গাছটিতে প্রতিদিন ফুল ফোটে, নানুর মতোই হাসে। আমাদের ভালো রাখাই যেন তার আনন্দ।
Published : 22 Jul 2023, 03:45 PM
কাল থেকে স্কুল বন্ধ। ঈদুল আজহার ছুটি। ভীষণ আনন্দ নিয়ে বাসায় ফিরছি আর মনে মনে ভাবছি কী কী করবো এই ছুটিতে।
রোজার ঈদের ছুটিতে অনেকগুলো হোমওয়ার্ক ছিল, তার উপর আবার সারাদিন রোজা। এবার মাত্র অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন শেষ হয়েছে, নো হোমওয়ার্ক। মজাই মজা।
২৩ জুনের প্ল্যানটা অনেক আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি মিরপুর ইউনিট আয়োজিত মাসিক আড্ডায় যাবো, কবিতা আবৃত্তি করবো। গত মাসে যেতে পারিনি। এর আগে পরপর দুবার প্রথম হয়ে পুরস্কার পেয়েছি।
এবারও পেতে চাই, তাই রাতে প্র্যাক্টিসও করলাম অনেকবার। কিন্তু ঘুম থেকে উঠেই বাসার পরিস্থিতি ভিন্নরকম হয়ে গেল। নানুর শরীরটা ঠিক নেই। কেমন যেন অস্থির লাগছে তার। নাস্তা করে ওষুধ খাওয়ার পর কিছু সময় ভালো কাটলো। আবার একই অবস্থা।
অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় নানুকে নিয়ে যাওয়া হলো বাসার সবচেয়ে কাছের হাসপাতাল ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে। চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানালেন, হার্টে কোন সমস্যা নেই। যেহেতু কাশি আছে, অক্সিজেন লেভেল কমে গেছে, মাল্টিপারপাস হসপিটালে নিতে হবে।
আর দেরি না করে অ্যাম্বুলেন্স ছুটলো ইবনে সিনা হসপিটালে। তখনও ভাবতে পারিনি নানুর অবস্থা এতটাই খারাপ, তাকে সরাসরি ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ভর্তি করাতে হবে। রাত তখন ১১টা, নানু আর বাবাকে হাসপাতালে রেখে বাসায় চলে আসলাম সবাই।
পরদিন জানা গেল নিউমোনিয়ার সঙ্গে আনুষঙ্গিক রোগ মিলে জটিল অবস্থা ধারণ করেছে। মাকে বারবার বলতে শুনেছি, ‘২১ তারিখ বুধবারতো কাশির জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখালাম, চিকিৎসা চলছে। তাহলে এত দ্রুত খারাপ অবস্থা হলো কী করে?’ কী ভুল ছিল জানা নেই।
যতবার আইসিইউতে দেখা করতে দিচ্ছে, আম্মুকে দেখলেই নানু বলছে, ‘আমার জাইমা কই?’ ওদিকে আইসিইউতে শিশুদের ঢোকা নিষেধ। তারপর একটা সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সময় পার করছিলাম আমরা। ২৬ জুন দুপুরে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয় নানুকে। ৫ জুলাই সবার সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে নানু চলে গেলেন না ফেরার দেশে। রেখে গেলেন অনেক অনেক স্মৃতি।
নানু ছিলেন আমার বন্ধু, আমার বোন। মা বলতো, ‘আমার দুটো মেয়ে, দুটোই বড় যন্ত্রণা করে। একটা কিছু হলে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে।’ সেবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাসিক আড্ডা থেকে জবাগাছের চারা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। মা আসতে আসতেই বললেন, ‘এখন বারান্দায় নিয়ে রেখে দিবা। কাল সকালে লাগাবার ব্যবস্থা করে দিব’।
কিন্তু আমার তো আর তর সইছিল না। মার রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে রাতের বেলাতেই ছোট্ট প্লাস্টিকের লাল বালতিতে গাছ লাগালাম আমি আর নানু। গাছের গোড়ায় যেন পানি না জমে বালতির নিচে ছিদ্র করলেন নানু। প্যাকেট খুলে গাছ বালতিতে বসালেনও তিনি। তারপর আমাকে বললেন, ‘এবার মাটি দাও চারপাশে’।
আরও অনেক গাছের সঙ্গে আদরে বেড়ে উঠছিল গাছটি। একদিন দেখি কলি এসেছে, তারপর ফুল। প্রথম ফুল ফোটা, কি যে খুশি হয়েছিলাম আমি আর নানু। মনে হচ্ছিল ধিতাং ধিতাং নাচি।
বাসায় গোলাপ গাছ আছে, প্রায়ই গোলাপ ফুল ফোটে। ফুলের রানি হলেও কেন জানি না গোলাপ ফোটার চেয়ে জবা ফোটাতে বেশি আনন্দ পেয়েছিলাম। আজও স্কুলে দারুণ মজার সময় কাটে। স্কাউটরা বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শেষে নিজেদের আয়োজনে বাজার করে, কাটাকুটি বাটাবাটি করে। সেই রান্না করা খিচুড়ি আর ডিমভুনার মজাই আলাদা। কিন্তু এতো আনন্দ নিয়ে বাসায় ফিরে নানুকে আর দেখতে পাই না।
আমার নানুর নাম বেগম রোকেয়া, ৭৯ বছর বয়সে চলে গেলেন তিনি। কিন্তু তার হাতের ছোঁয়ায় ধন্য সেই জবাগাছটা আছে। আজও সে ফুল ফুটিয়ে নানুর মতো করে স্নিগ্ধতা ছড়ায়। ২০ জুলাই, বাংলা ৫ শ্রাবণ ছিল নানুর জন্মদিন। সেদিনও জবাগাছে ফুটেছে ফুল, আমাদের ভালো রাখাই যেন তার আনন্দ।
রাকিকা শাহলা জাইমা: সপ্তম শ্রেণি, এসওএস হারম্যান মেইনার কলেজ, ঢাকা