার বোন সুইডেন থেকে এসেছিল বেড়াতে৷ লোরেলাই-এর গল্প শুনে সেও আগ্রহী হয়ে ওঠে জায়গাটি দেখতে৷ তাই এক সকালে রওনা হয়ে গেলাম লোরেলাই’য়ের পথে৷
কল্পকথায় আছে অনেক অনেক দিন আগে রাইনের তীরে শিলাপাহাড় লোরেলাইয়ে এক অপূর্ব সুন্দরী তরুণী বাস করতেন৷ যার নামও ছিল লোরেলাই৷ কন্ঠে ছিল তার মধুর সুর৷ তার সৌন্দর্য ও সুমধুর গান শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থেমে যেত মানুষ, হয়ে পড়ত বাকহারা৷
সেই এলাকার জমিদারপুত্রের কানেও এল এই তরুণীর অপূর্ব সৌন্দর্য ও মনোমুগ্ধকর কন্ঠের কথা৷ সেই সঙ্গে জাহাজিদের করুণ পরিণতির কথাও শোনেন তিনি৷ আর এই ‘জাদুর’ একটা ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেন৷
এক সন্ধ্যায় এক জেলের নৌকায় লোরেলাই শিলাপাহাড়ের উদ্দেশে যাত্রা করেন তিনি৷ পাহাড়ের কাছে আসতেই তিনি সেই চোখ ধাঁধানো রূপসিকে দেখেন৷ সোনালি কেশ আঁচড়াতে আঁচড়াতে বেদনাবিধুর গান গাইছিল সে৷
কেটে যায় মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত৷ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েন এই তরুণ৷ জেলেকে নির্দেশ দেন নৌকা েতীরে ভেড়াতে৷ পারে ওঠার আগেই পা পিছলে নদীতে পড়ে অতলে তলিয়ে যান জমিদারপুত্র৷ আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি৷
১৮ শতকের প্রথম দিকে জার্মান কবি ক্লেমেন্স ব্রেনটানো লোরেলাইকে এক জাদুকরী নারীর রূপ দেন৷ কেননা পুরুষরা তার রূপে আকৃষ্ট হয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তো৷ তবে শেষ পর্যন্ত লোরেলাই’য়ের হয় করুণ পরিণতি৷ প্রেমিককে হারিয়ে বিরহের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে উপত্যকা থেকে পড়ে গিয়ে চিরতরে হারিয়ে যায় এই মোহিনী নারী৷ হয়তো বা আত্মহত্যাই করেন৷
প্রায় ২০ বছর পর বিখ্যাত কবি ও লেখক হাইনরিশ হাইনে সাহিত্যে লোরেলাইকে আরও সুপরিচিত করে তোলেন৷
পর্যটকদেরও কম আকৃষ্ট করেনা ‘এই মোহময়ী নারী’। সারা বছরজুড়ে প্রায় দুই কোটি (২০ মিলিয়ন) মানুষের পদার্পণ ঘটে এই এলাকায়৷ জার্মানির বিভিন্ন স্থান থেকে তো বটেই প্রতিবেশী দেশ নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া এমনকি সুদূর অ্যামেরিকা, ব্রাজিল, ইসরাইল ইত্যাদি দেশ থেকেও বহু পর্যটক আসেন লোরেলাইকে এক নজর দেখতে৷ ছবি তোলেন এই ‘মোহিনী নারী’র সঙ্গে৷
২০০২ সালে আপার মিডল রাইন ভ্যালিকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷ সেই সঙ্গে লোরেলাইও স্থান করে নিয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায়৷